আরেক রকম ● নবম বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২১ ● ১৬-৩১ চৈত্র, ১৪২৭
প্রবন্ধ
জিনতত্ত্ব, ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী সম্পর্কিত বিতর্ক ও সাম্প্রতিক কিছু সিদ্ধান্ত
মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়
ভারতবর্ষে ইন্দো-ইউরোপীয়দের আগমন নিয়ে বিতর্ক আছে। দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্নটিকে নিয়ে বিভিন্ন দিক থেকে রাজনীতিকরণের চেষ্টা হয়েছে। একসময়ে ইউরোপীয়রা আর্য জাতিতত্বের আড়ালে নিজেদের আধিপত্যবাদ কায়েম করেছেন। আবার অন্যদিকে, ভারতবর্ষের হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা দাবি করেছেন যে, আর্যভাষীরা ভারতের আদি বাসিন্দা। একটি ‘অভিন্ন, ধারাবাহিক হিন্দু সংস্কৃতি’র প্রবর্তক হিসাবে বৈদিক ও হরপ্পীয় সভ্যতাকে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে।
মূল প্রশ্ন হল, ইন্দো-ইউরোপীয় কারা? তাদের উৎস কোথায়? এরা কি ভারতবর্ষের আদি জনগোষ্ঠী? কেন এদের সঙ্গে ইউরোপীয় বিভিন্ন ভাষার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়? আধুনিক বিজ্ঞানের আলোয় এই আলোচনা অত্যন্ত জরুরি।
‘জাতি বিজ্ঞান’-এর ইতিহাস
ঊনবিংশ শতকে বিভিন্ন ইউরোপীয় প্রাচ্যবিদ, যেমন জার্মান ভাষাতত্ত্ববিৎ ম্যাক্স মুলার, আর্য ভাষা, বেদ এবং ইউরোপীয় ও প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার অভিন্ন আর্য উৎস নিয়ে আলোচনা করেছেন। পরবর্তীকালে ইউরোপে ভাষা ও জাতি মিশিয়ে দিয়ে ‘আর্য জাতি’ তত্ত্ব নিয়ে এক প্রতিপাদ্য খাড়া করা হয়েছিল। ইউরোপে ‘জাতি বিজ্ঞান’-এর জনপ্রিয়তা বৈদিক এবং গ্রিকো-রোমান উভয় সভ্যতার প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে ‘আর্য জাতি’-কে ভাষা ও বর্ণের সংমিশ্রন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। আমেরিকা ও ইউরোপে দ্রুতই ‘জাতি বিজ্ঞান’ থেকে সৌজাত্যবিদ্যা তথা Eugenics এর জন্ম হয়। হিটলারের জার্মানিতে সৌজাত্যবিদ্যার চরম উত্থান হলেও নাজিবাদ বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্তত (ছদ্ম) বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে তার পতন শুরু হয়।
তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব
আবার এইসব ঘটনা প্রবাহের বাইরে থেকে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ইউরোপীয় তাদের নিজেদের মত করে ইউরোপীয় ভাষাগুলির সঙ্গে উত্তর ভারতের কিছু ভাষার সাদৃশ্য লক্ষ্য করে তাই নিয়ে চর্চা করেছেন। ১৫৮১ সালে গোয়ায় বসবাসকারী ফিলিপ্পো সসেটি সংস্কৃত ও ইতালীয় সংখ্যাবাচক শব্দের মিল খুঁজে পান। উনো, দুয়ে, ত্রে, কোয়াত্রো, চিনকোয়ে, সেই, সেত্তে ইত্যাদির সঙ্গে একম, দ্বে, ত্রিনি, চত্বরি, পঞ্চ, শট, সপ্ত-র সাদৃশ্য সহজেই লক্ষ্য করা যায়। ১৭৮৬ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির তৃতীয় বার্ষিকী সভায় তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাষাতত্ত্ববিদ স্যার উইলিয়াম জোন্স প্রস্তাব করেন যে, সংস্কৃত, গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষা একটি সাধারণ উৎস থেকে এসেছে। ইউরেশিয়া জুড়ে বিভিন্ন ভাষাগুলির সাদৃশ্য কোন এক প্রাচীন সময়ে দৃঢ় সাংস্কৃতিক সংযোগের ইঙ্গিত করে। তিনি অনুমান করেন, সুদূর অতীতে এদের মধ্যে সংযোগ ছিল। এই প্রশ্ন তখন অনেকের মনে উদয় হয়েছে, কোনো একদিন এই জনগোষ্ঠীগুলির পিতৃপুরুষরা কি একই অঞ্চলে বসবাস করত?
ইউরোপীয় ও প্রাচ্যের কিছু ভাষার উৎসের সন্ধানে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই এক আদি ভাষার অন্বেষণ চলে। সেই আদি ভাষা থেকে ইউরোপ, ইরান ও ভারতের বিভিন্ন ভাষাগুলির উদ্ভব বলে মনে করা হয়। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞ ডেভিড এন্থনি বিভিন্ন ইউরোপীয় ও ভারতীয় ভাষার শব্দভাণ্ডার নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। স্বতন্ত্র ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলিতে মালবাহী শকট, গাড়ির অক্ষ, অক্ষধুরা, চাকা ইত্যাদি শব্দভাণ্ডারের তুলনা করলে বোঝা যায় কোন এক সময়ে এই শব্দগুলি এক সাধারণ শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এন্থনি অনুমান করেন ভারত, ইরান ও ইউরোপের বিভিন্ন ভাষা এসেছে এমন এক ভাষা থেকে যে, সেই ভাষার ব্যবহারকারীরা অশ্ব ও শকট ব্যবহার করত। আর সেই আদি ভাষা ৬০০০ বছরের বেশি আগে উদ্ভূত হতে পারে না। কারণ প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান থেকে বোঝা যায় যে, ওই সময়সীমায় চাকা, শকট ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে। শেষ পর্যন্ত নানারকম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ববিদ্যার সাহায্যে বিভিন্ন ইউরোপীয় এবং এশীয় ভাষার এক ভাষাবৃক্ষ তৈরি করা হয়। এইভাবে বিভিন্ন শাখাপ্রশাখার নামকরণ করতে করতে একসময়ে অধুনালুপ্ত আদি এক ভাষাকে সনাক্ত করা যায়। সেই আদি ভাষার নাম দেওয়া হয় প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয়। মনে করা হয় প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় থেকেই পরবর্তীকালে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলির উৎপত্তি।
ভাষা নিয়ে এই প্রতিপাদ্য বিভিন্ন শব্দতাত্ত্বিক ও ভাষাতত্ত্ববিদদের গবেষণায় আরও তথ্যসমৃদ্ধ হয়েছে। ভাষাতত্ত্ববিদ মাইকেল উইটজেল প্রাচীন সাহিত্যগুলি থেকে বিভিন্ন শব্দবন্ধ উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন যে, আজকের বেশীর ভাগ উত্তর ভারতীয় ভাষা এবং তাদের পূর্ববর্তী ভাষা যেমন বৈদিক সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত ইত্যাদি অন্য দেশের ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত। বৃহত্তর পঞ্জাব অঞ্চলে ইন্দো-ইউরোপীয়রা আসবার সময়ে যেসব শব্দবন্ধ নিজেদের ভাষায় যুক্ত করেছে তার সাহায্যে ওদের আসার পথ, এদেশে আসার সময়কাল, ঋগ্বেদ রচনার সময়কাল ইত্যাদি গণনা করা যায়। অর্থাৎ ঊনবিংশ শতকে ভাষাতত্ত্ববিদরা যা অনুমান করেছিলেন আজকের শব্দতাত্ত্বিকরা তা আরও যুক্তিনির্ভরভাবে প্রতিষ্ঠিত করছেন।
ভাষাতত্ত্বর দিক থেকে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলির সাদৃশ্য প্রমাণিত।
হরপ্পীয় সভ্যতা ও বৃহত্তর ইতিহাসে তার স্থানাঙ্ক নির্মাণ
ইতিমধ্যে ব্রিটিশ আমলে হরপ্পীয় সভ্যতা আবিষ্কৃত হয়েছে। বিংশ শতকে মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতার আবিষ্কারের পরে বিখ্যাত ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ মর্টিমার হুইলার ও অন্যান্যরা ইন্দো-ইউরোপীয়দের ‘ভারতবর্ষ আক্রমণ’ বা এরিয়ান ইনভেশন তত্ত্ব প্রচার করেন।
মহেঞ্জোদাড়োতে কিছু কঙ্কাল পাওয়া যায়। কিছু কঙ্কাল শহরের রাস্তায় বা সিঁড়িতেও মিলেছে। এই কঙ্কালগুলি দেখে তৎকালীন পৃথিবীর অন্যতম প্রধান প্রত্নতত্ত্ববিদ মর্টিমার হুইলার ধরে নিয়েছিলেন যে, বাইরে থেকে ইন্দো-ইউরোপীয়দের আক্রমণে এই সভ্যতা অবলুপ্ত হয়েছে। হুইলার বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক হিসাবে স্বীকৃত। তদুপরি, দক্ষিণ এশীয় প্রত্নস্থল উৎখনন, তথ্য সংরক্ষণ ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তিনি এক বিরাট ব্যক্তিত্ব হিসাবে স্বীকৃত। তবে মর্টিমার হুইলারের বিভিন্ন ব্যাখ্যাগুলি পরবর্তীকালে অনেক সময়েই বদলানোর প্রয়োজন হয়েছে। তিনি মহেঞ্জোদাড়োর শীর্ষ স্তরের মৃতদেহগুলির উপস্থিতিকে ইন্দো-ইউরোপীয়দের যুদ্ধজয়ের প্রমাণ হিসাবে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন যে, এই সভ্যতার ধ্বংসের জন্য দেবতা "ইন্দ্র অভিযুক্ত"। এই ধরণের তত্ত্ব ওই বিতর্কের জট খুলতে তো সাহায্য করেই নি, বরং পরবর্তীকালে একেবারে বিপরীতমুখে তার সুদূরপ্রসারী অভিঘাত পড়েছিল। আজকে বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ সহকারে তার এই সিদ্ধান্তটিকে বাতিল করা হয়েছে। কঙ্কালগুলি ইন্দো-ইউরোপীয়দের গণহত্যার শিকার এমনটি আর নৃতাত্ত্বিক বা ঐতিহাসিকরা ভাবেন না।
তাহলে কী দাঁড়াল? ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলির সাদৃশ্য এবং এই নিয়ে ভাষাতত্ত্ববিদ ও শব্দতত্ত্ববিদদের গবেষণা ইঙ্গিত করে, ৬৫০০-৪৫০০ বছর আগে পর্যন্ত, নব্যপ্রস্তর যুগের শেষে ও ব্রোঞ্জ যুগের প্রাথমিক পর্বে, প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় রাশিয়ার পন্টিক-স্তেপভূমিতে একটি ভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হত। ওই ভাষার এক শাখা বৈদিক-সংস্কৃত ভারতবর্ষে এসেছে সম্ভবত ব্রোঞ্জ যুগের শেষের দিকে। তবে হরপ্পীয় সভ্যতার অবসান ও ইন্দো-ইউরোপীয়দের ভারতে আগমনের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নৃতত্ত্ববিদ বা প্রত্নতত্ত্ববিদরা প্রমাণ করতে পারেননি।
তবু এই বিষয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ ও ভারতের কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব দাবি করছেন, ভারতবর্ষেই মানুষ উদ্ভূত হয়েছে। এখান থেকেই আর্যভাষীরা স্তেপভূমি ও ইউরোপে পরিযান করেছে। হরপ্পীয় সভ্যতার ধারাবাহিকতাতেই এসেছে বৈদিক সভ্যতা।
জিনবিদ্যা কি বিতর্কে শেষ কথা বলবে?
দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা এই বিতর্কের অবসানে এমন কোনো পদ্ধতির সাহায্য নেবার দরকার ছিল, যা ভারতের জনগোষ্ঠীর পরিচয় জানতে সাহায্য করবে ও একইসাথে এই বিতর্কের অবসানও করতে পারবে। এই বিষয়ে শেষ কুড়ি বছরে আধুনিক জীববিজ্ঞানের কিছু প্রকৌশল মানুষের উৎস সন্ধান ও ভারতবর্ষে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর পরিযান অনুসন্ধানে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং খুব কম সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘জিনবিদ্যা’ বা জেনেটিক্স। আবার জিনবিদ্যার মধ্যেও বিশেষভাবে ‘জনজাতি জিনবিদ্যা’ বা পপুলেশন জেনেটিক্স মানুষের অভিবাসন চর্চায় ও জাতি গঠনের ধারণায় অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে।
এ বিষয়টা আরেকটু গভীরভাবে বুঝতে হলে আমাদের আলোচনা করতে হবে জিনবিদ্যার কিছু প্রাথমিক ধারণা নিয়ে। আমাদের শরীরে কোষের মধ্যে আছে এক বিশেষ ডিএনএ। তাকে বলে ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’। নারী-পুরুষ উভয়ের ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’ তাদের মায়ের ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’-র অনুরূপ হয়। ডিএনএ-র কোনো স্থায়ী গঠনগত পরিবর্তনকে বলে মিউটেশন বা পরিব্যক্তি। অন্যান্য ডিএনএ-র মত এই ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’-তেও নির্দিষ্ট সময় অন্তর কিছু সুনির্দিষ্ট পরিব্যক্তি হয়েছে। আর সেই পরিবর্তনগুলি নিয়ে ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’ মা থেকে তার সন্তানদের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে কোনো নারীর ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’-র আণবিক গঠন জেনে নিয়ে তার পরিব্যক্তি ধরে পিছিয়ে গেলে একটিই ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’-তে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া যায়। পরিব্যক্তির জন্য ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’-র যে সামান্য পার্থক্যগুলি হয় তার সাহায্যে মায়ের দিক দিয়ে সমগ্র আধুনিক মানুষকে কিছু নির্দিষ্ট জেনেটিক জনগোষ্ঠীতে ভাগ করা যায়। আবার পুরুষের ‘ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ’ একমাত্র পিতা থেকে পুত্রতে প্রবাহিত হয়। ‘ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ’ কোন নারীর শরীরে থাকে না। তাই ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’ দিয়ে যেমন মাতৃক্রমের (maternal lineage) উৎসের সন্ধান পাওয়া যায় তেমনই ‘ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ’ বিশ্লেষণ করে পিতৃক্রমের (paternal lineage) উৎসের খোঁজ পাওয়া যেতে পারে।
মানুষ অর্থাৎ হোমোসেপিয়েন্স-এর উৎস আফ্রিকাতে। জিনবিদ্যার সাহায্যে প্রমাণ করা যায়, সত্তর হাজার বছর আগে একবার মানুষ প্রচন্ড ঠাণ্ডা ও শুষ্ক আবহাওয়ায় বেরিয়ে পড়েছিল পূর্ব আফ্রিকা থেকে। বৈজ্ঞানিকদের অনুমান পৃথিবীতে অর্থাৎ আফ্রিকাতে তখন টিকে ছিল সামান্য কিছু মানুষ। লুপ্ত হবার সামনে দাঁড়িয়ে ওদের এক দল বেঁচে থাকার প্রয়োজনে অনিশ্চিতের পথে হাঁটতে শুরু করে। ওরা কেনিয়া থেকে হর্ন অফ আফ্রিকা ধরে চলে আসে ইয়েমেনে। তারপরে ইরান, আফগানিস্তান ধরে সিন্ধু নদ পেরিয়ে ওরা একদিন পা ফেলে ভারতভূমিতে। প্রায় পঁয়ষট্টি হাজার বছর আগে ওরা আফ্রিকা থেকে এসে এই দেশে বংশানুক্রমে বাস করতে থাকে। ওদের সাথে আজকের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের জারোয়া, ওঙ্গে-দের জেনেটিক সাদৃশ্য খুব বেশি। সাদৃশ্য মানে এই নয় যে জারোয়া, ওঙ্গে-দের মধ্যে পঁয়ষট্টি হাজার বছর বিবর্তন থেমে আছে। বিবর্তন চলছে, কিন্তু তাদের সঙ্গে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তেমন মিশ্রণ হয়নি। ফলে জারোয়া, ওঙ্গে-দের সঙ্গে ভারতে প্রথম আসা জনগোষ্ঠীর পঁয়ষট্টি হাজার বছরের বিবর্তন জনিত তফাৎ হয়েছে, কিন্তু মিশ্রণজনিত তফাৎ হয়েছে সামান্য।
ভারতবর্ষ তথা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার এই প্রথম জনগোষ্ঠীকে বলা হয় 'আন্দামানী শিকারী-সংগ্রাহক'। আজকের সমগ্র ভারতের অন্ততপক্ষে ৭০ শতাংশ মানুষ মাতৃক্রমের দিক দিয়ে সেই আফ্রিকা আগত মায়ের সরাসরি বংশধর। পিতৃক্রমের হিসেবটা ভিন্ন। আজকের ভারতীয় পুরুষদের মধ্যে আফ্রিকা আগত ওয়াই-ক্রোমোজোম হ্যাপ্লোগ্রুপের প্রভাব তুলনায় কম। স্থান, জাতি ও বর্ণভেদে আফ্রিকার পুরুষদের উত্তরসূরির সংখ্যা ১০ থেকে ৪০ শতাংশ মাত্র। এর অর্থ হল, প্রায় পঁয়ষট্টি হাজার বছর যারা আফ্রিকা থেকে ভারতবর্ষে এসেছিল, তাদের পুরুষদের একটা বড় অংশ বংশধর রাখতে পারেনি। কিন্তু তাদের নারীদের বড় অংশ বংশধর রেখেছে। এর সম্ভাব্য কারণ হল, প্রজননক্ষম নারীরা পরবর্তীকালে আসা গোষ্ঠীগুলির মধ্যে লীন হয়ে গেছে। আর পুরুষরা হয়তো নবাগতদের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গেছে, বা তাদের খাদ্য সংগ্রহ কম হয়েছে, ফলে নারীরা তাদের ছেড়ে গেছে।
সেই যে পঁয়ষট্টি হাজার বছর বা তার আগে ভারতবর্ষে প্রথম মানুষ এসেছে তার পরেও এই দেশে আরও কিছু পরিযান হয়েছে। তারা পূর্বোক্ত জনগোষ্ঠীর সাথে মিশ্রিত হয়েছে। ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে আরও দুটি পরিযান এই দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। পরবর্তী পরিযানগুলিতে যারা এসেছিল, তাদের আদি বাসভূমি আফ্রিকা হলেও তারা প্রথম পরিযানের মত সরাসরি ভারতে আসেনি। বরং তারা আফ্রিকা ও ভারতের মাঝামাঝি নানা অঞ্চলে বহু সহস্র বছর কাটিয়ে ভারতের দিকে এসেছে। এইসব নবাগত জনগোষ্ঠীতে পুরুষের সংখ্যা ছিল নারীদের তুলনায় অনেক বেশি, আর তারা আদি ভারতীয় ‘আন্দামানী শিকারী-সংগ্রাহক' পুরুষদের চাইতে বেশি বংশধর রাখতে সক্ষম হয়। তাই তাদের জিনগত ছাপ বর্তমান ভারতীয় পুরুষদের ওয়াই-ক্রোমোজোমের মধ্যে অধিক মাত্রায় রয়ে গেছে।
প্যালিও জেনেটিক্স
ভারতের মূল জনগোষ্ঠীগুলির ইতিহাস পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা জনজাতি জিনবিদরা অনুভব করেছিলেন বেশ কিছুদিন ধরে। তবে এই বিশাল অঞ্চল ও সময়কাল জুড়ে ইতিহাস পুনর্গঠন করে সকলের মান্যতা পাওয়া সহজসাধ্য কাজ নয়। বিশেষ করে খেয়াল রাখতে হবে, এই অঞ্চলে প্রাচীন মানব-কঙ্কাল বিশেষ পাওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত গত দশকে এই অঞ্চলে বিভিন্ন পরিযান ও জাতিগোষ্ঠী পুনর্নির্মাণ করতে ৯২ জন দেশি ও বিদেশী জনজাতি জিনবিদ ও নৃতত্ত্ববিদ একসাথে গবেষণা শুরু করেন। এই গবেষণা প্রকল্পে ওরা ৮ হাজার বছর আগের থেকে লৌহ যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়কালের ৫২৩টি প্রাচীন দেহাবশেষ সংগ্রহ করেন। কিছু দেহাবশেষ নব্যপ্রস্তর যুগের, কিছু ব্রোঞ্জ ও লৌহ যুগের। এগুলি সংগৃহীত হয়েছিল ইরান, তুরান (আজকের উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কাজখস্তান) ও দক্ষিণ এশিয়ার পাকিস্তান থেকে। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের জিনবিদ ডেভিড রাইখ এই প্রজেক্টে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
● ওদের সংগৃহীত কঙ্কালগুলির মধ্যে কিছু পাওয়া গেছে পূর্ব ইরানের শাহর-ই-শোকতা (আজ থেকে ৫২০০-৪১০০ বছর আগের), তুর্কমেনিস্তানের ব্যাকট্রিয়া-মার্জিয়ানা আর্কিওলজিক্যাল কমপ্লেক্সের গনুর (আজ থেকে ৪৫০০-৩৭০০ বছর আগের) অঞ্চলে। এই অঞ্চলগুলি থেকে ১১টি মানব কঙ্কালের ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়। ওই সময়কালে গনুর এবং শাহর-ই-শোকতা, উভয় অঞ্চলের সঙ্গেই হরপ্পীয় সভ্যতার মানুষের সরাসরি যোগাযোগের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ রয়েছে।
● পাকিস্তানের সোয়াট উপত্যকা হল হরপ্পা সংলগ্ন অঞ্চল। ওই অঞ্চলে প্রাপ্ত হরপ্পীয় সভ্যতার ক্ষয়ের প্রায় ১০০০ বছর পরেকার লৌহযুগের মানুষের দেহাবশেষের ডিএনএ বিশ্লেষণও করা হয়।
শাহর-ই-শোকতা ও ব্যাকট্রিয়া-মার্জিয়ানা আর্কিওলজিক্যাল কমপ্লেক্সে প্রাপ্ত ১১টি দেহাবশেষের অটোজোমল ডিএনএ বিশ্লেষণ করে ভারতবর্ষের প্রথম মানুষ আফ্রিকা আগত ‘আন্দামানী শিকারী-সংগ্রাহক’-দের জিনোমিক প্রোফাইল পাওয়া গেছে। এছাড়াও বিশেষভাবে চিহ্নিত করা গেছে প্রাচীন ইরান থেকে আগত এক জনগোষ্ঠীকে। এরা এদেশে এসেছে অনেক পরে, আজ থেকে প্রায় ১২০০০ বছর আগে। এদের বলা যেতে পারে ‘প্রাচীন ইরান সম্পর্কিত শিকারি-সংগ্রাহক’ জনগোষ্ঠী। হরপ্পীয় সভ্যতার সঙ্গে সাংস্কৃতিক সম্পর্কযুক্ত প্রত্নস্থলগুলিতে ও সভ্যতার ক্ষয়ের পরবর্তীকালে হরপ্পা সংলগ্ন অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত ফসিলে এই জনগোষ্ঠীর আধিক্য ইঙ্গিত দেয় যে, ওই সভ্যতা মূলত গড়ে তুলেছে এই জনগোষ্ঠী। ওরা ভারতে আসার পরে মিশ্রিত হয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার আদি অধিবাসী ‘আন্দামানী শিকারী-সংগ্রাহক’-দের সঙ্গে।
প্রায় হাজার বছর পরে অর্থাৎ আজ থেকে ৩৫০০ বছর আগের সোয়াট ভ্যালির লৌহ যুগের ফসিলেও এই জিনোমিক প্রোফাইল পাওয়া গেছে।
ডেভিড রাইখ ও তার সহকর্মীরা আজকের দক্ষিণ এশিয়ার (মূলতঃ ভারত) ২৪৬টি স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠীর থেকে নেওয়া মানুষের ডিএনএ নমুনা বিশ্লেষণ করেন। আজকের দক্ষিণ এশীয়দের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জিনোমিক তথ্যগুলি বিশ্লেষণ করে ওরা দেখিয়েছেন যে, হরপ্পীয় মিশ্র মানুষ দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বপুরুষের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
এই গবেষণা যখন চলছে তখন ভারতবর্ষে হরপ্পীয় সভ্যতার এক কেন্দ্র হরিয়ানার রাখিগর্হির সমাধিস্থানে কিছু দেহাবশেষ পাওয়া যায়। রাখিগর্হি ছিল হরপ্পীয় সভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ নগর। ওখানে ৪৫০০-৪০০০ বছর আগেকার সম্পূর্ণ বা আংশিক মানব দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। রাখিগর্হির কিছু দেহাবশেষ ডিএনএ বিশ্লেষণের অনুপযুক্ত হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত বহু প্রচেষ্টার পরে ৪৫০০ বছর আগের এক সমাধি থেকে একটি নারীর অটোজোমাল ডিএনএ বিশ্লেষণ করে আরও কিছু তথ্য মেলে।
● সেখানেও দেখা গেছে যে, রাখিগর্হির নারী ছিল ‘প্রাচীন ইরান সম্পর্কিত শিকারি-সংগ্রাহক’ ও ‘আন্দামানী শিকারী-সংগ্রাহক’-র মিশ্রণে তৈরি এক মানুষ।
● রাখিগর্হির নারীর সময়কালের নমুনার মাত্র এক হাজার বছর পরে পাকিস্তানের সোয়াট (আজ থেকে ৩২০০-২০০০ বছর আগে) উপত্যকার ৭টি প্রত্নস্থল থেকে বিভিন্ন দেহাবশেষের যে জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়েছিল তাতে ইন্দো-ইউরোপীয় জিনোমিক প্রোফাইল পাওয়া যায়।
● অথচ তার আগের শাহর-ই-শোকতা ও ব্যাকট্রিয়া-মার্জিয়ানা আর্কিওলজিক্যাল কমপ্লেক্সে প্রাপ্ত ১১টি দেহাবশেষ ও রাখিগর্হির নারীর অবশেষে কিন্তু ইন্দো-ইউরোপীয় জিন পাওয়া যায়নি।
● আবার উল্টো দিকে আজকের দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ইন্দো-ইউরোপীয় জিন পাওয়া যায়।
অর্থাৎ কোন একসময়ে ইন্দো-ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষে এসেছে। সময়টা হবে ৪০০০-৩৫০০ বছর আগে। পুরনো পুরুষ কঙ্কালের ওয়াই-ক্রোমোজোমে ডিএনএ থেকে প্রাপ্ত কিছু তথ্যর সাহায্যে ব্যাপারটা আরও ভালোভাবে বোঝা সম্ভব। R1a ও R1b ওয়াই-ক্রোমোজোমে ডিএনএ আজকের রাশিয়া সহ সারা ইউরোপে পুরুষদের মধ্যে সবচাইতে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়। ভারতবর্ষে, বিশেষ করে উত্তর ভারতেও R1a ওয়াই-ক্রোমোজোমে ডিএনএ যথেষ্ট পরিমাণে চোখে পড়ে।
● নব্যপ্রস্তরযুগ ও ব্রোঞ্জযুগের রাশিয়ায় যত পুরুষের দেহাবশেষের সফল ডিএনএ সিকোয়েন্স করা সম্ভব হয়েছে তাদের প্রত্যেকটিতে R1a বা R1b ওয়াই-ক্রোমোজোমে ডিএনএ পাওয়া গেছে।
● স্তেপভূমির পোল্ট্যাভকাতে আজ থেকে ৪৭০০ বছর আগের এক পুরুষের ফসিল পাওয়া গেছে। ওই পুরুষটি ওয়াই-ক্রোমোজোম হ্যাপ্লোগ্রুপ R1a-এর এক উপশাখা R1a-Z93 বহন করেছে। এই বিশেষ হ্যাপ্লোগ্রুপটি মিউটেট করবার সামান্য পরেই ওই পুরুষটি তা বহন করেছে। আবার R1a-Z93 হ্যাপ্লোগ্রুপ পাওয়া যায় আজকে উত্তর ভারতে। দক্ষিণ এশিয়া ও তুরানের ব্রোঞ্জ যুগের পুরুষ দেহাবশেসে কিন্তু R1a হ্যাপ্লোগ্রুপ অনুপস্থিত ছিল। এই সব তথ্য একত্রিত করলে বোঝা যায় স্তেপভূমি থেকে R1a হ্যাপ্লোগ্রুপ বহনকারী এক গোষ্ঠীর পরিযান হয়েছে তুরান ও দক্ষিণ এশিয়ার দিকে।
● আবার স্তেপভূমির পোল্ট্যাভকার সেই প্রাচীন দেহাবশেষে কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার 'আন্দামানী শিকারী-সংগ্রাহক' বা ‘প্রাচীন ইরান সম্পর্কিত শিকারি-সংগ্রাহক’ জনগোষ্ঠীর ডিএনএ পাওয়া যায় নি। তাই দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের ওই অঞ্চলে গমনে এই হ্যাপ্লোগ্রুপের বিস্তার সম্ভব নয়, বরং এর থেকে উল্টোটাই, অর্থাৎ স্তেপ ভূমির মানুষের এদেশে প্রবেশের প্রমাণ হয়।
স্তেপের পশুপালকরা ইউরোপেও গিয়েছিল। ওদের চেহারা ছিল লম্বা, দেহবর্ণ হালকা। চার হাজার বছর আগে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার এক শাখা বৈদিক-সংস্কৃতভাষী, ঘোড়ায় টানা রথে আরূঢ় স্তেপভূমির পশুপালকরা সিন্ধু উপত্যকায় প্রবেশ করে। তখন আবহাওয়ার পরিবর্তন, তার ফলে নদী প্রবাহের পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে হরপ্পীয় নগর সভ্যতা অবক্ষয়ের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের কৃষি, পশুপালন বন্ধ হতে চলেছে। আর্থ-সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়ছে। এই অবস্থায় হরপ্পীয় সভ্যতার মানুষ বেঁচে থাকার তাড়নায় দেশের পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে চলে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে হিন্দুকুশ পর্বত পেরিয়ে প্রবেশ করেছে ইন্দো-ইউরোপীয়রা। ওরা সেই সময়ে মিশ্রিত হয়েছে হরপ্পীয় মানুষের সাথে। নবাগত এই দল যেন মূলত পুরুষদের দল। তাই তখনকার ভারতীয় নারীদের মূল অংশ ছিল আগে আসা অন্যান্য জনগোষ্ঠীর অংশ। এদের পুত্র-কন্যাদের এক বড় অংশ তাই মিশ্রিত জিনগত উত্তরাধিকার পেয়েছে। বাবা-ঠাকুরদার দিক থেকে স্তেপভূমির জেনেটিক উত্তরাধিকার, মা-দিদিমার দিক থেকে হরপ্পীয় জনগোষ্ঠীর উত্তরাধিকার।
উপসংহার
রাখগর্হির নারীর অটোজোমাল ডিএনএ বিশ্লেষণে ইউরোপীয় জিন না পাওয়ার ফলে বিভিন্ন সংবাদপত্রে এক হট্টগোল শুরু হয়েছিল। যেন এতেই প্রমাণ হয়ে গেল, ভারতে ইসলামের আগমনের আগে আমরা সবাই ছিলাম এই দেশের স্থানীয় মানুষ। নকল সংবাদের যে বাড়বাড়ন্ত আজকাল দেখা যায়, তার ধারাবাহিকতাতেই দেখি এই নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ - আর্য আক্রমণ বাতিল, আমরা সকলে দেশজ ইত্যাদি। এই সবই আসলে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের সেই তত্ত্বকেই পৃষ্ঠপোষকতা দিতে চেষ্টা করেছে, যে তত্ত্ব বলে মুসলিম ও ব্রিটিশরা এই দেশে আসবার আগে আমরা সকলে ছিলাম দেশজ।
আজকের জিনবিদ্যা সেই তত্ত্বকে ভেঙে দিয়েছে।
প্রমাণিত, ভারতবর্ষে একের পরে এক পরিযান হয়েছে। রাখিগর্হির নারীর দেহাবশেষে ইন্দো-ইউরোপীয় জিন না পাওয়াই স্বাভাবিক ও বিজ্ঞান সম্মত। কারণ তখনও ওরা এই অঞ্চলে আসেই নি। আর সোয়াট ভ্যালির কঙ্কালে এই ইন্দো-ইউরোপীয় জিন নির্দিষ্ট করে ওদের ভারতবর্ষে আগমনের সময়। বর্ণ নির্বিশেষে আজকের ভারতীয়দের মধ্যে ওই জিনের উপস্থিতি থেকে বোঝা যায় যে, ওরা এই অঞ্চলে এসে মিশ্রিত হয়েছে তৎকালীন দক্ষিণ এশীয়দের সাথে। তাই আজ থেকে ৪০০০-৩৫০০ বছর আগে রাশিয়ার স্তেপভূমি থেকে আগত পিতৃক্রমের R1a ওয়াই-ক্রোমোসোম ডিএনএ ভারতীয়দের একটা অংশের মধ্যে ব্যাপকভাবে রয়ে গেছে।
বৈদিক আর্যভাষীরা এসেছিল আক্রমণকারী হিসেবে নয়। ওরা প্রব্রজন করেছিল দক্ষিণ এশিয়াতে।
তথ্যসূত্রঃ
১) Stephen Oppenheimer, “Out-of-Africa, the peopling of continents and islands: Tracing uniparental gene trees across the map”, Phil. Trans. R. Soc, B367770–784, (2012).
২) Romila Thapar, Jonathan Kenoyer, Madhab Deshpande, Shirin Ratnagar, “Historical Beginnings and the Concept of the Aryans”, National Book Trust, Chapter 2, (2017).
৩) Sheeren Ratnagar, “Understanding Harappa: Civilization in the Greater Indus Valley”, Tulika Book, Chapter 3, October (2002).
৪) V. M. Narasimhan et al., “The formation of human populations in South and Central Asia”, Science, 365(6457), (2019).
৫) Vasant Shinde et al., “An Ancient Harappan Genome Lacks Ancestry from Steppe Pastoralists or Iranian Farmers”, Cell, 179(3), (2019):729-735.
৬) Romila Thapar, Michael Witzel, Jaya Menon, Kai Friese, Razib Khan, “Which of Us Are Aryans?”, Aleph Book Company, Chapter 2, (2019).
৭) Peter. A. Underhil et al., “The Phylogenetic and Geographic structure of Y-Chromosome haplogroup R1a”, Eur J of Human Genet, 23, (2015):124-131.