আরেক রকম ● নবম বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২১ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪২৭
সম্পাদকীয়
দলবদলের নয়, দিনবদলের লড়াই হোক
ভারতের রাজনীতিতে ঘোড়া কেনাবেচা কথাটা খুব প্রচলিত। ভোটের আগে বা পরে টাকার বিনিময়ে একটি দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা অন্য দলে চলে যাচ্ছেন এবং তাঁদের সমর্থনে সরকার গড়া হচ্ছে, এই দৃশ্য খুব অপরিচিত নয়। তবে দৌড়ে পশ্চিমবঙ্গ এতদিন শামিল ছিল না, ঘোড়া কেনাবেচা মূলত গোবলয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। পশ্চিমবঙ্গ যেহেতু দেরিতে যোগ দিয়েছে এই দৌড়ে, তাই মনে হচ্ছে যেন তেন প্রকারেণ তাকে প্রথম ল্যাপেই উসেইন বোলটের মত ছুট লাগিয়ে অগ্রজদের সমান হতে হবে। ফলস্বরূপ যেটা হচ্ছে - ঘোড়া নয়, আস্তাবল কেনাবেচা চলছে।
হিসেব করে দেখা গেল, তৃণমূল থেকে বিজেপি-তে এ পর্যন্ত পঞ্চাশের উপর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা গিয়েছেন, তাও এর মধ্যে পঞ্চায়েতের হিসেব ধরা হয়নি। এই জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে বিধায়ক, সাংসদ, প্রাক্তন বিধায়ক, পৌরপিতারা আছেন। বিজেপি থেকে তৃণমূলে এসেছেন, সংখ্যাটা কম হলেও একদম শূন্য নয়। অবশ্য তাঁদের মধ্যে জনপ্রতিনিধি কম, কিন্তু বিশিষ্ট নেতানেত্রীরা আছেন, যেমন বাঁকুড়ার সাংসদ সৌমিত্র খাঁ-এর স্ত্রী সুজাতা খাঁ। তবে মূল ট্রেন্ডটা দেখা যাচ্ছে, বিজেপি টাকার থলি নিয়ে লোকজনের দরজায় দরজায় ঘুরছে, ঠিক যেরকমভাবে পুরনো দিনের কলকাতার কোনো কোনো বাসের কন্ডাক্টর বাস থামিয়ে প্রায় মানুষের বাড়িঘরে গিয়ে ডেকে ডেকে এনে বাসে তুলতেন, সেরকমভাবে বিজেপি নেমে পড়েছে। তৃণমূলের নেতারাও টোপ গেলবার জন্য হাঁ করেই ছিলেন, কারণ তাঁদের দল এখন ডুবন্ত জাহাজ, যেখান থেকে ইঁদুরেরা আগে পালায়। এই ডুবন্ত জাহাজেই একসময়ে সারদা, নারদা, টেট, আপার প্রাইমারি, আম্পান ইত্যাদি বহুবিধ দুর্নীতিজাত চালের কণা সঞ্চিত ছিল, যেগুলো খেয়ে পেটমোটা করেছে এই ইঁদুরের দল। এখন তাদের হঠাৎ মনে হয়েছে যে দলে থেকে মানুষের জন্য কাজ করা আর সম্ভব হচ্ছে না, কারোর কারোর আবার শ্বাসরোধ হয়ে আসছে ! তাই সুপারকম্পিউটারের হার্ডড্রাইভ ট্রান্সফার করবার মত গতিবেগে তৃণমূল সাফ করে জনপ্রতিনিধি ও নেতানেত্রীরা লাফ মারছেন বিজেপি-তে। বিধায়কের টিকিট না পেয়ে যেমন এক নেত্রী কাঁদতে কাঁদতে নিজের হৃদয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রেখেই পাড়ি দিলেন অন্য দলে। অথবা সিঙ্গুরের তথাকথিত সৎ মাস্টারমশাই, যিনি টিকিট না পেয়েই বিজেপি চলে গেলেন। এই হল এঁদের চরিত্র! আর এঁদের এতদিন আমরা ভোট দিয়ে এসেছিলাম!
এতদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দলবদলের থেকে বেশি হয়েছে দল ভাঙার ঘটনা। সিপিআই ভেঙে সিপিআই(এম), সেখান থেকে নানা নক্সালপন্থী দল, অথবা কংগ্রেস ভেঙে বাংলা কংগ্রেস, পরবর্তীকালে তৃণমূল কংগ্রেস, এবং তখনো এক দল থেকে অন্য দলে অনেক নেতা কর্মীরা চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাম দলগুলিতে তো বটেই, অন্যান্য দলের ক্ষেত্রেও এই বদলের ঘটনাটা ছিল অনেকটাই নীতি আদর্শের ভিত্তিতে, অথবা ক্ষমতা দখলের অঙ্কে। টাকার প্রশ্নটা সেখানে গৌণ ছিল। যেমন তীব্র বামবিরোধী অজয় মুখোপাধ্যায় যখন বাংলা কংগ্রেস গঠন করলেন, তাঁর ব্যক্তিগত সততা নিয়ে কেউ আঙুল ওঠাতে পারেনি। অথবা প্রফুল্ল সেন। বামদলগুলোর কথা বাদই দেওয়া হল কারণ তাঁদের সততা একটি অনুসরণযোগ্য চারিত্রিক গুণ ছিল। আজকের দিনের এই দলবদলকারী নেতানেত্রীদের সঙ্গে তাই অজয়বাবু বা প্রফুল্ল সেনের তুলনাই চলে না, আর ঠিক এই কারণেই এই টাকার বিনিময়ে দলবদল ব্যাপারটা নতুন। বাংলার রাজনীতিতে আগে এত টাকার ছড়াছড়িও ছিল না, এবং অল্পবিস্তর দুর্নীতি হলেও কোনো দলেই হাজার কোটি টাকার নয়ছয়ের অভিযোগ ওঠেনি, না বাম, না কংগ্রেস। কিন্তু তৃণমূল এসে প্রথমেই যেটা করেছে, সারদার মাধ্যমেই মূলত, এই সংস্কৃতিটাকে ভেঙে দিয়ে বিহার বা উত্তরপ্রদেশের মত একটা টাকার উপর বসে থাকা রাজনীতির সংস্কৃতিকে মান্যতা দিয়েছে। এমনকি কলেজগুলিতে ভর্তি করা নিয়েও একসময়ে তাদের ছাত্র সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে যেরকম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল সেটা অভূতপূর্বই বলা যায়। কিন্তু তৃণমূল যেটা হয়ত বুঝেও বোঝেনি, একবার বাঘের গুহার মুখ খুলে দেবার পর বাঘ তো বেরবেই, তার পেছন পেছন বেরিয়ে আসবে বাঘের থেকেও করাল ও হিংস্র জীবের দল। এবার আসরে নেমেছে বিজেপি, যাদের টাকা ও দুর্নীতির পরিমাণের কাছে তৃণমূলও শিশু। কয়েক হাজার কোটি টাকা নিয়ে তারা এবার তৃণমূলকেই তাদের নিজেদের খেলায় কিস্তিমাত করে দিচ্ছে। ব্যাপারটা আয়রনিক, কিন্তু তৃণমূলের এই দুর্দশায় কাব্যিক বিচারের আনন্দটা এখানে অনুচিত, কারণ গণতন্ত্র ও বামপন্থার প্রতি আমাদের দায়।
যেহেতু 'আরেক রকম' ঘোষিতভাবেই বামপন্থার পক্ষে এবং স্বৈরাচার ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে, সেই পক্ষাবলম্বনের দায় থেকেই যে আশঙ্কা আসছে, তা হল - রাজনীতি কি তাহলে এভাবেই তার সিরিয়াসনেস হারিয়ে ফেলছে? যে জনপ্রতিনিধিরা মানুষের সেবায় জীবন উৎসর্গ করবেন বলে ভাবা হয়েছিল একদা, তাঁরা আসলে এটাকেও টাকা রোজগারের রাস্তার বাইরে আর কিছুই ভাবছেন না? একইসঙ্গে সিনেমা ও সিরিয়ালের নায়ক নায়িকাদের এই এ রাজনীতিতে যোগদানের হিড়িক, সকলেই নাকি মানুষের জন্য কাজ করতে চান, এবং দলে যোগ দেবার দুই দিনের মধ্যে ভোটের টিকিট পেয়ে যাচ্ছেন, এই ব্যাপারটাও কি আসলে সেই একই ইঙ্গিত দিচ্ছে না? যে, রাজনীতি তার সিরিয়াস ব্যাপারটা হারিয়ে ভাঁড়ামি ও তামাশায় পর্যবসিত হচ্ছে, এবং এক ধরনের লুম্পেন সংস্কৃতি এসে সরিয়ে দিচ্ছে মানুষের জন্য সত্যিকারের কাজ করবার ব্যাকুলতাকে। লকডাউন, আমফান ইত্যাদি পর্বে কোথাও এই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দেখা যায়নি, হঠাৎ আজ কিছু অর্থের বিনিময়ে তাঁদের মনে মানুষের জন্য কাজ করবার ইচ্ছেটা জেগে উঠছে, এই ব্যাপারটাই হাস্যকর। যে কোনো দলীয় রাজনীতিতেই যোগদানের পূর্বশর্ত হল সেই রাজনীতির দর্শন বিষয়ে চর্চা, পথে নেমে কাজ করা। এঁরা কেউ সেই কাজ করেছেন এই স্তুতি তাঁদের পরম মিত্ররাও করবেন না। এইরকম যেখানে আবহাওয়া, সেখানে ক্ষতিটা একমাত্র বামপন্থীদের হচ্ছে এটা ভাবা ভুল।
ভুল, কারণ বামপন্থা হোক অথবা দক্ষিণপন্থা, যে কোনো নীতিকে টিকিয়ে রাখতে গেলে দরকার পড়ে ব্যক্তিগত সততা, ত্যাগ, আদর্শ। বিজেপি-র দীনদয়াল উপাধ্যায়রা সারাজীবন নাকি শক্ত মেঝের উপর শুয়েছেন, যাতে ভোগ তাঁদের গ্রাস না করতে পারে। অথবা একদা সংঘপ্রধান সুদর্শন, যিনি কপর্দকশূন্য অবস্থায় মারা যান। কিন্তু বর্তমানের এই কোটি কোটি টাকার খেলা বিজেপির-ও আদর্শগত ভিতকে ধসিয়ে দিতে বাধ্য। স্বল্পদিনের লাভের বিনিময়ে তারা নিজের দলেরই দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করে দিয়ে যাচ্ছেন না তো? নাকি বিজেপি-র তথাকথিত মহান হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ বাজারের মাঝখানে কিছু টাকার বিনিময় নিলামযোগ্য? তৃণমূলকে নিয়ে আলাদা করে বলার কিছু নেই কারণ এই দল একটা ক্লাবের মত, দু'দিন বাদেই হয়ত উঠে যাবে। বিজেপি-কে তৃণমূল আটকাবে এই আশায় যারা তৃণমূলকে ভোট দিলেন তাঁরা দেখবেন যে তাঁদেরই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হাতে গেরুয়া পতাকা তুলে নিচ্ছেন। কিন্তু রেজিমেন্টেড দলের ক্ষেত্রে উপরে উল্লিখিত বিপদ থেকেই যায়।
এই প্রসঙ্গেই বামেদের কথায় আসতে হয়। দলবদলের ইতিউতি ঘটনা তাদের মধ্যেও আছে, যদিও সামগ্রিকভাবে সেই সংখ্যাটা নগণ্য। কিন্তু পরে এটা বাড়বে না সেই নিশ্চয়তা নেই। তাই বামেদের আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত, হওয়া উচিত আরও বেশি করে কঠোর, শৃঙ্খলাপরায়ণ। কারণ বামপন্থী রাজনীতি ছাড়া এই টাকার পাঁকে ডুবে থাকা দুর্গন্ধময় বঙ্গীয় রাজনীতিতে আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। লড়াইটা যে আসলে দল বদলের নয়, দিন বদলের, এই সত্যের দায় একমাত্র বামপন্থীদের উপরেই বর্তায়। তাই তাদের দলে এরকম নীতিহীন ঘটনা আরও বেশি করে অবাঞ্ছিত, আরও বেশি করে বেদনার। সততা এবং ন্যায়নিষ্ঠতার যে কোনো বিকল্প এই নয়া উদারীকরণের জমানাতেও নেই, এটা বোঝানোর দায় একমাত্র বামেদের, তাদের কঠোর ও সৎ হওয়াও তাই সময়েরই দাবি।