আরেক রকম ● নবম বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২১ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪২৭

প্রবন্ধ

অথ টুম্পা কথা

শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার


সত্যি কথা বলতে কী, 'তোকে নিয়ে ব্রিগেড যাবো, টুম্পা' প্রথমে শুনে আমার একটা সাংস্কৃতিক আঘাতই লেগেছিল। হতচকিত হয়ে পড়েছিলাম। ভাবলাম, তবে কি সংগ্রামের আহ্বান পাড়ার চ্যাংরা ছেলেদের টিটকিরির ভাষাতেই জানাতে হবে! গানের কথায় যতই ইতিবাচক দিক থাক, ব্যাপারটা তো চ্যাংরামোর ঢঙেই। ভাষাটা ইভটিজিং-এর। নিজেদের অন্দর মহলে কিছু অসন্তোষ ব্যক্ত করেই ক্ষান্তি দিলাম। কারণ এখন ভোটের বাজার। এখন জ্ঞানী গুণী বিদ্বজ্জনেরাও কে কোন দলে সেসব হিসেব করেই সর্ববিষয়ে মতামত দেন। এবং এখন প্রতিটি মানুষের প্রতিটি কথাকেই ভোটের কথা ধরে নেওয়া হবে।

একটি টেলিভিশন চ্যানেল আমাকে ফোন করে পাগল করে দিল ক'দিন। টুম্পা নিয়ে বাইট চাই। বললাম দেবো। একবার কলকাতায় বলল, এক্ষুনি আসছি। এলো না, আমি বর্ধমানে চলে এলাম। বর্ধমানে ফোন করে বলল, স্যার, এক্ষুনি একজন যাচ্ছে। এলো। সবিস্তারে বললাম। আমার কথাগুলো ওদের মন মত হয়নি। ওরা ভেবেছিল, মুখে কথা বসিয়ে দেবে। সেটা হল না। কারণ আমিও রাজনৈতিক কর্মী। সাংবাদিকতাও করেছি কয়েক বছর। কী কথা কে শুনতে চায়, আর আমি কী কথা বলতে চাই, সেটাকে গুলিয়ে দেওয়া অত সহজ নয়। ফলে অত লম্ফঝম্প করে নেওয়া বাইটের একটি শব্দও সম্প্রচারে স্থান পেলো না। এখন ব্রিগেড শেষ, ফলে মিডিয়ার টুম্পাবাজীও শেষ। তাই ভাবলাম এখনই কথাগুলি বলি। সবসময় সংকীর্তনে গলা মেলানো পছন্দ হয় না। কথা একই হলেও একক কন্ঠে একটু নিরালায় বলতে ভালো লাগে।

আমি আসলে জানতামই না, এই গানটা আসলে অন্য একটি তুমুল জনপ্রিয় গানের প্যারোডি। বুঝলাম আমি নামক মানুষটা 'তিনি বৃদ্ধ হলেন'। তারপর একদিন মূল গানটি শুনলাম। আমি হতচকিত, এমন অশ্লীল কদর্য ইঙ্গিত কোনো গানে থাকতে পারে আমার ধারণা ছিল না! কামনা-বাসনা-বঞ্চিত সাধারণ মানুষের অবদমিত কামনার এমন পণ্যায়ন খুব কমই দেখেছি। হিন্দি ছবির 'তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত' বা মমতাজের 'বুকটা ফাইট্যা যায়' বা 'গুলিস্তানের মোড়ে বইসা বন্ধু বেচে পান' এর কাছে হার মানবে। যা নিয়ে বিতর্ক, সেই টুম্পার ব্রিগেড সংস্করণটি সম্পূর্ণ বিপরীত আবেদনের। একদম তিনশ ষাট ডিগ্রি উল্টো। আগেই বলছিলাম, এখন জ্ঞানী গুণীদের সাংস্কৃতিক অভিমতও ভোটের তারে বাঁধা। বাংলা গানের এক সম্মানীয় দিকপাল বললেন, সিপিএম-এর টুম্পা প্যারোডিটি কুরুচিপূর্ণ। কিন্তু মূল গানটি একটি অসাধারণ সৃষ্টি। আমি স্তম্ভিত!! নির্বাচনের হিসেব নিকেশ মানুষকে কতটা অন্ধে পরিণত করতে পারে! অবদমিত কামনা-বাসনাকে পণ্যায়িত করে যে গানে অবদমনজাত বিকারের প্রকাশ পেয়েছে সেখানেই তিনি অসাধারণ শিল্প উদ্ভাবন করেছেন। 'তোকে নিয়ে দীঘা যাবো' কথার অর্থ কী বোধহয় তিনি জানেন না। তার চেয়ে বড় কথা টুম্পা নামটির গূঢ় অর্থও সম্ভবত তাঁদের জানা নেই। জনসাধারণ্য থেকে যে দূরত্বে তাঁদের বাস সেখানে এই সাব কালচারের খবর কখনোই পৌঁছয় না। কিন্তু ভুক্তভোগীরা জানে, পশ্চিমবঙ্গের কোন বিশেষ জেলার গ্রামীণ মানুষদের হেয় চোখে উপস্থিত করার জন্যেই এই টুম্পা শব্দটি ব্যবহার হয়। অঞ্চলগত বিদ্বেষ ও অবদমনজাত বিকারের এই বিকৃত ভিয়েনকে তাঁর মনে হয়েছে অসাধারণ সৃষ্টি। আপত্তি যা কিছু তা ওই গানের সিপিআইএম কৃত প্যারোডি নিয়ে যেখানে কোনো বিকৃত কামনা-বাসনার কথা নেই। আছে মানুষের সত্যিকার সমস্যা ও স্বপ্নভঙ্গের কথা।

মূল গানটি শোনার পর আবার নতুন করে ভাবতে বসি টুম্পার ব্রিগেড সংস্করণ নিয়ে। ভাবি কী কী প্রধান অভিযোগ এই গানটি নিয়ে। প্রথম অভিযোগ, গানটি একটি প্যারডি। বলা হল, এক সময়ে যারা হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরীর গানে মানুষকে ডাক পাঠাতেন, তারা এখন প্যারোডির আশ্রয় নিয়ে ব্রিগেডের ডাক পাঠাচ্ছে। সুতরাং এটা নিন্দনীয়। আচ্ছা, এই সমালোচকরা কি হেমাঙ্গ সলিলদের সৃষ্টিগুলির খবর রাখেন? নাকি, শুধু সিপিআইএম বিদ্বেষ থেকে জানা কথাটাও না-জানার ভান করছেন? মহাত্মা গান্ধীর ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ সবচেয়ে সার্থকভাবে পাওয়া যায় যে গানে তা হল 'রঘুপতি রাঘব রাজা রাম, পতিতপাবন সীতারাম, ঈশ্বর আল্লা তেরে নাম, সবকো সম্মতি দে ভগবান'। ১৯৪৭ সালের খণ্ডিত অসম্পূর্ণ স্বাধীনতাকে ব্যঙ্গ করতে হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্যারোডি করলেন এই গানেরই। তিনি লিখলেন, 'রঘুপতি রাঘব মাউন্টব্যাটন, টাটা বিড়লা তেরে নাম, মুঝকো মুনাফা দে ভগবান'। ওই গানটি তৈরি হয়েছিল এক অত্যাচারী দুশ্চরিত্র জমিদারকে নিয়ে লেখা গানের প্যারোডি হিসেবে। মূল গানের কথা ছিল, 'বাবু গোপীচাঁদ রায়/ সুনার পুরী আন্ধার কইরা কই চলিলায়/ ফুয়ায় কান্দে ফুরিয়ে কান্দে, কান্দে বাপে মা'য়/ আর তিনতলাতে বইয়া কান্দে রাসমণি বেইশ্যায়'। হেমাঙ্গ বিশ্বাস এর আদলে লিখেছিলেন, 'মাউন্টব্যাটন সাহেব ও, তুমার সাধের ব্যাটন কার হাতে থুইয়া গেলায় ও/ সর্দার কান্দে পণ্ডিত কান্দে, কান্দে মৌলানায়/ আর মাথাইয়া যে মাথা খুটে বলদায় বুক থাপড়ায়/ তুমার শ্যামা চেট্টি ভক্তবৃন্দে ও, তুমার লেডির গাউন কান্দিয়া ভিজায়'। কেউ কি কখনো বলেছে হেমাঙ্গ বিশ্বাস অন্যায় করেছেন? নেহরু মৌলানা আজাদ সর্দার বলদেব সিংরা মাউন্টব্যাটেনের বিদায়ে শোকে মূহ্যমান হয়ে কান্নাকাটি করে লেডি মাউন্টব্যাটেনের গাউন ভিজিয়ে দিচ্ছেন বলাটা অশ্লীলতা? টুম্পার প্যারোডি এ রকম একটি শব্দও কি আছে? নেই। বরং ওই গান রচনার জন্য যখন সদ্য স্বাধীন দেশের সরকার লর্ড সিনহা রোডের গোয়েন্দা দফতরে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল, সেটাকেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ জ্ঞান করে এসেছেন এতকাল! বাকি রইল, রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে ব্যঙ্গ বক্রোক্তির কথা গানে বলার প্রসঙ্গ। এ নিয়ে বলতে গিয়ে যারা হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরীর কথা বলে সামাজিক গণমাধ্যম ও টেলিভিশন চ্যানেলকে কাঁপিয়ে দিচ্ছেন তারা কি সত্যিই হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরীর গান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।ওই মাউন্টব্যাটন মঙ্গলকাব্য গানটিই আবার শুনুন। সেখান একটি কথা আছে, 'রাম গেলা বনবাসো বেউলা অইলা রাড়ি/ যুগল ব্যাটন বিলাত গেলা, কান্দে কেটায় রে? রাজাগোপালাচারী'। এর চেয়ে বেশি বক্রোক্তি ও ব্যঙ্গ আছে কি কোনো রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী নিয়ে ওই ব্রিগেড যাওয়ার টুম্পায়? সলিল চৌধুরীর 'ও ভাইরে ভাই, মোর মত আর দেশপ্রেমিক নাই' গানেও যে তীব্র শ্লেষ ও ব্যঙ্গ স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে সম্পর্কহীন কংগ্রেস নেতাদের নিয়ে তার কত শতাংশ 'ব্রিগেড-টুম্পা'য় আছে? চল্লিশের দশক থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময় অবধি প্রতিবাদী গানে তো চিরকাল প্যারোডি ও ব্যঙ্গ বিদ্রুপের ছড়াছড়ি। বিদেশেও শুনেছি রাজনৈতিক গানে প্রচুর প্যারোডির ব্যবহার। পরের অভিযোগ, মূল গানের স্রষ্টাদের অনুমতি না নিয়ে প্যারোডি করা। এটাও একটা আশ্চর্য কুযুক্তি। আমি জানি না 'দাদাঠাকুর' বা 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ' ছবিতে ব্যবহৃত দু'টি প্যারোডি মূল গানের স্রষ্টার অনুমতি নিয়ে তৈরি হয়েছিল কিনা। নিশ্চয়ই সম্ভব নয়। কারণ ওই দুটি ছিল পরম্পরাগত প্রার্থনা সঙ্গীতের প্যারোডি।

একটি কথা বলার। অধিকারহীন বঞ্চিত প্রান্তিকায়িত পদদলিত জনসমাজের মধ্যে অবদমিত বাসনা বা কামনার একটি স্বাভাবিক বিষয়। তবে অবদমিত বাসনা শুধুমাত্র আর্থ সামাজিক দিক থেকে প্রান্তিক মানুষের মধ্যেই থাকে না। অবদমিত কামনার একটি সংস্কৃতি আছে, রাজনীতিও আছে। আর্থ সামাজিক অবস্থান বিশেষে তার ধরনটা আলাদা। পদদলিত বঞ্চিত মানুষের মধ্যে যেমন উচ্চকোটির মানুষের মত ধনী হওয়ার সাধ থাকে, রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার বাসনা থাকে, তেমনি থাকে নানা অবদমিত কামনা পূরণের স্বপ্ন। আর্থিক সঙ্গতি, রাজনৈতিক ক্ষমতার পাশাপাশি বাধাহীন যৌন আকাঙ্ক্ষা পূরণের অবদমিত বাসনাও থাকে। শ্রেণি বৈষম্যের সমাজ ব্যবস্থা যেমন তার আর্থ সামাজিক আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথে বাধা, তেমনি পশ্চাৎপদ সাংস্কৃতিক চেতনা, অন্ধ ধর্মবিশ্বাস ও আচারসর্বস্বতার শৃঙ্খল তাকে নরনারীর সম্পর্ক, বিশেষ করে প্রেম ও যৌনতা নিয়ে এমন এক বদ্ধমূল ধারণার কারাগারে বন্দী করে যে সেখান থেকেই জন্ম হয় যৌনতা বিষয়ক অবদমিত কামনার। সামন্ততান্ত্রিক সংস্কারের কারাগারে বন্দী উচ্চকোটির ধনী সমাজেও নরনারীর পারস্পরিক সম্পর্ক নানা ধরনের আচারসর্বস্ব নিষেধাজ্ঞার দ্বারা শাসিত। ফলে অবদমনজাত বিকারের প্রকাশও সেখানে কোনো অংশে কম নয়। হয়ত বেশিই। আবার সেনাবাহিনীর সদস্যদের সমাজ সংসার থেকে দূরত্বে ঘেরাটোপের কঠোর শৃঙ্খলার জীবনও অবদমিত কামনার নানা বিকৃত প্রকাশের জন্ম দেয়। এই অবদমিত কামনা-বাসনাকে বাজার পণ্যে রূপান্তরিত করে। প্রান্তিক মানুষের সকল ধরনের চাওয়া পাওয়াকে অবদমনজাত বিকারের রূপ দিয়ে বাজার জাত করে। উল্টোদিকে, বামপন্থীদেরও কর্তব্য এই অবদমিত কামনা-বাসনাকে উপেক্ষা না করা। কারণ শোষক শ্রেণিকে ক্ষমতাচ্যুত করার ইচ্ছেরও জন্ম হয় অবদমন থেকে। বামপন্থীরা প্রান্তিক মানুষের কামনা বাসনাকে উপেক্ষা করে না। বরং তাকে যোগ্য স্বীকৃতি দিয়ে ব্যক্তিগত ইচ্ছাপূরণের অন্ধগলি থেকে তাকে মুক্ত করে মানুষের সামূহিক স্বপ্নে পরিণত করে। যার মধ্য দিয়ে দিনবদলের লড়াইয়ে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে চায়। এই লড়াই একইসাথে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক।

দেশে দেশে বামপন্থীরা আরো একটি কাজ করে, তা হল শাসকশ্রেণীর রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে অন্তর্ঘাত তৈরি করে একটি ভিন্ন অভিমুখ তৈরি করা। এই প্রগতিমুখী অন্তর্ঘাতই শাসকশ্রেণীর মতাদর্শের কবলে থাকা মানুষকে সুড়ঙ্গের শেষে থাকা আলোটি দেখিয়ে দেয়। এটা একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সাংস্কৃতিক গেরিলা যুদ্ধ। মূল ধারায় প্রবেশ করে তার পাঁক গায়ে না মেখেই সেখান থেকে একটি ভিন্ন বর্হিপথ তৈরি করা। অনেকটা মোহহীন হয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশ নেওয়ার মত, যেভাবে সংসদীয় গণতন্ত্রের অংশ হয়েই এই ব্যবস্থা থেকে একটি মহত্তর উত্তরণের পথ খোঁজার মত। 'টুম্পা, তোকে নিয়ে ব্রিগেড যাবো' গানটি আমার কাছে ওই প্রয়োজনীয় কালচারাল সাবভার্সন বা অন্তর্ঘাতই মনে হয়েছে আমার বিবেচনায়। মূল গানটি গেয়ে সরস্বতী পুজোয় নেচেছিল পশ্চিমবঙ্গের তরুণ তরুণীরা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃণমূল ছাত্র পরিষদ ওই গানেই সরস্বতী পুজোর শোভাযাত্রা করেছে। অবদমিত কামনার বিকৃত রসের গানে বুঁদ হয়ে থাকা তরুণ সমাজকেই নিশানা করেছে বামপন্থীদের প্যারোডি। বলতে চেয়েছে, অবদমনজাত বিকারের ওই অশ্লীলতায় নেশাগ্রস্ত হয়ো না, বন্ধুরা। তার বদলে এসো এই ব্রিগেডমুখী জীবনের মিছিলে। দীঘায় হোটেল বাস ও আনুষঙ্গিক বিকৃত জীবনাচারের পথ যৌবনের পথ হতে পারে না। যৌবনের পথ দ্রোহের ময়দান ব্রিগেডের দিকে। টুম্পার মূল গান ও ডিজে বাহিত তার উন্মাদনা ভুলিয়ে দিতে চায় এই বাস্তবতাকে যে এ রাজ্য ও কেন্দ্রের দু'টি সরকারের জনবিরোধী নীতির ফলে যৌবনের সামনে কোনো এগিয়ে যাওয়ার পথ নেই। গোটা সমাজটাকেই দিশাহীন করে দিতে চায়। কর্মসংস্থান বন্ধ। শিল্প নেই। ডিজের তালে তালে নাচতে নাচতে অবদমনজাত কামনা পূরণের বিকারগ্রস্ত নেশায় বুঁদ হয়ে যেন ভুলে যায় 'দুই ফুল, এক মালীর' রাজনীতিটাই একমাত্র রাজনীতি নয়। একটা অন্য বিকল্প রাজনীতিও রয়েছে চোখের সামনে। ওরা চাইছে অন্ধ গলিতে ঢুকে পড়ুক এ রাজ্যের যৌবন। বামপন্থীদের প্যারোডি ওই অন্ধগলি থেকে এ রাজ্যের যৌবনকে ব্রিগেডের ঝলমলে সবুজে ফিরিয়ে আনতে চায়। সেজন্যেই সাবভার্ট করার জন্যে বেছে নিয়ে বাজারের হিট গানটিকেই। সিপিআই(এম) সমর্থক তরুণদের এই প্যারোডি মূল গানের চেয়েও জনপ্রিয় হয়েছে। তার কারণ তারা সফলভাবে কামান দাগতে পেরেছে সরাসরি সদর দপ্তরে। এজন্যেই সমালোচনার স্বরকে ছাপিয়ে গেছে বিরুদ্ধতার কুৎসা। এই কুৎসাও এতটাই অন্ধ যে প্যারোডিকে নিন্দা করতে গিয়ে বিকৃত রসের মূল গানটিকেই প্রশংসা করতে হয়েছে অনেককে। সাবভার্ট বা অন্তর্ঘাত তো নানা ভাবেই হয়। কখনো বাজার পরম্পরাগত গভীর বোধের গানকে চটুল বাণিজ্যে পরিণত করে। কখনো ইতিবাচক অন্তর্ঘাতে অনেক বাজার চলতি চটুল গানেও চমকপ্রদ ইতিবাচক উত্তরণ ঘটে। একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমরা সবাই প্রায় জানি সুফিভাবনার কাওয়ালি 'দম মস্ত কলন্দর'কে কীভাবে চটুল স্থূল রুচির 'তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত' এ রূপান্তরিত করা হয়েছিল মুম্বাইয়ের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে। সুফি গানের অনুরাগী মানুষেরা এই কদর্য পণ্যায়নে গভীর দুঃখ পেয়েছিলেন। কারণ মূল গানটি তাঁদের কাছে উপাসনা সঙ্গীতের মত। বরাক উপত্যকার এক যাযাবর ফকিরি গানের শিল্পী মীর আবদুল মান্নান 'তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত' গানে এক অভিনব অন্তর্ঘাত করেছিলেন একান্তে। তিনি তাঁর দারিদ্র্যের সঙ্গী জীর্ণ বেহালাটি বাজিয়ে গাইতেন, 'জিনিসটা বড় ভালা, জিনিসটা বড় ভালা, যে জিনিসের লাগিয়া হায় দুনিয়া উতলা'। যে গানটি ছিল প্রেমহীন কদর্য যৌন ইঙ্গিতে ভরা, তাকে প্রেমের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন মীর আবদুল মান্নান যাকে আমরা 'মামু' বলে ডাকতাম।

তবে কি আমার কোনো সমালোচনা নেই এই গান নিয়ে? অবশ্যই আছে। আমার আপত্তি 'টুম্পা' শব্দটি নিয়ে। কারণ এই 'টুম্পা' শব্দের মধ্যে একটি বাজার চলতি জাতিগত বা আঞ্চলিক অবমাননার ইঙ্গিত রয়েছে। যারা জানেন তারা জানেন এই শব্দের পুরো অর্থ টিপিক্যাল আনএডুকেটেড মিডনাপুরিয়ান পিপলস অ্যাসোসিয়েশন। আমার ধারণা মূল গানের স্রষ্টারা 'টুম্পা' শব্দের এই অর্থ জেনে বুঝেই তাদের গানে ব্যবহার করেছে। সেজন্যেই 'টুম্পা' শব্দের সাথে সংযোজিত হয়েছে দীঘা যাওয়ার ব্যাপারটি। সম্ভবত প্যারোডি যারা তৈরি করেছে তারা 'টুম্পা' শব্দের এই গূঢ়তর আঞ্চলিক অবমাননার বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। বামপন্থীরা যত ভুলই করুক, কখনো জাতিবিদ্বেষ বা আঞ্চলিক অবমাননাকে পোষণ করবে না। শিলচরে এক সময়ে একটি অবাঙালি জনগোষ্ঠীর অশুদ্ধ বাংলা উচ্চারণকে উপজীব্য করে একটি কৌতুক নক্সা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। বিশাল বাণিজ্যিক সাফল্যও পেয়েছিল সেই কৌতুক নক্সা। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ওই কৌতুক নাটকটি তৈরি করেছিলেন তৃতীয় থিয়েটারের সাথে যুক্ত কিছু বামপন্থী নাট্যকর্মী। একটি বিশেষ অবাঙালি জনগোষ্ঠীর বাংলা যথাযথভাবে বলতে না-পারাকে এভাবে ব্যবহার করা আমার তখনই আপত্তিজনক ঠেকেছিল। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, তাঁরা কিছুতেই মানতেন না যে এতে কোনো ধরনের আপত্তিকর জাতিগত ঘৃণা রয়েছে। বলতেন এটা একটা বিশুদ্ধ হাস্যরস। এই না-মানতে পারাটা বা বুঝতে না-পারাটা প্রকৃতপক্ষে এক ধরনের জাতিগত সংখ্যাগুরুবাদিতার প্রকাশ। টুম্পার প্যারোডির প্রেক্ষিতে এই কথাগুলো বলার কারণ এটাই যে ওই জাতিগত অবমাননাকর কৌতুককে যাদের আপত্তিকর মনে হয়নি, তাদের অনেকেই এখন টুম্পা নিয়ে মুখর। আসলে এটাও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ব্যাপার।

আমার আপত্তি এটি। আর বলার কথাও আরেকটি। আপত্তি 'টুম্পা' নামটি নিয়ে। দীঘাকে যেমন সাবভার্ট বা অন্তর্ঘাত করে ব্রিগেড করা হয়েছে, তেমনি টুম্পাটাও রুম্পা বা শম্পা করে দিলে আঞ্চলিক অবমাননার দায়মুক্ত হত গানটি। আর বলার কথাটি হল, এই গানের সমর্থকরা অনেকেই বলছেন, গণসঙ্গীত এমনটাই হওয়া উচিত এখন। এটাই পথ। আমার মতে এটা সম্পূর্ণ ভুল। গণসঙ্গীতকে সর্বকালেই বৈচিত্র্যময় হতে হবে। কোনো ধরনের এক বগ্গা ছাঁচ সবসময়ই অচল। আবার যারা বলছেন হেমাঙ্গ সলিলের জলাঞ্জলি হয়ে গেল। তারাও ভুল। তারা আসলে হেমাঙ্গ সলিলের সৃষ্টি বা তাদের পথ সম্পর্কে কিছুই জানেন না।

ভোট না থাকলে এত হৈচৈও হত না। একটিমাত্র গানে কোনো ভুবনজয়ও হয় না। পৃথিবীও অশুদ্ধ হয় না।