আরেক রকম ● নবম বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২১ ● ১৬-৩১ চৈত্র, ১৪২৭
সমসাময়িক
কৃষক আন্দোলনের দাপটে সরকার দিশাহারা
রাজধানীর সীমান্ত অবরোধ করে রাখা কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে দৈনিক সংবাদপত্রের পাতায় কোনো খবর নেই কেন? টিভির চ্যানেলগুলো সারাদিন ধরে এটা ওটা নানান বিষয়ে বকবকানি চালিয়ে গেলেও কৃষক আন্দোলন নিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করছে না কেন? তবে কি কৃষক আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়েছে?
এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে কৃষক আন্দোলন সংক্রান্ত তথ্য বিনিময়ের ব্যাপারে টুইটার অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে ওঠার জন্য রাষ্ট্রের বিরাগভাজন হয়েছে।‘#মোদী-প্ল্যানিং-ফারমারস-জেনোসাইড’ অর্থাৎ ‘কৃষকদের হত্যার পরিকল্পনা করছেন মোদী’ হ্যাশট্যাগ নিয়েই টুইটারের সঙ্গে রাষ্ট্রের মনোমালিন্যের শুরু হয়। ওই হ্যাশট্যাগটি সরিয়ে দিতে টুইটার কর্তৃপক্ষকে বলেছিল কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রক। সেই সঙ্গে কৃষক আন্দোলন সমর্থনকারী ২৫০টি টুইটার অ্যাকাউন্টও বন্ধ করে দিতে বলা হয়েছিল। সরকারের নির্দেশ মেনে টুইটার ওই অ্যাকাউন্টগুলি প্রথমে বন্ধ করলেও পরে তা আবার চালু করে দেয়। এরই প্রেক্ষিতে টুইটারকে সতর্ক বার্তা পাঠিয়ে জানানো হয় টুইটারের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করা হবে।
স্বাভাবিকভাবেই টুইটার কর্তৃপক্ষ ভারতের মতো এত বিরাট বাজার হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে সংস্থার অন্দরে কিছু পরিবর্তন এনে সরকারকে তুষ্ট করার চেষ্টা করেছে। ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার নীতি নির্ধারক অধিকর্তা দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। টুইটার তাঁর সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। কৃষক আন্দোলন নিয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে টুইটারের সম্পর্ক যখন ক্রমশই অবনতির পথে, তখনই এই ঘটনা ঘটেছে। ভারতে টুইটারের নীতি নির্ধারণের বিষয়টি গত ছ’বছর ধরে দেখাশোনা করছিলেন যে অধিকর্তা অকস্মাৎ ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়েই কাজ থেকে তাঁর নিষ্কৃতি চাওয়ার প্রস্তাব নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। ভারত সরকারের সঙ্গে টুইটারের মনোমালিন্যের মধ্যেই ভারতীয় অধিকর্তার পদত্যাগ প্রচারমাধ্যমের জন্য এক সতর্ক বার্তা হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে।
প্রচারমাধ্যম কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে নীরব থাকলেও অথবা এই বিষয়ের খবরাখবর বর্জন করলেও আন্দোলন কিন্তু বন্ধ হয়নি।কৃষক আন্দোলনের ৪ মাস পূর্তির দিনেগত ২৬শে মার্চ কৃষকদের তরফেসংযুক্ত কিসান মোর্চা (এসকেএম)সারা দেশে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল।এই সংগঠনের ছাতার তলায় একত্র হয়ে দেশের প্রায় ৪২টি কৃষক এবং ক্ষেতমজুর সংগঠন গত ২৬ নভেম্বর থেকে দিল্লির সিঙ্ঘু, টিকরি এবং গাজিপুর সীমানায় আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ৬ ডিসেম্বরের পর শুক্রবার ফের বন্ধ পালন করছে তারা। এসকেএম নেতৃত্বর ঘোষণা অনুসারে ২৬শে মার্চ শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বন্ধত চলে। বিতর্কিত কৃষি আইনগুলি প্রত্যাহারের পাশাপাশি ফসলে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে আইনি প্রতিশ্রুতিও দাবি করা হয়েছে। কৃষক সংগঠনগুলির পাশাপাশি অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ভারত বন্ধেপ সমর্থন জানিয়েছিল।
৩টি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে ভারত বন্ধো শামিল হয়ে দেশের ৩২টি জায়গায় অবরোধ করা হয়। সকাল ৬টা থেকে বন্ধ শুরু হওয়ার পর দিল্লি, পঞ্জাব এবং হরিয়ানার বিভিন্ন রাস্তা, জাতীয় সড়ক এবং ট্রেন চলাচলের ক্ষেত্রে অবরোধ শুরু হয়। শুধুমাত্র উত্তর ভারত নয়, কর্ণাটক এবং অন্ধপ্রদেশেও এই বন্ধেলর প্রভাব পড়েছে।
পঞ্জাবের একাধিক জায়গায় কৃষক নেতা থেকে শুরু করে মহিলারাও ধর্মঘটে শামিল হন। শাহপুরের রেল লাইনেও বসে পড়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেন আন্দোলনকারীদের একাংশ। ওয়াগায় ইন্দো-পাক সীমান্তেও জড়ো হন অসংখ্য আন্দোলনকারী। সেখানে জাতীয় সড়কের উপরেই বন্ধের সমর্থনে পথসভা করেন কৃষক নেতারা। পঞ্জাবের বারনালা জেলায় বনধে শামিল হয়ে ট্রেন অবরোধ করেন মহিলারা। মানসা জেলায় ধর্নায় বসেন অসংখ্য মহিলা। কিসান মজদুর সংঘর্ষ কমিটির সদস্যরা ‘রেল রোকো’ কর্মসূচি পালন করেন। অমৃতসরে দিল্লি-অমৃতসর রেল লাইনে বসে পড়েন তাঁরা। মোহালিতে বিমানবন্দরে যাওয়ার রাস্তাতেও প্রতিবাদ করেছেন কৃষকেরা। এই ভারত বনধেপড পঞ্জাব বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরাও সমর্থন যুগিয়েছেন। রাজ্যের ৯ নম্বর জাতীয় সড়কে চাক্কা জ্যামের কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।
পঞ্জাবের মতো রাজ্য ছাড়া বন্ধের প্রভাব পড়েছে হরিয়ানা এবং অন্ধ্রপ্রদেশেও। হরিয়ানায় শুক্রবার সকাল থেকে বিভিন্ন হাইওয়ে যাওয়ার রাস্তায় অবরোধ শুরু হয়। বন্ধহ চলাকালীন অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমের রাস্তা প্রায় ফাঁকাই ছিল।
বন্ধ্ চলাকালীন কোনওরকম অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। সবমিলিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বন্ধা শান্তিপূর্ণ ভাবেই পালন করা হয়েছে। এবং ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যম ধর্মঘটের সাফল্যের খবর কোনো এক অজ্ঞাত কারণে অথবা টুইটারের তিক্ত অভিজ্ঞতার পরে সম্প্রচার করতে সাহস করেনি।
একইভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে লোটা নুনের শপথ। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের ৩৬টা বেরাদরির কয়েক লক্ষ কৃষক মুজফফরনগর মহাপঞ্চায়েতে সমবেত হয়ে "লোটা নুনের শপথ" নিয়ে গেরুয়া শিবিরকে সামাজিক বয়কট করার শপথ নেয়। প্রচলিত পদ্ধতি অনুযায়ী এক লোটা (ঘটি) গঙ্গাজলে কিছুটা নুন দিয়ে এই শপথ নেওয়ার পরে ব্যক্তির মত গোটা সম্প্রদায়ের মতে পরিণত হযে যায়। ব্যক্তি আর সমষ্টির এই যৌথ মত সকলের জন্য প্রযোজ্য।
লোটা নুনের শপথ ঠিক কবে কোথায় কীভাবে শুরু হয়েছিলো সঠিক জানা যায় না। ইতিহাসের বইতে এইসব লেকচারের কথা লেখা হয় না। তবে লোকশ্রুতি যাকে আজকাল oral history বলে, সেই অনুযায়ী এটুকু জানা যায় যে মাত্র অল্প কয়েকবারই সমষ্টিগতভাবে এই শপথ নিয়েছে বেরাদরির লোকেরা। খুব সম্ভবতঃ ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে তৈমূরের আক্রমণের সময় প্রথমবার এর ব্যবহার হয়। তারপর ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মীরাট অভ্যুত্থানের সময় এই শপথ নেওয়া হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করতে ১৮৫৭ সালের পর আরও নব্বই বছর লেগেছিল। কৃষকের মৃত্যু পরোয়ানা বলে অভিহিত নতুন তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে কত সময় লাগে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
কৃষক অবিশ্যি লড়াই না জিতে ফিরে যেতে রাজি নয়। আসন্ন গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে অস্থায়ী ঘর। টিকরি সীমান্তে ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে এক অস্থায়ী হাসপাতাল। সেখানে ৪০টি শয্যার বন্দোবস্ত হয়েছে। রয়েছে মহিলাদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড। অবস্থান স্থলে হাসপাতালের প্ৰয়োজনীয়তা রয়েছে। চার মাসের বেশি সময় ধরে কৃষকরা রাজপথে চরম প্রতিকূল আবহাওয়ায় দিন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁরা তো আর সকলে মিলে পিকনিক করতে আসেননি। নিজেদের মৃত্যু পরোয়ানা ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি আদায় করতে এসেছেন। ইতিমধ্যেই আড়াইশোর বেশি আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়েছে।
সরকার এখন দিশাহারা। এই মুহূর্তের কর্তব্য বিবেচনা করতে ব্যর্থ। আর সময়ই বা কোথায়? দিল্লি থেকে প্রতিদিন ডিব্রুগড়, গুয়াহাটি, শিলিগুড়ি, কলকাতা সহ আরও কত কত জায়গায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি করতে হচ্ছে। তার উপরে আন্দোলনের মধ্যে কোনো বিভাজন সৃষ্টি করা যাচ্ছে না। সম্পন্ন কৃষকের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে যাচ্ছেন গরিব ক্ষেত মজুর। শিখ হিন্দু মুসলিমের বিভাজনও সম্ভব হয়নি। যে মুজফ্ফরনগর কয়েক বছর আগে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিধ্বস্ত হয়েছিল সেখানেই হয়েছিল সবচেয়ে বড়ো মহাপঞ্চায়েতের আয়োজন।
পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রিসভার প্রায় সব সদস্যই গত জানুয়ারি মাস থেকে মহাব্যস্ত। দেশের পূর্বতম এলাকা থেকে শুরু করে দক্ষিণ বিন্দু পর্যন্ত তাঁরা ছুটোছুটি করার সময় পাচ্ছেন। কিন্তু রাজধানীর সীমান্তে অবস্থানরত কৃষকদের মুখোমুখি হওয়ার সময় পাচ্ছেন না। অথবা ইচ্ছে নেই। কিংবা ঔদ্ধত্যের চরম সীমায় পৌঁছে যাওয়ার পর এখন আর আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের সূত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
লোটা নমক-এর সামাজিক প্রতিক্রিয়া যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তা নিয়েও বোধ হয় সরকারের কোনো চিন্তা নেই। এমনকি নিজেদের বিধায়কের নিগৃহীত হওয়ার পরেও সরকার নির্বিকার। পঞ্জাবের মুক্তসর জেলার মলোটে গেরুয়া শিবিরের এক বিধায়ক প্রকাশ্যে নিগৃহীত হয়েছেন। দলীয় নির্দেশে বিধায়ক মশাই নিজের নির্বাচনী এলাকায় নতুন কৃষি আইনের গুণগান করতে গিয়েছিলেন। বেচারি! সামাজিক বর্জনের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে দলীয় নির্দেশ পালন করতে গিয়ে ভদ্রলোক জনতার হাতে মারধোর খাওয়ার পর প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় কোনোরকমে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন। অবস্থা এতটাই সঙ্গিন যে রাজ্য সরকার গেরুয়া শিবিরের সব নেতাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে।
কৃষক আন্দোলন নিয়ে সরকার উদাসীন মানসিকতা নিয়ে চলতে পারে। প্রচারমাধ্যমকে বিভিন্ন পন্থায় এ ব্যাপারে নীরব করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কৃষক আন্দোলন যে সামাজিক আলোড়ন সৃষ্টি করছে তার অভিঘাত সরকার সামলাতে পারবে তো?