আরেক রকম ● নবম বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২১ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪২৭

সমসাময়িক

কৃষক আন্দোলন ক্রমশ গণ আলোড়নে পরিণত হচ্ছে


একশো দিন পেরিয়ে গেল। দু'শোর বেশি কৃষকের প্রাণ গেল। কিন্তু কোনো সমাধান সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। অচলাবস্থার নিরসনে কোনো উদ্যোগ নেই। রাষ্ট্র নির্বিকার। রাষ্ট্র যেন মূক ও বধির। এমনকি সংসদের অধিবেশনেও এ বিষয়ে আলোচনা করতে রাজি নয়।

কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মূলধারার প্রচারমাধ্যমে কৃষকদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান আন্দোলন সম্পর্কে কোনো খবর সম্প্রচার প্রায় বন্ধ। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এই দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন নিয়ে খবর প্রকাশিত/প্রচারিত হলে রাষ্ট্র বিরক্তি প্রকাশ করছে। আন্দোলনের পক্ষে বিদেশি রাষ্ট্রনায়কের মন্তব্যে রাষ্ট্র রুষ্ট। বিদেশের সংসদে কৃষক আন্দোলন নিয়ে আলোচনা হলে রাষ্ট্র ক্ষোভ প্রকাশ করছে।

এত ঔদ্ধত্য! এত উপেক্ষা! এত তাচ্ছিল্য! এত অবজ্ঞা!

ওদিকে গ্রামে গঞ্জে, নগরে শহরে শাসকদলের নেতা কর্মীদের তো বটেই কোথাও কোথাও সমর্থকদেরও সামাজিক জীবন বিপর্যস্ত। স্থানীয় সমাজ তাঁদের বর্জন করেছে। বাংলার ধোপা নাপিত বন্ধের উত্তর ভারতীয় সংস্করণে লোটা-নমক বন্ধ। পঞ্জাবের স্থানীয় নির্বাচনে শাসকদল সম্পূর্ণভাবে পরাজিত। দিল্লির পাঁচটি আসনের উপনির্বাচনে গেরুয়া শিবির সম্পূর্ণ অন্তর্হিত। রাষ্ট্র তখন প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি প্রকল্পের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উদযাপন নিয়ে মহাব্যস্ত। সে নাকি এক সাংঘাতিক বিকাশ প্রকল্প! বছরে ৬ হাজার টাকা কৃষকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার প্রকল্প। তাও আবার তিন কিস্তিতে। মানে মাসে ৫০০ টাকা। এবং সব কৃষকের জন্য নয়। তার জন্য ঢাকঢোল পিটিয়ে আসমুদ্রহিমাচল দিবারাত্র প্রচার চলল। কিন্তু কৃষক আন্দোলনের বিষয়ে কোনো সাড়াশব্দ নেই।

আন্দোলনে অবস্থানরত কৃষকও রাষ্ট্রকে পাত্তা দিতে রাজি নন। নতুন তিন কৃষি আইন, যেগুলোকে কৃষক নিজেদের মৃত্যু পরোয়ানা বলে গণ্য করছেন, সেগুলি প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত কৃষক রাজধানীর সীমান্তের রাজপথেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশে প্রতিবাদ জানিয়ে যাবেন। আন্দোলন চলাকালীন আরও কয়েকটি দাবি সংযুক্ত হয়েছে। ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য অর্থাৎ এমএসপি-কে আইনি স্বীকৃতি দিতে হবে। পেট্রো পণ্যের দাম কমাতে হবে। এবং প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ বিলে কৃষিক্ষেত্রের বিদ্যুৎ মাশুল বাড়ানো চলবে না।

নভেম্বর থেকে চলতে থাকা আন্দোলনে দিল্লির চরমপন্থী আবহাওয়ায় বারবার ঋতুবদল ঘটেছে। হাড়কাঁপানো ঠান্ডা, কিছুটা বৃষ্টির পরে এখন উষ্ণতার পারদ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। সামনে অপেক্ষায় খাঁ খাঁ গ্রীষ্ম। কিন্তু খোলা আকাশের নীচ থেকে ‘ঘর ওয়াপসি’ করবেন না বলে শপথ নিয়েছেন কৃষকেরা। ট্র্যাক্টরের খোঁদলে, রাস্তায় চট পেতে, খড়ের বিছানা করে, তাঁবু খাটিয়ে, দিল্লির সীমানায় একশো দিনেরও বেশি কাটিয়ে দেওয়া আন্দোলনরত কৃষকদের জেদ এবং ধৈর্য যেন দিন দিন বাড়ছে। প্রত্যয়ী চোয়াল যেন দিন দিন প্রতিদিন আরও শক্ত হচ্ছে।

গাজিপুর হোক বা টিকরি। কিংবাসিঙ্ঘু। সর্বত্র একই চিত্র।আন্দোলনস্থলের দু’কিলোমিটার আগেই রাস্তা জুড়ে ব্যারিকেড। জাতীয় সড়কে এমনভাবে পাকাপোক্ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে যা দেশের সীমানা এলাকায়ও অনুপস্থিত। এইভাবেই দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে রাজধানী দিল্লির সীমান্তে।

দিল্লির দিক থেকে পৌঁছনোর জন্য জাতীয় সড়কের পাশে বিস্তীর্ণ ঝোপের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা রাস্তা। সকাল থেকেই যেখানে লঙ্গর চালু দফায় দফায়। একশো দিনে যেন অনেকটাই পরিণত হয়েছে আন্দোলন। একটু কি বদলেছেও? কারণ এখন শুধু সীমানায় স্লোগান, বক্তৃতা আর গর্জনেই সীমাবদ্ধ থাকছে না আন্দোলনের ভাবনা। সারা দেশ জুড়েই তো ছোটো ছোটো করে আন্দোলন হচ্ছে, বৈঠক হচ্ছে। হচ্ছে হাজারে হাজারে মানুষের মহাপঞ্চায়েত।হারিয়ে যাচ্ছে জাতপাত সাম্প্রদায়িকতার বিভাজন। উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগরের হিন্দু মুসলিম দলিত আজ একজোট। মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক, বাংলা, তেলঙ্গানা - সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে আইন প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন। অবস্থানরত কৃষকদের নেতারা ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে গিয়েছেন। এখন আর শুধু দিল্লি সীমানায় নয়, গ্রামে গ্রামে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। কিসান মজদুর জনজাগরণ চলছে। পাশাপাশি যে যাঁর গ্রামে মানুষকে সচেতন করছেন। বলা হচ্ছে, যেখানে যখন ভোট আসবে, গেরুয়া প্রার্থীদের বিরুদ্ধে যেন ভোট দেওয়া হয়।

অবস্থানের মধ্যেই নাকি চলছে বিশ্বাসঘাতকতার ষড়যন্ত্র। অনেকেই নাকি শাসকদলের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আন্দোলনের বদনাম করার চেষ্টা করছে। চলছে অন্তর্ঘাতের চেষ্টাও। অথচ ফসল কাটার সময় কৃষকরা চাষের ক্ষেত ছেড়ে এসে মাসের পর মাস রাস্তায় বসে ছিলেন। শুধু উত্তরপ্রদেশেই সরকারের ঘরে চাষিদের পনেরো হাজার কোটি টাকা পড়ে রয়েছে। দু’বছর ধরে বকেয়া টাকা দেওয়া হচ্ছে না। রাস্তায় বসে থাকা কৃষক এখন উচ্চকণ্ঠে প্রকাশ্যে বলছেন যে তাঁরা ভুল করে চোরকে চৌকিদার করেছেন! এই সরকার বেইমান।

কৃষকদের সম্মিলিত সুর, তাঁরা নিজেরা কোনও রাজনৈতিক দলের ছাতার নীচে আসবেন না। তাঁদের নিয়ে কোনও রাজনীতি হোক, এটাও তাঁদের না-পসন্দ। কিন্তু সরকারের উপর রাজনৈতিক চাপ তৈরি করার জন্য ‘জনজাগরণ’ তাঁরা শুরু করে দিয়েছেন। কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গাঁটছড়া না বাঁধলেও বিভিন্ন রকমের সমর্থন কিন্তু ভিড় জমাচ্ছে গাজিপুর, টিকরি এবংসিঙ্ঘু সীমান্তে।ফলে কৃষক এখন যা বলছেন, তাতে কিন্তু তিনটি কৃষি আইন, এমএসপি, মজুতদারদের কথার পাশাপাশি, উঠে আসছে ‘অচ্ছে দিন’ নিয়ে শানিত বিদ্রুপ, লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার বিবরণ, তালি-থালি বাজানো নিয়ে ব্যঙ্গও।

একশো দিনে পৌঁছে টিকরি, সিঙ্ঘু, গাজিপুরের আশা, কেরল, বাংলা, তামিলনাড়ু প্রথমে যোগ না দিলেও ধীরে ধীরে সেখানেও ‘চেতনা’ তৈরি হচ্ছে। শুধু দিল্লির সীমানা নয়, অদূর ভবিষ্যতে উদ্ধত-অহঙ্কারী সরকারকে ঘিরে ফেলবে দেশের গ্রাম, মাটি, শস্য বাঁচানোর এই লড়াই। সেই লড়াইয়ে যোগ দিতে আসছেন বিভিন্ন শ্রমিক কর্মচারীদের সংগঠন। ব্যাঙ্ক কর্মচারীরা ব্যাঙ্কের বি-রাষ্ট্রীয়করণ ও আনুষঙ্গিক দাবি দাওয়া নিয়ে ইতিমধ্যেই দু' দিন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন। দাবি না মিটলে তাঁরা একটানা ধর্মঘটের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রেল, বীমা সহ সমস্ত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প ও পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক কর্মচারী আধিকারিক নিজেদের জীবিকার স্বার্থে আন্দোলনের পথে পা বাড়িয়েছেন। এহেন শ্রমিক সংহতির সাহসে বলীয়ান হয়েই হয়তো নতুন তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিকে সামনে রেখে ফের দেশ জুড়ে ধর্মঘটের ডাক দিল কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংগঠনগুলি। আন্দোলনকারী সংগঠনগুলির তরফে আগামী ২৬ মার্চ এই ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে।

কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবির পাশাপাশি পেট্রল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং রেল বি-রাষ্ট্রীয়করণ বিরোধিতাকেও এ বার আন্দোলনের হাতিয়ার করেছেন কৃষকেরা। কৃষক নেতারা জানিয়েছেন যে পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং রেল বি-রাষ্ট্রীয়করণের বিরোধিতায় দেশজুড়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হবে। এই আন্দোলনে সামিল হবেন শ্রমিক সংগঠনগুলির প্রতিনিধিরাও।

দিল্লির সিঙ্ঘু সীমানায় অবস্থানকারী কৃষকদের সমাবেশে জানানো হয়েছে যে দেশব্যাপী ধর্মঘটের আগে ১৯ মার্চ দেশ জুড়ে ‘মন্ডি বাচাও ক্ষেতি বাচাও’ কর্মসূচি পালন করে হবে। কারণ, নয়া কৃষি আইন চালু করে কিসান মন্ডিগুলি অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে দিতে চাইছে সরকার।

কৃষকদের আন্দোলনকে অবহেলা করে অচলাবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে। সমাজের সমস্ত অংশের ক্ষোভ কৃষকদের আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে এক সর্বাত্মক গণ আলোড়নে পরিণত হতে চলেছে। স্বৈরাচারের পথে চলা বিভাজনে বিশ্বাসী, অহঙ্কার ও হুঙ্কার সর্বস্ব সরকার সেই একত্রিত-পুঞ্জীভূত গণ আলোড়নের সামনে কতদিন টিকে থাকতে পারে সেটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।