আরেক রকম ● নবম বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২১ ● ১৬-৩১ চৈত্র, ১৪২৭

প্রবন্ধ

উত্তরবঙ্গের রাজবংশী ভাষা

সুখবিলাস বর্মা


২৫শে এপ্রিল, ২০১৭ তারিখে কামতাপুর পিপলস পার্টির কোচবিহার রাস মেলার সভায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ঘোষণা করেন - 'রাজবংশী থাকবে, কামতাপুরীও থাকবে'। এই ঘোষণায় বিচলিত হয়ে ২২শে জুলাই একটি পত্রিকায় লিখেছিলাম 'ভাষার নাম কামতাপুরী নয়, রাজবংশী' শীর্ষক প্রবন্ধ।

'কামতাপুরী ভাষা সাহিত্য পরিষদ' প্রকাশিত 'ভাষার নাম কামতাপুরী-প্রসঙ্গ, পরিপ্রেক্ষিত, বিতর্ক ও পর্যালোচনা' পুস্তিকাতে উত্তরবঙ্গের পাঁচ বিদগ্ধ ব্যক্তি আমার প্রবন্ধটির তীব্র সমালোচনা করে পাঁচটি প্রবন্ধ লিখেছেন। ওই সমালোচনায় অবশ্য ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের থেকে আমার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণের ধারই বেশি ছিল। তাই এই পুস্তিকার নাম অনায়াসেই দেওয়া যেতে পারত 'সুখবিলাসনামা'। আর ঐ সুখবিলাসনামার প্রবন্ধগুলির বক্তব্য থেকে আর একবার পরিষ্কার হয়েছে যে কামতাপুরি নামের দাবিদারদের যুক্তি একেবারেই ভিত্তিহীন । এবং সেকথা বলার জন্যই অনিচ্ছাসত্বেও পঞ্চবীরের লেখাগুলির বিশ্লেষণ করতে হয়েছে।

রাজ্য সরকারের অনুপ্রেরণায় রাজবংশী জনগোষ্ঠীকে বিভাজিত করবার অপচেষ্টায় তাঁরা যে নানা রকমের বিভ্রান্তি চালিয়ে যাচ্ছেন, সেই বিভ্রান্তি দূর করার উদ্দেশ্যেই বাধ্য হয়ে আমাকে 'তথ্যের আলোকে রাজবংশী ভাষা' শীর্ষক ৩২ পৃষ্ঠার একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকা প্রকাশ করতে হয়েছিল।

রাজবংশী ভাষা নিয়ে লেখালেখি, বিতর্ক, আলোচনা অবশ্য আমার কাছে নতুন কিছু নয়। প্রবন্ধাদি ছাড়াও গবেষণাপত্র, কয়েকটি প্রকাশিত পুস্তকের সর্বত্র রয়েছে এই বিশ্লেষণমূলক আলোচনা।

এ বিষয়ে প্রকৃত তথ্য কি? দুই বাংলার উত্তরিভাগ, অসমের পশ্চিমভাগের বিস্তৃত ভূভাগের আদি জনগোষ্ঠীর পরিচয় ছিল দেশী মানুষ নামে। তাদের মুখের ভাষার নাম ছিল দেশী ভাষা। এই জনগোষ্ঠীর সামাজিক নৃতাত্ত্বিক পরিচয় জানতে ইংরেজ সরকারের উদ্যোগে বহু প্রশাসক নৃতত্ত্ববিদ গবেষণামূলক কাজ করেছেন। সেইসব গবেষণা কাজের ফলে উঠে এসেছে নানা অভিমত। কেউ বলেছেন রাজবংশীরা মঙ্গলয়েড, কেউ বলেছেন এঁরা দ্রাবিড়, কারও মতে আর্য-দ্রাবিড়-মঙ্গলয়েড মিশ্রিত এক গোষ্ঠী। কিন্তু সবাই একমত যে অন্য অনেকের মতো এই নৃগোষ্ঠীও স্থানীয় আদি বাসিন্দার স্তর থেকে সাংস্কৃতিক বিবর্তনের (sanskritisation) বা সংস্কৃতায়নের মধ্য দিয়ে পরিচিতি লাভ করে 'কোচ' নামে। কোচ থেকে আরও সংস্কৃত অর্থাৎ হিন্দুকৃত হয়ে এঁরা পরিচিত হন রাজবংশী নামে। এইসব গবেষক প্রশাসকদের অন্যতম ছিলেন Buchanon Hamilton (1812), B. H. Hodgson (1849), E. T. Dalton (1872), H. Beverley (1872), H. B. Rowney (1872), W. W. Hunter (1876), H.F.J.T. Megayer (1890), O. Donnel (1891), H. S. Risley (1891), E. A. Gait (1901), G. A. Grierson (1904) এবং O. Malley (1911). Imerial Gazetteer of India (1908)-ও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এঁদের সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে আচার্য সুনীতি কুমার চটোপাধ্যায়ের নাম। এইসব প্রতিবেদন থেকে উঠে এসেছে একটি বড় বিতর্ক - রাজবংশী ও কোচ কি অভিন্ন? মনে রাখা প্রয়োজন যে মূলত এই বিতর্ক থেকেই ১৮৯১ সালে দানা বেধেছিল ক্ষত্রিয় আন্দোলন।

১৮৯১ সালে লোকগণনার প্রাক্কালে এই জনগোষ্ঠীর জাতির ঘরে 'কোচ' লেখার আদেশের বিরুদ্ধে শ্যামপুকুরের জমিদার হরমোহন খাজাঞ্চির নেতৃত্বে গড়ে ওঠে 'রংপুর ব্রাত্য-ক্ষত্রিয় জাতির উন্নতি বিধায়নি সভা'। আন্দোলনের মূল দাবি - রাজবংশী ও কোচ পৃথক জাতি এবং রাজবংশীরা ব্রাত্য-ক্ষত্রিয়। তাই জাতির ঘরে 'ব্রাত্য-ক্ষত্রিয়' লিখতে হবে। রংপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বিষয়টির উপর পণ্ডিত সমাজের মতামত চাওয়া হলে রংপুর ধর্মসভার সভাপতি পণ্ডিত যাদবেশ্বর তর্করত্ন বিভিন্ন শাস্ত্র আলোচনা করে মত প্রদান করেন যে কোচ ও রাজবংশী পৃথক জাতি এবং রাজবংশীরা ব্রাত্য-ক্ষত্রিয়। এই মতামতের উপর ভিত্তি করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ১৭ই ফেব্রুয়ারির আদেশ কিন্তু কার্যকরী হয়নি। ১৯০১ ও ১৯১১ লোকগণনায় একই ঘটনা ঘটে। ইতিমধ্যে নেতৃত্বে আসেন রায় সাহেব পঞ্চানন বর্মা। ১৯১০ এ তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে 'ক্ষত্রিয় সমিতি'। আন্দোলন তীব্র হয় এবং অনেক আলোচনা বিতর্ক বিশ্লেষণ ইত্যাদির পর জাতির ঘরে 'রাজবংশী' নাম গৃহীত হয়।

ভাষার ক্ষেত্রে অনুসৃত হয় একই নীতি। দেশী মানসির ভাষা আছিল দেশী ভাষা। দেশী স্থানে রাজবংশী, অর্থাৎ ভাষার নামও রাজবংশী। ভাষার ক্ষেত্রে 'রাজবংশী' নামকে গ্রহণ ও স্বীকৃতি আরও যুক্তিযুক্ত হয় ১৯০৪ সালে জি. এ. গ্রিয়ারসনের Linguistic Survey of India-র প্রতিবেদন প্রকাশের ফলে। গ্রীয়ার্সন-এর Monumental Work/Stupendous Task-টির নাম Linguistic Survey of India. ভাষা নিয়ে ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে উঠে আসা তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন। বৃটিশ সরকার তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছিল সারা ভারতবর্ষের নানা ভাষা গোষ্ঠীর পরিচয় নিয়ে সমীক্ষার জন্য। সিয়ামিজ-চাইনিজ (খাসি, তাই), টিবেটো বার্মান, টিবেটন ডায়লেষ্ট, বোড়ো, নাগা, কুকি-চীন, বর্মা, মুন্ডা, দ্রাবিড়, ইন্দো আর্যের বিভিন্ন শাখা-পূর্বীয় (বাংলা, আসামী, বিহারি, ওড়িয়া), উত্তর পশ্চিম শাখা (সিন্ধি, কাশ্মীরি), মধ্য শাখা (হিন্দি, পাঞ্জাবী, রাজস্থানী, গুজরাটি, ভিল ভাষা গোষ্ঠী), পাহাড়ী ভাষা গোষ্ঠী, দক্ষিণ শাখা (মারাঠী), ইরানিয়ান ও জিপসী-সমস্ত ভাষা গোষ্ঠীর ক্ষেত্র সমীক্ষার দারিত্বে ছিলেন তিনি। তাঁর সমীক্ষার প্রতিবেদন রয়েছে ১৯টি খন্ডে, কোনো কোনো খন্ডে একাধিক পার্ট। সেই কারণে ভারতের যে কোনো ভাষা গোষ্ঠীর ভাষাতত্ত্বের আলোচনা শুরু হয় গ্রীয়ার্সনকে দিয়ে। ক্ষেত্র সমীক্ষার ভিত্তিতে 'রাজবংশী' নিয়ে রিপোর্টে কি লিখেছেন গ্রীয়ারর্সন? লিখেছেন - It is spoken in the following districts - Rangpur, Jalpaiguri, the tarai of the Darjeeling district, the Native State of Cooch Behar, together with the portion of Goalpara in Assam, already mentioned. ...We thus find that the Rajbanshi dialect is spoken by the following number of people: Grand Total 35,09,171. এলাকার ভাষার নাম 'রাজবংশী' সেই তথ্য ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে বেরিয়ে এসেছে - গ্রীয়ার্সন এই নাম চাপিয়ে দেননি। গ্রীয়ার্সনের সার্ভে ভিত্তিক তথ্য তাই সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, নির্মলেন্দু ভৌমিক, নির্মল দাস, গিরিজা শংকর রায়, সত্যেন বর্মন, দীপক রায় প্রমুখ সবাই মেনে নিয়েছেন। The Ramkrishna Mission Institute of Culture প্রকাশিত Linguistic Survey of India: Languages and Scripts (Volume 1) নিবন্ধে ড. সুনীতি কুমার চ্যাটার্জি স্বীকার করেছেন 'The meticulous and all inclusive classification of the languages and dialects current in India and Burma (which, until 1937, was politically a part of India) as given in the Linguistic Survey of India, shows a total number of 179 languages and 544 dialects. These figures are staggering indeed for any single country or state claiming to be a Nation. ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে উঠে আসা ভাষার নাম 'রাজবংশী' গ্রহণ করে তিনি প্রতিবেদনে ভাষা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন নানা উদাহরণ সহযোগে। তাঁর সুপারিশকৃত এই নাম গ্রহণ করেছেন দেশি-বিদেশি ভাষাবিদ, নৃতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক, লেখক সাহিত্যিক এবং রাজবংশী জনগোষ্ঠীর সর্বস্তরের মানুষ। রাজবংশী (কামতাপুরী)র পাঁচ পন্ডিতের কাছে 'সুখবিলাস ও তাঁর সতীর্থ এবং অতি সাম্প্রতিক অধ্যাপক পন্ডিত' বিদ্রুপের পাত্র, কারণ তারা গ্রীয়ার্সনের ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে উঠে আসা অভিমতকে মান্যতা দান করেন।

'কামতাপুরী' নামটি নিয়ে যাঁরা ব্যাটিং করে যাচ্ছেন তাঁদের দাবির ভিত্তি কি? এক কথায় উত্তর - রকমারি আবোল তাবোল।

উত্তরবঙ্গের মানুষ, বিশেষ করে রাজবংশী জনগোষ্ঠী কলকাতা কেন্দ্রিক রাজ্য প্রশাসনের কাছ থেকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার; এই জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক উন্নয়ন সব দিক থেকে পিছিয়ে-সব দিক থেকে তাঁরা বঞ্চিত, নিপীড়িত ইত্যাদি বিষয়ের উপর নানা অভিযোগ অনুযোগ নিয়ে এবং তার সমাধান কল্পে ১৯৬৯ সালে পঞ্চানন মল্লিক, জগদানন্দ রায়, হরিপদ রায় প্রমুখ রাজবংশী বিদ্বজনের নেতৃত্বে শুরু হয় উত্তরখণ্ড আন্দোলন। বছর দশেক পর একই অভিযোগের ভিত্তিতে, বিশেষ করে রাজবংশী ও অন্যান্য তপশিলি-আদিবাসি ছাত্র ছাত্রীদের প্রতি প্রশাসনের ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির বিরূপ মনোভাব ও ব্যবহার-এ অতিষ্ঠ হয়ে ১৯৭৭-এ উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের নরেন দাস, প্রভাত সেন ঈশর, বিজয় বর্মণ, রণজিৎ অধিকারি, রঞ্জনা রায়, কৃষ্ণ রায় প্রমুখ কতিপয় ছাত্র শুরু করেন উতজাস (উত্তরবঙ্গ তপশিলি জাতি ও আদিবাসী স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন)। কিন্তু সঠিক নেতৃত্বের অভাবে এবং উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনগোষ্ঠীর সমর্থনের অভাবে সেসব আন্দোলন কিছুদিন পরেই মুখ থুবড়ে পড়ে। বামফ্রন্ট সরকারের ভূমি সংস্কার কর্মসূচী ও ত্রিস্তর পঞ্চায়েত মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পের সাফল্যে রাজবংশী সমাজের মানুষ এই সব দিশাহীন আন্দোলনে সামিল হননি।

১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে উত্তরখণ্ড আন্দোলন থেকে বেরিয়ে কতিপয় নেতা, যথা অতুল রায়, নিখিল রায় প্রমুখ শুরু করেন কামতাপুর আন্দোলন । ১৯৯৬-এর ৭ই জানুয়ারি ডাউকিমারিতে শুরু হয় 'কামতাপুর পিপলস পার্টি'। সব আন্দোলনের মূল বিষয় - রাজবংশী জনগোষ্ঠীর উপর কলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালির চাপিয়ে দেওয়া বঞ্চনা। সেই সময়ে অসমে সংগঠিত আসু, আমসু, বোড়ো আন্দোলনের প্রভাবে কামতাপুরী আন্দোলনের একটি জঙ্গি মুখের সৃষ্টি হয় কে এল ও (কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন) নামে। এই সব আন্দোলন নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা রয়েছে ২০০৭ সালে গ্লোবাল ভিসন পাবলিশিং হাউস কর্তৃক প্রকাশিত আমার সম্পাদিত Socio-Political Movements in North Bengal (Volume 1) পুস্তিকায়।

ইতিমধ্যে ১৯৯২ সালে কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ হাই স্কুলের সংস্কৃত শিক্ষক শ্রী ধর্মনারায়ণ বর্মা প্রকাশ করলেন A STEP OF KAMTA BIHARI LANGUAGE. পুস্তকের ৫ পৃষ্ঠায় তিনি বললেন যে রায় সাহেব ঠাকুর পঞ্চানন called it Kamta Bihari Language in his book, 'History of Kamta Bihari Literature', এবং 'কামতাবিহারী' কথাটি তিনি সেখান থেকেই নিয়েছেন। উল্লেখ্য যে 'হিস্ট্রি অফ কামতাবিহারী লিটারেচার' নামে রায় সাহেব পঞ্চানন বর্মার কোনো পুস্তক নেই। কামতাবিহারী নিয়ে আছে তাঁর একটি প্রবন্ধ। পরবর্তী সময়ে ধর্মনারায়ণ বাবু সেকথা স্বীকার করেছেন। তাছাড়া 'কামতাবিহারী' কথাটি তিনি ব্যবহার করেছেন শুধু বইয়ের নামকরণে - বাদবাকি সব জায়গায় তিনি এই ভাষাকে 'কামতাবিহারী' না বলে 'কামতাপুরী' বলে চালিয়েছেন এবং এই বিস্তৃত জনপদকে বলেছেন কামতাপুর।

ধর্মনারায়ণ বর্মার প্রণীত তত্ত্ব হল যে '১২৫০ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বত এই জায়গাটির নাম কামরূপ আছিল। ১২৫০ খ্রীষ্টাব্দত রাজা পৃথু কামতাপুরত রাজধানী সারেয়া আনেন। সেলা থাকি এই রাজধানীর নাম হয় কামতাপুর রাজ্য'। এই তত্ত্ব তিনি প্রায় তিন দশক ধরে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাঁর সেই তত্ত্ব যে ভুল তথ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত সেই ভুল তিনি স্বীকার করে নিয়ে Dr. N. N. Acharya-র History of Medieval Assam - reference দিয়ে বলেছেন যে 'বখতিয়ার খলজি কামরূপ আক্রমণের সময় পৃথুই কামরূপের রাজা ছিলেন। নাসিরুদ্দিন মামুদ কামরূপের রাজা পৃথুকে আক্রমণ করেছিলেন। এই যুদ্ধেই পৃথু ১২২৮ খ্রীষ্টাব্দে মারা যান'। সুতরাং ইতিহাস হল যে পৃথু কামতাপুরের নয়, কামরূপের রাজা ছিলেন এবং এই ঐতিহাসিক সত্য অনুযায়ী ধর্মনারায়ণ বাবুর 'সেলা থাকি এই রাজ্যটার নাম হয় কামতাপুর রাজ্য' বক্তব্যটি এবং কামতাপুরের ভাষা কামতাপুরী এই তথ্য ও তত্ত্ব সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নয় । অথচ এই অসত্য তথ্যকে সম্বল করে ধর্মনারায়ণবাবু মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলেছেন। তাঁর তত্ত্বের ভিত্তিতে কামতাপুর আন্দোলনকে ভাষা আন্দোলনের রূপ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কামতাপুরীকে বাংলা ভাষা থেকে পৃথক ইত্যাদি বলার চেষ্টা করা হয়েছে।

১৪১৮ বঙ্গাব্দে/২০১১ খ্রিস্টাব্দে 'রায়ডাক' পত্রিকার দেবী পূজা সংখ্যার ৫৫ পৃষ্ঠায় ধর্মনারায়ণ বর্মা আবার ভুল তথ্যের ভিত্তিতে লিখেছেন - 'পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক যুগের ১২৫৫ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৭৭৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত কামতাপুর এবং ১৭৭৪ থেকে এই স্থানটির নাম নিজ বেহার, কামতা বেহার, বেহার এবং ১৮৯৬ সন থেকে কুচবেহার, যদিও কুচবেহার কামতাপুরের সংকুচিত অংশ মাত্র।' ঐ সংখ্যার ৫৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন - '১২৫৫ খ্রীষ্টাব্দের পর এই কামরূপের নাম হয় কামতাপুর। মহারাজ নরনারায়নের সময় অবিভক্ত আসাম ও অবিভক্ত উত্তরবঙ্গ ছিল কামতাপুর রাজ্য।' কামতাপুর নিয়ে এই হল ধর্মনারায়ণবাবুর দ্বিতীয় তত্ত্ব, যা সেই একই ভুলের, বরং বলা যায় মিথ্যাচারের পুনরাবৃত্তি।

নিজের বক্তব্যের সমর্থনে কোনো বিদগ্ধ কাউকে না পেয়ে ধর্মবাবু শরণ নিয়েছেন School of Language Studies, Australian National University-র তরুণ গবেষক Matthew Toulmin-এর। ২০০৬ সালে submit করা Matthew Toulmin-এর Ph.D Dissertation Paper ছিল Restructuring Linguistic History in a Dialect Continuum; The Kamta, Rajbanshi and Northern Deshi Bangla Sub-group of Indo-Aryan. রাজবংশী ভাষার উপর এই গবেষণা কাজে তিনি ধর্মনারায়ণবাবুর সাহায্য নিয়েছিলেন। মিঃ টুলমিন তাঁর গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে ধর্মনারায়ণবাবুদের 'রায়ডাক' পত্রিকার ১৪১৭ বঙ্গাব্দ/২০১০ খ্রিস্টাব্দের দেবী পূজা সংখ্যায় প্রবন্ধ লিখেছেন - 'Kamta/Rajbanshi as spoken in India and Bangladesh' নাম দিয়ে। এই প্রবন্ধে মিঃ টুলমিন আলোচনা করেছেন K(Kamta)/R(Rajbanshi)র Geographic Spread অর্থাৎ কোথায় কোথায় কথ্য ভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হয় এই ভাষা, এর Affiliation, written sources, linguistic characteristics, literature, phonology, phonetics, morphology, lexicon ইত্যাদি। সর্বত্র ব্যবহার করেছেন K for Kamta এবং R for Rajbhanshi. তিনি বলেছেন - Some leaders of the speech community argue that the variant Kamta is not loaded with the same political connotations as Kamtapuri. উল্লেখ করেছেন নেপালের ঝাপা ও মোরঙ্গে ব্যবহৃত হয় রাজবংশী ভাষা হিসাবে। বলেছেন কামতাপুরী কথাটার মধ্যে রাজনীতি যত বেশি আছে, ভাষাতত্ত্ব ততটা নেই। আর নেই বলেই বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার তথ্যের ভিত্তিতে মিঃ টুলমিন এই কথ্য ভাষাকে কামতাপুরী বলতে পারেননি। 'রাজবংশী' নাম ধর্মনারায়ণবাবুর প্রিয় ভাষাতাত্ত্বিক টুলমিনও মেনে নিয়েছেন। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজির অধ্যাপক গিরীন্দ্রনারায়ণ বাবুর বক্তব্য - 'এরই মধ্যে এক রাজনীতিতে তৈরী হল 'Rajbanshi Bhasa Academy' ২০১২ সালে। ...আবার আর এক রাজনীতিতে এই ২০১৭তে প্রস্তাব এল ভাষার নাম কামতাপুরী হিসাবে। 'কামতাপুরী একাডেমি' তৈরি হল। ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে এল। পাঁচ মহাজন ও তাদের মুষ্টিমেয় সমর্থকের প্রস্তাব যে নিছক রাজনৈতিক কারণে, তা আর একবার প্রকাশ্যে এল।

বর্তমান প্রবন্ধে ধর্মনারায়ণবাবু স্বীকার করেছেন তিনি 'কামতাবিহারী' নামটি রায় সাহেবের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া 'কামতাবিহারী'কে তিনি 'কামতাপুরী' করলেন। বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের এক সন্ধ্যায় 'রায়ডাক' পত্রিকার অনুষ্ঠানে তিনি ঘোষণা করলেন - এখন থেকে এই ভাষার নাম হল 'কামতাপুরী'। নামকরণের authority তাঁকে কে দিল? ধর্মনারায়ণ বর্মা নাম দিয়ে দিয়েছেন, গিরীন্দ্রনারায়ণ বলছেন ভাষার নাম কামতাপুরী হিসাবে প্রস্তাব এল ২০১৭-তে, কামতাপুরী ভাষা সাহিত্য পরিষদ এবং নরেন দাস বলছেন - নামকরণ করতে হবে। মোট কথা বর্তমান অবস্থা যাইই থাকুক না কেন, কামতাপুরী নামকরণ করতেই হবে।

নরেনবাবু বলছেন - রাজবংশী শব্দটি কালিকাপুরাণ, ভ্রামরীতন্ত্রের দ্বিতীয় ভাগ, বিষ্ণুপুরাণের চতুর্থ ভাগ, কামতেশ্বরী কুলকারিকা, হ্যামিলটন বুকানন ও জর্জ আব্রাহাম গ্রীয়ার্সনের লেখাতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ গ্রীয়ার্সনের ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে উঠে আসা 'রাজবংশী' শব্দটি কমপক্ষে বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ কাল থেকে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, এবং সেই কারণে সমস্ত জনপদে দেশী ভাষা নামের স্থানে 'রাজবংশী ভাষা' গৃহীত হয়েছে। মিঃ টুলমিনের ভাষ্যতেও একই সত্য উঠে এসেছে। কিন্তু এই পণ্ডিতগণ তা মানছেন না। তাঁদের মতে এই নাম পরিবর্তন প্রয়োজন, কারণ রাজবংশী হল জাতিগত নাম এবং জাতিগত ভাষার নাম সমীচীন নয়। এক্ষেত্রে অবশ্যই প্রশ্ন ওঠে, 'দেশী' মানুষের ভাষা যদি 'দেশী' হতে পারে, বোড়োদের ভাষা যদি বোড়ো, নেপালীদের ভাষা যদি নেপালী, মনিপুরীদের ভাষা মনিপুরী, ওড়িয়াদের ভাষা ওড়িয়া, মারাঠীদের ভাষা যদি মারাঠী, পাঞ্জাবী, সিন্ধি যদি ভাষার নাম হতে পারে তবে রাজবংশীদের ভাষা রাজবংশী হতে অসুবিধা কোথায়? তাছাড়া ঔচিত্য সমীচিনতার প্রশ্ন এখানে অবান্তর। মাঠে (ক্ষেত্রে, জনপদে) যা আছে তাই উঠে এসেছে সমীক্ষায়। সমগ্র অঞ্চলের মানুষ প্রকাশ করেছে তাদের মুখের ভাষার নাম রাজবংশী।

এখানে আমার দেখা কংগ্রেসের বিখ্যাত নেতা ডি পি রায় (মিঠু)-এর সঙ্গে ধর্মনারায়ণবাবুর একটা সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ না করে পারছি না। সেখানে ধর্মনারায়ণবাবুর মূল বক্তব্য ছিল যে মিঠুবাবু রাজবংশী ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা করছেন কিন্তু ভাষাটিকে রাজবংশী বলছেন কেন? মিঠুবাবুকে তাঁর প্রণীত তত্ত্ব ভাষার নাম কামতাপুরী গ্রহণ করার জন্য বহু যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করলে মিঠুবাবু মোক্ষম কথাটি বললেন তাকে - দেখুন ধর্মদা, জ্ঞান হওয়ার পর থেকে জানি এই এলাকার মানুষ যে ভাষায় কথা বলে তার নাম রাজবংশী। আমার রাজনৈতিক কর্মসূত্রে সমস্ত এলাকায় - উত্তরবঙ্গ তো বটেই, আসাম, নেপাল, বিহার সর্বত্র আমি গেছি এবং সর্বত্র এ ভাষাকে রাজবংশী ভাষা বলা হয়। আপনারা এই নাম চাইছেন না তাতে তো আর বাস্তবতা পালটায় না। যেমন আমাকে সবাই মিঠুদা বলে ডাকে, এমন কি আমার মেয়েও আমাকে মিঠুদা বলে ডাকে। এটাই বাস্তব, অকারণ অবাস্তব কিছুর পিছনে দৌড়াবেন না।

কিভাবে কামতাপুরীর প্রবক্তারা সত্য-মিথ্যা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করেন তার আর একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। নরেনবাবুদের দাবি যে, ডঃ সীতাকান্ত মহাপাত্রের সভাপতিত্বে গঠিত ভাষা বিশেষজ্ঞ কমিটি কামতাপুরী ভাষা সহ ৩৮টি ভাষার নাম মান্যতার জন্য সুপারিশ করেছেন ২০০৪ সালে । এই দাবি যে ভুল সেটি পরিষ্কার হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী কিরেন রিজুজু ৩১.০৮.২০১৫ তারিখে দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রের মাননীয় সাংসদ এস. এস. আলুওয়ালিয়াকে যে উত্তর পাঠান তা থেকে। ডঃ সীতাকান্ত মহাপাত্র কমিটি কর্তৃক কোনো ভাষা নিয়ে সমীক্ষার প্রশ্ন ছিল না। এই কমিটি তৈরি হয়েছিল কোনো ভাষাকে সংবিধানের ৮ম তফশীলে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য কি কি বিষয় বিচার্য হবে সেই বিচারের নীতি নির্দ্ধারণ করা । (To evolve a set of objective criteria with reference to the inclusion of more languages in the Eighth Schedule). পরবর্তীকালে অন্যান্য সব কিছুর সঙ্গে মহাপাত্র কমিটির প্রস্তাব বিবেচনা করার জন্য একটি অন্তর্বিভাগীয় (Inter-Ministerial) কমিটি তৈরি হয়। এই কমিটির দু-একটি মিটিং হয়েছে মাত্র। অন্তর্বিভাগীয় (Inter-Ministerial) কমিটির সি.আই.আই.এল-এর প্রতিনিধি সদস্য প্রয়াত সত্যেন বর্মণের কাছে জানতে পেরেছি যে উক্ত বিচার্য বিষয়গুলির (Criteria) মধ্যে প্রস্তাবিত কামতাপুরী একটি মাত্র বিষয়ে পাশ করেছে।

উল্লেখ্য যে Census Report-এর No. of persons who returned the language and the mother languages grouped under each as their mother tongue - শীর্ষক তালিকায় অনেক নাম আছে - যেমন বানজারি, ভোজপুরী, বুন্দেলখন্ডী, ছত্তিশগড়ি, হরিয়ানভী, গারোয়ালি, জৌনসারি, মাগহি, নাগপুরিয়া ইত্যাদি। কিন্তু কামতাপুরী নাম সেখানে নেই। 'রাজবংশী' কথ্যভাষার নাম কিন্তু সেখানে আছে।

গ্রীয়ার্সন কি মূল্যবান কাজ করেছেন ভারতবর্ষের জন্য সেটা উল্লেখ করেছি। ভাষাতাত্ত্বিক নৃতাতাত্ত্বিকরা ছাড়াও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ কিভাবে দেখেছিলেন গ্রীয়ার্সনকে সেটা আমাদের জানা দরকার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক বিজয় চন্দ্র মজুমদারের ওড়িশার বাসকালে প্রাদেশিক ভাষায় জ্ঞান লাভের জন্য বন্ধু রবীন্দ্রনাথ ১৩১০ সালে ২২শে অগ্রহায়ণ পরামর্শ দিয়ে লেখেন - 'মৈথিলী ভাষা সম্বন্ধে গ্রীয়ার্সনের যে দুই খন্ড বহি এশিয়াটিক সোসাইটি হইতে প্রকাশিত হইয়াছে তাহা আপনার পড়া দরকার। শান্তিনিকেতনে আমাদের গ্রন্থালয়ে সেই দুটি বই আছে; ...বাংলা ভাষার সহিত মৈথিলীর সাদৃশ্য অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।'

ভাষার নাম 'রাজবংশী' এই সত্যটি কমপক্ষে একশো বছর ধরে এলাকায় চলে আসছে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ সেই ভাষাকে নিছক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নতুন নামকরণ করতে চাইছেন। কামতাপুর রাজ্য চাই, তাই কামতাপুরী নামে এই ভাষার নামকরণ করতে হবে। একটা ভাষার নতুন করে নামকরণের অধিকার তাদেরকে কে দিল এই প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা বোধহয় উত্তরবঙ্গের ত্রিশ লক্ষের বেশি জনগণের মধ্যে যে কয়েক হাজার মানুষ কেপিপিকে ভোট দিয়েছেন তাঁদের অধিকারের কথা বলবেন। ২০১৬-র বিধানসভার নির্বাচনে তো কেপিপি নেই। ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে এই পার্টির অস্তিত্ত্ব মুছে গেছে। কেপিপি পার্টি এখন তৃণমূল কংগ্রেসের অঙ্গ। কে.এল.ও. নেত্রী মিতালী রায় তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক, কেপিপি-র নয়।

সেই কারণেই ২০১৭-তে গঠিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের 'কামতাপুরী (রাজবংশী) ভাষা বিশেষজ্ঞ কমিটি' এবং 'কামতাপুরী ভাষা একাডেমি'র সদস্য পদের ললিপপ্‌ পেয়েই কেপিপি প্রধান অতুল রায় খুশি ও সন্তুষ্ট। কামতাপুর রাজ্যের দাবিদার অতুলবাবু এতদিনে বুঝতে পেরেছেন যে তাদের রাজ্য-দাবি একটা অবাস্তব-অলীক স্বপ্ন। তাই যতটুকু পাওয়া যায় তাতেই সন্তুষ্ট। তিনি সন্তুষ্ট, সন্তুষ্ট তাঁর সাকরেদরাও। সুখের কথা, হঠকারি আন্দোলন চালিয়ে রাজবংশী যুবক-যুবতীদের বিভ্রান্ত করার খেলা ছেড়ে দিয়ে বাস্তবমুখী হয়েছেন অতুলবাবুরা। কিন্তু এখানেই তাঁরা থেমে থাকেননি; কামতাপুরীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বও তাঁরা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতি মমতা ব্যানার্জীর উপর। কামতাপুরীওয়ালাদের কাছ থেকে এই দায়িত্বভার পাওয়ার পর শ্রীমতি ব্যানার্জী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ নীতি প্রয়োগ করে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির পূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছেন। কোনও রাজ্যের অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে সংবিধানের ধারাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে তিনি কামতাপুরীকে অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজের স্বীকৃতি দিয়ে আইন পাশ করেছেন, বিরোধীদের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও। Amendment এর মাধ্যমে যেভাবে আইন পাশ করেছেন তাতে কামতাপুরী (অস্তিত্ববিহীন) ও রাজবংশী দুটি আলাদা ভাষা।

Amendment-এর সাংবিধানিক বৈধতা নিয়েও প্রশ্নও রয়েছে । রাজ্য সরকার কোন আঞ্চলিক ভাষাকে অবশ্যই Official Language হিসাবে স্বীকৃতি দিতে পারে। এ ব্যাপারে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট Articles ৩৪৫ থেকে ৩৪৭ দ্রষ্টব্য। Official Language সংক্রান্ত Article 345 হল - subject to the provisions of Articles 346 এবং 347. Article 347 এর বিধান হল - Special provision relating to language spoken by a section of population of a State: On a demand being made in that behalf the President may, if he is satisfied that substantial proportion of the population of the State desire the use of any language, spoken by them to be recognized by that state, direct that such language shall also be officially recognized throughout that State or any part thereof for such purpose as he may specify.

সুতরাং সংবিধান অনুযায়ী কোনও কথ্য ভাষাকে Official Language হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হলে প্রয়োজন হবে মহামান্য রাষ্ট্রপতির নির্দেশ এবং রাষ্ট্রপতি সেই নির্দেশ দেবেন যদি তিনি সন্তুষ্ট হন যে সেই কথ্য ভাষাটি বেশ কিছু মানুষ ব্যবহার করেন। কিন্তু Census-এর কোনও তালিকাতেই যে নাম নেই, কারণ বাস্তবে এই নামে কোনও কথ্য ভাষা নেই তাঁকে Official Language-এর অন্তর্ভুক্তির নির্দেশ দেশের রাষ্ট্রপতি মহোদয় দেবেন কি করে? সংবিধান সম্মত নয় জেনেও কামতাপুরী নামে এক অস্তিত্ব বিহীন কথ্য ভাষাকে Official Language-এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কামতাপুরীওয়ালাদেরকে মদত দিয়ে রাজবংশী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির পবিত্র উদ্দেশ্যে।

২৮.০২.২০১৮ তারিখে বিধানসভায় মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী Official Language Bill-এর জবাবী ভাষণে বলেছেন - 'আমি রাজবংশী ভাষাকেও সম্মান করি, আমি কামতাপুরী ভাষাকেও সম্মান করি।' রাজবংশী ও কামতাপুরী যে পৃথক ভাষা এই তথ্য তিনি নাকি পেয়েছেন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির নেতৃত্বে সাত সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ থেকে। অর্থাৎ এই কমিটির মতে রাজবংশী এবং কামতাপুরী দুটি আলাদা ভাষা। কমিটির কয়েকজন তো রাজবংশী গোষ্ঠী বা রাজবংশী সংস্কৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তাঁরা কি এই মত গ্রহণ করেছেন যে রাজবংশী ও কামতাপুরী দুটি আলাদা ভাষা? সরকারী কিছু সুবিধার লোভে নিজেদের স্বকীয়তা, যা নিয়ে এঁরা খুব গর্ব করেন, তাকে বিসর্জন দিয়েছেন এবং ভেদ নীতিতে অপার বিশ্বাসী মমতা ব্যানার্জীর রাজবংশী জনগোষ্ঠীকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করার অনুপ্রেরণা ও মিশনে মদত জুগিয়ে চলেছেন। তাই রায় সাহেব পঞ্চানন বর্মার অনুকরণে আক্ষেপ করে বলা ছাড়া আর কিই বা করবো?

ছিকো ছিকো রে রাজবংশীগুলা ধিক্‌ ধিক্‌ তোকে ধিক্‌
গুষ্টিক তোর ভাগা ভাগি করে তেঁও থাকিস তুই ঠিক?