আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২১ ● ১৬-২৯ ফাল্গুন, ১৪২৭

প্রবন্ধ

ফিরে দেখা মধুসূদনঃ স্বকাল এবং সমকাল

গার্গী সরকার


মধ্যযুগে সৃষ্টির কেন্দ্রে ছিলেন ঈশ্বর। মধ্যযুগের সাহিত্য এক কথায় ধর্মসাহিত্য। মঙ্গলকাব্য থেকে শুরু করে বৈষ্ণব পদাবলী, শাক্তপদাবলী, অনুবাদ সাহিত্য সবই কোনো না কোনো দেব-দেবীর কাছে নতজানু হবার কথা বলে। ব্যক্তির জীবন নিয়তি নির্দিষ্ট বা ঈশ্বর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তাই দেব-দেবীর কৃপা লাভ ভিন্ন আশ্রয় নেই আর। "সকলি তোমারি ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি মা/তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি" কিম্বা "বাজীকরের মেয়ে শ্যামা, তুমি যেমনি নাচাও তেমনি নাচি"- এই ছিল এককথায় মধ্যযুগের জীবনদর্শনের মূল সুর। তবে একথাও মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের দেব দেবীরা কিন্তু প্রথম থেকেই বেশ মানুষ মানুষ। দুর্গা মা মেনকার সঙ্গে কোমর বেঁধে ঝগড়া করেন। উড়নচন্ডী নেশাখোর স্বামী আর চার পুত্র কন্যা নিয়ে সংসার চালাতে নাজেহাল হন। আবার হিমালয় পত্নী মেনকা-ও মেয়ে গৌরী অর্থাৎ উমাকে কথা শোনাতে ছাড়েন না। চন্ডীমঙ্গলের কথায় -
'রান্ধি বাড়ি আমার কাঁকাল্যে হইল বাত
ঘরে জামাই রাখিয়া জোগাব কত ভাত'

পাশাপাশি মনে পড়বে ভোলা মহেশ্বর শিব আর দুর্গার সংসার চিত্রটি -
"আজিকার মত যদি বান্ধা দেহ শূল
তবে সে আনিতে পারি, প্রভু হে, তণ্ডুল"।।

তবে ভক্তকে কৃপা করার প্রশ্নে এঁরাই আবার অকৃপণ। এঁদেরই কাছে নিজের ভালো-মন্দ-হিত-অহিত সমর্পণ করে নিশ্চিন্ত থাকতে চেয়েছে মধ্যযুগের সাধারণ মানুষ। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগের পর থেকেই ছবিটা বদলাতে শুরু করলো একটু একটু করে। ঐ যে অন্নদামঙ্গলে পথে খেলা দেখাতে আসা শিবের গায়ে ধূলো মাটি ছুঁড়েছিল শিশুর দল, সেখান থেকেই দেবমহিমার অবসৃত হবার সূচনা, এমনটাই ভেবেছিলেন 'বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস' লেখক সুকুমার সেন। তবু দেবমহিমা থেকে মানব মহিমায় যথাযথ ভাবে পৌঁছনোর জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয় আরো প্রায় একশো বছর। এক যুগান্তকারী প্রতিভার বিস্ফোরণ নিয়ে যতক্ষণ না উপস্থিত হচ্ছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য নতুন কোনো স্বর খুঁজে নিতে ব্যর্থই ছিল।

পলাশীর যুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার পরাজয় (১৭৫৭) ইংরেজদের বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভের পর থেকেই (১৭৬৪), ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা। বণিকের মানদন্ড ব্রিটিশের রাজদন্ডে পরিণত হতে চলেছে। ১৭৯৩-এর 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত' বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতির ভীতকে ধ্বংস করতে সচেষ্ট হল। গ্রামীণ অর্থনীতির পরিবর্তে গড়ে উঠতে থাকল নগর কলকাতাকে কেন্দ্র করে দেওয়ানি-জমিদারি-মুৎসুদ্দিগিরি নির্ভর অর্থনীতি। ইতিমধ্যে হুগলীর শ্রীরামপুর মিশনে ছাপাখানা চালু হল। আর হাতে লেখা পুঁথি নয়, যন্ত্রে ছাপা বই প্রকাশিত হতে শুরু করলো। উনিশ শতক বাংলাদেশের পরিবর্তনের কাল, নবজাগরণের সময়। কিন্তু সেই নবজাগরণের পটভূমি, বৈশিষ্ট্যকে না জানলে মধুসূদনের আগমনকেও ব্যাখ্যা করা যাবে না।

মধ্যযুগ যদি দেবমহিমা বা তন্ময়তার কাল হয়, তাহলে উনিশ শতক নিঃসংশয়েই মানবমহিমার যুগ। মানুষের শ্রম, ব্যক্তির আত্মপ্রতিষ্ঠার স্বীকৃতির সময় উনিশ শতক। ইংরেজরা এদেশে আসার পর শাসন ব্যবস্থা চালানোর উপযোগী বাংলা জানা কর্মচারীর প্রয়োজন অনুভব করেছিল। সেখান থেকেই ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ স্থাপন। আর তারপর ইংরেজদের নতুন রাজা জেনে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রয়োজন অনুভব করল বাঙালিরাই। তাই হিন্দু কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ এসেছিল হিন্দুদের পক্ষ থেকেই। ১৮১৭-তে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তার ও চিন্তা-যুক্তি-বুদ্ধি-র অনুশীলনের আকর ক্ষেত্র হয়ে উঠতে থাকল। ভবিষ্যতে মধুসূদন-ও যে প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হবেন। যোগীন্দ্রনাথ বসুর ভাষায় -
"মধুসূদন যে সময়ে হিন্দু কলেজে প্রবেশ করিলেন,
তখন ইহার পূর্ণ যৌবনাবস্থা। ছাত্রদিগের ও শিক্ষকগণের
গৌরবে হিন্দু কলেজ তখন বঙ্গদেশের বিদ্যালয়
সমূহের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করিয়াছিল।
যদিও জিরোজিও সে সময় কলেজ ত্যাগ করিয়াছিলেন
তথাপি সুপ্রসিদ্ধ, কাপ্তেন রিচার্ডসন, গণিতশাস্ত্রবিদ
রিজ, হালফোর্ড এবং ক্লিন্ট প্রভৃতি সে সময়কার
প্রসিদ্ধনামা অধ্যাপকগণ ইহাতে অধ্যাপনা করিতেন।
.... সুতরাং মধুসূদন, সে সময়ে এদেশের পক্ষে
যতদূর সম্ভব ততদূর উৎকৃষ্ট শিক্ষালাভের সুযোগ প্রাপ্ত
হইলেন।"

১৮১৭ তে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশের পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কাল হল ১৮৩৫। একদিকে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা অন্যদিকে লর্ড মেকলে প্রকাশিত ঐতিহাসিক মিনিটে শিক্ষা বিস্তারের বাহন হিসেবে ইংরেজি ভাষাকে স্বীকৃতি দান পাশ্চাত্য শিক্ষার পরিসরকে আরো উন্মুক্ত করতে থাকলো। শুধু পুরুষদের জন্যেই নয়, নারীদের ও বিদ্যাশিক্ষার প্রয়োজন আছে তাও উপলব্ধির সীমায় আসতে শুরু করলো। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং জন ড্রিঙ্ক ওয়াটার বেথুনের উদ্যোগে ১৮৪৯-এ স্থাপিত হল বেথুন স্কুল। উনিশ শতকের নারী শিক্ষা ও নারী মুক্তির ইতিহাসের প্রথম মাইলফলক এটি। ১৮৫৭-এ স্থাপিত হল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। নব্যতন্ত্রের ধারক ও বাহক হয়ে উঠল পাশ্চাত্য শিক্ষা। আবার শুধু শিক্ষাক্ষেত্রেই নয়, সমাজের অন্ধতার পাঁচিলগুলো-ও ভাঙতে শুরু করল উনিশ শতকেই। ১৮২৯-এ রাজা রামমোহন রায়-এর উদ্যোগে সতীদাহ প্রথা রদ আইন পাশ মধ্যযুগীয় বর্বরতা থেকে মুক্তি দিল। কিন্তু সতীদাহ প্রথার অবলুপ্তি যে বাংলাদেশের বিধবাদের কাঙ্খিত মুক্তি দিতে পারবে না, একথা বুঝেছিলেন বিদ্যাসাগর। তাই বহু বাধা-বিপত্তি-প্রতিরোধ পোড়িয়ে ১৮৫৬-তে চালু হল বিধবা বিবাহ আইন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক উদ্যোগে। সতীদাহ প্রথা রদ, বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়ণ এবং নারীশিক্ষার প্রতিষ্ঠান তৈরি -এ সবের ভিতর দিয়ে উনিশ শতকীয় সমাজে নারীমুক্তির একটি ধারণাও তৈরি হতে থাকছিল। বলা বাহুল্য ১৮২৪-এ জন্ম নিলেন যে মধুসূদন, ১৮৩১-এ কলকাতা বাসের সময় থেকে বড় হলেন এই নবজাগৃতির কালেই। উনিশ শতকীয় সময়, ব্যক্তিগত প্রতিভার বিচ্ছুরণ তাঁকে পরিণত করল বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণের শ্রেষ্ঠতম ফসল হিসেবে। দূর দূরান্ত পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না যে মধুসূদনের, সেই মধুসূদনই আধুনিক বাংলা সাহিত্যকে সাবালকত্ব এনে দিলেন। পুরাতনের নবমূল্যায়ণ যদি উনিশ শতকের নবজাগরণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয় তাহলে তার যোগ্যতম প্রতিনিধি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বাংলা সাহিত্যকে, পুরাণকে যে নতুন আলোয় তিনি দেখিয়েছিলেন তা সেদিন তো বটেই আজও চোখ ধাঁধিয়ে দেবার জন্যে যথেষ্ট।

১৮২৪-এ জন্ম। ১৮৩১-এ কলকাতায় আসা। ১৮৩৩-এ হিন্দু কলেজের জুনিয়র ডিপার্টমেন্টের সর্বনিম্ন শ্রেণিতে ভর্তি। ইংরেজি তথা ইউরোপীয় সাহিত্য রস ও মানববিদ্যার প্রথম পাঠ হিন্দু কলেজের মাটিই মধুসূদনকে দিয়েছিল। আবার পোশাক-পরিচ্ছদ-বিলাস-ব্যসন-বাগবৈদগ্ধ্য-বুদ্ধিমত্তায় তিনি সবার নজর কাড়েন অল্প বয়সেই। পড়াশোনার প্রতি তাঁর অগাধ আগ্রহ। শেক্‌স্‌পিয়র, বায়রন তাঁর প্রিয় কবি। ছাত্রাবস্থাতেই মধুসূদনের লেখা ইংরেজি কবিতা 'জ্ঞানান্বেষণ', 'Bengal Spectator', 'Literary Gleaner', 'Calcutta Literary Gazette' প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। ভবিষ্যতে তিনি ইংরেজি ভাষার মহাকবি হবেন এবং তার জন্য ইংল্যান্ড তাঁকে যেতেই হবে - এ আকাঙ্খা দীর্ঘদিন লালন করেছেন –গৌরদাস বসাককে লেখা চিঠিতে জানাচ্ছেনঃ
"I am reading Tom Moore's Life of my
Favourite Byron - a splendid book upon
my word! Oh! how should I like to see
you writting my life if I happen to be
a great poet - which I am almost sure
I shall be if I can go to England."

আর তারপর ঐ স্বপ্নকে সত্যি করতেই বোধহয় ১৮৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ মধুসূদনের। হিন্দু কলেজে অহিন্দু ছাত্রের প্রবেশাধিকার নেই তাই ছাড়তে হল প্রতিষ্ঠান। ভর্তি হলেন বিশপ্‌স্‌ কলেজে। এখানেই বহু ভাষার জ্ঞানভান্ডার উন্মুক্ত হল তাঁর কাছে। বিশপ্‌স্‌ কলেজে সাধারণ বিভাগের ছাত্র হিসেবে শিখলেন গ্রিক, লাতিন, হিব্রু, সংস্কৃত। এরপর হঠাৎই ১৮৪৮-এ মাদ্রাজ চলে যাওয়া। মাদ্রাজে থাকাকালীন সাহিত্যচর্চা করছেন ইংরেজিতে। 'রিজিয়া' নাটক এবং 'Visions of the Past', 'The captive Ladie' নামক দুটি দীর্ঘ কবিতা এই সময়ই রচনা করছেন। 'ক্যাপটিভ লেডি' পাঠ করে বেথুন সাহেব যে পরামর্শ দেন তা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য -
"As an occasional exercise and proof of
his proficiency in the language, such
specimens may be allowed. But he could render
far greater service to his country and have
a better chance of achieving a lasting reputation
for himself, if he will employ the taste and
talents, which he has cultivated by the study
of English, in improving the standard and
adding to the stock of the poems of his own
language..."

শুধু বেথুনের পরামর্শই নয়, মধুসূদন নিজেও সুদূর প্রবাসে বসে মাতৃভাষার প্রতি টান অনুভব করেছেন। তাই নিজে থেকেই বন্ধু গৌর দাসের কাছে চেয়ে বসলেন বাংলাদেশের নিজস্ব গন্ধ মাখা কৃত্তিবাসী রামায়ণ এবং কাশীদাসী মহাভারত -
"... can't you send me a copy of the
Bengali translation of the Mahabharut by
Casidoss as well as a ditto of the Ramayana, -
Serampore edition. I am losing my Bengali
faster than I can mention..."

এই মাদ্রাজে থাকাকালীনই অবিস্মরণীয় প্রতিভাধর মধুসূদন তৈরি করছেন নিজেকে -
"My life is more busy than that of a
school boy. Here is my routine: 6 to 8
Hebrew, 8 to 12 School, 12-2 Greek,
2-5 Telegu and Sanskrit, 5-7 Latin,
7-10 English. Am I not preparing for
the great object of embellishing the tougue
of my fathers?"

বিশ্বভাষার চর্চাকে মধুসূদন বাংলা সাহিত্য রচনার পাথেয় করবেন অচিরেই। ১৮৫৬ সালে কবি ফিরে আসবেন কলকাতায়।

'রত্নাবলী' নাটকের বাংলা অনুবাদ পছন্দ হয়নি মধুসূদনের। বন্ধু গৌরদাস বসাককে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রেখেই লিখে দেখালেন প্রথম বাংলা নাটক 'শর্মিষ্ঠা'। প্রকাশকাল ১৮৫৯। উনিশ শতকীয় নবজাগরণের কালে বিকশিত হচ্ছিলেন মধুসূদন। পাশ্চাত্য যুক্তিবাদ তাঁর অস্থিমজ্জায়। তাই মহাভারতের শর্মিষ্ঠা-যযাতি-দেবযানীর কাহিনিকে উনিশ শতকের ছাঁচে ফেলতে চাইলেন মধুসূদন। এ নাটকে যযাতির স্ত্রী শর্মিষ্ঠা যখন জানতে পারলেন তার স্বামী অন্য নারী শর্মিষ্ঠায় আসক্ত তখন দেবযানীর উক্তি উনিশ শতকের নবজাগরণ উদ্ভুত নবচেতনার পরিচয় দেয়। দেবযানী তাঁর সখী পূর্ণিকা-কে জানাচ্ছে -
"সখি, তুমি কি আমাকে ঐ পাপ নগরীতে ফিরে যেতে এখনও পরামর্শ দাও? এমন নরাধম, পাষন্ড, পাপী, কৃতঘ্ন পুরুষের কি আমার দেখা উচিত? সে দুরাচার, তার প্রেয়সী শর্মিষ্ঠাকে লয়ে সুখে রাজ্যভোগ করুক,
... তার সঙ্গে আমার আর কী সম্পর্ক? তবে আমার দুইটি শিশু সন্তান আছে, তাদের আমি আমার পিত্রাশ্রমে শীঘ্র আনাবো।"

এমনকী পূর্ণিকা যখন দেবযানীকে 'রাজগৃহিনী' বলে বিশেষিত করেছে তখন দেবযানীর ভর্ৎসনা -
"সখি, আমাকে তুমি সধবা বল কেন?

আমার কি স্বামী আছে..?

মনে রাখতে হবে কৌলীন্য প্রথা দুষ্ট বাংলাদেশে বহুবিবাহ অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনাই ছিল। সেই বাংলাদেশে উনিশ শতকের মধ্যভাগে পৌঁছে অন্য নারীতে আসক্ত পুরুষের স্ত্রী-র এই জোরালো প্রতিবাদ অন্য স্বর বয়ে আনে। পুরুষের বহুগামিতা যেখানে সমাজ স্বীকৃত সেখানে দেবযানীর ভর্ৎসনা উনিশ শতকের নারীকে মধুসূদন কীভাবে দেখতে চান তার একটা ছবিকে তুলে ধরে। যদিও এ নাটকের শেষে শর্মিষ্ঠা, দেবযানী ও যযাতির মধ্যে মিলন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তবু এই অংশটি নারীর অধিকারের প্রশ্নে একটি ভিন্ন মাত্রা যোজনা করে এটাও তো ঠিক।

কৃত্তিবাসী রামায়ণের সূত্রে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পঠিত হয়েছিল রামায়ণ কাহিনি। মধুসূদন নিজেও তা পাঠ করেছেন। কিন্তু সেই কাহিনিকে যখন লিপিবদ্ধ করার কথা ভাববেন মধুসূদন তখন তা নিশ্চয়ই কৃত্তিবাসের অনুকরণ বা অনুরণন হবেনা তা প্রত্যাশিতই ছিল। তাই ১৮৬১-তে প্রকাশিত ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ সেদিনের বাঙালি পাঠকের কাছে পরম বিস্ময়ের বিষয় হয়েই থাকল। বাল্মীকির রামায়ণে রাম ভগবানস্বরূপ, অবতার বিশেষ। কৃত্তিবাসী রামাযণের রাম নরচন্দ্রমা, আদর্শ পুরুষ। কিন্তু মধুসূদন প্রথমেই জানিয়ে দিলেন হিন্দুয়ানির প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ তিনি অনুভব করেন না। তাঁর যা কিছু অভিনিবেশ পুরাণের কাহিনির কাব্যসৌন্দর্যের প্রতি -
"I don't care a pin's head for Hinduism.
I love the grand mythology of our
ancestors. It is full of poetry."

আর তাই বাল্মীকির রামায়ণ কাহিনির কাছে তাঁর ঋণ সামান্যই। বরং গ্রীকদের মতো মহাকাব্যই লিখতে চান তিনি রামায়ণের কাহিনি কাঠামোটিকে সম্বল করে -
"... I mean to give
free scope to my inventing powers
(such as they are) and to borrow as little as
I can from Valmiki. ...I shall not borrow
Greek stories but write, rather try to write,
as a Greek would have done."

তাই নবজাগরণের শ্রেষ্ঠ ফসল মধুসূদনের শ্রেষ্ঠতম কীর্তি 'মেঘনাদবধ কাব্য'-এ রাম হয়ে উঠলেন 'ঘৃণাযোগ্য চরিত্র' আর রাবণ হয়ে উঠলেন 'grand fellow', বা 'চমৎকার মানুষ'। মেঘনাদ তাঁর 'favorourite hero'। যাঁর মৃত্যুতে কবি-ও অকাতরে অশ্রু বিসর্জন করেন - 'It costs me many tear to kill him'। ভেবে দেখতে হবে, বাংলার ঘরে ঘরে রামায়ণ কাহিনি যখন সুপ্রতিষ্ঠিত তখন পুরাণের এই নবমূল্যায়ণ কতখানি বৈপ্লবিক। মধুসূদন বিশ্বাস করেন ব্যক্তির পৌরুষ ও কর্মপ্রয়াসে। তিনি দেখেন রাম চিরকাল দৈবানুগৃহীত। অন্যদিকে স্বর্ণলঙ্কার অধীশ্বর রাবণ জানেন- 'বিধি বাম মম প্রতি', তাই পরাজয় তার অবশ্যম্ভাবী। তবু হেরে যাবেন জেনেও লড়াই থেকে সরে আসেন না। পুত্র বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ, চিত্রাঙ্গদার শোক, লঙ্কার শ্রেষ্ঠতম বীর মেঘনাদের অন্যায় সমরে হত্যা, মন্দোদরীর ক্রন্দন, প্রমীলার বিলাপ-এ সবই ব্যক্তিগত শোকের বলয়ে রাবণকে বিপর্যস্ত করে রাখে কিন্তু তিনি জানেন নিজ শক্তিতে শেষ বিন্দু পর্যন্ত লড়াই চালাতে হবে। উনিশ শতকের আধুনিক মন এই অপরাজেয় পৌরুষ ও আবেগের কাছেই নতজানু হয়। মধুসূদনের রাবণ শেকসপীরীয় ট্র্যাজেডির সেই নায়ক যার পতনের মূলে আছে একটিই 'tragic flow'- সীতা হরণের পাপ। বস্তুত যে উনিশ শতকের নবজাগরণ প্রসূত চেতনা নারীমুক্তির বার্তা এনেছিল সেই নবজাগরণের প্রতিটি বৈশিষ্ট্যকে আত্মস্থ করেছিলেন মধুসূদন। তাই তাঁর 'grand fellow' রাবণের সীতাহরণকে ছোটো করে দেখতে পারেন না মধুসূদন। রাবণ মহৎ তবু সীতা হরণের পাপই তার পতনের কারণ হয়ে থাকে। আজকের ভারতবর্ষে যেখানে রাম-কে গোটা ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেবার চেষ্টা চলতে থাকে সেখানে ১৮৬১-তে প্রকাশিত এক কাব্যে এক ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানের 'ঘৃণাযোগ্য' রাম চরিত্রের রূপায়ণ কতখানি দুঃসাহসী ভাবনা সহজেই অনুমেয়। বস্তুত মধুসূদনের না ছিল হিন্দুধর্মের প্রতি, কোনো বাড়তি আবেগ না তিনি 'সাহিত্য দর্পণ'কার বিশ্বনাথ কবিরাজের চোখ রাঙানির দ্বারা চালিত; তাই মধুসূদনের মুক্তিকামী মন কেবল আকৃষ্ট হয় বীরধর্ম ও পুরুষকারের প্রতি। তাই মেঘনাদ তাঁর কাব্যে হয়ে ওঠে গ্রীক ট্র্যাজেডির সেই নায়ক যে নিয়তির দ্বারা চালিত। তবু নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে বিভীষণ ও লক্ষণকে একসঙ্গে প্রবেশ করতে দেখে নিজের মৃত্যু অনিবার্য জেনেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই থামায়না মধূসূদনের 'favourite hero' মেঘনাদ। যজ্ঞের উপকরণ হয়ে ওঠে লড়াই-এর আয়ুধ। তবে দৈবের দ্বারা নিরাপদ আবেস্টনীতে থাকা লক্ষণের হাতে মৃত্যু হল মেঘনাদের। কিন্তু জয়ী হয় সেই পরাজিত বীর। এই হল উনিশ শতকের সেই ধর্ম যা ব্যক্তির কর্মপ্রয়াসকে দেবমুখিতার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছিল।

নারীমুক্তি প্রসঙ্গ মধুসূদনের রচনায় বারবার এসেছে। 'মেঘনাদবধ কাব্য'-এর প্রমীলা সেই বীর্যবতী নারী যে স্বয়ং রামচন্দ্রের কাছে গিয়ে যুদ্ধ বাঞ্ছা করে। বস্তুত মধুসূদনের নারী মধ্যযুগ পেরিয়ে উনিশ শতকের মধ্যভাগে দাঁড়িয়ে আপন আবেগের বহিঃপ্রকাশে অকপট। তাই পুরাণের নারী চরিত্রের আবরণে উনিশ শতকের নারীমুক্তির দিশা দেখাতে চান মধুসূদন। ঘটে যায় পুরাণের নবনির্মাণ। গোটা 'বীরাঙ্গনা কাব্য'-ই এই নতুন আলো দেয়। 'ব্রক্ষ্মবৈবর্ত্য পুরান'-এর কাহিনিতে ছিল সোমদেব অর্থাৎ চন্দ্রদেব বৃহস্পতি পত্নী তারাকে স্নানরতা অবস্থায় দেখে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তারা-র ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করে ভোগবাসনা চরিতার্থ করেন। এই কাহিনিকেই বদলে দিলেন মধুসূদন। কবির হাতে 'সোমের প্রতি তারা' হয়ে উঠল নারীর প্রেমের সেই দুঃসাহসী স্বর যেখানে তারা দেবী-প্রেম নিবেদন করল সন্তানসম সোমদেবের কাছে। বৃহস্পতি সর্বদা অধ্যায়নরত, দাম্পত্য সম্পর্কে স্ত্রীর চাহিদা সম্পর্কে অচেতন। সেই ছিদ্র দিয়ে যে নারীর শরীরে প্রেমের আবেদন আসতে পারে তার স্বীকৃতি দিলেন মধুসূদন। যদি পুরুষ বা নারী প্রেমে একনিষ্ঠ হয়, তাহলে তথাকথিত সমাজ বহির্ভূত প্রেম-ও যে মান্যতা পেতে পারে একথা জানালেন মধুসূদন নারী মুক্তির প্রথম প্রহরে দাঁড়িয়ে। মনে রাখতে হবে, সে সময়ে বিবাহ বা যে কোনো সিদ্ধান্তের প্রশ্নে নারীর মতামত জানতে চায়না সমাজ তবু সাহিত্যের মাটিতে মধুসূদন এমন এক ক্ষেত্র বা পরিসর তৈরি করছেন যেখানে নারীরা তার প্রিয়তম পুরুষের কাছে অকপটে প্রেম, ভর্ৎসনা, অনুযোগের মতো বিভিন্ন আবেগের স্বতস্ফূর্ত উৎসার ঘটাচ্ছেন। এখানেই মধুসূদনের আধুনিকতা। তাই যে কৈকয়ীকে আমরা এতদিন পর্যন্ত রামের দুর্ভাগ্য, সীতার দুঃখের একমাত্র কারণ বলে ঘৃণা করে এসেছি তাকে-ও যুক্তিসহকারে বিশ্লেষণ করলেন। মনে পড়বে দশরথের প্রতি কৈকয়ীর ভর্ৎসনা -
"পরম অধর্মাচারী রঘুকুলপতি!
থাকে যদি ধর্ম, তুমি অবশ্য ভুঞ্জিবে
এ কর্মের প্রতিফল! দিয়া আশা মোরে,
নিরাশ করিলে আজি;..."

একদিন বিগত অতীতে কৈকয়ীকে স্বেচ্ছায় যে বর দিয়েছিলেন দশরথ সেই প্রতিশ্রুতি পালনের সময় যখন দশরথ মুখ ফিরিয়ে নেন তখন রাজধর্ম, সত্যধর্ম থেকে ভ্রষ্ট হন রাজা। তাই প্রজা হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে, মা হিসেবে গর্জে ওঠেন কৈকয়ী। কৈকয়ীও তা?র সন্তান ভরতকে দেবযানীর মতোই পিতৃগৃহে রেখে আসতে চায়। আবার সূর্পণখার চরিত্র আঁকতে গিয়ে মধুসূদন প্রথমেই সতর্ক করেছেন পাঠককে -
"কবিগুরু বাল্মীকি রাজেন্দ্র রাবণের পরিবারবর্গকে প্রায়ই বীভৎস রস দিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন; কিন্তু এ স্থলে সে রসের লেশমাত্রও নাই। অতএব পাঠকবর্গ সেই বাল্মীকিবর্ণিতা বিকট সূর্পণখাকে স্মরণপথ হইতে দূরীকৃতা করিবেন”।

মধুসূদনের কলমে রাম দেবতা নন, রাবণ রাক্ষস নন, দুজনেই মানুষ। ঠিক তেমনি ভাবে সূর্পণখাও বিকট কুৎসিত রাক্ষসী নন, মানবী। এমন এক মানবী যিনি প্রথম প্রেমের আলোয় রঞ্জিত। এমনকী মধুসূদনের আধুনিক মন প্রেমের অঙ্গীকারেও নারীকে এগিয়ে রাখে - "প্রেম ভিখারিণী আমি তোমার চরণে।" 'বীরাঙ্গনা কাব্য'- এর নারীদের মধ্যে 'নীলধ্বজের প্রতি জনা' পত্রকাব্যের জনা ব্যতিরেকে কেউই প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ প্রার্থনা করেনি। তবু প্রত্যেকেই তারা বীরাঙ্গনা, অর্থাৎ বীর যে অঙ্গনা, কারণ তাঁরা তাদের স্ব স্ব আবেগের প্রকাশে অকপট ও সমুজ্জ্বল। যে নারীকে বারবার পিঞ্জরাবদ্ধ পাখির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে সেই নারীদের মুখেই ভাষা দিতে চেয়েছিলেন মধুসূদন। আর আমরা মনে করতে চাই 'বীরাঙ্গনা কাব্য'টি উৎসর্গ করা হয়েছিল নারী মুক্তি বা নারীজাগরণের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগরকে।

বস্তুত মধুসূদন সর্বাথেই উনিশ শতকীয় নবজাগরণের শ্রেষ্ঠতম প্রতিনিধি। আর মাত্র ৩ বছর পর দ্বিশতবর্ষে পা দেবেন তিনি। তবু তাঁর আধুনিক মন, প্রতিস্পর্ধী স্বরকে ছুঁতে পারিনা আমরা। মধুসূদনের ইংল্যান্ড প্রীতি এবং স্বদেশানুরাগ একই ধারায় বহমান। বাংলাদেশের নদনদী, পথঘাট, চন্ডীমঙ্গল, রামায়ণ, বউকথা কও, শ্যামাপক্ষী, কপোতাক্ষ নদ কিম্বা অন্নপূর্ণার ঝাঁপির প্রতিও তাঁর আজন্মের টান। প্রমীলা আর সীতা দুইই তাঁর মনোরাজ্যের সমান জায়গা জুড়ে থাকে। মধুসূদন-এর নারী চেতনায় বীর্যবত্তা এবং সৌন্দর্যসত্তা দুই-ই জায়গা করে নেয়। আর মধুসূদনের রাবণ বীর্যবত্তা আর কারুণ্যে মেশা এমন এক চরিত্র যার মধ্যে উনিশ শতকের বিদ্রোহ আর অদৃষ্ট তাড়িত মানুষের যন্ত্রণা দুই-ই মিশে থাকে। 'মধুসূদনের কবিমানস' গ্রন্থে শিশির কুমার দাশ-এর এই বিশ্লেষণ সর্বদা প্রাসঙ্গিক। আর আজ মধুসূদনের দুশো বছরের দোরগোড়ায় ভারতবর্ষ এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে যেখানে বহুস্বর, বৈচিত্রই প্রশ্নের মুখোমুখি। আজকের ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে কোনো কবি যদি 'মর্যাদা পুরুষোত্তম' রামকে 'ঘৃণাযোগ্য চরিত্র' হিসেবে উপস্থাপন করতেন তাহলে তার পরিণতি কী হতে পারে তা বুঝতে বাকী থাকেনা। ক'দিন আগেই ফেসবুকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর গলায় জুতোর মালা পরিহিত একটি ছবি ঘুরে বেড়াতে দেখে সাহিত্য সন্ত্রাসের যে ধারণা সম্পর্কে শিউরে উঠি আমরা তার আঁচ যে বিদ্রোহী, চির আধুনিক মধুসূদনের গায়েও লাগবেনা সে কথা বোধ হয় নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবু সাহিত্যিকের স্বাধীন মুক্ত বুদ্ধির প্রশ্নে, আধুনিকতার স্বর নির্মাণে, আত্মপ্রতিষ্ঠার গভীরতর উন্মোচনে উনিশ শতকীয় বাংলাদেশের নবজাগরণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভূ মধুসূদনের কাছে প্রায় দু'শ বছর পেরিয়েও আমাদের বারবার ছুটে আসতেই হবে। প্রবল সেই প্রতিভার বিচ্ছুরিত আগুনের তাপে নিজেদের শুভবুদ্ধি, যুক্তিবোধকে বারবার যাচাই করে নিতে হয়।


গ্রন্থ ঋণঃ
১) মধুসূদনের কবিমানস - শিশির কুমার দাশ।
২) মধুসূদন রচনাবলী, ডঃ ক্ষেত্র গুপ্ত সম্পাদিত এবং জীবন - কথা ও সাহিত্য সাধনা আলোচিত, সাহিত্য সংসদ, ২০১৯, কলকাতা।
৩) মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মেঘনাদবধ কাব্য, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ২০১৮, কলকাতা।
৪) কবি কঙ্কণ-চণ্ডী (কালকেতু পালা), মুকুন্দ চক্রবর্তী, সম্পাদনাঃ সনৎকুমার নস্কর, রত্নাবলী, ২০১৩, কলকাতা।