আরেক রকম ● নবম বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২১ ● ১৬-৩১ চৈত্র, ১৪২৭
প্রবন্ধ
রাজনীতিতে তারাদের কথা এবং কিছু প্রশ্ন
গৌতম হোড়
পশ্চিমবঙ্গের ভোটে এবার প্রধান দুই প্রতিপক্ষ তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি প্রচুর অভিনেতা, অভিনেত্রী, খেলোয়াড়কে প্রার্থী করেছে। এমন নয় যে, এই নির্বাচনেই অভিনেতা এবং অন্য গ্ল্যামার জগতে থাকা মানুষদের প্রার্থী করা হলো। গত লোকসভা নির্বাচনে হয়েছে। আগের বিধানসভা নির্বাচনে বা লোকসভাতেও হয়েছে। তার আগেও যে হয়নি এমন নয়। তফাতের মধ্যে এবার সংখ্যাটা অনেক বেশি।
তৃণমূলের তারকা প্রার্থীদের মধ্যে আছেন জুন মালিয়া, কাঞ্চন মল্লিক,রাজ চক্রবর্তী, সায়নী ঘোষ, কৌশানি মুখোপাধ্যায়, সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, লাভলি মিত্ররা। লড়ছেন গায়িকা অদিতি মুন্সি। বাংলার প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক মনোজ তিওয়ারি, প্রাক্তন ফুটবলার বিদেশ বসুও তৃণমূলের হয়ে ভোটের লড়াইয়ে আছেন।
বিজেপি-র তারকা প্রার্থীদের মধ্যে আছেন, শ্রাবস্তী, রুদ্রনীল ঘোষ, পার্নো মিত্র, অগ্নিমিত্রা পাল, কল্যান চৌবে, অশোক দিন্দারা। অভিনেত্রী স্বস্তিকা বামেদের নেতৃত্বাধীন ব্রিগেডের সভায় ছিলেন। পরে প্রচারও করছেন। তবে প্রার্থী হননি।
লোকসভাতেও এখন দেব, মিমি, নুসরত, শতাব্দী, লকেটের মতো একঝাঁক তারকা প্রার্থী পশ্চিমবঙ্গ থেকে আছেন। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, দক্ষিণ ভারত, মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ থেকেও প্রচুর তারকা লোকসভায় জিতে এসেছেন। তারকারা অতীতেও জিতেছেন। এখনো জিতছেন। ভবিষ্যতেও জিতবেন। তাঁদের গ্ল্যামার, ক্যারিশমা দিয়ে।
তারকারা রাজনীতিতে আসতেই পারেন, প্রার্থীও হতে পারেন, এবং জিততেও পারেন, তাতে কোনো অসুবিধা নেই। অসুবিধাটা হচ্ছে, তারকা সহ বিভিন্ন পেশার একঝাঁক মানুষ হঠাৎ ঠিক করছেন, তাঁরা রাজনীতিতে আসবেন, দলগুলিও তাদের নেওয়ার জন্য বসে আছে। আমরা কী দেখতে পাচ্ছি, ভোটের আগে তারা রাজনৈতিক দলে যোগ দিচ্ছেন, প্রার্থী হচ্ছেন, অনেকেই জিতে যাচ্ছেন। রাজনীতির জন্য তাদের ঘাম-রক্ত ঝরাবার দরকার হয় না। মানুষের জন্য কাজ করার দরকার হয় না। তাদের বিপদে আপদে পাশে থাকার দরকার হয় না। রাজনীতি তাঁদের কাছে ৩৬৫ দিনের পেশা বা নেশা নয়। তাদের আলাদা জগত আছে। সেই জগতে তারা মোটামুটি বা ভালরকম সফল। তার জন্য তাদের একটা জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছে। সেই জনপ্রিয়তাকে রাজনৈতিক দলগুলি কাজে লাগাতে চায়। বড় হোক বা ছোট এখনও তারকাদের মানুষ সামনে থেকে দেখতে চায়। তাদের কাছে রাজনীতি মানে, ভোটের প্রচারের সময় শিখিয়ে দেওয়া বা না দেওয়া কথাগুলো আউড়ে যাওয়া। রোড শো করা। ছোটখাট জনসভা। তাদের দেখতে মানুষ ভিড় করবে। সেলফি তেলার চেষ্টা করবে। তাদের রূপ নিয়ে, ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করবে। তারপর ইভিএমে বোতাম টিপে তাদের জেতানোর ব্যবস্থা করবে।
এখানেই একটা বিপজ্জনক প্রবণতা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। কারণ, এই তারকারা, প্রাক্তন আমলারা, ফুটবলার-ক্রিকেটার, এমনকী সাংবাদিকরাও এই ভাবে সাংসদ বা বিধায়ক হয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা বুঝে যাচ্ছেন, রাজনীতিতে সারা বছর মানুষের মাঝে থেকে কাজ করার কোনো দরকার নেই। ও সব করার জন্য দলের কর্মীরা আছে। তাঁরা লড়াই করবেন, রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের লাঠি খাবেন, জেলে যাবেন। আর তারকারা তাদের গ্ল্যামার দিয়ে একবার সাংসদ ও বিধায়ক হতে পারলে কেল্লা ফতে। রোজ রোজ লোকসভা বা বিধানসভায় যাওয়ারও দরকার নেই। লোকের জন্য নির্বাচনকেন্দ্রে অফিস করে সেখানে নিয়মিত বসে থাকারও দরকার নেই। মানুষের প্রয়োজনের কথা শুনে তাদের সাহায্য করারই বা কী দরকার। ও সব দল সামলে নেবে। তাঁরা তাদের গ্ল্যামার জগত নিয়েই থাকবেন।
লোকসভা বা রাজ্যসভার সাংসদ বা কোনো রাজ্য বিধানসভার বিধায়ক হওয়ার পরেও নেতাদের একটা দায়িত্ব থেকে যায়। আমরা সংসদে দেখেছি, কীভাবে ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, জর্জ ফার্নান্ডেজ, অটল বিহারী বাজপেয়ী, সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি, প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি, প্রণব মুখোপাধ্যায়রা একের পর এক বিষয়ে সরকারকে বিপাকে ফেলতেন। প্রশ্ন তুলে, বিতর্কে অংশ নিয়ে, কোনো কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দিয়ে। এখন তো বিতর্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে, সরকারে থাকার সময় আপনি কী করেছিলেন, আগে কী বলেছিলেন, এখন কী বলছেন। অনেকটা টিভির বাইট-কালচারের মতো। একজনের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী নেতার কাছে চলে যাওয়া। উনি এই কথা বলেছেন, আপনি কী বলবেন। তারকাদের কাছ থেকে খুব বেশি প্রত্যাশাও থাকে না। তারা সংসদ বা বিধানসভায় নিজের কেন্দ্র নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন করবেন। খুব বেশি হলে সংসদের অধিবেশন যখন হবে, তখন কখনো সখনো সেখানে থাকবেন। একটা দুটো বিতর্কে অংশ নেবেন।
ভালো সাংসদ বা বিধায়ক হতে গেলে প্রচুর পড়াশুনো করতে হয়, সংসদ বা বিধানসভার নিয়ম সম্পর্কে পুরো ওয়াকিবহাল হতে হয়। কোন বিষয়ে কী কথা বলতে হয় তা শিখতে হয়। প্রতিটি বিষয়ের গভীরে যেতে হয়। বিপক্ষ কী বলবে, তা অনুমান করতে হয়। প্রণববাবুকে দেখেছি, ইতিহাস পুরো মুখস্ত থাকত। কবে ইন্দিরা গান্ধী কী বলেছেন, বাজপেয়ী তার জবাবে কী বলেছিলেন, বিদেশি রাষ্ট্রনেতারা এসে কী বলেছেন, সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদে কী আছে, সংসদের নিয়ম-কানুন, রীতি-রেওয়াজ সব গড়গড় করে বলে যেতে পারতেন। ইন্দ্রডিৎ গুপ্ত মন্ত্রীদের এমন প্রশ্ন করতেন যে, তারা পালাবার পথ পেতেন না। নরসিমহা রাও যখন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা অন্য কোনো বিষয় বলতেন, তখন তাঁর পান্ডিত্যের ঝলক দেখে অবাক হয়ে যেতে হত। বাজপেয়ীর ভাষণে কথার খেলা ও বিপক্ষকে ফালাফালা করে দেওয়া ছিল দেখার মতো। জর্জ যেমন যুক্তিজাল বিস্তার করতে পারতেন, তেমনই বিপক্ষকে আক্রমণে ফালাফালা করে দিতে পারতেন। এই গুণটা সুষমার ভাষণেও ছিল। জেটলিরও। আর সংসদে চালু কথাই ছিল, ইংরাজি শিখতে হলে জয়পাল রেড্ডি বা যশবন্ত সিং-এর ভাষণ শুনতে হবে। এটা একদিনে হয় না। অধ্যাবসায় লাগে। চেষ্টা লাগে। কষ্ট করে শিখতে হয়। আর এখানেই তারকা সাংসদ ও বিধায়কদের অধিকাংশই ডাহা ফেল করে যান। তা তিনি ধর্মেন্দ্র হোন বা রেখা বা অন্য কেউ। বিনোদ খান্না ও শত্রুঘ্ন সিনহার মতো কয়েকজন তারকা অন্যদের থেকে কিছুটা বেশি গুরুত্ব দিয়ে রাজনীতি করেছেন। এখন লকেট চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে এই গুণটা দেখা যাচ্ছে।
যে কথাটা বলছিলাম, তারকারা একটা ভয়ঙ্কর প্রবণতার জন্ম দিচ্ছেন। অভিনেতা, অভিনেত্রী, আমলা এবং অন্যান্যরা রাজনীতির মূল জায়গাটাই ভুলে যাচ্ছেন। মানুষের পাশে্ থেকে, মানুষের জন্য, তাদের সাহায্য করতে রাজনীতি করতে হয়। অন্য পেশার থেকে রাজনীতি আলাদা এই কারণে। তারকারা তো চিরাচরিত পথে রাজনীতি করে সাংসদ বা বিধায়ক হননি বা হচ্ছেন না। তাঁরা তো জানেন, গ্ল্যামার এবং দলের জনপ্রিয়তা দেখিয়ে তাঁরা জিতে যাবেন। ফলে তাঁদের ওসব করার কী দরকার। দুইটি ঘটনার উল্লেখ করি। দুটোই পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটের ঘটনা। দুইটি ঘটনার কথা আনন্দবাজার ডিজিটালে বিস্তারে বেরিয়েছিল। তৃণমূলের এক তারকা সাংসদ রোড শো করছিলেন। ঘণ্টাখানেক প্রবল রোদ ও গরমে তিনি রোড শো করেছেন। তারপর তাঁকে কর্মীরা অনুরোধ করেন, আর আধ কিলোমিটার করুন। তাহলেই হবে। কিন্তু তিনি গাড়ি থেকে নেমে পড়েন। নামার সময় না কি তিনি বলেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীর জন্যও এতটা তিনি করেন না। অর্থাৎ, এই একঘণ্টা প্রবল গরমে রোড শো করে তিনি দলকে ধন্য করে দিয়েছেন, এরকম একটা মনোভাব তাঁর কথা থেকে বেরিয়ে এসেছে। তাঁকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তাঁর কাছে রাজনীতি মানে ওই রোড শো। মানুষকে দেখে হাত নাড়া। মানুষও হামলে পড়বে তাঁকে একবার কাছ থেকে দেখার জন্য। প্রচুর ভিড় হবে। ব্যস। খেল খতম।
অন্য ঘটনাটা বিজেপি-র তারকা প্রচারক মিঠুন চক্রবর্তীর রোড শোর ঘটনা। সেখানে মানুষের ঢল নেমেছিল। একজন জানিয়েছেন, তিনি ১৪ কিলোমিটার সাইকেলে করে এসেছেন শুধু মিঠুনকে কাছ থেকে দেখবেন বলে। এই উন্মাদনা দেখেই তো রাজনৈতিক দলগুলি তারকাদের জন্য ঝাঁপায়। তারকারাও রাজনীতিতে আসেন। তাদের কাছে সম্ভবত রাজনীতি মানে তো ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া। আর মানুষও তাদের ভোট দেয়। কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়কে হারিয়ে দেন এক অভিনেত্রী। অথচ, মানুষ জানেন, ঝড়-জল হলে বাঁধ ভাঙলে কান্তি বা তাঁর মতো রাজনৈতিক নেতারা সব কিছু ছেড়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবেন, জলকাদায় নেমে কাজ করবেন। তারকা বিধায়ক বা সাংসদ সচরাচর ওই পথে হাঁটবেন না। তা সত্ত্বেও তারা গ্ল্যামার দেখে ভোট দেন। সে জন্য ভোটের ময়দানে নেমে পড়েন, নবীন গায়িকা, টিভি তারকা, সিনেমা তারকারা। তাঁদের মানুষ ভোট দিয়ে জেতালে আর কী বলার আছে। শুধু একটাই কথা বলার, এরপর যেন মানুষ, সাংসদ-বিধায়ককে এলাকায় দেখা যায় না, তিনি মানুষের কাজ করেন না বলে অভিযোগ না করেন। কারণ, তাঁরা সব জেনেশুনেই তো ভোট দিচ্ছেন।
তার উপর এখন রাজনীতির চাল-চরিত্র চেহারাই বদলে গেছে। এখন কে লড়েছেন সেটা গৌন হয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে ২৯৪ কেন্দ্রেই লড়েন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ভোটটা তাঁকে দিতে। তিনিই সব কাজ করবেন। বিজেপি-র তো মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী নেই। অনেক রাজ্যেই থাকে না। সেই সব জায়গায় বিজেপি লড়ে নরেন্দ্র মোদীকে সামনে রেখে। অর্থাৎ, মোদীই লড়েন সব কেন্দ্রে। বিজেপি-তে ভোট পড়ে তাঁর নামে। তাঁর প্রতি মানুষের আস্থা এবং অমিত শাহের ভোটকৌশলের জন্য প্রার্থীরা জিতে যান। সেজন্য ভোটের ঠিক আগে প্যারাসুট করে অন্য দল থেকে বিজেপি-তে নেমে এসে জিতে যান নেতারা। দলের মতাদর্শ দেখার দরকার হয় না, যিনি এতদিন তৃণমূলে থেকে বিজেপি-র প্রবল সমালোচনা করেছেন বা বিজেপিতে থেকে তৃণমূল নেত্রীকে তুলোধুনা করেছেন, তিনিই নতুন দলে গিয়ে ঠিক উলটো কথা বলতে থাকেন। তারপরেও মানুষ তাঁদের ভোট দিয়ে জেতান। সেখানে অবশ্য তাঁদের নিজস্ব একটা ভোটব্যাঙ্ক থাকে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় দল বা নেতার জনপ্রিয়তা। ফলে রাজনীতিকরা ঢালাও দলবদল করছেন এবং জিতে আসছেন যে, তাতে অনেকগুলি বিষয় সাফ হয়ে যাচ্ছে। যেমন, মানুষের স্মৃতিশক্তি খুব ভাল নয়। নইলে যে দলের, দলের নেতার বিরুদ্ধে এতদিন দোষারোপ করেছেন, পর দলবদল করে ঠিক উলটো কথা বলার পরেও মানুষ তা মেনে নিচ্ছন। তখন তাঁরা আগের কথাগুলো ভুলে যাচ্ছেন। দুই, মানুষের পাশে থাকার চিরাচরিত রাজনীতির অঙ্ক এখন মিলছে না। তার থেকে অনেক বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে আবেগের বিষয় এবং অন্য নানা প্রশ্ন। তিন, তারকাদের গ্ল্যামার পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের যে কোনো রাজ্যেই তাদের ভোটে জিতিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, তা তিনি যে দলেরই হোন না কেন। চার, যেভাবে তারকারা জিতছেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে, রাজনীতিতে বোধহয় প্রশিক্ষণের দরকার হয় না। পাঁচ, দলবদলুদের রমরমায় এটাও প্রমাণিত, মতাদর্শ ইত্যাদির কোনো দাম নেই। ছয়, আসল হচ্ছে, হাওয়া মোরগের মতো হাওয়া কোনদিকে বইছে, তা বুঝে ফেলা। তারপর দলবদল করে জিতে যাওয়া। ক্ষমতার সঙ্গে থাকার আর্টটা রপ্ত হয়ে গেলেই আর চিন্তা নেই। ছয়, ভোটদাতারা কয়েকটি রাজ্যে খুব রাজনীতি সচেতন বলে যে কথাটা বলা হয়, তার অনেকটাই মিথ।
তাই তারকাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তারা যদি এত সহজে রাজনীতির জগতে ঢুকে পড়তে পারেন, তা হলে তা ছাড়বেন কেন?