আরেক রকম ● নবম বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২১ ● ১৬-৩১ চৈত্র, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

নন্দীগ্রামঃ হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানো


ইতিহাসে কিছু ঘটনা ঘটে যার ভূত আজীবন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে তাড়া করে বেরায়। নন্দীগ্রামের ১৪ মার্চ, ২০০৭ ছিল সেরকম একটা ঘটনা। একটা রাত পালটে দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মানচিত্রকে। সর্বত্র ঘৃণিত ও ধিক্কৃত হতে হতে বামপন্থীরা সেদিন থেকেই কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিলেন। বাংলার মসনদে উঠে এসেছিল নতুন শক্তি তৃণমূল। এই বহুচর্চিত বিষয়গুলো বাদ দিলেও যেটা হয়েছিল, তা হল জনমানসে বাম ভাবধারা নড়বড়ে হয়ে যাওয়া। সিপিআই(এম) যাঁরা করতেন, তাঁরা লজ্জায় মুখ লুকিয়েছিলেন পাড়ায় পাড়ায়। রক্তক্ষরণের সেই ছিল শুরু, আজ এতদিন পরেও যা অব্যাহত। নন্দীগ্রামের ভূত কমিউনিস্ট পার্টিকে তাড়া করেছে টানা চোদ্দ বছর। এখনো প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবিদের চোখে বামপন্থা ও সিপিআই(এম), এই দুইয়ের মধ্যে এক অলঙ্ঘনীয় প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ১৪ মার্চের সেই রাত। অবিশ্বাস, সন্দেহ, ক্ষোভ, ধিক্কার বহন করতে করতে পার্টি যখন ক্লান্ত, ঠিক তখনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন যে নন্দীগ্রামে পুলিশ ঢুকেছিল শুভেন্দু ও শিশির অধিকারীর সাহায্যে। অধিকারী পরিবার অনুমতি না দিলে পুলিশ ঢুকতে পারত না, গুলি চালানো তো অনেক পরের ব্যাপার। আবার উসকে উঠল পুরনো ক্ষত ও যন্ত্রণার স্মৃতি। দুই তরফের চাপান উতোর চলবে, কে আসল অপরাধী সেসব নিয়েও তরজা চলবে, কিন্তু কিছু প্রশ্ন রাজনীতির থেকেও ওপরে, যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নৈতিকতার প্রশ্ন, ব্যক্তিগত যন্ত্রণার প্রসঙ্গ। নন্দীগ্রাম তেমনই একটি বিষয়।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছেন যে বাম সরকার অধিকারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে পুলিশ ঢুকিয়েছিল। পালটা শিশির অধিকারী বলেছেন যে এই প্ল্যান ছিল মমতার নিজের, তিনি সব জানতেন, যেসব পুলিশ গুলি চালিয়েছিল তৃণমূল জমানায় তাদের পদোন্নতি হয়েছে। একধাপ এগিয়ে এটাও বলেছেন যে তৎকালীন বাম সরকারকে কীভাবে ম্যানিপুলেট করতে হয় তাঁরা সেটাও জানতেন। অস্ত্রযোগের কথাও স্বীকার করেছেন। এবার, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিক লাভের জন্যই এই অভিযোগ করেছেন সেটা সত্য। কিন্তু এই অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তাহলে কী দাঁড়ায়? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানতেন যে গুলি চলেছিল কাদের হস্তক্ষেপে, এবং জানার পরেও সেই সত্য চোদ্দ বছর ধরে শুধু চেপেই রাখেননি, অধিকারী পরিবারকে কাঁথির একচ্ছত্র সম্রাট বানিয়েছেন। বিধানসভা, লোকসভা, পুরবোর্ড, হলদিয়া উন্নয়ন নিগম, সমস্ত কিছুর রাশ তুলে দিয়েছেন সেই তাদের হাতে, যাদের অঙ্গুলিহেলনে নাকি গুলি চলেছিল। তার মানে, নিজের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে মমতা চোদ্দটা লাশকে শুধুমাত্র ব্যবহার করলেন এতদিন ধরে! জমি আন্দোলনকে নিছক ব্যবসায় পরিণত করলেন! এর বিচার হবে না?

আর, মমতা যদি মিথ্যে বলেন, তাহলে শিশির অধিকারী কি সত্যি বলছেন? মানে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এগুলো আগে থেকে জানতেন? এই ভয়ংকর অভিযোগের তদন্ত হবে না? আর যদি এমন হয় যে মমতা এবং শিশির দুজনেই মিথ্যে কথা বলছেন, মানে দুজনেই নির্দোষ এবং মূল দায় বাম সরকারের, তাহলে প্রশ্ন উঠবেই, যে আন্দোলন এতদিন ধরে তাঁদের উভয়কেই ডিভিডেন্ড দিয়েছে, সেখানে দুম করে নিজেদের গায়ে কাদা লাগাতে তাঁরা উভয়েই এগিয়ে এলেন কেন? যদি তাঁদের হাতে রক্তের দাগ না-ই লেগে থাকে, তাহলে কেন এতদিন পর পরস্পরকে দুষছেন? এর কারণ একমাত্র একটাই হতে পারে। মমতা এবং শিশির অধিকারী, কেউই নির্দোষ নন। তাঁদের প্রত্যেকে কোনও না কোনওভাবে জড়িত ছিলেন। আর তাই এতদিন পর একে অপরকে ব্ল্যাকমেল করবার খেলায় নেমেছেন।

তাহলে সত্যিটা কি বেরবে না? বাংলার সাধারণ মানুষ ন্যায়ত সত্যিটা জানবার অধিকারী। যে চোদ্দজন মারা গিয়েছিলেন তাঁদের পরিবারের অধিকার আছে সত্যিটা জানবার। এই ঘটনার অভিঘাতে সিপিআই(এম)-এর যে নেতা কর্মীরা খুন হলেন, মার খেলেন, এখনো ঘরছাড়া হয়ে পালিয়ে বেড়ালেন, তাঁরা এবং তাঁদের পরিবার, প্রত্যেকের অধিকার আছে সত্যিটা জানার। তাঁদের নিজেদের স্বার্থেই এই অধিকার আছে। এমনকি যে তৃণমূল কর্মীরা মারা গিয়েছেন বা সততার সঙ্গে নিঃস্বার্থ ভালবাসায় ওই অঞ্চলে পার্টি করেছেন, তৎকালীন সরকারের সঙ্গে সম্মুখ সমরে নেমেছেন, জমি অধিকার রক্ষা কমিটির হয়ে রক্ত ঝরিয়েছেন, তাঁরও জানবার অধিকার আছে, যে মমতা ও অধিকারী বাড়ির রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার খেলাতে তিনি সেদিন বোড়ে হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিলেন কি না। সেই সঙ্গে এটাও জানার অধিকার সবার আছে যে কেন এতদিনেও সিবিআই রিপোর্ট এবং বিচার বিভাগীয় তদন্ত রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। সেটা কি এই কারণে যে তা করতে গেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা সেখানে বেআব্রু হয়ে যেত? একটি নির্বাচিত সরকার এবং তার মুখ্যমন্ত্রীকে যে যে বিষয়গুলো নিয়ে কালিমালিপ্ত করা হয়েছিল, সেগুলোর ভাগিদারী যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও হন, তাহলে তাঁর বিচার কে করবে?

আর যেসব মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবিরা সেদিন বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন? স্বীকার করি, তাঁদের কেউ কেউ সৎ উদ্দেশ্যেই নেমেছিলেন, কিন্তু অনেককেই তো পরে দেখা গেল তৃণমূলের জমানায় লুটেপুটে খেয়ে, কোটি টাকার দুর্নীতি করে গুছিয়ে বসতে। সেই বুদ্ধিজীবিদের আখের গোছানো তো পুরোটাই কিন্তু হল ওই চোদ্দটা লাশের বিনিময়ে। রক্ত তো তাঁদের হাতেও লেগে আছে। তখন না হয় জানতেন না, কিন্তু আজ যখন জানছেন, যখন প্রশ্ন উঠছে সেদিন সত্যিই কী ঘটেছিল তাই নিয়ে, তখন কি নিজেদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করবেন? ক্ষমা চাইবেন সাধারণ মানুষের কাছে? জেনে হোক অথবা না জেনে, যে ক্ষতিকর ভূমিকা তাঁরা সেদিন নিয়েছিলেন, তার প্রায়শ্চিত্ত করবেন কি? সম্ভবত মিথ্যে আশা হয়ে যাচ্ছে। কারণ এই বাংলায় অধিকাংশ বুদ্ধিজীবি ও শিল্পীদের মেরুদণ্ড যে আসলে রাবারের তৈরি সেটা তো দেখাই গেছে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের ইঙ্গিতমাত্রই দলে দলে বিজেপি-তে তাঁদের যোগদানের হিড়িক দেখে। কিন্তু শতমুখে যে কথা বলার, রক্ত তাঁদের হাতেও লেগে আছে। এবং নন্দীগ্রামের ভূত তাঁদের ভবিষ্যতেও তাড়া করে বেড়াবে।

এই দাবি করা হচ্ছে না যে সিপিআই(এম) নির্দোষ ছিল। সিপিআই(এম)-এর কেন্দ্রীয় কমিটি নন্দীগ্রামের গুলি চালনার ঘটনার পরে বলে যে অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা এবং এই ধরনের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। ২০১১ সালের নির্বাচনী পর্যালোচনা রিপোর্টেও সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটি বলে যে নন্দীগ্রামে প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক ভুল হয়েছিল। কিন্তু তারা যা করেছে এবং যা করেনি, সেই সবের হিসেব চুকে গেছে এতদিনে। সরকার থেকে এক দশক হল নির্বাসিত, রক্তপাতে ক্লান্ত, দুর্বল একটি দলে পরিণত হয়েছে তারা। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা অধিকারী বাড়ির হিসেব কে চোকাবে? গুলি চালনায় তাদের হাত থাকুক বা না থাকুক, জমি আন্দোলন যে তাদের কাছে নিছক রাজনৈতিক পণ্য ছিল, সেটা তো আজকের নন্দীগ্রামে গেলেই বোঝা যাবে। যেখানে জমির প্রশ্ন এখন গৌণ। ওই চোদ্দজন শহীদকেও ভুলে গেছেন মানুষ। যেখানে এখন ভোট হচ্ছে হিংস্র ধর্মীয় মেরুকরণের ভিত্তিতে। শুভেন্দু এবং বিজপি নন্দীগ্রামের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ হিন্দু এবং ৩০ শতাংশ মুসলমান, মুসলমান তোষণ, পাকিস্তান ইত্যাদি বলে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করছে। অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী একের পর মিটিংয়ে চণ্ডীপাঠ করছেন এবং মন্দিরে মন্দিরে পুজো দিচ্ছেন। দুই পক্ষই একে অপরের দিকে তির চালাচ্ছে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা থেকে নয়, ধর্মের দোহাই দিয়ে। দুর্বল একটি স্বর, যা অর্থনীতি, শিল্প কর্মসংস্থানের কথা বলছে, মীনাক্ষী মুখার্জি যে স্বরের নাম, সেটি ওই বামপন্থীদেরই। কিন্তু সেটুকু বাদ দিলে পুরো ভোটটা যখন তীব্র ও ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক রূপ নিয়েছে, তখন বোঝাই যায় যে মমতা বা শুভেন্দু, কারোর কাছেই জমি আন্দোলনমানুষের পাশে দাঁড়াবার অ্যাজেন্ডা ছিল না, ছিল শুধুমাত্র ওপরে ওঠবার সিঁড়ি।

আজ চোদ্দ বছর পরে এসে এত কথা লিখতেও ভাল লাগে না, কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে চায়! সেই দিনটি ছিল বাংলার প্রগতিশীল মানুষদের কাছে একটি ট্রমা। আবার অনেকের কাছে শহীদ দিবস। কিন্তু যাঁদের কাছে শহীদ দিবস ছিল, তাঁরাও আজ তার পবিত্রতাকে এরকম কালিমালিপ্ত হতে দেখে যন্ত্রণা পাচ্ছেন। আর হয়ত সেই সময়কার সিপিআই(এম) কর্মীরা, যাঁরা নিন্দিত ঘৃণিত হতে হতে অন্ধকারে মুখ লুকিয়েছিলেন, তাড়া খেয়েছিলেন, মার খেয়েছিলেন, তাঁরাও আবার যন্ত্রণা পাচ্ছেন। দিনের শেষে কোন দলের কতটা লাভ হল, তার বাইরেও তো সৎ পার্টিকর্মীদের ব্যক্তিগত যন্ত্রণাটুকু থেকেই যায়, সে তিনি যে দলই করুন না কেন। আজ যখন দেখা যায় সেই জমি আন্দোলনের নায়কেরা দুটি হিংস্র অন্ধকারাচ্ছন্ন দলে বিভক্ত হয়ে একে ওপরের দিকে দাঁত নখ বাগিয়ে ধরেছেন, যখন দেখা যায় যে তাঁদের অ্যাজেন্ডায় জমি বা অর্থনীতির ছিটেফোঁটাও নেই, আছে শুধুই ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা আর দুর্নীতি, তখন যন্ত্রণা হয়। তখন বোঝা যায়, রাজনীতির এই কুশীলবদের তুলনায় আমরা বোকা মানুষের দল এখনো এগোতে পারিনি। আর এগোতে পারেননি নানা রাজনৈতিক দলের কিছু বোকা মার খাওয়া সমর্থক ও কর্মীরা। তাঁরা হয়ত আজও সেখানেই আটকে পড়ে আছেন, যাকে ছেঁড়া কাগজের মত অবহেলায় পরিত্যাগ করে চলে গেছে রাজনীতির ট্রেন, দূর দিগন্তের হিন্দুরাষ্ট্র সারদা নারদা টেট দুর্নীতি গণতন্ত্র হরণের গন্তব্যে। শুধু সেই সব বোকা মানুষদের দল, আর কিছু সাধারণ মানুষ, যাঁরা সরল বিশ্বাসে জমি আন্দোলনের পক্ষে বা বিপক্ষে উদ্বেল হয়েছিলেন, তাঁরা পড়ে আছেন সেই জনহীন পরিত্যক্ত স্টেশনেই। স্টেশনটির নাম - ২০০৭, ১৪ই মার্চ, নন্দীগ্রাম!