আরেক রকম ● নবম বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২১ ● ১৬-৩১ চৈত্র, ১৪২৭
প্রবন্ধ
সময়ের ডাক
বরুণ কর
আসন্ন নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে সব রাজনৈতিক দল নিজেদের ঘর গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত। রাজ্যে রাজ্যে নির্বাচন কোনো নতুন ঘটনা না। কিন্তু এবারের নির্বাচনের চেহারা, রঙ, চরিত্র সব যেন ভিন্নতর। শাসক দল তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে বিজেপি সংবাদমাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছে। রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে আগ্রহী মানুষ জানেন আমাদের রাজ্য কখনই বিজেপি-রাজনীতির সহায়ক জমি ছিল না। ধর্মীয় বিশেষত হিন্দু ভাবাবেগ- সর্বস্ব এই দলটি বিধানসভায় তার প্রতিনিধি খুব বেশিদিন আগে পাঠাতে পারেনি। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ধর্মচিন্তা বরাবরই একটু নিচু পর্দার, ব্যক্তিগত পর্যায়ের। গত শতকের শেষ ভাগে লালকৃষ্ণ আদবানীর রথযাত্রা এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর রাজ্যের এখানে সেখানে কিছু তৎপরতা ও কার্যকলাপ দেখা গেলেও তার প্রভাব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। স্বাধীনতা ও দেশভাগ পরবর্তী সময়ে এই রাজ্য উদ্বাস্তু সমস্যা সহ বিভিন্ন সমস্যায় এতটাই ব্যতিব্যস্ত থেকেছে যে মন্দির, মসজিদ, রথ, রাম বা হমুমান নিয়ে মাতামাতি এক রকম ছিলনা বললেই চলে। যতটুকু যা ছিল সেটা নৈমিত্তিকতার সীমা অতিক্রম না করায় সহনীয় ছিল।
অন্যদিকে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে বাংলার রাজনৈতিক নেতাদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা, শহীদদের আত্মবলিদান,নবজাগরণকে কেন্দ্র করে মেধা ও সংস্কৃতির চর্চায় বাংলার মাটি বামপন্থী রাজনীতির পক্ষে অনুকূল হয়ে ওঠে। সমাজ জীবনে বামপন্থার নানাবিধ চর্চা নাগরিক জীবনকে সঞ্জীবিত ও সমৃদ্ধ করে তোলে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রমুখ উল্লেখযোগ্য অগ্রগণ্যের কথা বাদই দিলাম-গণনাট্য সংঘের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড সংগীত, নাটক মায় চলচ্চিত্র জগতে আলোড়ন আনে। পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও হেমন্ত-কন্ঠে রানার, গাঁয়ের বধূ, পাল্কির গানের রেকর্ড প্রকাশ করতে গ্রামাফোন কোম্পানী দু'বার ভাবেনি। এতটাই উর্বর ছিল তখন বাংলার মনোজগৎ। আমার মতো মানুষের শৈশব, কৈশোর ও বাল্যকাল যখন সে সব গানের কথা, সুর ও মনকাড়া গায়ন ভঙ্গীতে মসগুল থেকেছে, এই শতকের কিশোর, বালকের কানে তখন বেজেছে 'যতই ঘুড়ি ওড়াও রাতে', 'হান্ড্রেড পার্সেন্ট লাভ' বা 'ভোকাট্টা তোমার ভালোবাসা'র মত গানের কথা, সুর। কোনো বিশেষ মহলকে দোষারোপ করার উদ্দ্যেশ্যে নয়, দুটো সময়ের মনোভূমির তারতম্য শুধু বিবেচনায় রাখার কথা বলছি।
স্বাধীনতা লাভের দু'দশক পর থেকে রাজ্যে রাজ্যে যখন কংগ্রেস দল তার প্রাধান্য খোয়াতে শুরু করেছে এ রাজ্যও তার ব্যতিক্রম ছিলনা। যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়েছে এই রাজ্যে। কিন্তু একদশক ধরে জারি রাখা হয়েছে নানা রাজনৈতিক অস্থিরতা। একাজে সেদিনও বিশেষ ভূমিকা পালনের কাজ করে গেছেন রাজভবনের মালিকেরা। গোটা দেশ জরুরি অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছে, এই রাজ্যও। যাই হোক, সাতাত্তর সালে বামফ্রন্ট সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে সেই অস্থিরতার খানিক অবসান ঘটে। জনজীবনের বিভিন্ন দাবিদাওয়াকে কেন্দ্র করে সংগঠিত ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলেই এই সুস্থিতি, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু মুশকিল হ'ল, সেই সরকারের পরিচালনায় যেহেতু সিপিএমের নেতৃত্ব, স্বার্থান্বেষী মহল নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে গেছে ফ্রন্ট বিরোধিতার নানা মঞ্চ তৈরির কাজে ইন্ধন জুগিয়ে যেতে।
দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে প্রায় চুরাশি লক্ষের মত উদ্বাস্তু এ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে আশ্রয় নেয়। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসীন হবার পর উদ্বাস্তুদের যে অংশকে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যবস্থাপনায় দন্ডকারণ্যে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিল তাদের একাংশকে নানা ভাবে উসকানি দিয়ে, প্রলুব্ধ করে, ভুল বুঝিয়ে সুন্দরবনের মরিচঝাঁপিতে পাঠানোর জন্য ক্রমাগত উৎসাহিত করা হয়। এমন উদাহরণের অভাব নেই। তবুও আটাত্তর সালে রাজ্যে ভয়াবহ বন্যার মোকাবিলায় বামকর্মীদের চোয়াল শক্তকরা লড়াই রাজ্যকে বেসামাল হতে দেয়নি। একের পর এক জনমুখী কর্মসূচীতে রাজ্যবাসী সরকারকে নিজেদের সরকার বলে ভাবা শুরু করে। প্রশাসনে বিকেন্দ্রীকরণ গ্রামস্তর পর্যন্ত প্রসারিত হওয়ায় সরকারী কাজকর্মে গতি আসে। জনসাধারণের উৎসাহ ও অংশগ্রহণে সরকারের জনভিত্তি যতই মজবুত হয়েছে, স্বার্থান্বেষী ও প্রভাবশালী মহল ততই আশঙ্কায় ভুগে সরকারকে অসুবিধায় ফেলার নানা ছক সাজিয়ে গেছে।
একটা সাধারণ সত্য মনে রাখা দরকার-গৃহনির্মাণে শক্তভিতের প্রয়োজন পড়ে। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসন কালে তেমন কিছুই হয়নি, এমনটা নাকি অনেকে মনে করেন। বিরোধী নেতা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক কলমচি সুযোগ পেলেই তুলে ধরেন বামেদের কালো দিক। তাদের মনে পড়েনা সরকারে এসেই ফ্রন্ট সরকার সব ধরনের রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির বন্দোবস্ত করেছে। উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছে। ভূমি সংস্কার, সেচের সম্প্রসারণের পাশাপাশি সরকারী কর্মচারীদের সংগঠন করার অধিকার দিয়েছে, বেকার যুবক-যুবতীদের যন্ত্রণা প্রশমনে ভাতা চালু করার ব্যবস্থা করেছে। ফ্রন্ট বিরোধী শক্তি কিন্তু মগ্ন থেকেছে কর্মসংস্কৃতি, বন্ধ সংস্কৃতির নিন্দায়, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সরকার বদলের সুফল ব্যাখ্যায়। বেকার ভাতাকে ক্যাডার ভাতা হিসাবে দেখা কলমচিদের কারো চোখে বর্তমান সরকারের অপচয়, দুর্নীতি, নিয়ম বহির্ভূত ব্যয় নির্বাহের কোনো ছবি ধরা পড়েনা। মেলা, খেলা ও ক্লাব-খয়রাতি যে এই সরকারের প্রাণভোমরা।
২০০৬ সালের নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্যের পর ফ্রন্ট বিরোধী ষড়যন্ত্রের সলতে পাকানোর কাজ নতুন উদ্যমে শুরু হল। রাজ্যের শিল্প সম্ভাবনার বাস্তব রূপায়ণের সমস্ত চেষ্টাকে নস্যাৎ করার কাজে দেশী-বিদেশী সব শক্তির মদতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রতিবাদের মুখ হিসাবে তুলে ধরে নানা ছল ছুতোয় রাজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা চললো। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম পরিক্রমা শেষে যখন ২০১১'র নির্বাচনে বামেদের রাজ্যপাঠ উঠে গেল, ফ্রন্ট বিরোধী শিবিরে তখন যুদ্ধ জয়ের উল্লাস। বামকর্মী নেতাদের ধর-পাকড়, মিথ্যা মামলা আরোপ, পার্টি অফিস দখল, নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, চাতুরির সাহায্যে দলবদলের মাধ্যমে পঞ্চায়েত, মিউনিসিপ্যালিটি দখল-সব যেন তখন জলভাত। বাম সরকারের রেখে যাওয়া ঋণের বোঝা নিয়ে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিন থেকেই সভাসমিতিতে সোচ্চার হতে শুরু করেন অথচ কেন্দ্র-রাজ্যের আর্থিক বিন্যাসের সূত্র অনুযায়ী এমন কোনো রাজ্য সরকার নেই যে সরকারের ঘাড়ে এই ঋণের বোঝা নেই। ঋণভারের সবিস্তার ব্যাখ্যা না সংবাদপত্রের কলমে না মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণে। অথচ বামেদের ঋণের বোঝার সিংহভাগের কারণ স্বল্প সঞ্চয়ের আবশ্যিক পূর্বশর্ত। মজার ব্যাপার, তৃণমূল জমানায় চিটফান্ডের ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠতেই স্বল্প সঞ্চয় সংগ্রহে রাজ্য পিছিয়ে পড়ে। আমানতকারীরা সর্বস্ব খুইয়ে যখন প্রতিবাদে মুখর, এখানে ওখানে বিক্ষোভ-ভাঙ্গচুর চলছে, চিটফান্ডের মালিকদের কেউ তখন সরকারী অতিথিশালায় প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে নিবিড় আলোচনায় ব্যস্ত কেউ বা দোর্দন্ডপ্রতাপ নেতার জ্ঞাতসারে 'উত্তরে' গা ঢাকা দিয়েছেন। পরিস্থিতির তাগিদে সর্বোচ্চ আদালতকে তদন্তের আদেশ শোনাতে হয়েছে। রাজ্য প্রশাসন যথারীতি মাছ ঢাকার চেষ্টায় তদন্তের কাজে বাধা দিয়ে গেছে। এই লগ্নেই দেখা মিলেছে গন্ডায় গন্ডায় সংবাদপত্র, দেখা মিলেছে রাজ্যের বিনোদন জগতে আলোড়ন ফেলে দেওয়া এক ঝাঁক প্রযোজক, পরিচালক ও কুশীলবদের। এদের কেউ সরকারী সফরে মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী, কেউবা আবার 'ব্র্যান্ডঅ্যাম্বাসেডর'-এর ভূমিকায়। টেলিভিশনে নিত্যই প্রচার এদের নানাবিধ সামাজিক কাজকর্মের, পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসার লড়াইয়ের কাহিনী। টেলিভিশনের চ্যানেলে চ্যানেলে সিরিয়ালের নায়ক নায়িকা, প্রযোজক, পরিচালকদের বেছে নেওয়ার জন্য চ্যানেল কর্তৃপক্ষের উদাত্ত আহ্বান ও পরিশেষে 'টেলি এ্যাওর্য়াড' বিতরণের ধামাকাদার মঞ্চ। সেই তারকাদের কেউ তদন্তের জালে ছটফট করেছেন, কেউ ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে দেওয়ার শাসানি দিয়ে ইহলোক ত্যাগ করেছে, কেউবা আবার শ্রী-ঘরে দিনাতিপাত করছেন। এক প্রশ্নে একলাখ টাকার কারবারি 'চিটফান্ডে সব থেকে কে বেশী লাভবান' সেই গবেষণায় ইতি টেনে কী জাদুতে যেন আবার টিভির পর্দায় উদ্ভাসিত-ভিন্ন মঞ্চের ভিন্ন পালায় এবার আরো চকচকে। এই পালায় রোজ প্রায় হাফডজন রাজনৈতিক নেতাদের অশালীন বাকযুদ্ধে দর্শক আপনাকে বুঝিয়ে ছা়ড়া হবে আসন্ন নির্বাচনে প্রধান দুটি প্রতিপক্ষ তৃণমূল বা বিজেপি। বোঝানোর পালাটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার কাজে দু একজন পরিচিত বিশেষজ্ঞের উপস্থিতি প্রয়োজন পড়ে, তা থাকে যদিও সীমিত সুযোগ তাদের।
নির্বাচন আসন্ন, তাই যুক্ত হয়েছে জনমত সমীক্ষার নানা কারসাজি, কাঙ্ক্ষিত ফল পাবার আগ্রহে সাজানো প্রশ্নমালায়। আলোচকদের মধ্যে কোনো মজুমদার বা মিশ্রকে যদি বছর দুয়েক আগে অন্য কোনো দলের হয়ে গলা ফাটাতে দেখেন, আজ হয়তো দেখবেন তাদের মালিকানা বদল হয়ে গেছে। শর্তসাপেক্ষে মেধা বন্ধকে তারা সদাই আগ্রহী। দু বছর আগে যিনি উন্নয়নের ধ্বজা উড়িয়েছেন, সেই তিনিই আজ উন্নয়নের চাকায় লেগে থাকা কাদার রহস্য উন্মোচন করছেন। অথচ কৃষক আন্দোলন, শ্রমিকের বঞ্চনা, যুব সম্প্রদায়ের চাকরির দাবিতে আন্দোলন কোনো কিছুই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা হয়না। রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রের ঢালাও বেসরকারীকরণ, শ্রম আইনে সংশোধন, অর্থনীতির সামগ্রিক বেহাল দশা সব উধাও তাদের আলোচনায়। লাখো কৃষক নাকি নয়া কৃষি আইনের সুবিধা না বুঝেই প্রবল শীতে রাস্তায় অবস্থানরত। আর কৃষি আইনের সুবিধা টের পাইয়ে দিতে কৃষক - দরদী কেন্দ্রের সরকার তাদের উপর লাঠি বন্দুক উঁচিয়ে, ব্যারিকেড তুলে, রাস্তাকেটে, রাস্তায় পেরেক গেঁথে, জলকামান, টিয়ার গ্যাসের সেল ফাটিয়ে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির মান্যতা দানে ব্যস্ত।
নাগরিকদের একাংশকে ছারপোকা, উইপোকা বলতে কোন দ্বিধা নেই দেশের সরকারের।নাগরিকত্ব আইনের নেশায় তারা বুঁদ। অসমে নাগরিকত্ব আইনের প্রয়োগে যে বিপত্তি দেখা গেছে সে কথা মাথায় রেখে আসন্ন নির্বাচনের প্রেক্ষিতে তা নিয়ে সেখানে নেতারা মুখে টুঁ শব্দটি করেন না কিন্তু এরাজ্যের মতুয়া সম্প্রদায়ের সামনে সেই আইনেরই প্রতিশ্রুতি। বিজেপি শাসিত রাজ্যসরকার গুলির হাল হকিকত যাই হোক না কেন'সোনার বাংলা' তারা গড়বেনই। চাইলে রাজ্যবাসীকে আকাশের চাঁদও এনে দিতে পারেন বইকি! এ রাজ্যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায় বিজেপি অথচ বাক স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বিপন্ন তাদের শাসনাধীন রাজ্যগুলিতে। পেট্রল, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের দাম আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চললেও সরকারীভাবে কোনো আশ্বাস মিলছে না কেন্দ্রের তরফে। কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীদের মহার্ঘভাতা বন্ধ করে এ রাজ্যের কর্মীদের জন্য নাকি তারা মহার্ঘ ভাতা সহ সপ্তম পে-কমিশন গঠন করবেন। উত্তর প্রদেশে নারী নির্যাতনের রেকর্ড গড়েও তারা এ রাজ্যের মহিলাদের চাকরি ক্ষেত্রে সংরক্ষণের বন্দোবস্ত করবেন।
বিপরীতে এ রাজ্যের শাসকদলের দিকে তাকান-দলনেত্রীর শুভাষিত বক্তৃতায় পাবেন বঙ্গ সংস্কৃতির উজ্জ্বল উত্তরাধিকার। দুটি দলেরই লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। বিজেপি দল পরিচালিত হয় আরএসএসের নির্দেশে। আরএসএস কম্যুনিস্ট বিরোধী, মুখ্যমন্ত্রীও কম্যুনিস্ট বিরোধী। ত্রিপুরায় তৃণমুল দলের সকলেই এখন বিজেপি। অথচ এই ত্রিপুরাতে ঘটা করে নেত্রী তার শাখা খুলে ছিলেন বিজেপিকে সেখানকার মসনদে বসিয়ে দিতে। ত্রিপুরায় ক্ষমতায় আসার আগে বিজেপি ডাবল ইনজিনের (অর্থাৎ কেন্দ্র ও রাজ্যে একই সরকরা) তত্ত্ব শুনিয়েছিল। এখন রাজ্যে সেই তত্ত্ব আওড়াচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর শিবির ত্যাগ করে চলে যাওয়া দুই মহারথী শুভেন্দু ও রাজীব। বিজেপির বিরুদ্ধে প্রখান মুখ নাকি মুখ্যমন্ত্রী। তো তার শাসন কালেই রাজ্যে আরএসএসের শাখা সংগঠন দ্বিগুন বৃদ্ধি পেয়েছে শুধু নয়, মাত্র একদশকেরও কম সময়ে বিজেপি ভোটে তার অংশীদারত্ব বাড়িয়ে নিয়েছে চার থেকে প্রায় চল্লিশ শতাংশ। বিজেপি বিরোধিতার আর কি প্রমাণ লাগে। রাজ্যের বিধানসভার আসন সংখ্যা ২৯৪। বিজেপির সাংগঠনিক শক্তি রাজ্যে যতই বৃদ্ধি পাক, অত আসনে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী নির্বাচনে নামানো সহজ কথা নয় সুতরাং দলবদলের পালা এ শিবির থেকে ও শিবিরে। তাও আবার চুড়ান্ত নয়, দুদিন পরে আবার ফিরে আসা বা ফিরে যাওয়ার দৃষ্টান্ত পাবেন। নির্বাচন প্রার্থীদের এহেন চাহিদা বৃদ্ধিতে তাই তথাকথিত 'সেলিব্রিটি' মহলে দেখা যাচ্ছে বিপুল উৎসাহ, উদ্দীপনা। 'আগে কে বা প্রাণ করিবেক দান' এই তাড়নায় তারা আক্রান্ত। এই নাহলে সেলিব্রিটি!
করোনার অতিমারি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে বিপর্যয়কালে আমাদের দেশ, আমরা কতো অসহায়। উপযুক্ত প্রতিবিধানের পরিবর্তে দেশনেতা থালা বাজিয়ে, আলো জ্বালিয়ে রোগ তাড়ানোর উপদেশ শোনালেন তো রাজ্যে নেত্রী এঁকে দেখালেন গন্ডী। অবাক চোখে দেশবাসী কেখলো রেল, সড়ক পথ ধরে লাখো ভুখা পরিযায়ী শ্রমিকের মিছিল। সেই করুণ দৃশ্যে দেশবাসী হতচকিত, বিহ্বল। দুই শাসকের এক পক্ষ তাদের বিতাড়নের (কু) বন্দোবস্ত করেছে তো অন্য পক্ষ 'করোনা এক্সপ্রেস' নামকরণ করে অমানবিকতার নির্দশন রেখেছে। সারা দেশের সাথে তখন এই রাজ্যে মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছে যারা তারা আর কেউ নয় - বামপন্থী কর্মীরা। বেশ কিছু অরাজনৈতিক সংগঠনকেও এগিয়ে আসতে দেখা গেছে, সাধুবাদ প্রাপ্য তাদের। মহল্লায় মহল্লায় শ্রমিক ক্যান্টিন, বিনামূল্যে সব্জি, রান্না ঘরের মাধ্যমে তারা চেষ্টা চালিয়ে গেছে গরীব মানুষজনের মুখে অন্তত একবেলা দু মুঠো অন্ন জোগানোর; তখন দেখা মেলেনি কোনো'দুয়ারে সরকার' বা 'পাড়ায় সমাধান' বা 'মা ক্যান্টিন'। ভোটের গন্ধ নাকে যেতেই শুরু হয়েছে দূরে ঠেলে দেওয়া মানুষদের কাছে টেনে নেওয়ার হুড়োহুড়ি এ দলে ও দলে। তার সঙ্গে তাল ঠুকে শুরু হয়েছে ঘন্টাব্যাপী আলোচনা, রথযাত্রার, দিদির দূতের সাতকাহন সংবাদপত্রে, টেলিভিশনে। সে তরজার আসরে শুনতে পাবেন না শ্রমিক - কৃষক মেহনতী মানুষের আন্দোলনের, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে, বিকল্পের সন্ধান খুঁজতে কর্ম প্রার্থী যুবক-যুবতীদের নিয়ে রাস্তার আন্দোলনে, শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের অবস্থান, অনশন মঞ্চে উপস্থিত বামপন্থী নেতা কর্মীদের নিরলস সংগ্রামের কথা। শাসক ভজনায় অভ্যস্ত সংবাদিক কুলের যে বড়ই ব্যস্ততা বিজ্ঞাপনের নামে ছুঁড়ে দেওয়া উচ্ছিষ্ট সংগ্রহ করার কাজে।
তাই আবেদন, বন্ধ করে দিন মিথ্যার বেসাতি করা তৃণমূল ও বিজেপির লোক দেখানো এই ছায়াযুদ্ধের নাটক। শ্রমিক-কৃষকের বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঁধা গান যারা চুরি করে, শ্রমিক-কৃষক দরদ দেখিয়ে যারা শিল্প সম্ভাবনা নষ্ট করে, প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে, লোক ঠকিয়ে যারা জনহিতের কথা বলে তাদের বেআব্রু করে দিন। বাম গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সপ'ক্ষে সুস্পষ্ট মত দান করে রাজ্যের প্রতিবাদী চরিত্র, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার বহনের দায়িত্ব তুলে দিন নব প্রজন্মের কাঁধে। সময়োপযোগী আরো একটি কাতরপ্রার্থনা- 'নোটা' নামক ফাঁদের জালে নিজের মতকে জড়াতে দেবেন না। তুলনামূলক বিচারে গ্রহণযোগ্য প্রার্থীকে বেছে নিন আপনার প্রতিনিধি হিসাবে- নতুবা তার ফল ঘরে তুলবে স্বার্থান্বেষী শাসক কুল। প্রমাণ করে দিন লোক ঠকানোর প্রবঞ্চনা চালিয়ে যাওয়া দুটি দল একই মুদ্রার দুটো পিঠ। তাই তো ব্যাঙ্গালুরুর পরিবেশকর্মী দিশা রবির জন্য তৃণমূল নেত্রী কুম্ভীরাশ্রু ফেললেও যাদবপুরের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে আদালত চত্বরে দৌড় করাতে কসুর করেন না। আবার মইদুল ইসলাম মিদ্যা যুবক-যুবতীদের চাকরির দাবিতে মমতার পুলিশের বর্বর আক্রমণে জানকবুল লড়াই করে যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন, তখন সেই মমতারই একদা বিশ্বস্ত অনুগামীদের (যারা আজ পাঁচিলের ওপারে) গলায় ওঠে নিন্দার ঝড়- সবই যেন এক রকম গড়াপেটার খেলা। এই খেলা বন্ধ করতে পারি আমরা। আসুন, আমার আপনার ঘরের ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে, খেটেখাওয়া মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা ভেবে, সমাজের চেনা চেহারাটা ফিরিয়ে এনে বাংলা ও বাঙ্গালীর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে এক জোট হয়ে বাতিল করি মুদ্রার কোনো একটা পিঠ নয়, অচল মুদ্রাটাকেই।
জয় হোক শুভ বুদ্ধির, জয়ী হোক গণতন্ত্র।