আরেক রকম ● নবম বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২১ ● ১৬-৩১ চৈত্র, ১৪২৭

সমসাময়িক

প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর


দেশের পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন চলছে, যার মধ্যে দুটি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ এবং অসম বাংলাদেশের সীমানাবর্তী। এই দুটি রাজ্যেই এনআরসি-সিএএ এবং অনুপ্রবেশকে কেন্দ্র করে রাজ্য রাজনীতি সরগরম থেকেছে বিগত দুই বছর। তদুপরি, মতুয়া সমাজের মধ্যে বিজেপি-র প্রভাব বাড়লেও, সিএএ বিধি প্রণয়ন করতে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা বিজেপি-র পালের হাওয়া কিছুটা হলেও কমিয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে কী করণীয়? প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি বাংলাদেশ যাবেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ যাবেন তা নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকার কথা নয়। কিন্তু আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কূটনৈতিক শিষ্টাচার বা নিয়মের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখলে রাজনীতির রুটি সেঁকা হবে কী করে? অতএব, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের প্রথম দিনে তিনি গেলেন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ওড়াকান্দিতে মতুয়া সমাজের প্রতিষ্ঠাতা হরিচাঁদ ঠাকুর এবং গুরুচাঁদ ঠাকুরের মন্দিরে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। হরিচাঁদ ঠাকুর এবং গুরুচাঁদ ঠাকুর বাংলার জাতিবর্ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে লড়াই লড়েছেন তা ভারতের ইতিহাসে বিরল। তাঁরা দলিত শ্রেণির মুখে ভাষা জুগিয়েছেন, তাদের শিক্ষিত হওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন এবং সংগঠিত হয়ে লড়াই করার শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁদের শ্রদ্ধা জানানো সবার কর্তব্য। কিন্তু প্রশ্ন হল পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের সময়টিকেই প্রধানমন্ত্রী বেছে নিলেন কেন? এর আগেও তিনি বাংলাদেশ সফর করেছেন। কিন্তু তখন তো তাঁর ওড়াকান্দি গিয়ে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরকে শ্রদ্ধা জানানোর কথা মনে পড়েনি। ওড়াকান্দিতে বক্তৃতা করার সময় প্রধানমন্ত্রী বিজেপি সাংসদ এবং মতুয়া নেতা শান্তনু ঠাকুরের গুণগান গাইলেন। ভারতে এবং বাংলাদেশে মতুয়া সমাজের জন্য কিছু প্রকল্প ঘোষণা করলেন যা সরাসরি নির্বাচনের বিধিনিষেধের পরিপন্থী। বুঝিয়ে দিলেন যে তাঁর ওড়াকান্দি যাওয়ার উদ্দেশ্য আসলে কিছু ভোটের ব্যবস্থা করা। হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের যে সাম্যের বাণী বাংলার নিপীড়িত মানুষকে প্রেরণা জুগিয়েছে তাকে সাম্প্রদায়িক আকার দিতে চায় মোদী ও বিজেপি। সিএএ-র বিধি তারা তৈরি করতে দেরি করছে কারণ এই বিধি তৈরি হলেই প্রমাণিত হয়ে যাবে যে মতুয়া-সহ সমস্ত মানুষকে এই আইনের আওতায় নাগরিকত্ব পেতে হলে স্বীকার করতে হবে যে তারা ভারতে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে এসেছিলেন। এই বিষয় প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খোলসা করে কিছু বলছেন না। বরং বাংলাদেশের মাটিকে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছেন।

কূটনীতির একটি মৌলিক শর্ত এই যে বিদেশের মাটিতে দেশের রাজনীতিকে টেনে না আনা, অথবা বিদেশের রাজনীতি নিয়ে কোনো মন্তব্য না করা। মোদী এই দুই শর্তেরই উল্লঙ্ঘন করেছেন। আমেরিকায় গিয়ে বলে এসেছেন, ‘অবকি বার ট্রাম্প সরকার’। আবার বাংলাদেশে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করলেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিও মোদীর সফর নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছে। মোদীর সফরের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে সেখানকার মানুষ। ভারতে মোদী মুসলমানদের উপর অত্যাচার করছেন এই অভিযোগে বহু সংগঠন বাংলাদেশে রাস্তায় নেমেছে। বিশেষ করে মৌলবাদী শক্তি হেফাজতে ইসলাম এই বিক্ষোভে শামিল হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলি চলেছে। ইতিমধ্যেই মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। কিছু জায়গায় হিন্দুদের উপর আক্রমণ করা হয়েছে এবং মন্দিরের ক্ষতি করা হয়েছে। এই সমস্ত ক্রিয়াকলাপকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করা উচিত এবং তা অবিলম্বে বন্ধ করে দোষীদের শাস্তি দেওয়া উচিত।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উত্তেজনা অবিলম্বে প্রশমিত হওয়া প্রয়োজন। হেফাজতের মতন উগ্র মৌলবাদী এবং সাম্প্রদায়িক সংগঠন বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর যদি এই অজুহাতে আবার অত্যাচার নামিয়ে আনে তবে তার প্রতিক্রিয়া পশ্চিমবঙ্গ এবং অসমের উপরেও পড়বে। নির্বাচনের রাজনৈতিক উত্তাপ ইতিমধ্যেই সাম্প্রদায়িকতার মোড়কে পরিবেশিত হতে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের উত্তেজনার অভিঘাত পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ভয়ংকর আকার ধারণ করতে পারে। অতএব, বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমাদের আবেদন অবিলম্বে উত্তেজনা প্রশমিত করুন। বাংলাদেশের মানুষদের কাছেও আমরা দাবি জানাব গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিবাদ অবশ্যই করুন। কিন্তু প্রাণঘাতী সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে কিছুতেই বাংলাদেশে বাড়তে দেবেন না, যার মূল্য বাংলাদেশ এবং ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে চোকাতে হবে। ভারত সরকার, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের কাছে আমাদের আবেদন থাকবে সজাগ থাকুন, যাতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্তাপ আমাদের রাজ্যের নির্বাচনী বাতাবরণকে সাম্প্রদায়িকতার বিষে নিমজ্জ না করতে পারে।