আরেক রকম ● নবম বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২১ ● ১৬-৩১ চৈত্র, ১৪২৭

প্রবন্ধ

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি

গোলাম রাশিদ


আমরা যে বছর জন্মেছিলাম, সে বছর শাহরুখ-কাজলের 'দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে' সিনেমাটি মুক্তি পায়। বিশাল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। আমরা জানতাম না। তখন দেখার তো প্রশ্নই আসে না। পরে বড়ো হয়ে দেখেছি। দেখতে দেখতে বড়ো হয়েছি। প্রিয় ছবির তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে।

আমদের জন্মের আগেই বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলা হয়। আমরা জানতাম না। পরে পড়েছি। শুনেছি বিস্তর বাক-বিতণ্ডা।

আমাদের ছেলেবেলাতে গুজরাটে দাঙ্গা হয়। তখন রেডিওতে শুনতাম। কিন্তু জানতাম না,এক ধর্মের লোক অপর ধর্মের লোককে মেরে ফেলে। কারণ আমাদের ছোটবেলায় চুল কেটে দিত নাপিত নায়ায়ণ কাকা। বাড়িতে দুধ দিয়ে যেত অমূল্য ঘোষ। ছানা দিত ননীবালা দিদি।

হাইস্কুলে পড়ার সময় আমাদের বন্ধু ছিল সুদীপ, সুজিত, মিঠুন, সুদেষ্ণা। স্কুলের পাশের মসজিদে নামাজ পড়ে বেরনোর পর মসজিদের গেটে সবাই আড্ডা দিতাম। ওরা 'সালাম' কীভাবে দিতে হয় শিখত। উত্তরে কী বলতে হয় জেনে নিত। আমরা কবিতা আবৃত্তি শুরু করার সময় বলতাম, নমস্কার, আমি একটি কবিতা বলব। কলেজে এসে অরুন্ধতীর কাছে জেনে নিলাম শাঁখ বাজানোর নিয়মকানুন, কোন পুজো কিভাবে সম্পন্ন করতে হয়। সন্তু বোরখা পরা মেয়েদের প্রতি তার দুর্বলতা জানিয়ে দেয় নিঃসঙ্কোচে। কখনও কেউ আমাদের বলেনি তোরা 'মুসলিম'। আমরা কাউকে বলিনি তুই 'হিন্দু'। একটা বিফ রোল শেয়ার করেছি সবাই মিলে।

আজ হঠাৎ করে 'আমরা-তোরা'র ব্যবধান। হঠাৎ করেই? না, এতদিন পাশাপাশি বাস করার পর জানিনি পরস্পরকে তাই এমন অবস্থা। এটা দুর্বলতা। কিন্তু মূল কারণ কখনই নয়। আজানের আরবি শব্দগুলো তাপসের ভালো লাগে, একবর্ণ অর্থও অথচ সে বোঝে না। বিমলবাবু বলেন, ভোরের আজানটা অ্যালার্মের কাজ করে। ভোরাইয়ের মাধ্যমে সূর্যদেবতার দর্শন হয়। কখনই কেউ বলেনি, ভোরের আজান আমার ঘুমের ডিস্টার্ব করে। সারা রাত্রি ধরে গ্রামের মাদ্রাসায় জলসা (ধর্মীয় বক্তব্য) হয়,পাশে হিন্দুদের বসবাস। কেউ বলেনি, এসব বন্ধ করো। মহরমের দরগা কালী মন্দিরের পাশে। গণ্ডগোল হয়নি। 'হরে রাম, রাম রাম, হরে কৃষ্ণ, হরে রাম' ভেসে আসে সারা রাত। ঘুমিয়েছি তো। ইনসমনিয়াক ছিলাম না। এখন কি তাহলে সবাই ইনসমনিয়ায় (অনিদ্রা রোগ) ভুগছে? নাকি সেনসিটিভ হয়ে উঠেছে শ্রবণশক্তি? কেউ সহ্য করতে পারছে না কোনো শব্দই। আজানের, হরিনাম সংকীর্তনের।

অথচ, ৮০০ বছরের বেশি সময় ধরে এখানে হিন্দু-মুসলিমের পাশাপাশি বসবাস। মঙ্গলকাব্য, হিন্দুপুরাণের বাংলা তরজমায় হোসেন শাহি আমলের অবদান দিয়ে শুধু এই প্রতিবেশীসুলভ গভীরতা মাপা যাবে না। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ঐতিহ্য এখানকার জল-হাওয়ায় বিদ্যমান। তাই লকডাউনের (২০২০) মধ্যে সারা দেশে যখন মুসলিম-বিরোধী প্রপাগান্ডা ছড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিল সাম্প্রদায়িক শক্তি, তখন প্রতিবন্ধী মুহাম্মদ গায়ুরকে ৭০০ কিমি পাড়ি দিতে সাহায্য করেছে নাগপুরের অনিরুদ্ধ। কোয়ারেনটাইনের দিনগুলিতে তাদের চেনাজানা। ধর্ম আলাদা, বাড়িও ভিন জায়গায়। কিন্তু সম্প্রীতি ও সহানুভূতি সেসবে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তাই যোধপুরে ১৪ দিনের কোয়ারেনটাইন শেষে আবেগ মিশ্রিত কণ্ঠে মুহাম্মদ গায়ুর অনিরুদ্ধকে বলে ওঠেন, বিদায় বন্ধু, দুজনে যদি বেঁচে থাকি তবে আবার কোনো একদিন দেখা হবে। এরপর অনিরুদ্ধর কাছে থেকে গায়ুর এমন উত্তর প্রত্যাশা করেননি। তিনি বলেন, গায়ুর ভাই আমি তোমাকে এখানেই ছেড়ে যাচ্ছি না। আমি তোমার সঙ্গে যাব। তোমার পক্ষে একা ঘরে ফেরা সম্ভব নয়। আমি তোমাকে তোমার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়ে তবে বাড়ি যাব। একেই বলে হেফাজত। দেশের সব হিন্দু-মুসলিম যদি পরস্পরের এভাবে হেফাজত করত, তবে আর অশান্তির সৃষ্টি হত না।

এই ঘটনার তিন সপ্তাহ আগে কোয়ারেনটাইন সেন্টারে তাদের প্রথম দেখা হয়। গায়ুর মুজফফরনগরের একজন উস্তাদ ছুতোর মিস্ত্রি। অনিরুদ্ধ নাগপুরের অধিবাসী। অনিরুদ্ধের ভাষায়, গায়ুর ভাই খুব ভালো মানুষ। শারীরিক ভাবে অক্ষম। ট্রাই সাইকেল নিয়ে চলাফেরা করেন। যোধপুর থেকে ৭০০ কিমি পথ পাড়ি দিয়ে মুজফফরনগর পৌঁছানো তার পক্ষে খুবই কষ্টসাধ্য। কিন্তু মহারাষ্ট্রের নাগপুর ও উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগর দুই ভিন্ন দিকে। দুরত্ব প্রায় ১১০০ কিমি। আবার অনিরুদ্ধ কীভাবে একলা পথ ফিরে আসবে। তাই অনিরুদ্ধের প্রস্তাবে প্রথমে রাজি হননি গায়ুর। কিন্তু অনিরুদ্ধও তার ১৪ দিনের বন্ধুকে ছেড়ে যেতে রাজি হননি। পাঁচ দিন সফর করে অবশেষে তারা মুজফফরনগর পৌঁছান। যুবক অনিরুদ্ধ প্রায়ই ট্রাই সাইকেল ঠেলে গ্রামশহরের মধ্য দিয়ে বন্ধুকে পোঁছে দেন। মুজফফরনগরে এসে দুজনেই গায়ুরের বাড়িতে হোম কোয়ারেনটাইন ছিলেন। গায়ুর জানান, অনিরুদ্ধ আমার ঈদের উপহার। এবার আমার দায়িত্ব তাকে সহি-সালামতে বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া।

লকডাউনে আটকে পড়া মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকদের আশ্রয় ও খাবার দিয়ে এই সম্প্রীতির চিত্রটিকেই আরও প্রামাণ্যতা দিয়েছেন অসমের ধুবড়ি জেলার বছর পঞ্চান্নর দেব কুমার। বিহারের খাগারিয়া ও সহর্ষ থেকে কাজ করতে আসা ১৩ জন খেলনা নির্মাণ কর্মী ও বিক্রেতা অসমে আটকে পড়ে আচমকা লকডাউন ঘোষণার কারণে। থাকা-খাওয়া নিয়ে গুরুতর সমস্যা শুরু হয়। তাদেরকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিতে দু'বার ভাবেননি দেব কুমার। পাড়াপড়শিরা মিলে জুগিয়েছেন তাদের ইফতারের খাদ্যসামগ্রী। করোনা ভাইরাস ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দেশে ব্যাপক হারে ছড়িয়েছে সাম্প্রদায়িক ভাইরাস। কিন্তু বহু জায়গাতে হিন্দুদের শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছেন মুসলিমরা। উলটোটাও ঘটেছে। মুম্বইয়ের সেউরিতে লকডাউনের জন্য ৭২ বছর বয়সি পান্ডুরঙ্গ উবালের আত্মীয়স্বজন কেউ তার শেষকৃত্যে আসতে না পারায় চরম অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছিল। মুসলিম অধ্যুষিত সেউরিতে তিনি থাকলেও তার আত্মীয়রা থাকত মুলান্ড, বেলাপুর, আলিবাগে। ফলে লকডাউনের জন্য তারা আসতে পারেনি। পান্ডুরঙ্গের স্ত্রী ও পুত্র শেষকৃত্যের সমস্ত ব্যবস্থা করে উঠতে পারছিলেন না। তখন তারা মুসলিম প্রতিবেশীদের জানান ব্যাপারটি। তারা সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। প্রতিবেশী আসিফ সেখ জানাচ্ছেন, আমরা পান্ডুরঙ্গ চাচাকে দীর্ঘদিন ধরে চিনি। আমাদের উৎসবে তিনি সবসময় অংশ নিতেন। আমরাও তাদের উৎসব-অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি। আমরা সকলেই তাকে শেষ বিদায় জানাতে এগিয়ে আসি এবং শেষকৃত্যে সাহায্য করি। এই তো ভারতবর্ষ! যা এখনও জেগে আছে, জাগিয়ে রাখছে মানবিক সত্তাকে।

ভারতবর্ষ। শব্দটা উচ্চারণ করলেই কেমন লাগে। জাতীয় সংগীত গাইতে গেলে গায়ে কাঁটা দেয়। আমার দেশ। আমার মায়ের দেশ। আমার ভায়ের দেশ। ভালোবাসি তাঁকে। খুব ভালোবাসি। মহান দেশ, সব ধর্মের মিলনক্ষেত্র। কোথায় আছে এমন আরেকটি? নতুন সময় এখন। সারা বিশ্ব ধর্মের হাত থেকে নাকি নিষ্কৃতি চাইছে? অথচ ধর্মের কারণেই তো আমরা মহান আসনে বসেছি, এতগুলো সংস্কৃতি একসঙ্গে উপভোগ করছি। কোথায় আছে এমন আরেকটি? ধর্মহীনতাই যদি সকল সমস্যার সমাধান হত, তাহলে কোনও ধর্মের অস্তিত্ব আজ থাকত না। ধর্ম তো মানুষকে গড়ে তোলে, সভ্যতাকে নির্মাণ করে। ধর্ম তো আজানের সুর, কোরআনের কাব্য, শাঁখের আওয়াজ, মসজিদের মিনার, মন্দিরের কারুকার্য। ধর্ম অনুসরণকারী মানুষ আজ কমে গেছে। কমেছে এই দেশেও। তাহলে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বাড়ছে কেন? কেনই বা আক্রান্ত করা হচ্ছে ধর্মকে? ফ্রিজে গরুর মাংস আছে সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় কেন? কেন লেখা হচ্ছে ত্রিশূলের অপমান হয় এমন কথা? বিধর্মী মেয়েরা মরার পরও কেন ধর্ষণের হুমকির শিকার হয়? সব দোষ ধর্মের, নাকি জিরাফটিরও কিছু দায়-দায়িত্ব আছে?

কারা করে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি? বুদ্ধিজীবী, বিবেকবান, বিদ্বজনরা। ধর্মের আফিম খাইয়ে ফায়দা তোলে রাজনীতির কারবারিরা। কিন্তু গান্ধী, নেহরু, মৌলানা আজাদ, চিত্তরঞ্জন দাশও তো এই দেশেরই মানুষ ছিলেন, তাই না? তাহলে হঠাৎ কী এমন হল? সবাই এতদিন ভারতমাতার বৈচিত্র্যময় ঐক্য নিয়ে গর্ব করেছে, আজ কী এমন হল যে বাক-স্বাধীনতা প্রকাশের জন্য সবাই ধর্মকে বলির পাঁঠা হিসেবে বেছে নিচ্ছে? ধর্ম গোঁড়া। ধর্ম জেহাদ করতে বলে। ধর্ম রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা বলে। ধর্ম মানেই সেকেলে, অধর্মই তবে আধুনিকতা! অথচ সব ধর্ম শান্তির জন্য গলা ফাটিয়ে গেল। কেউ শুনল না। শুনল শুধু ভুল ব্যাখ্যা আর তার ততোধিক ভুলের প্রেক্ষাপটটুকু। এবং পোস্টমডার্ন সর্বান্তকরণে মেনে নিল এই ভুলই ধর্ম, এই ধর্মহীনতাই ধর্ম। কেউ ধর্মের পক্ষে কথা বলে না। যদি বাক-স্বাধীনতার বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হয়! যদি মৌলবাদী তকমা সেঁটে দেয়, তাহলে তো আর পুরস্কার জুটবে না। তুমি ধর্মের কথা বলেছ কিনা তোমার প্রগতির কল বাতাসে নড়ে উঠবে। প্রগতিও এত সস্তা! ধর্মকে ভয় পায়! ঈশ্বরকে ভয় পায়। আল্লাহকে ভয় পায়। ভগবানকে ভয় পায়। শিক্ষা নেই, পরনের কাপড় নেই, হাসপাতালে চিকিৎসা নেই, দুইবেলা দু'মুঠো জোটাতে হিমশিম। সেসব নিয়ে কেউ প্রেস ক্লাবে মিটিং করে না।

আমার দেশ ভারতবর্ষ। বুদ্ধ-গান্ধী-স্বামীজির দেশ। কবিরের দেশ, গুরু নানকের দেশ। রবীন্দ্র -নজরুলের দেশ। তেরঙ্গা কপালে এঁকে ইডেনে সৌরভের খেলা দেখতে গিয়েছি আমরা। এ আর রহমান, আর ডি বর্মনের সুর, লতা-অলকার কণ্ঠে বুঁদ থেকেছে সারা দেশ। সবাই যেন এক সুরে বাঁধা। সেই সুরযন্ত্রের তার আজ ছিঁড়ে গেছে। কারা যেন ক্রমাগত কালি লেপে দিচ্ছে দেশের মানচিত্রে। অথচ,আমরা সব আগের মতো ফিরে পেতে চাই। বাঁচতে চাই। নাঙ্গা তলোয়ারের ভয়ে ভীত হয়ে নয়, সেই তলোয়ারধারীকে বন্ধু করে নিয়ে বাঁচতে চাই, তাকে তলোয়ার হাতে নিয়ে রক্ষকের ভূমিকায় দেখতে চাই। কারণ, আমরা তো পালটে যাইনি। এখনও প্রত্যেক ভারতবাসীর রক্তের রং লাল এবং প্রিয় সিনেমা 'দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে'।

'সম্প্রীতি' আসলে আমাদের মাধ্যমিকের মন খারাপের নাম। লেডিবার্ড সাইকেল নিয়ে দু'ধারে দু'খানা বেণী ঝুলিয়ে সে উড়ে যেত। আমরা তাকে ধরতে পারিনি। তবে তাকে দেখেছি। কখনও ছলছুতোয় দু'দণ্ড আলাপ। ভাবিনি তাকে একদিন চলে যেতে হবে বরের ঘর। কিন্তু সব বর তো 'বর' হয় না। দু'বছরের মাথায় সে ফিরে আসে সিঁদুরের লাল দাগ ধুয়ে। দাগ কি সহজে ধোয়া যায়! যায়, যায়। মাবুদের মনে যে এতটা আকাশ ছিল জানতাম না। সে বিয়ে করে ফেলে একটি হিন্দু বিধবা মেয়ে, সম্প্রীতিকে। আমাদের মন-খারাপ কেটে যায়। পাতা ঝরে যাওয়া সেগুন গাছে নতুন পাতা আসে। একেই কি সম্প্রীতি বলে? হবে হয়তো। এই এক সঙ্গে হাঁটাহাঁটি আমরা সবাই পারি না। কেউ কেউ পারে। রিজওয়ান-প্রিয়াঙ্কা পেরেছিল। কিন্তু ওই যে সবাই পারে না। তাই একদিন রিজওয়ানের লাশ পাওয়া যায় রেল লাইনে। হায়, প্রিয়াঙ্কা! ছাদের ঘরে একলা হয়ে কার কথাটি ভাবো? কেয়াপাতার নৌকো গড়ে সাজিয়ে দেব ফুলে / তালদিঘিতে ভাসিয়ে দেব, চলবে দুলে দুলে। তা হলেই কী সৌহার্দ্য ধরা দেবে? না দিক, দুলে দুলে চলবে তো। রাজদিয়াতে কেউ হেমনাথের (কেয়াপাতার নৌকো, প্রফুল্ল রায়) বিরুদ্ধে ভালবাসাহীন ছিলনা। ধনী মুসলিম হোক সে, থাকুক তার ত্রিশ কানি (৪ বিঘা = ১ কানি) জমি। সে হেমকর্তার আজ্ঞাবাহক। রাজদিয়ার সুখদুঃখের ভগবান হেম। তার পরিচিত মজিদ মিয়া এক কথায় দশ কানি জমি বিনা মূল্যে দিয়ে দেয় তার জামাই অবনীমোহনকে। বিনু সিগারেট খেয়েছে বলে হেমকর্তা মিয়াকে বলে, তুমিও বিনুর অভিভাবক, যা শাস্তি দেবে দাও। মেরে জ্বর এনে দিনরাত যে সেবা করে তার নাম মজিদ মিয়া, নাকি সম্প্রীতি? দেশভাগের আগের এই ছবি বদলে যায় কয়েক বছরের ব্যবধানে। বিনুর সঙ্গিনী ঝিনুক ধর্ষিতা হয়। জীবন হাতে নিয়ে এপারে চলে আসে বিনু আর ঝিনুক। হেমনাথ, যার মুখের উপর কেউ একটি টুঁ শব্দ করত না, সে দেশ ছেড়ে চলে যাবার জন্য হুমকি পায়। কার দেশ ছেড়ে সে কার দেশ যাবে? কোথায় যাবে? রাজদিয়ার দিগন্তবিস্তৃত বিল, পাখি, ধানক্ষেত, বন-জঙ্গল, হাট ছেড়ে তাকে চলে যেতে হবে অন্য দেশ। আর সেটাই নাকি তার আসল দেশ! না না, কক্ষনো না। এমন হাহাকারই আমরা শুনতে পাই 'আগুনপাখি'র (হাসান আজিজুল হক) নারীটির জবানে, ‘আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না ক্যানে আলেদা একটা দ্যাশ হয়েছে গোঁজামিল দিয়ে যিখানে শুধু মোসলমান থাকবে কিন্তুক হিঁদু কেরেস্তানও আবার থাকতে পারবে। তাইলে আলেদা কিসের? আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না যি সেই দ্যাশটা আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটা আমার লয়।’ এই উক্তির পরে কি এই নারীকে আর হিন্দু-মুসলিম বলে আলাদা করা যায়? সবাই তো আলাদা হয় টাকায়-পয়সায়, ক্ষমতায়। ক্ষমতাবান লোকের বন্ধু ধনীরা। গরিবের বন্ধু তো গরিবরাই। পৃথিবীর সব মজলুম পরস্পরের ভাই। তাই দেশভাগের সময় শিয়ালদহ চত্বরে রিফিউজিদের লাইনের সঙ্গে মিলে যায় লকডাউনে ভিন রাজ্য থেকে হেঁটে ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের লাইন।

উদাহরণ আসে বানের পানির মতো। সেসব দিয়ে গাছের ডালপালা পাতায় ভরতি হয়। পাতা-ফুল, বৃন্ত-কুসুম কেউ দেখে না। তাই মাংস খাওয়ার 'অপরাধে' রাস্তায় টেনে হিঁচড়ে মেরে ফেলা হয়। তাজমহল ভেঙে ফেলার হুমকি আসে। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামের কোণের পাড়াতে গিয়ে দেখুন, কেমন শান্তিতে বাস করছে রামা কৈবর্ত আর রহিম শেখরা। অথচ দেশভাগ হলে হেমনাথ জায়গা পায়না। তার নিজের আত্মীয় ধর্ষিতা হয়। পশ্চিমবাংলাতে আসতে জীবনকে বন্ধক রাখতে হয়। কারা ছড়িয়েছিল বিষের উদগার। রাজনৈতিক নেতা। মানুষ তিন প্রকার। মানুষ, অমানুষ আর রাজনৈতিক নেতা। তারা লড়িয়ে দেয়, উলুখাগড়া প্রাণ হারায়। স্বাধীনতার দিনে মানুষ সব বিদ্বেষ ভুলে গিয়েছিল। তাদেরই আবার অনেকে গান্ধি-নিধনের দিন বেশকিছু পাড়ায় মিষ্টি বিতরণ করেছিল। এই হল আমাদের দেশ ও দ্বেষ।

পানি একটি সংস্কৃত শব্দ। মুসলিমরা নিয়েছে। বাবা, দাদা, কাকা তুর্কি। হিন্দুরা ব্যবহার করে। শিবাজীর সেনাপতির নাম দৌলত খান। ঔরঙ্গজেবের প্রধান সেনাপতি বিজয় সিংঘ। আকবরের রাজসভায় তানসেন, বীরবল, মানসিংহের দাপট। রুকুনুদ্দিন বরবক শাহের অর্থে 'শ্রীকৃষ্ণভাগবত' লেখেন মালাধর বসু। উপাধি পান 'গুণরাজ খাঁ'। ভাই গীরিশ চন্দ্র অনুবাদ করেন পবিত্র কুরআন। মেদিনীপুরের ইয়াসিন পাঠান আগলে রাখেন হিন্দুদের পুরনো মন্দির। পোশাক দেখে তাকে চেনা গেছে কি?

আমাদের সব মহাকাব্য-গল্প-উপন্যাস তো মিথ্যে হয়ে যায়, যদি-না আমরা এক সঙ্গে চলতে পারি। একজন মানুষ তো মুসলিম হয়ে, ইয়াসমিনের আব্বু হয়ে, ডাক পিওনের চাকরি করে, সতীনাথ ঠাকুরের প্রতিবেশী হয়ে, রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের গান-কবিতা শুনে, মুহাম্মদ শাহ্‌ ও মার্ক্সের পাঠক হয়ে, কিউবা ও ফিলিস্তিনকে সমর্থন জানিয়ে আদর্শ বিশ্ব নাগরিক হতে পারে। এসবের কোনও একটিও তার ভাল মানুষ হওয়ার জন্য বাধা হতে পারে না। আর এটা হতে পারলেই সভা-সমিতিতে সম্প্রীতি নিয়ে ঝুড়ি ঝুড়ি ফাঁকা বুলি আউড়াতে হবে না।

একদল মানুষ হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। কিন্তু হিন্দুরাষ্ট্র মানে কি একটা ধর্মের মানুষের রাজত্ব? 'হিন্দু' শব্দের গরিমা কি তারা বোঝেন? 'হোয়াই আই অ্যাম এ হিন্দু' গ্রন্থে বিচক্ষণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞ শশী থারুর ধর্মের সর্বজনীনতা ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি বাস্তব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পলিটিকাল হিন্দুইজমের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই সময়োচিত ব্যাখ্যাই বইটির গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্যক্তিজীবন ও ধর্মীয় জীবনের সঙ্গে রাষ্ট্রকে জড়িয়ে ফেলে যে গণ্ডগোল হচ্ছে তার প্রতিবাদ তিনি করেছেন। হিন্দু সংস্কৃতিকে জাতীয়করণ করার যে প্রচেষ্টা সেটার জন্য তিনি সাভারকর, গোলওয়ালকর, শ্যামাপ্রসাদ, দীনদয়ালের ভূমিকার কথা আলোচনা করেছেন। যারা হিন্দু নয় তারা কী এ দেশের প্রতি অনুরাগী, বিশ্বস্ত, কৃতজ্ঞ? গোলওয়ালকারের এই প্রশ্ন বিদ্ধ করে সংখ্যালঘু মনকে। ধর্মীয় পরিচিতি ও জাতীয়তাবাদকে এক আসনে বসিয়ে দেয়। অথচ মুসলিম সেনারা শিবাজির হয়ে যুদ্ধ করেছেন,আসফাকউল্লাহ খান শহীদ হয়েছেন স্বাধীনতা যুদ্ধে। তবুও তাদের জাতীয়তা ও দেশপ্রেম নিয়ে আরএসএস-এর মতো হিন্দুত্ববাদী দল সন্দেহ প্রকাশ করে এসেছে। যদিও এই দলটিই ১৯৪৮-এ গান্ধিজি হত্যার পর নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। এরপর শুধু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কাজ করার অনুমতি ছিল। হিন্দু সমাজ তৈরির স্বাধীনতা তাদের ছিল। কিন্তু হিন্দু রাষ্ট্র তৈরির জন্য জনসংঘের মতো দল গঠনের প্রয়োজন পড়ল, যা পরে ভারতীয় জনতা পার্টির জন্ম দিয়েছে। ১৯৮৪-র লোকসভা নির্বাচনে ৫৪৫ আসনে মাত্র দুটি সিটে জয়লাভ করে দলটি। তারপর দেশে ক্রমাগত সংখ্যালঘু বিরোধী হাওয়া তুলে, ধর্মীয় আগ্রাসনকে কাজে লাগিয়ে তারা ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে। দেশ সাক্ষী থেকেছে আমেদাবাদ, মোরাদাবাদ, মিরাট, বিহার শরিফ, নেলি, গুজরাত প্রভৃতি দাঙ্গার। সাড়ে চারশো বছরের বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছে। মুসলিম পরিচয়ের অপরাধে জুনায়েদ খানকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে ট্রেন থেকে। অথচ হিন্দু-মুসলিম ঐক্য এ দেশকে সমৃদ্ধ করে আসছে। নিজামুদ্দিন আউলিয়া, মইনউদ্দিন চিশতি, শেখ নাসিরুদ্দিনের দরগায় হিন্দুরাও মানত করে। সুন্দরবন অঞ্চলের 'রক্ষাকালী' বনবিবি মুসলিম দেবতা হয়েও তাঁর প্রতিকৃতি রয়েছে। অযোধ্যার নবাবরা রামলীলা, কৃষ্ণলীলা উদযাপন করতেন। লখনউ-এর হনুমান উৎসবের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন তাঁরাই। মুসলিম শিল্পীরা দশেরার মুখোশ তৈরি করে বারানসিতে। ধর্ম এখানে মিশে গেছে দুটো নদীর মতো। হিন্দু ধর্মের এই ইনক্লুসিভনেস থারুর বারবার উল্লেখ করেছেন। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের নর্দান সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন একজন মুসলিম, আর্মি কমান্ডার ছিলেন একজন পারসি, বাংলাদেশে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন একজন শিখ। এই হচ্ছে ভারত। এই হচ্ছে হিন্দুস্থান।

হিন্দু সংস্কৃতি যখনই জাতীয়তাবাদী রূপ নিয়েছে তখনই তা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। ভেঙে পড়েছে দেশের ঐক্যের ভিত। স্বাধীনতার পূর্বে ব্রিটিশদের প্রতি যে - ঘৃণা ছিল, পরে তা সংখ্যালঘুদের দিকে ধেয়ে এসেছে। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রকৃত হিন্দু ধর্মের সনাতন ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে সবাইকে বুকে টেনে নেওয়ার কথাই বলেছেন শশী থারুর। তাতে ধর্মেরই গৌরব। এবং এটাই প্রকৃত ধর্মের পরিচয়। দেশের সকলে সংখ্যাগুরুর ধর্মের অনুসারী হলেই সংহতি আসবে না। এ দেশে এত ভিন্ন ভাষা, ভৌগলিক অঞ্চল, জাতি যে সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু। বরঞ্চ এই বৈচিত্র্য মেনে নিলেই দেশের মানুষের একতার প্রাচীর মজবুত হবে।

অসতো মা সদ্‌গময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়

(অসত্য থেকে সত্যের দিকে পথ দেখাও।
অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে চলো।
)