আরেক রকম ● নবম বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২১ ● ১৬-৩১ চৈত্র, ১৪২৭

প্রবন্ধ

জাঁলিয়াওয়ালা বাগের জার্নাল থেকে

শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত


৭ ডিসেম্বর ২০২০

আজ থেকে দেড় বছর আগে ২৩শে জুলাই ২০১৯-এ ইতিহাসবিদ বিশ্বনাথ ডাট্ বা ভি এন ডাট্-এর দক্ষিণ দিল্লির ফ্ল্যাটে যখন পৌঁছেছিলাম তখন বেলা ১ টা বাজে। ঠিক দুপুরের খাওয়ার সময়টাতে এইভাবে উপস্থিত হওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। তার ওপর যাঁর কাছে যাচ্ছি তাঁর বয়েস ৯৩ এবং তিনি কয়েকদিন আগেই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। কিন্তু তাঁর ছোটো মেয়ে অধ্যাপক ননিকা ডাট্ আমার সব দ্বিধান্বিত মেসেজের উত্তরে বারবার লিখলেন যে দুপুরের খাওয়াটা যেন আমরা তাঁদের সঙ্গেই সারি। আমরা মানে চিত্রগ্রাহক-শিল্পী উৎসব ও আমি।

ননিকার মেসেজ আসছিল এরকম - বাবা তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারবেন কিনা জানি না... খুবই অশক্ত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু চেষ্টা করা যাক। ...ওই সময়টা বাবার জন্য সুবিধার। কথা হয়ে গেলে উনি খেয়ে বিশ্রাম নেবেন। তোমরা কিন্তু আমাদের সঙ্গে খাবে দুপুরে। ...আমি খুব চাই যে বাবা কথা বলুন।

ওইদিন দুপুরে কথোপকথনের রেকর্ডিংটা আজ আবার খানিকক্ষণ শুনছিলাম। সকাল থেকে মনটা ভারি হয়েছিল কারণ খবর এল সাত দিন আগে চলে গেছেন বিশ্বনাথ ডাট্ এবং গতকাল রাতে বিদায় নিয়েছেন তাঁর স্ত্রী কমলা।

সেদিনের রেকর্ডিং-এর মধ্যে ধরা আছে রান্নাঘরে প্রেশার কুকারের সিটি এবং একসঙ্গে বসে খাওয়া ও কথা বলার সময়কার আরো কত আনুষাঙ্গিক শব্দ। কিছু শব্দ মনে করিয়ে দিচ্ছে মূল কথোপকথনের বাইরেও অনেক কথা। যেমন, খাবার ঘরের দেওয়াল জুড়ে ফ্রেমবন্দি একটা অপূর্ব ফুল্কারি কাজ ছিল যেটা তখনকার পাঞ্জাবী দস্তুর অনুযায়ী কমলা ডাট্-এর বিয়ের সময় তাঁর মাতৃসমা মহিলারা অনেকদিন ধরে তৈরি করে উপহার দিয়েছিলেন।

ওইদিন দুপুরবেলা আমরা বাড়ি খুঁজে পৌঁছে দেখেছিলাম পড়ার ঘরে ফুল রাখা হয়েছে চেয়ারের পাশে। টেবিলের ওপর সাজানো ১৯৬৯-এ, অর্থাৎ জাঁলিয়াওয়ালা বাগের পঞ্চাশ বছরে প্রকাশিত ভি এন ডাট্-এর বহূ-চর্চিত বই 'Jallianwala Bagh', তার কয়েক বছর পরের 'New Light on the Punjab Disturbances in 1919' ও অন্যান্য বইপত্র। বৃদ্ধ মানুষটিকে পাশের ঘর থেকে হুইলচেয়ারে করে নিয়ে এসে এ'ঘরের চেয়ারে বসানো বাকি। ননিকা বললো, পাঁচ-দশ মিনিট দাও।

অপেক্ষার এই সময়টায় নিজে থেকে আলাপ করলেন এসে ননিকার দুই দিদি। নিয়ে গেলেন তাঁদের মা কমলা ডাট্-এর সঙ্গে দেখা করাতে। ক্যান্সার কমলার বৃদ্ধ শরীরকে কাবু করলেও হার মেনেছে সজীব মনের কাছে। ফোকলা হাসিতে এক লহমায় আমাকে কাছে টেনে নিলেন তিনি, বসালেন তাঁর বিছানার পাশে। আমার বাড়ির কথা, কাজের কথা যখন জিজ্ঞেস করছেন, কথা বলতে বলতে লক্ষ করলাম দেওয়ালে একটি ছবিতে গান্ধীজির সঙ্গে একজন অচেনা মানুষ। কোথায় যেন চলেছেন হেঁটে। কে ইনি? জানলাম ছবির মানুষটি কমলার বাবা। অবিভক্ত পাঞ্জাবে পুলিশে চাকরি করতেন। আমাকে কৌতূহলী দেখে ছবিটা দেওয়াল থেকে নামিয়ে দিতে বললেন মেয়েদের। যত্ন করে দেখালেন দেশভাগের পর কোনো একটি উদবাস্তু শিবিরের সামনে গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর বাবার ছবি। ততক্ষণে আমরা দুজনেই জেনে গেছি যে আমাদের উভয় পরিবার পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগের ধাক্কাটা নানাভাবে সরাসরি অনুভব করেছে। আমি শিহরিত হয়েছি শুনে যে দাঙ্গার সময় কমলার এক আত্মীয়া নিজেকে রক্ষা করতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন কুয়োতে। ভীষ্ম সাহনির উপন্যাস আর গোবিন্দ নিহালনির 'তামস' ছবিটা চোখের ওপর ভেসে উঠছে। এমন সময় ডাক এলো পড়ার ঘর থেকে - আমি আর কমলা বললাম, খেতে খেতে আবার কথা হবে।

অধ্যাপক বিশ্বনাথ ডাট্-কে বসানো হয়েছে তাঁর চেয়ারে। উৎসব ক্যামেরা রেডি করলো। ওদিকে ননিকা তার বাবার কানে দিল হিয়ারিং এইড। আমি সাউন্ড রেকর্ডার চালিয়ে কথা শুরু করবার প্রস্তুতি নিলাম সেই মানুষটার সঙ্গে যিনি ১৯২৬ সালে জন্মেছিলেন জাঁলিয়ানওয়ালা বাগ থেকে দশ মিনিটের দূরত্বে তাঁর পৈতৃক বাড়িতে।

অনেক প্রশ্ন ছিল আমার তাঁর কাছে। কিন্তু অসুস্থতা ও কানে শোনার সমস্যা থাকার জন্য দশ মিনিটের বেশি ভি এন ডাট্-এর সঙ্গ আমরা পাইনি। সেই দশটা মিনিট আমাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল ভি এন ডাট্-এর মুখে শোনা অল্প ক-টি কথার চেয়েও অনেক বেশি তাঁর না-বলা কথা ও উথলে-ওঠা আবেগ। জাঁলিয়ানওয়ালা বাগ-এর কথা তিনি প্রথম কীভাবে শুনেছিলেন - এটাই ছিল তাঁর কাছে আমার প্রথম প্রশ্ন। এর উত্তরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে পড়তে তিনি বলেছিলেন, "আমার দিদি আমাকে প্রথম বলে যখন আমার চার বছর বয়েস... দিদি বলেছিল আমাদের মা সেদিন বুক চাপড়ে কাঁদতে শুরু করেছিলেন গুলি চলার খবর শুনে... বাবা বাড়ি ছিলেন না... মা ভেবেছিলেন বাবা বোধহয় ওখানেই গেছেন... আর ফিরবেন না... তাই মা বুক চাপড়ে কাঁদছিলেন...।"

এই ক-টি কথা বলতেই বারবার কান্নায় তাঁর গলা বুজে আসে। আমি স্পষ্ট শুনতেও পাচ্ছিলাম না সব কথা। ননিকা তার বাবার হাত ধরে ভি এন ডাট্-কে সামলাচ্ছিল। আমি অভিভূত হয়ে দেখছিলাম এমন একজন মানুষকে যিনি ওই হত্যাকাণ্ডের সাত বছর পরে জন্মান অমৃতসরে, মাত্র এক বছর বয়সে হন মাতৃহারা এবং যাঁর শৈশব-কৈশোরে প্রায় প্রতিদিন যাওয়া-আসা ছিল ওই বধ্যভূমিতে। সে জায়গাটা বাগানে পরিণত হওয়া তখন ছিল কল্পনার অতীত! যে আঘাত পাঞ্জাবের মানুষ ও সমস্ত দেশের মানুষকে শোকস্তব্ধ, নির্বাক করে দিয়েছিল ১০১ বছর আগে, তার তীব্রতা ওই ৯৩ বছরের মানুষটির মধ্যে দিয়ে যেন ছুঁয়ে গেল আমাকে কয়েক মুহূর্তের জন্যে। আজও গুলির চিহ্ন বহন করছে জাঁলিয়ানওয়ালা বাগ-এর যে দেওয়াল - যে চিহ্নগুলোকে সাদা রং-এর চৌখুপির মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় এখন সেখানে গেলে - সেই দেওয়ালের সামনে একাধিকবার দাঁড়িয়েও আমি কখনো যে সময়টাকে ছুঁতে পারিনি, সেই জাঁলিয়ানওয়ালা বাগ-কে অনুভব করলাম ভি এন ডাট্-এর আবেগমথিত কন্ঠস্বর ও শৈশবস্মৃতি আলোড়নের মধ্যে! যে স্মৃতির মধ্যে হয়তো মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে এক বছর বয়সে তাঁর মা-কে হারানোর একান্ত নিজস্ব বেদনা ও জাঁলিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের সময়কার পাঞ্জাববাসী তথা দেশবাসীর মনের গভীর বিষাদ।

৮ ডিসেম্বর ২০২০

ভি এন ডাট্-এর বাড়ির খাবার ঘরে তাঁর বাবার একটা সাদা-কালো ছবি টাঙানো ছিল। তিনি নামকরা কবি। নাম ব্রহ্মানন্দ ডাট্। উর্দু ও ফার্সিতে কবিতা লিখতেন। অমৃতসরে বড় কারবার ছিল তাঁর। ১৩ই এপ্রিল জাঁলিয়ানওয়ালা বাগের জমায়েতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে কাউকে কাউকে ভালো চিনতেন ব্রহ্মানন্দ। এর মধ্যে তাঁর বন্ধু রতনচাঁদ কাপূর প্রাণে বেঁচে যান, যদিও দৌড়ে পালিয়ে আসার সময় পায়ে গুলি লাগে তাঁর। অপারেশন হয়েছিল কিন্তু পায়ের পাতায় গুলি লাগার দরুন রতনচাঁদ তারপর থেকে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। এই মানুষটিকে ছোটবেলা থেকে দেখেছেন ভি এন ডাট্ ও তাঁর পরিবার। তাঁদের যৌথ স্মৃতিতে রতনচাঁদ কাপূরের খুঁড়িয়ে হাঁটার মধ্যেও রয়ে গেছে জাঁলিয়ানওয়ালা বাগ।

ননিকার থেকে শুনলাম ব্রহ্মানন্দ ডাট্-এর বাড়িতে কবি-সাহিত্যিকদের মেহফিল বসতো, ফৈজ থেকে শুরু করে অনেকে আসতেন। কবিতাই সেখানে জাত-ধর্ম নির্বিশেষে কবিদের কাছাকাছি এনেছিল। ব্রহ্মানন্দ ডাট্-রা আবার ছিলেন হুসেনি ব্রাহ্মণ। হুসেনি ব্রাহ্মণদের কথা এর আগে আমি কখনো শুনিনি।

কথিত আছে এঁদের পূর্বপুরুষ বহুকাল আগে আরব দেশে থিতু হন এবং কারবালার যুদ্ধের সময় হাসান-হুসেনের পাশে ছিলেন ডাট্ বংশের বীর যোদ্ধা রাহিব ও তাঁর দলবল। পরে আবার রাহিব ডাট্ ও তাঁর বংশধররা এদেশে চলে এসে মূলত পাঞ্জাব-সিন্ধে বসবাস করেন। এঁরা ইসলাম ধর্মের কিছু কিছু রীতি-রেওয়াজ গ্রহণ করেছিলেন। ডাট্-দের পারিবারিক স্মৃতিতে ধরা আছে বংশের ব্রাহ্মণ বালকদের মুণ্ডনের সময় ইমাম হুসেনের নাম নিতে বলার কথা! এসব অঞ্চলে বহু বছর মহরমের তাজিয়ায় এঁদের যোগদান ছিল স্বতস্ফূর্ত ও প্রত্যাশিত। অমৃতসরের ফরিদ চক থেকে প্রতি বছর যে তাজিয়া বেরোতো, ডাট্ বংশের হুসেনি ব্রাহ্মণরা কাঁধ না দিলে তা শুরু হতো না।

ননিকা ও তার দিদিরা বলছিল ১৯৪৭-এর আগে অবধি এই ছিল অমৃতসরের ট্র্যাডিশান আর ব্রহ্মানন্দ ডাট্ ছিলেন এর পুরোভাগে। তারপর দাঙ্গা ও দেশভাগ পালটে দিল সব কিছু। ব্রহ্মানন্দ তাঁর বাড়িতে কিছু বন্ধুদের আশ্রয় দেন যাঁরা মুসলমান ছিলেন বলে দাঙ্গাবাজ হিন্দুরা একেবারেই ভালো চোখে দেখেননি বিষয়টা। তাছাড়া হুসেনি ব্রাহ্মণরা যথেষ্ট হিন্দু নন, এরকম ধারণাও কারো কারো মধ্যে ছিল। দেশভাগের কিছুদিনের মধ্যে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো অমৃতসরের কাটরা শের সিং-এ ব্রহ্মানন্দ ডাট্-এর বাড়ি। ননিকার জবানীতে, "আমার ঠাকুর্দা স্টেশনে গিয়েছিলেন তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে বিদায় জানাতে। সেই রাতে তাঁর অনুপস্থিতিতে আগুন লাগানো হলো বাড়িতে। কিন্তু... সে তো আর একটা গল্প!"

গল্পটা আলাদা ঠিকই। কিন্তু বেশিরভাগ পাঞ্জাবি পরিবারের সঙ্গে জাঁলিয়ানওয়ালা বাগ নিয়ে কথা বলতে গেলে যে ১৯১৯-এর ওই কিস্যার সঙ্গে প্রায় ৩০ বছর পরেকার দেশভাগের নানা স্মৃতি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে থাকবে, সেটা আমি একটু একটু করে বুঝতে শুরু করেছিলাম সেদিন থেকে।

খাবার টেবিলে আবার কথা হয়েছিল কমলা ডাট্-এর সঙ্গে। ভাতের সঙ্গে নানা পাঞ্জাবি পদ চেখে দেখতে দেখতে আমি বলে ফেলেছিলাম যে পাঞ্জাবিদের হাতে-গড়া রুটি/পরোটার কোনো তুলনা নেই। কমলা বুঝেছিলেন আমি রুটি/পরোটা ভালোবাসি ও পেলে খুশি হব। উনি সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের বললেন আমাকে যেন একটা পরোটা তক্ষুণি বানিয়ে দেওয়া হয়। আমার কোনো মানা মানলেন না। গরমাগরম পরোটা চলে এল চটপট আমার প্লেটে।

সেদিন বাড়ি ফিরে অনেক রাত অবধি আমি ঘুমোতে পারিনি। ডাট্ পরিবারের সঙ্গে কাটানো একটা আশ্চর্য দুপুরের উষ্ণতায় আচ্ছন্ন ছিলাম। তারপর যখনই জাঁলিয়াওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের অভিঘাত বুঝতে চেষ্টা করেছি, ভি এন ডাট্-এর মনের উথালপাথাল আমার কাছে ফিরে ফিরে এসেছে।


[এটি 'জাঁলিয়াওয়ালা বাগের জার্নাল' নামে লেখকের প্রকাশিতব্য বইয়ের একটি অংশ।]