আরেক রকম ● নবম বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২১ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪২৭
সম্পাদকীয়
ধর্মনিরপেক্ষতার প্রহরী হোন, ধর্মাবতার
দেশ স্বাধীন হয়েছে ৭৫ বছর হতে চলল। স্বাধীনতার পাওয়ার জন্য যেই ঐতিহাসিক আন্দোলন তৈরি হয়েছিল তার ভিত্তিতে ভারতের সংবিধানকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান হিসেবে গড়ে তোলা হয়, যেখানে সমস্ত ধর্মের মানুষ নির্দ্বিধায় তাদের ধর্ম পালন করতে পারবেন। কিন্তু ভারতীয় জনতা পার্টি ও সংঘ পরিবার ভারতের সুমহান বিবিধতার ঐতিহ্যের সরাসরি বিরোধী অবস্থানে দাঁড়িয়ে। তাই ৪০০ বছর আগে রাম মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরি হয়েছিল এই মিথ্যা প্রচার করে তারা বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে। আজ সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ফলে সেখানে রাম মন্দির গড়ে উঠছে।
অনেকে হয়ত ভেবেছিলেন যে, এই বিবাদের মীমাংসা হওয়ার ফলে দেশে মন্দির মসজিদ রাজনীতির অবসান হবে। নতুন করে আবার কোনো বিতর্ক দানা বাঁধবে না যে অমুক স্থানে মন্দির ছিল যা ভেঙে মসজিদ অথবা গির্জা গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু রাজনীতি অত সরল মনের মানুষের কাজ নয়। বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়ার সময় থেকেই সংঘ পরিবার প্রচার করে এসেছে যে, বাবরি মসজিদ কোনো একক বিষয় নয়, বরং এক দীর্ঘ হিন্দুত্ববাদী জঙ্গী রাজনীতির সূচনা। তাই বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার স্লোগানের পাশাপাশি বলা হত যে কাশী এবং মথুরার মসজিদের হালও বাবরি মসজিদের মতই করা হবে, সেগুলিকে ধ্বংস করে সেখানে মন্দির নির্মাণ হবে।
এই দাবি সংঘ পরিবার উত্থাপন করলেও একটি বাধা ভারতের সংসদ খাড়া করেছিল। ১৯৯১ সালে বাবরি মসজিদ বিবাদ যখন তুঙ্গে, সেই সময়, ভারতের সংসদে একটি আইন পাশ হয় - ধর্মীয় প্রার্থনাস্থল সম্পর্কিত আইন। এই আইনে বলা হয় যে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের আগে ভারতের মধ্যে অবস্থিত সমস্ত ধর্মীয় স্থলের যা চরিত্র ছিল, তাই বজায় রাখা হবে এবং কোনো অবস্থাতেই কোনো ধর্মীয় স্থলের চরিত্র বদল করা যাবে না। একমাত্র বাবরি মসজিদকে এই আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছিল। ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে যখন সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদ রামজন্মভূমি সংক্রান্ত রায় প্রদান করেন, সেখানেও বিচারপতিরা এই আইনের উল্লেখ করে বলেন যে, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করার জন্য এই আইন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা বলেন, ১৯৯১ সালের এই আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় হস্তক্ষেপ যা ভারতের ধর্মস্থানগুলিকে অপরিবর্তনীয় ঘোষণা করে, যা দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার এক প্রয়োজনীয় উপাদান। অতএব, সুপ্রিম কোর্টের এই বক্তব্যের পরে এই কথা আলাদা করে বলে দিতে হয় না যে এই আইন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের একটি মৌলিক উপাদান।
কিন্তু তা বলে হিন্দুত্ববাদীরা চুপ করে বসে নেই। তারা দেশের সুপ্রিম কোর্টে একের পর এক মামলা দায়ের করছেন এই দাবি নিয়ে যে ১৯৯১ সালের ধর্মীয় প্রার্থনাস্থল সংক্রান্ত আইনকে অবৈধ ঘোষণা করতে হবে। তাদের মতে রামজন্মভূমি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট যেই কথাগুলি বলেছিল তা আদালতের পর্যবেক্ষণ, রায় নয়। অতএব, আদালত আবার পুনর্বিবেচনা করুন।
দুঃখের বিষয় মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ এই মামলাগুলিকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ না করে, তা গ্রহণ করেছে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই বিষয় হলফনামা প্রদান করার নির্দেশ দিয়েছে। যেই বিতর্ক উসকে উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তি দেশে ক্ষমতা অর্জন করেছে, বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছে, সাম্প্রদায়িকতার বিষে দেশের আকাশ-বাতাস বিষিয়ে দিয়েছে, তাদের এই অন্যায় সাম্প্রদায়িক আবদারের কোনো সারবত্তা আছে কি না, তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট পুনরায় বিতর্ক চাইছেন!
মনে রাখতে হবে, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের অধীনে গঠিত আদালত। সংবিধানের জন্মের মধ্য দিয়েই আধুনিক সুপ্রিম কোর্টের জন্ম। সংবিধান গৃহীত হয় ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি। অতএব এই তারিখের আগে বর্তমান সুপ্রিম কোর্টের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তাই পরাধীন ভারতে ধর্মের নামে কী ঘটেছে, সেই বিতর্ককে আবার গণপরিসরে আসতে দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট, দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, সাম্প্রদায়িক শক্তির মনোবল বাড়াচ্ছেন। যেখানে একটি পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ বাবরি মসজিদ মামলার রায়ে সুস্পষ্টভাবে ১৯৯১ সালের আইন নিয়ে তাঁদের বক্তব্য রেখেছেন, সেখানে তিন সদস্যের বেঞ্চ কীভাবে সেই বিষয় আবার শুনানি চালাবেন?
আমরা মনে করি এই বিতর্কের অবিলম্বে অবসান হওয়া উচিত। ১৯৯১ সালের আইন যদি বাতিল হয় বা তাকে দুর্বল করে তোলা হয়, তবে সংঘ পরিবারের দীর্ঘদিনের যে স্বপ্ন, ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করে মুসলমান সমাজকে হেয় করে, তাদের প্রার্থনাস্থলকে ধ্বংস করে ক্ষমতা দখল করা, তা আবারো শুরু করার অজুহাত তারা পেয়ে যাবে। এই পোড়া দেশে ধর্মের নামে হানাহানি বন্ধ করতে হলে, কোনো ঐতিহাসিক স্মারককে বাঁচাতে হলে, ধর্মনিরপেক্ষতার ভিতকে আরো মজবুত করতে হলে ১৯৯১ সালের এই আইনকে বলবত রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা মহামান্য আদালতের কাছে আর্জি জানাব, ধর্মাবতার, ধর্মের নামে হানাহানির পথ প্রসস্ত করবেন না। অবিলম্বে সিদ্ধান্ত নিন যে ১৯৯১ সালের আইন বৈধ এবং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য জরুরি। রাম মন্দির বানানোর রায় দান করে যে ভুল আপনারা করেছেন, তার পুনরাবৃত্তি করবেন না। পাড়ায় পাড়ায় দাঙ্গাবাজদের দল যাতে অমুক মন্দির মসজিদ ভেঙে তৈরি হয়েছিল অতএব আমরা তা ভেঙে আবার মন্দির গড়ব - এই দাবি তোলার সাহস না পায়, তার জন্য ১৯৯১ সালের আইন বাতিলের দাবিকে নস্যাত করুন।
ইতিহাস কিন্তু সাক্ষী থাকছে। একদিন সময়ের আদালতে আপনাদেরও বিচার হবে। সেদিন সাক্ষী দেবে ইতিহাস। সেদিন যেন সে গর্ব করে বলতে পারে যে ভারতের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট ধর্মের নামে রাজনীতির কারবারিদের পথ রুদ্ধ করে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতে দ্বিধা করেনি।