আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২১ ● ১৬-২৯ ফাল্গুন, ১৪২৭

প্রবন্ধ

ঔপনিবেশিক মন ও মননের শিল্প, বি-উপনিবেশিকরণ লীলাভাষ্য

গৌতম গুহ রায়


‘‘আমাদের রিয়ালিটি আলাদা। আমরা যাদুতে বিশ্বাস করি, প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়াতে দেখি। তাতে আপনাদের কী? সব সময় আপনাদের ওই ইউরোপিয় যুক্তিবাদের অঙ্ক দিয়ে ভাবতে হবে না কি?’’ - গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কোয়েজ


প্রতিটি কালপর্বেরই একটি নির্দিষ্ট শিল্পরূপ থাকে। যেমন আদি ও সনাতন ভারতবর্ষে ছিল মহাকাব্য, প্রাচীন গ্রীসের ট্যাজেডি, অষ্টাদশ শতকের ইউরোপের উপন্যাস, একসময়ের জাপানে হাইকু, নো-নাটক, ইন্দোনেশিয়ার রামায়ণাশ্রিত আখ্যানাবলী, ল্যাটিন আমেরিকার জাদুবাস্তবতা ইত্যাদি, গত শতকের পালটে যাওয়া বিনোদনের বিশ্বে সিনেমা, এরপর টেলিভিশান, সবার্ধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি। কোন যুগের শিল্পমাধ্যম কি হবে তার পেছনে কাজ করে নির্দিষ্ট সামাজিক- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি। এই ক্রমপরিবর্তনশীল আবহেই ইউরোপের আগ্রাসী উপনিবেশবাদ ও তার থেকে মুক্ত হওয়ার আর্তি নিয়ে জেগে ওঠা উত্তর-উপনিবেশবাদ নিয়েই আমাদের চর্চা।

আইজাজ আহমেদ একটি স্মরণীয় উক্তি করেছিলেন, ‘post -coloniality is also, like most things, a matter of class’. মুলত ৪০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকে ইউরোপের দখলিকৃত উপনিবেশগুলোর থেকে মুক্ত মানুষের নিজের ইতিহাস, দেশ ও সাহিত্য সংস্কৃতির খোঁজে যাত্রাই উত্তর-উপনিবেশিকতার ধারণার জন্ম দিয়েছিল। ঔপনিবেশিকতার চর্চা ধনতান্ত্রিক দেশে শুরু হলেও এর হওয়ার কথা ছিল দক্ষিণ গোলার্ধে, সেই সব দেশে, যারা ঔপনিবেশিক কাল অতিক্রম করে এসেছে। সোজাসাপ্টা ভাবে বললে এ এক স্বাধীনতা উত্তর কালের জন-সংস্কৃতি, সমাজচর্চা। উত্তর উপনিবেশ বা Post colonialism’এর চর্চা গত ৬০-৭০ বছরের সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায়, বিশেষত সাহিত্যের জন্য। পশ্চিমের পুঁজির স্বার্থে একসময় দক্ষিণের দেশগুলোকে দখলে আনা ও সেই ইতিহাস থেকে মুক্ত হওয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতা, তার সামাজিক বাস্তবতায় পরিবর্তিত হওয়ার যে যাত্রা তার সঙ্গে মিলিয়ে উচ্চারণে করলেও এটি সমার্থক নয়। উপনিবেশবাদ ও পুঁজিবাদ একে অপরের পরিপূরক ছল, তাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দাপটে সেই সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের ছায়ামুক্তি বাস্তব হয়ে ওঠে না। যে পশ্চিমী জাতীয়তাবাদের কুহক অবদমিত এই তৃতীয় বিশ্বে ঔপনিবেশিক শাসন মুক্তির প্রক্রিয়ায় বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে, বাস্তবিক অর্থে সেই জাতীয়তাবাদ সামাজিক মুক্তির প্রশ্নে একার্থক থাকেনি। Colonialism বা উপনিবেশিক অবস্থা আর্থ সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক ঘটনাভিঘাতজাত। একথা মনে রাখতে হবে যে উপনিবেশবাদ কেবল মাত্র রাজনৈতিক প্রভুত্ব চায় না সে চায় অধিকৃতের সামগ্রিক সংস্কৃতিকে, সামাজিক যাপনকে, রীতিনীতি সহ সেই অঞ্চলের যাবতীয় স্বকীয়তাকেই দখল করে নিতে, তাঁর নিজের মত পুনর্নির্মাণ করে নিতে। এই সময়কালেও তাই দেখা যাচ্ছে যে রাজনৈতিক প্রভুত্ব স্থাপন সবসময় সহজ ও বাস্তবিক হচ্ছে না, সে তাই অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের দিকে যা তার বিপনণ বাজারেরও সম্প্রসারণ ঘটাবে। প্রাজ্ঞজনদের সংজ্ঞায় Cultural Imperialism বা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলতে বোঝান হচ্ছে, ‘Cultural Imperialism is the practice of promoting, distinguishing, separating, artificially injecting of the culture or language of one nation on another.’। উপনিবেশের রসায়নটাই হলো উপনিবেশ প্রস্তুত করে যে সত্ত্বা সেও উপনিবেশ, ও তারপর তৈরি হয় আর একটি উপনিবেশ, এর পরবর্তী উপনিবেশ।

এই আলোচনার শুরুতে আমারও শৈশবে ঘুরে আসতে ইচ্ছে করছে। খুব প্রিয় ‘কার্টুন’ বা ‘ইন্দ্রজাল কমিকস’ স্ট্রিপ নেশার মত আচ্ছাদিত রেখেছিল সেই বয়স। এর সঙ্গে আডভেঞ্চার। ‘ফ্যান্টম’এর বাংলায় অরণ্যদেব, আফ্রিকার অরণ্যলালিত টারজান তখন ঈশ্বরপ্রতীম, অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন, অশুভের বিরুদ্ধে একাই মহাযোদ্ধা। আরো ছোটবেলায় পড়া ঠাকুরমার ঝুলি, ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী, বুদ্ধুভূতুম, ক্ষীরের পুতুল তখন ম্লান। আজ এই স্মৃতি বিস্মৃতির দিকে তাকালে সাদা চামড়ার অহংকারী চাহুনি আমাকে ভিন্নভাবে তাকাতে বলে, দেখি বিশ্বব্যাপী ইউরোপিয় উপনিবেশবাদ কত গভীরে তার শেকড় ছড়িয়ে ছিল, সেই হানাদা্রি থেকে নিস্তার পায়নি আমাদের শৈশব। এই সুচতুর কৌশল ধরতে হলে একটু বিস্তারে যেতে হবে। আমরা স্মরণ করি বিখ্যাত ইংরেজ কিশোর সাহিত্যিক জর্জ আলফ্রেড হেন্টিকে (১৮৩২-১৯০২)। পেশায় সাংবাদিক হেনটি তাঁর নানা দেশ ভ্রমণের ও যুদ্ধের বিপুল অভিজ্ঞতা নিয়ে ছোটদের জন্য একের পর এক উপন্যাস লেখেন, বলতেন ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’। প্রথম উপন্যাস ‘আউট অন দ্যা পম্পাসঃ অর দ্যা ইয়ং সেটলার’ প্রকাশিত হয় ১৮৮১তে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই তাঁর বই বিক্রি সংখ্যা ছিল কয়েক কোটি। তাঁর বইগুলোর নাম দেখলেই বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা হবে, ‘উইথ কোর্তেস ইন ম্যাক্সিকো’, ‘উইথ কিচেনার ইন সুদান’, ভারত ভ্রমণের রসদ নিয়েও তাঁর কিছু বই আছে, যেমন ‘উইথ ক্লাইভ ইন ইন্ডিয়া’, ‘এ্যট দ্য পয়েন্ট অভ দ্য বেয়নেটঃ আ টেল অভ দ্য মারাঠা ওয়ার’, ‘বাই ইংল্যান্ডস এড’ ইত্যাদি এবং প্রতিটিতেই সাদা চামড়ার মহত্ত্ব ও বিশালত্ত্বের গুণকীর্তন রচিত হয়েছে। হেনটির উপন্যাসগুলোয় নিছক বিনোদন ছিল না, যুদ্ধ ও সংঘাতের রোমহর্ষক বিবরণের অন্তরালে বার্তা ছিল উপনিবেশগুলোর শান্তির জন্য ইংরেজের আধিপত্যের, তবেই শান্তি আসবে এবং তবেই ব্যাবসা বাণিজ্য ও শিল্পের প্রসার ঘটবে, উপনিবেশগুলোর উন্নতি হবে, মানুষ শান্তিতে থাকবে। সেই সময়ের আর এক কিশোর সাহিত্যিক উইলিয়াম হেনরি কিংসটন, যিনি ‘ইউনিয়ন জ্যাক’ পত্রিকার সম্পাদনা করতেন এবং পরবর্তীতে সেই দায়িত্ব হেনটিকে দিয়েছিলেন। কিংসটন ছিলেন ‘দ্য কলোনিস্ট, দ্য কলোনিয়াল ম্যাগাজিন এন্ড ইস্ট ইন্ডিয়া রিভিউ ও ইউনিয়ন জ্যাক’ পত্রিকার সম্পাদক, ছিলেন ‘সোসাইটি ফর প্রোমোটিং কলোনাইলজেশন’এর কমিটি সদস্য। এই সমিতির ঘোষিত লক্ষ্য ছিল সে দেশের বেকারত্ব নিরসন। এহেন হেনরি কিংস্টন ৩০ বছরের মধ্যে ১৫০র উপর উপন্যাস লিখেন। ১৮৪৯ এর ১ জানুয়ারি তিনি এই সভায় একটি বক্তৃতা দেন যেখানে উপনিবেশবাদ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি জানা যায়। তিনি বলেছিলেন যে, এঙলো স্যক্সনদের ওপর ঈশ্বর দুটো গুরুভার অর্পণ করেছেনঃ সভ্যতার প্রসার ও খৃষ্টধর্মের প্রচার; বিশ্বের যে সমস্ত এলাকায় এখনো বসবাস নেই, সে-সব অঞ্চল আমাদের জন্যই বরাদ্দ করেছেন ঈশ্বর। এবং এটাও সত্যি যে পৃথিবীর নানা প্রান্তের এলাকা দখল করে উপনিবেশ স্থাপন করে সেখানে এই দেশের লোকেরা বসবাস করার ফলে আমার মাতৃভূমির ওপর জনসংখ্যার চাপ কমবে। ঈশ্বর নির্ধারিত এই পথে আমাদের বেকারত্বও কমবে। চার্টিস্ট আন্দোলনের বিভ্রান্তি থেকে আমাদের শ্রমিকদের উদ্ধার করতে হবে, এতে ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী অধিকৃত দেশগুলোর অধঃপতিত মানুষদেরও উন্নতি হবে।

কিংসটনের এই বক্তৃতার অভিমুখ ছিল দ্বিমুখী, উপনিবেশগুলোর সস্তা শ্রমিক কাজে লাগানো ও ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ সামাজিক সমস্যাকে বাইরে চালান করা, এর ফলে শুধু অর্থনীতি নয় রাজনীতি ও মতাদর্শ এই তিনটি স্তরেই ইংল্যান্ড ও তার অধিকৃত উপনিবেশগুলোকে ইংল্যান্ডের উপর নির্ভরতাকে অবিচ্ছিন্ন রাখতে পারবে। হেনটি বা কিংস্টন শুধু নয় ইউরোপীয় মনন জগতের বিরাট অংশের প্রচেষ্টায় এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া শুরু হয় নিজেদের জাতিগত, সাংস্কৃতিগত উত্তম প্রতিষ্ঠার। এই অভিমুখ নিয়েই ক্রমশ আধিপত্যবাদী সাদাচামড়া সাহিত্য, সংস্কৃতির মোড়কে তাদের ‘সুপিরিয়র’ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া চালু রেখেছে। এর অভিঘাত থেকে বেরিয়ে আসাটাই উপনিবেশিক দেশগুলোর মুক্তির লড়াই উত্তর উপনিবেশবাদের প্রধান লক্ষ্য। শিল্প বিপ্লব ও তারপরের সময়কালের ইউরোপে যখন মানবিকতার উন্মেষের কথা উচ্চারিত হচ্ছিলো তখনো পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর দ্বিচারিতা লক্ষ করা যাচ্ছিলো। মুখে মানবিকতার বুলি, মানুষের অধিকারের কথা আর অধিকৃত অঞ্চলের মানুষদের উপর ক্ষমতার অধিকার কায়েম রাখার জন্য নানা কৌশল প্রয়োগ। আমরা কিংসলে, ব্যালান্টাইন, হেনটির মতো উপনিবেশবাদী ‘সাদা’দের রচিত সাহিত্যেও সেই স্বর লক্ষ করি। সেখানে শিষ্ট সমাজভুক্ত সাদারা একভাষায়, একভাবে কথা বলে আর অধিকৃত উপনিবেশের ভূমিপুত্রেরা নিচুতলার, নিঃস্বর থাকে। ঔপনিবেশিক বয়ানে স্তরে উপস্তরে বিভক্ত সমাজকে যতই শিভদ বলে প্রতিপন্ন করা হোক, সুস্থিত ভারসাম্যের ছবিটি বারেবারে বিপর্যস্ত হতে বাধ্য। সেই বিপর্যয়ের সাক্ষ্য বহন করে সাহিত্য, সংস্কৃতির নানা আঙ্গিক।

আমাদেরই কিশোরকালে আমরা বুঁদ হয়ে ছিলাম টারজানে, সেই টারজান ছিল আমাদের স্বপ্নের অধিপতি, যে আফ্রিকার অরণ্যপালিত শিশু থেকে যুবক হয়ে ওঠা এক অতিমানব। টারজানের কারণেই কিশোর সাহিত্যের এক অন্যতম প্রধান নাম এডগার রাইজ বারোজ। ১৯১১ থেকে ৩০ বছরে তিনি ২১টি কিশোর উপন্যাস লেখেন যার মুখ্য চরিত্র টারজান। ‘টারজান’এর আক্ষরিক অর্থ ‘সাদা-চা্মড়া’। একটি শিশু আফ্রিকার জঙ্গলে জন্তুজানোয়ারের মধ্যে পালিত হচ্ছে, অরণ্যবাসীর সাহচর্যে সে বড় হচ্ছে, কিন্তু সে সাদা চামরার আভিজাত্যময়, অন্যের থেকে স্বতন্ত্র ও ‘সুপিরিয়র’। যেমন ‘ফ্যান্টম’ বা আমাদের ‘অরণ্যদেব’ কালো মানুষদের মধ্যে সাদা চামড়ার ‘সুপিরিয়র’। বারোজের কিশোর উপন্যাসের নায়ক টারজান তার আবাসস্থলের বাইরে নোটিশ টানিয়ে রাখে, ‘এটা জন্তু জানোয়ার ও কালামানুষদের সংহারকর্তা টারজানের বাড়ি’। শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় এনিয়ে তাঁর একটি প্রাসঙ্গিক আলোচনায় লিখেছেন যে স্যান্ডার্স বা টারজানের স্বরের কাঠিন্য, তাদের নিষ্ঠুর ক্রিয়াকান্ডের বীভৎসতায় সাম্রাজ্যবাদের মারমুখী চেহারাটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সাম্রাজ্যবাদের বিবর্তনের সঙ্গে দুই এডগারের উপন্যাসও বদলায়। সে-বিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখেই টারজানের মডেলে ক্রমান্বয়ে তৈরি হবে ফ্যান্টাম বা অরণ্যদেব, সুপারম্যান, ব্যাটম্যান ইত্যাদি অতিমানব চরিত্র। আর সেই বিখ্যাত মংগলি? ১৯০৭-এ নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্ত লেখক রাডিয়ার্ড কিপলিং-এর ‘দ্য জঙ্গল বুক’-এর সেই নায়কের সঙ্গে কি টারজানের মতাদর্শগত আত্মীয়তা নেই?’(গোপাল-রাখাল দ্বন্দ্বসমাস/শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়)। জাঙ্গল বুক প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯৪-এ। সাদাদের সাহিত্য শুধু নয় সমাজবিজ্ঞান চর্চা, জীবন বিজ্ঞান গবেষণার মধ্যেও অনেক সময় এই উপবিবেশিক দর্শনের স্বর ঘোষিত বা অনুচ্চারের লেখা থেকেছে। মানবের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ডারুইনের বিবর্তনবাদ, কিন্তু সেই ডারুইন তাঁর ‘দ্য ডিসেন্ট অভ ম্যান’এ তথাকথিত সভ্য ও বর্বরদের মধ্যে আচরণগত ও ‘স্বাভাবিক’ পার্থক্য চিহ্নিত করে ‘প্রাগ্রসর’ ও ‘অনগ্রসর’ জাতির ধারণাটিকে বিজ্ঞানভিত্তিক গ্রহণযোগ্যতার শিলমোহর দিয়েছিলেন। উল্লিখিত জগৎবিখ্যাত কিপলিং মনে করতেন ‘কালো মানুষদের উন্নত করা সাদা মানুষদের দায়’। সেসিল রোদস, কিপলিং সম্পর্কে লিখেছিলেন যে, ‘ডিস্রেলির পর যিনি সব চাইতে মুন্সিয়ানায় সারা পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করেছেন যে ব্রিটিশ চরিত্র খাঁটি এবং নিষ্কলঙ্ক, তাতে কখনো মরচে ধরে না বা ধুলো জমে না, তিনি কিপ্লিং’। উল্লিখিত হেনটিং থেকে কিপলিং, এঁদের সঙ্গে ঔপনিবেশিক ভারতের সম্পর্ক ছিল। কিপলিং জন্মেছিলেন ভারতে আর হেনটিং বেশ কয়েকবার এদেশে ভ্রমণ করেছেন এবং তাঁর উপন্যাসের অনেকটা জুড়ে পরাধীন ভারতের মানুষজন ও তাঁদের আধা সভ্য ও বিকৃত চিত্রায়ণ। এদের মধ্যে রুশ ভীতি, বিশেষত বলশেভিক বিপ্লবীদের প্রতি ভীতি প্রকাশ করেছিলেন। সমাজবাদের বিরুদ্ধে এদের অবস্থান ছিল ঘোষিত, এ নিয়ে পরে আসছি আলোচনায়। এখানে ম্যাথু আর্নল্ডকে নিয়ে কিছু কথা বলা আবশ্যিক।

‘কালচার এন্ড আয়ানার্কি’র লেখক ম্যাথু আর্নাল্ড-এর (১৮৬৯ নাগাদ লিখিত) উপন্যাস সেই সময়ের বিলাতের বুর্জোয়া মতাদর্শের অধিক্যবাদী সাহিত্যের অন্যতম উদাহরণ হয়ে উঠেছিল। তাঁর অভিমত ছিল যে ব্যক্তির চেয়ে সমষ্টি অনেক বড়, ব্যক্তির মঙ্গলের জন্যে ব্যক্তির ইচ্ছাবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে এনে, সমষ্টির সঙ্গে অন্বিত করে নিতে হবে। তিনি পক্ষান্তরে চেয়েছিলেন যে বুর্জোয়ারা সংকীর্ণ স্বার্থের ঘেরাটোপ ছেড়ে দায়িত্বের সঙ্গে সমাজের হাল ধরুক, সমাজের সর্বস্তরে তাদের আধিপত্য বিস্তৃত হোক। শ্রমিক শক্তির মেধা ও ধীশক্তি নেই, তাই তারা কেবল হইচই বাধিয়ে ঝঞ্জাট করে, ‘পুঁজির রেওয়াজি রকমটিকে বানচাল করাই তাদের মতলব। সেই ‘নৈরাজ্যকে’ সামাল দিতে দরকার ‘সংস্কৃতি’র। বুর্জোয়া ও শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে পালক পাল্য সম্পর্ক, অর্থাৎ মধ্যবিত্তকেই শ্রমিকদের শোধিত করার দায়িত্ব নিতে হবে। মধ্যবিত্তের উপর শ্রমিক শ্রেণি যদি আস্থা না রাখতে পারে তবে দেখা দেবে ভয়ানক বিপর্যয়। তাঁর মতে শ্রেণি-পরিধির বাইরে যে বেরোতে পারে, সমষ্টির প্রয়োজনে বা রাষ্ট্রের স্বার্থে নিজের ব্যক্তিসত্ত্বাকে যে বিসর্জন দিতে জানে, সেই আদর্শ। তাঁর দর্শনে শ্রেণি চরিত্র নিরপেক্ষ নৈতিকতার ভিত্তিতে রচিত হবে ‘সংস্কৃতিপরায়ণ’ মন। এই ‘সংস্কৃতি’র দাপট যত বাড়বে ততই নিরঙ্কুশ হবে বুর্জোয়া শ্রেণির ক্ষমতা। এখানেই উপনিবেশবাদীদের বা আধিক্যবাদীদের সঙ্গে মিল, ম্যাথুওর সংগে কিপলিং-এর মিল।

১৯১৩তে উপনিবেশবাদী দর্শনের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা রাইডার হ্যাগার্ড কিপলিংকে উদ্দেশ্য করে ‘দ্য টাইমস’এ একটি চিঠি লেখেন, যেখানে তিনি আবেদন জানান, ‘বলশেভিকদের বিপদ সম্পর্কে দেশবাসীকে সতর্ক করার জন্য। এরা পরবর্তীতে এই মতাদর্শগত লড়াই চালাতে ‘লিবার্টি লিগ’ প্রতিষ্ঠা করেন। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে উপনিবেশবাদীদের ভয় ছিল স্বাভাবিক। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল মার্ক্সবাদ। ১৮৮৯-১৯১৪ দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামকে সমর্থন করতে সফল না হলে লেনিন বিকল্প পথ বেছে নেন। ১৯১৯ সালে তাঁর উদ্যোগে তৈরি হয় কমিন্টার্ন বা তৃতীয় আন্তর্জাতিক। তৃতীয় আন্তর্জাতিকে উপনিবেশবাদ বিরোধী লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এই সময় ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার লড়াইয়ের ক্ষেত্রে যে ঘাটতি ছিল তাও ক্রমশ গুরুত্ব পায়। আমিল্কার কাব্রাল, নক্রমা, ফানান প্রমুখের ভূমিকায় আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদ ও মার্কসবাদের সমন্বয়ে এক স্বতন্ত্র ধারা গণসংগ্রামে পথ দেখায়। কিউবাতেও মার্ক্সবাদের স্বতন্ত্র ধারার প্রয়োগ ঘটে ও বিপ্লব সফল হয়। বিশ্বযুদ্ধপূর্বে পশ্চিম ইউরোপের বৌদ্ধিক মহল, বুর্জোয়া মতাদর্শের কাছে যে আশংকা ছিল যে মার্ক্সবাদ বা সমাজবাদের লড়াই উপনিবেশবাদের, দখলিবাদকে বিপর্যস্ত করবে সেই আশংকাই বাস্তব হলো। তবে মনে রাখতে হবে যে পুঁজিবাদ মানেই উপনিবেশবাদ নয়, এর একটি রূপ মাত্র। বিপিন চন্দের মতে, ‘Colonies do not become capitalist in the same way as the metropolis do. Capitalism is a world system, but it has one face in the metropolis and another in the colony.

‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে কয়েক দশক পর্যন্ত উপনিবেশবাদবিরোধী এই বিভিন্ন সংগ্রামগুলিকে, মূলত পরে র‍্যাডিক্যাল, বামপন্থী, মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণ করার যে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি বৌদ্ধিক ধারা গড়ে উঠেছিল, যার প্রধান বর্গগুলি ছিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এবং যেখানে অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক প্রভুত্বকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা হত, তার একটি বৌদ্ধিক বিকল্প হিসাবে মোটামুটি আশির দশকের প্রারম্ভে একটি ভিন্ন ধাঁচের যে র‍্যাডিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে তারই নাম উত্তরউপনিবেশবাদ’’। (শোভনলাল দাশগুপ্ত/উপনিবেশের বিরোধিতা) এই ‘উত্তর-উপনিবেশবাদ সম্পর্কে আনিয়া লিম্বা তাঁর Colonialism/post-colonialism’গ্রন্থে (১৯৯৮) বলেছেন ‘a contestation of colonial domination and the legacies of colonialism’, উপনিবেশবাদী আধিপত্য ও উপনিবেশবাদী ঐতিহ্যসমূহের প্রতিস্পর্ধী দৃষ্টিভঙ্গি রূপে। এই নানা মতের সম্মিলন করলে আমরা বলতে পারি যে উপনিবেশবাদের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা থেকে শুরু করে ঔপনিবেশিক ভাবনা-মূল্যবোধ-সংস্কৃতি-শিক্ষা-অর্থনীতি ইত্যাদির বিরোধিতা, স্বদেশ ও তার ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি আনুগত্য, জাতি-ধর্ম-বর্ণ উত্তীর্ণ হয়ে মানুষ ও তার জীবন সম্পর্কে আস্থাশীলতা, লোকস্মৃতি-লোকপ্রতীক-আইকনের ব্যবহার, রাষ্ট্রীয় দমনে সকল প্রকার সন্ত্রাস-শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ইত্যাদি। এনিয়ে কুন্তল চট্টোপাধ্যায় সুন্দর বলেছেন, ‘পোস্ট-কলোনিয়ালিজম’ এক বহুমাত্রিক জীবনদৃষ্টি যা সাহিত্য-সংস্কৃতির পাঠ ও মূল্যায়নে এক মূল্যবান আঙ্গিক। যা সংস্কৃতি ও ক্ষমতার সম্পর্ককে চিহ্নিত করবে’’।

যে উপনিবেশবাদের বিস্তারে আমরা পশ্চিম ইউরোপের সাহিত্য সংস্কৃতিকে উদ্বেল হতে দেখছি তার গোড়াপত্তন ঘটেছিল ষোড়শ শতাব্দীতে। প্রথমে পর্তুগাল ও পরে স্পেন ও হল্যান্ডের ঔপনিবেশিক প্রভুত্বের মাধ্যমে। ১০৭৩ থেকে ১৪৯৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইউরোপের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে পোপের আজ্ঞা দান ও অনুগ্রহ বিতরণ এবং পর্তুগাল ও স্পেনের রাজাদের মধ্যে বিশ্বের বন্টন আর পোপের প্র্তি আনুগত্যানুসারে পর্তুগাল ও স্পেনের সমুদ্রাভিযানের পেছনে প্রথম প্রেরণা ছিল খ্রিষ্টান পৃথিবীর সম্প্রসার অর্থাৎ অন্য চেহারায় ক্রুসেডের উদ্দ্যেশ্য সাধন, দ্বিতীয় প্রয়োজন ছিল আন্তর্জাতিক বানিজ্যের অধিকার অর্জন এবং তৃতীয় কারণ ছিল অজানা সম্পর্কে কৌতূহল। কিন্তু চতুর কৌশল ও বাণিজ্যিক ধুর্তামির অস্ত্রে পরবর্তীতে ব্রিটেন ও ফ্রান্স হয়ে ওঠে দুই প্রধান ঔপনিবেশিক প্রভুরাষ্ট্র। এই দুই পরস্পর বিরোধী শক্তির উপনিবেশবাদের চরিত্রেও ছিল ভিন্নতা। ফরাসী মডেলের ঝোঁক ছিল আত্মীকরণের ওপরে, ব্রিটিশ মডেল ছিল সহযোগিতাকেন্দ্রিক। অর্থাৎ ফরাসিরা চাইতেন অধিকৃত দেশের মানুষদের বুঝিয়ে দিতে যে ফরাসী সাহিত্য সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করাতেই তাদের মঙ্গল। এখানেই তারা পাবেন সভ্যতার প্রকৃত স্বাদ। আর ব্রিটিশ শাসন চাইতো যে উপনিবেশের শাসন পরিচালিত হবে ব্রিটিশ সংস্কৃতি ও স্থানীয় মানুষের সংস্কৃতির মধ্যে একটা দূরত্ব বজায় রেখে এবং যার মাধ্যমে প্রতিপন্ন করা যে উপনিবেশের মানুষ ইংরেজ শাসনের সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বকে অনুসরণ করার চেষ্ঠা করবে, কিন্তু চিরকালই তারা থাকবে ব্রিটিশদের পদাঙ্ক অনুসারী হিসাবেই, তার বেশি কিছু নয়। আমরা এই প্রসঙ্গে এডওয়ার্ড ডাব্লু সাইদ এর ‘ওরিএন্টালিজম’ বইতে প্রাচ্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির এই ধরনের অপব্যাখ্যার নানা নিদর্শন দেন। পাশ্চাত্য ‘পন্ডিত’দের লেখায় ভারতের মতো প্রাচ্য দেশ সাপ, ষাঁড় জাদুকর, আফিংখোর ইত্যাদির দেশ। আসলে পাশ্চাত্য সভ্যতার জয়গানের আড়ালেই থাকে উপনিবেশিকতার মহাত্মকীর্তন। সাইদ ‘ওরিয়েন্টালিজম’ গ্রন্থের কথামুখে দুজনের কথা উল্লেখ করেছেন, একজন বেনজামিন ডিজারেইলি অন্যজন কার্ল মার্ক্স। ডিজারেইলি বলেছেন যে প্রাচ্য হল একটি কেরিয়ার বা পেশা, যার অর্থ প্রাচ্যে ইংরেজদের জন্য, পশ্চিমের জন্য আসলে, অফুরন্ত সুযোগ আছে পেশাগত সমৃদ্ধির। আর মার্ক্স বলেছেন, প্রাচ্য নিজেদের উপস্থিত করতে পারে না, তা ই তাদেরকে উপস্থিত করাতে হবে। যার সরল অর্থ প্রাচ্য পশ্চাৎপদ, সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না, অন্যের সাহায্য আবশ্যক হয়। প্রাচ্যবাদের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ, নাট্যকার ইস্কাইলাস থেকে দান্তের মহাকব্যে এর উপস্থিতি দেখা যায়। তবে প্রাচীন ও মধ্যযুগে এই প্রাচ্যবাদ ছিল আদর্শিক ও ভৌগলিক। গ্রীকদের কাছে প্রাচ্য দূরের রহস্যময় দেশ, মধ্যযুগের খ্রিস্টানদের কাছে প্রাচ্য অধার্মিকদের দেশ। তখন প্রাচ্যবাদ ছিল নিরীহ, কৌতুককর, কিন্তু ক্ষতিকর যে প্রাচ্যবাদ তার যাত্রা শুরু অষ্টাদশ শতকের সূচনায়। তখন প্রাচ্যবাদ রাজনৈতিক চেহারা নিতে থাকে। উপনিবেশবাদের চেহারা নেয়, তারা বলে যে উপনিবেশের মানুষজন শাসিত হওয়ার জন্যই জন্মেছে, কেননা জ্ঞান ও সংস্কৃতিতে তারা নিতান্তই পিছিয়ে পড়া, তাদের পক্ষে স্বাধীন হবার দরকার নেই, স্বাধীন হলে তারা বিপদে পড়বে। এভাবেই উপনিবেশের মানুষদের জন্য নতুন তত্ত্ব তৈরি হয়ে গেলো। তাদের চিন্তা, চেতনা, কল্পনা ও অনুভবকে আবদ্ধ করার তৎপরতা সমানে চললো। পাশ্চাত্য প্রাচ্যতত্ত্ববিদেরা আসলে প্রাচ্য সভ্যতা এবং কৃষ্টির অপব্যাখ্যা করেন এবং তুলনায় শাসকদেশের শিল্পসাহিত্য-সংস্কৃতির মাহাত্মকীর্তন করেন। এই উপনিবেশাবাদ ভারতের মত দেশে তাদের মতবাদ বাস্তাবয়নের পরীক্ষাগার করে নিয়েছিল। ক্রমান্বয়ে লুপ্ত করার প্রক্রিয়ায় ভারতীয় উপমহাদেশের বহুত্ববাদি সংস্কৃতি, হাজার বছরের শিল্পের সমৃদ্ধি আক্রান্ত হলো, উপনিবেশবাদ সৃষ্ট মধ্যবিত্তের চর্চায় যে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির উত্থান ঘটতে থাকলো সেখানে ভারতীয় সনাতনী সংস্কৃতি সম্পূর্ণভাবে অবলুপ্তির বিপদের সম্ভাবনার মুখে পড়লো।

ভারতীয় উপমহাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা করতে গেলে গুরুত্বপুর্ণ ক্রান্তিকাল ১৭৫৭, ও ১৭৬৫ সাল। পলাশিতে খলযুদ্ধে ব্রিটিশ শক্তির রাজশক্তিতে প্রত্যক্ষ পরিবর্তন, দেওয়ানি লাভের মধ্য দিয়ে ‘বনিকের মানদন্ড রাজদন্ড’ হয়ে স্থায়ী ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। মোটামুটি এই অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেই এদেশে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা কয়েম হয়। মধ্যযুগে বাংলা ছিল গ্রাম অধ্যুষিত, সমাজ পটভূমি ছিল সামন্ততান্ত্রিক, ব্রিটিশরা সেখানে পুঁজিবাদ বাহিত ভাবধারা নিয়ে আসে। গ্রাম কেন্দ্রিক বাংলার স্থানু অর্থনীতিতে গ্রামগুলো ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ, মানুষের চাহিদাও তেমন প্রবল ছিল না। ইউরোপিয়রা এলো রেনেসাঁস পরবর্তী ইউরোপের প্রতিনিধি হয়ে। সেখানে ব্যক্তির মর্যাদা অনেক বেশি, সেই মর্যাদা রক্ষা পায় নির্দিষ্ঠ আইনি বর্মে। মধ্যযুগের ভারতবর্ষ ছিল বর্ণানুসারী সমাজ, এখন এলো বিত্তানুষারী সমাজ, বিত্তের ক্ষমতায় নির্ধারিত হবে ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান। বিদেশি রাজশক্তি কায়েম হয়ে নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা চালু করে, গ্রামীণ ভারতের বিশেষত বাংলার সমাজজীবন ও দেশজ শিল্পবাণিজ্যকে বিপর্যস্ত করে দেয়। এর ফলে অধিকৃত ভূমি হয়ে ওঠে ব্রিটিশ তথা ঔপনিবেশিক শাসকের বানিজ্য পণ্যের বাজার। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এই প্রক্রিয়াকে ত্বরাম্বিত করল। ১৭৬৫-র পর যে অর্থনৈতিক শোষণের শুরু করে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে দেশীয় কৃষিসমাজের উপর। এদেশ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিজেদের দেশের উন্নত প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজরা উপনিবেশের অর্থনীতিকে সংকটাপন্ন করে তোলে। এরফলে ভয়াবহ মন্বন্তর। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর ফলে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তন আসে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের আবির্ভাব ঘটে। এদেশের একদল মানুষ হয়ে উঠলো ব্রিটিশ শাসকের অন্নে পালিত বশংবদ কর্মচারী। এই ক্রান্তি কালেই রাজশক্তির শাসন পরিকাঠামো সম্প্রসারিত করার জন্য তৈরি হলো করনিককুল, জন্মনিল নব্য-মধ্যবিত্ত শ্রেণি। নব্য উপনিবেশিক ব্যবস্থার সহায়ক শিক্ষা ব্যবস্থা জন্মদিলো শেকড়চ্যুত এক হাসজারু শিক্ষিত সমাজ, যারা আত্মনির্ভরতার থেকে পরনির্ভরতায় সাচ্ছ্বন্দ অনুভব করতেন বেশি। আবার এই নব্যবাবুদের একাংশের মধ্যে ইংরাজী শিক্ষাতে শিক্ষিত হয়ে স্বজাতীয় ঐতিহ্য ও স্বাধিকারের জন্য বিদেশি দখলদারী শক্তির বিরুদ্ধে স্বাধিনতার আন্দোলনে সামিল হতে দেখা গেলো। জাতীয়তাবাদের এই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতাই উপনিবেশবাদকে রাজনৈতিক ভাবে চ্যলেঞ্জ জানালো। উপনিবেশিক শক্তির প্রভাবেই কলকাতায় যার কেন্দ্রিক খন্ডিত নবজাগরণের উদ্ভব ঘটলো।

ভারতে ইউরপিয় উপনিবেশিক শাসন শুরু হওয়ার পর ১৭৭২-এ কলকাতাকে ইংরেজদের রাজধানী করা হয়। এর পর শুরু হয় তাদের শাসনের পরিকাঠামো নির্মাণ প্রক্রিয়া। তাদের আগ্রহে এবং ইউরোপিয়দের আগ্রহের সমান্তরালে বাংলা ও মারাঠির মত আঞ্চলিক ভাষায় নাট্য ও সাহিত্য রচনা শুরু হয়। উনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বোম্বে, কলকাতা ও মাদ্রাজের মত ঔপনিবেশিক ভারতের প্রধান বানিজ্যিক কেন্দ্রগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন শুরু হয়। শাসন সহায়ক মদ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়। পরিকল্পিত ভাবেই সেই সময় স্থানিয় ভারতীয় সংস্কৃতিকে ছিন্নমূল করে ইউরোপিয় ভাবনার বিস্তার ঘটানো হচ্ছিলো। এই সময় উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটালেন রুশ নাট্যমোদী গেরাসিম স্তেপানেভিচ লেবেদেভ (১৭৪৯-১৮১৬)। পন্ডিত গোলকনাথের সহযোগিতায় তিনি M. jo-drelle-এর The Disguise এবং Moliere L’Amou Medecin Love is the best Doctor নাটক দুটি বাংলায় রূপান্তর করে ১৭৯৫ সালে ধর্মতলায় মঞ্চস্থ করান। এর পর চালু থাকা ইংরেজদের এই নাটকের পাশাপাশি বাংলা নাটকের মঞ্চায়নের সূচনা হয়। আধুনিক নাটকের এই প্রসারের পরিণামে আর একটি ঘটনাও ঘটতে থাকে। এর ফলে আমাদের লোকনাট্য, আমাদের আখ্যান, পালাগান চর্চা ক্রমশ এই সব কেন্দ্রীয় শহরের বৃত্ত থেকে দূরে চলে যেতে থাকে। আজ তাই সনাতনী ভারতীয় সংস্কৃতির খোঁজে সেই প্রান্তে যেতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী শাসকের সচতুর কৌশলে ক্রমশ যুগ যুগ ধরে বয়ে আসা দেশজ মডেলগুলো ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির চাপে বাতিল হয়ে গেল, এবং সঈদ যেমন বলেছেন, ইউরোপের মডেলটিকেই মনে করা হলো শিল্পোত্তীর্ণ, ভারতীয় মডেল তুলনায় অনেক দুর্বল। উপিবেশবাদ বিরোধী চেতনার বিস্তারে আবার এই নব্য-বাংলা থিয়েটার বা নাটকের মধ্যেও ঔপনিবেশিক অবদমনের প্রতিবাদ উচ্চারিত হতে শুরু করেছিল। ১৮৬০-এ দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পন’ বা দক্ষিণাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘চা-কর দর্পন’, ‘গজদন্ত ও যুবরাজ’ নাটকগুলো যার উদাহরণ। ব্রিটিশ শাসক তাই বাধ্য হয়ে এই প্রতিবাদের উচ্চারণ স্তব্ধ করতে চায়, জারি হয় ‘নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন’।

নাটকের মতোই ইউরোপের সাহিত্যাদর্শনকেই গ্রহণ করলেন বাংলা সাহিত্যের নব্য-সাহিত্যিকেরা। এর ফলে একদিকে যেমন সাহিত্যের নতুন নতুন সংরূপ এবং প্রকাশভঙ্গী চলে এলো আমাদের সাহিত্যে এবং শিল্পকলায়, তেমনি আবার পুরোনো সমস্ত সংরূপগুলি অবহেলিত হতে লাগল, বিলুপ্ত হয়ে গেল মধ্যযুগীয় সংরূপের সম্ভার। ‘‘মহাকাব্য গীতিকবিতা উপন্যাস পঞ্চাঙ্ক নাটকেই লেখা হতে লাগল, আর কেউ মঙ্গলকাব্য লেখেন না, বৈষ্ণব শাক্ত পদাবলীর ধারা রুদ্ধ। ফলে, আধুনিক সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এইসব প্রকাশভঙ্গীর যে বিবর্তন হতে পারত তার সুযোগ আর রইলো না। সেই সঙ্গে এ কথাও মনে রাখা চাই, নতুন সংরূপগুলি যেহেতু বিবর্তনের স্বাভাবিক ধারায় এল না, এল পাশ্চাত্য সাহিত্য থেকে চালান হয়ে, আর যেহেতু সেই পাশ্চাত্য ভাবনার সঙ্গে আমার দেশের অধিকাংশ মানুষের কোন অন্তর সংযোগ তৈরি হয় নি, তাই সেই সব মানুষ এই ইউরোপীয় সাহিত্য-নাটকাদর্শকেও পুরোপুরি গ্রহণ করলেন না। এখানে প্রাসঙ্গিক ভাবেই আসে ‘জাতীয় থিয়েটার’এর প্রসঙ্গ। উপনিবেশোত্তর সময়কালে আমাদের সাংস্কৃতিক চর্চায় বি-উপনিবেশিকিকরণের ভাবনা সর্বস্তরেই শুরু হয়েছিল। ঔপনিবেশিক শাসন থাকার সময়কালে সংস্কৃতির উপর যে ঔপনিবেশিক আধিপত্য কায়েম থাকে মুক্তির পরেও তা তাৎক্ষনিক ভাবে অবসৃত হয় না, আমাদের দেশেও তা হয়নি। এই বি-উপনিবেশিককরণের চিন্তা থিয়েটার কর্মীদের মধ্যেও দেখা দিয়েছিল। ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে সঙ্গীত নাটক আকাডেমিতে এই পদক্ষেপ হিসাবে জাতীয় থিয়েটার আদর্শ সূচিত হয়। ১৯৭০-৮০ দশকে এই প্রচেষ্ঠা একটি সংহত রূপ নেয়। ‘জাতীয় থিয়েটার’এর ভাবনা আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতির আত্মার নিকটস্থ হতে চায়। নতুন এই খোঁজ ‘শেকড়ের থিয়েটার’ নামে চিহ্নিত হয়। নাট্যকারেরা, কলাকুশলীরা কথানির্ভর শরীর চালনা ও পশ্চিমি ধাঁচে দর্শক বিযুক্ত মঞ্চায়নের থেকে বেড়িয়ে এসে লোক বা আঞ্চলিক ফর্মগুলো থেকে নিজেদের উপস্থাপনার ভাষা খুঁজতে লাগলেন। এই শেকড়ের অনুসন্ধানীদের অগ্রগণ্য পানিক্কর, রতন থিয়াম, হাবিব তনবীর, গিরিশ কর্নাড, বিভাষ চক্রবর্তী, সেলিম আল দিন প্রমুখ। এরা আমাদের পুরাণ, লোককথা, স্থানীয় ঐতিহ্য থেকে তাদের কাহিনির উপকরণ, নাটকের উপকরণ গ্রহণ করেছেন। এও এক বি-উপনিবেশিকরণের যাত্রা।

নাটকের মতো সাহিত্যেও এই আত্মজিজ্ঞাসা উঠে আসতে শুরু করলো, আমরা আমাদের বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার প্রশ্নেও সেই আত্মপরিচয়ের খোঁজ লক্ষ্য করবো। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র আধুনিকতার অনেক প্রচেষ্টা আমরা দেখেছি। বলা যেতে পারে, জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক প্রকল্পটাই তাই - একটি বিশিষ্ট, স্বতন্ত্র, জাতীয় আধুনিকতার জন্ম দেওয়া। এই স্বতন্ত্র আধুনিকতার খোঁজ ও উপনিবেশবাদী মোহাচ্ছন্নতা বা কলোনিয়াল হ্যাঙ্গোভার এর বাস্তবতাকে উত্তরণের খোঁজ সমকালীন সাহিত্য সংস্কৃতির অন্যতম অভিমুখ হয়ে উঠতে পারে। বাংলা সাহিত্য, বিশেষকরে কথাসাহিত্যে এই স্বতন্ত্রের যাত্রাকে খুব গুরুত্ব দিয়ে বিচার করছেন অনেকেই। কথাকার দেবেশ রায় এই জিজ্ঞাসাটাই রেখেছেন, ‘‘একজন বাংলা ঔপন্যাসিক হিশাবে কোন শিল্পের আমি চর্চা করি, কী আমার আত্মপরিচয়? খুব আলগাভাবে আমি বলতে পারি _ আমি গল্প-উপন্যাস লিখি বা আমি একজন ঔপন্যাসিক।... ইউরোপ থেকে যারা উপনিবেশ তৈরি করতে এসেছিলেন, তাঁদের কাছে এই শব্দগুলি আমরা শিখেছি। তাঁরা এদেশে এসেছিলেন, আরো নানা দেশে গিয়েছিলেন - আফ্রিকায়, এশিয়ায়। এইসব দেশেই তাঁদের কাছ থেকে আমরা শিখেছি এইরকম ভাষায় নিজের কাজের পরিচয় দিতে - ‘আমি গল্প-উপন্যাস লিখি’, ‘আমি একজন ঔপন্যাসিক’। তার আগে আমরা জানতাম না উপন্যাস কাকে বলে, লিরিক কাকে বলে, ট্রাজেডি-কমেডি কাকে বলে। ইউরোপের এই উপনিবেশ নির্মাতারা আমাদের শেখালেন - দেশের অর্থনীতি বলতে বোঝায় শিল্প, দেশের শাসন বলতে বোঝায় গণতন্ত্র, দেশের শিল্প সাহিত্য বলতে বোঝায় এ-রকম সব ভাগ-উপভাগ - লিরিক, ট্রাজেডি-কমেডি, নভেল।এখন, গত তিন-চারশ বছরে এগুলো সাধারণ সত্য হয়ে গেছে। ইউরোপীয় আলোকপর্বের, এনলাইটেনমেন্টের, ‘আবিষ্কৃত’ এইসব সত্য বিজ্ঞানের যুগ, যুক্তির যুগ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে।... এখন, যদি কোনো ভারতবাসী প্রশ্ন তোলেন যে সাহেবরা আমাদের ভাষাগুলোকে তাদের তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে বা আমাদের সাহিত্যগুলিকে তাদের তুলনামূলক সাহিত্যতত্ত্বে ব্যাখ্যা করেছেন সেই ব্যাখ্যাই কেন একমাত্র ব্যাখ্যা বলে মানবো তখন তাকে বোঝানো হবে যে ভাষা, সাহিত্য, ধর্ম এই সব তো সনাতন বিষয়; সাহেব এলেও যা, সাহেব না এলেও তা; কলনিয়ালিজম বা উপনিবেশবাদ দিয়ে এই সার্বজনীন সিদ্ধান্তকে খাটো করে ব‌োঝো না। অর্থাৎ উপনিবেশের সুবাদে সাহেবরা আমাদের যা শিখিয়েছেন, সেগুলোই এখন উপনিবেশ-নিরপেক্ষ সাধারণ সত্য হয়ে গেছে। ১৮৬৫ বা সেই সময়কালকে সূচনা ধরলে আমাদের ‘বাঙ্গাল উপন্যাস’এর যাত্রাকাল দেড়শ বছরের আসেপাসে মাত্র। অথচ আমাদের ছিল বেশ প্রাচীন কাল থেকে বাহিত সংস্কৃতির নিজস্ব ধরন। ব্রতকথা, পাঁচালি কতকথা, কীর্তনে আমাদের একটা কাহিনির ধরন ছিল। লোক নাটক, পালাগানে আমারা আখ্যানের স্বাদ পেতাম। কথকের বলা কাহিনিগুলো আমাদের দেশজ অনুভূতির সঙ্গে নৈকট্য অনুভব করতো। চেনা জানা শোনা গল্পগুলোই বারংবার পুনঃউচ্চারণে ক্লিশে হতো না। এটাই ছিল আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক বিশেষত্ব। কিন্তু হাজার বছর ধরে তিলে তিলে গরে ওঠা এই সংস্কৃতর উপর পাশ্চাত্যবিদ্যার আক্রমণ ঘটেছিল এমনই সর্বাত্মক যে আমাদের দোইনন্দিন জীবনের ভিতসুদ্ধ নড়ে গিয়েছিল। ‘‘কবিরাজ তাঁর বিধান দেওয়ার জন্য আয়ুর্বেদের প্রাচীন গ্রন্থের চর্চা করতে পারতেন না। স্মার্ত আর তাঁর বিধান দিতে ন্যায়ের প্রাচীনশাস্ত্র ঘাঁটতে পারতেন না। স্মার্ত পন্ডিতের কথা না হয় থাক। কারণ তিনি যে-সমাজকে বিধান দেবেন সেই সমাজটাই অত্যন্ত দ্রুত পালটে যাচ্ছিল। কিন্তু আয়ূর্বেদ? তার সঙ্গে তো আমাদের বাঁচা মরার সম্পর্ক। দর্শনশাস্ত্র, সৌন্দর্যতত্ত্ব বা অন্যান্য তত্ত্বচিন্তা- সেগুলো তো হাজার হাজার বছর ধরে ছড়ানো। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের প্রতাপ এমনই সর্ব ব্যাপক যে ওই হাজার-হাজার বছর মাত্র গুটিকয়েক বছরের হিন্দু-স্ক্যলি বিদ্যায় অবাস্তব হয়ে যেতে পারে’’। (দেবেশ রায়/উপন্যাসের নতুন খোঁজে)।

তবে এটাও এড়িয়ে গেলে সত্যের অপলাপ হবে যে কেউ কেউ উত্তর-উপনিবেশবাদ ধারণাটিকে গুলিয়ে দিতে চান। উপনিবেশীকরণের মুহূর্ত থেকে আদ্যাবধী সাম্রাজ্য দখলের প্রক্রিয়ার প্রভাবিত সমস্ত সাংস্কৃতিই উত্তর-উপনিবেশীক সংস্কৃতি নয়। ইতিহাস আজ আগ্রাসী ধনতন্ত্রে বদ্ধ, ফলতঃ আর নতুন যুগের, নব পর্যায়ের ভাষা নেই। উত্তর-উপনিবেশকাল কে উত্তর স্বাধীনতার কালের সংজ্ঞায় সীমায়িত রাখা যৌক্তিক নয় আজ। আমাদের সাহিত্য ও থিয়েটারের কথা এখানে তুলে ধরা যায়। ঔপনিবেশিক যুগেই আমাদের সাহিত্যের যে নতুন পর্যায়ে উত্তরণের কথা ছিল, যে স্বপ্ন ও কল্পনার দেশজ বিন্যাসের পর্যায় গ্রথিত হওয়ার কথা ছিল তা বাস্তবে সেভাবে বিচ্ছিন্ন কিছু উদাহরণের বাইরে দেখা তেমন গেল না। সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশিক প্রক্রিয়ায় ইংরাজি শিক্ষিত ‘আধুনিক’ মন এক জটিল সমীকরণে রপ্ত, এই রহস্যময় আচরণের মধ্যেই তৈরি হয়েছে বাংলার উপনিবেশিক ‘আধুনিক’ মন। এই আধুনিকতাই বাইরের বিস্তৃত বৃহত্তর অংশের সঙ্গে আনল বিচ্ছিন্নতা। পশ্চিমি শিক্ষায় শিক্ষিত মন দ্বান্দিকভাবে তৈরি করতে চায় মনের অন্য পরিসর, স্বাধীনতা-জাতীয়তা-সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা এইসব বুদ্ধিজিজ্ঞাসা আসে ঔপনিবেশিক বাস্তবতা থেকে। উপনিবেশকতার বিপ্রতীপে জাগ্রত শিল্প যেমন একদিন খুঁজে নিতে চায় তার হারানো সংস্কৃতিকে, পুরাণ বা ঐতিহ্যকে নিয়ে আসতে চায় আওতার মধ্যে, চর্চায়, তাকে ব্যাখ্যা করতে চায় ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গিকে অগ্রাহ্য করে, তেমনি আনতে চায় লোকজীবনের ছবি, স্বদেশীয় সংকটকে তুলে আনতে।

বিংশ শতাব্দীর সূচনা থেকেই উত্তর-উপনিবেশিক মন ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যেন একটা বৈপরীত্য সৃষ্টি করতে থাকে। বাঙ্গালীর মনন খুঁজতে থাকলো সমকালীন আধুনিকতাকে। অনুভব করলো নিজ বাস্তবতার বৃহত্তর অংশের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা। যে কুহকে আক্রান্ত ছিল বাংলার মধ্যবিত্ত সেই ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতি অবচেতন ও চেতনের টান আর পশ্চিমের জ্ঞানের একতা ব্যত্যয় থেকে উলটোদিকে যাওয়া। তাঁর উপনিবেশ প্রযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত মন প্রাক-অষ্টাদশ শতাব্দীর পরম্পরা উপনিবেশিক এক মানষ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এই অ-উপনিবেশিক প্রক্রিয়ায় জাতীয়তা বোধ কাজ করেছিল কিন্তু এই জাতীয়তা পশ্চিমী জাতীয়তাবোধ লালিত। রবীন্দ্রনাথ এই পশ্চিমি অন্ধ জাতীয়তাকে অস্বীকার করে বিকল্পের রাস্তার খোজে নেমেছিলেন। কারণ তিনি জানতেন এই পশ্চিমি জাতীয়তা বিভেদের বিষবৃক্ষ রোপণ করবে। আজ সেই বিষবৃক্ষ তার ডালপালা মেলে আমাদের এই উপমহাদেশের সনাতনী সৌভ্রাতৃত্বের মধ্যে হানাহানির ও অবিশ্বাসে এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতার আমদানী করেছে। রবীন্দ্রনাথ সেই বিগত শতকের প্রথম ভাগেই বুঝেছিলেন যে পশ্চিমি জাতীয়তাবাদ আসলে নব্য উপনিবেশবাদকেই আনবে। স্বদেশের সামগ্রিক রূপ এখানে অনুপস্থিত, দেশকে আবিষ্কার করতে হবে। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শক্তি দেশ বলতে আমাদের যা বুঝিয়েছে সেখানে স্বদেশ নেই। তাঁর বিশ্বাস ছিল ভারত চিরদিন পরিচালিত হয়েছে সমাজের দ্বারা, রাষ্ট্রের দ্বারা নয়। এর আগে দেখি যে ব্রিটিশদের আগমনকে অনেক সচেতন যুগপুরুষ স্বাগত জানিয়েছিলেন। রামমোহন এদেশে ইংরেজদের আগমনকে বিধাতার আশীর্বাদ বলে মনে করেছিলেন। ইংরাজী ভাষার প্রচার, পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের আমদানী তো তিনি চেয়েই ছিলেন, এদেশে ইংরেজ জমিদারিও তিনি স্বাগত জানিয়েছিলেন। ক্রমে ক্রমে যখন ইংরেজের আগ্রাসী চেহারা দেখা দিয়েছে, শিল্পবিপ্লবত্তোর তার দেশের শিল্পের জন্য কাচামাল রপ্তানির মৃগয়া ক্ষেত্র হিসাবে ভারতবর্ষকে তারা বেছে নিল তখন সম্বিত ফিরতে লাগলো এঁদের। ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে এদেশে ইংরেজের শোষণ প্রণালী। এদেশে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের প্রসাদে রেল-স্টিমার টেলিগ্রাফ ইত্যাদীর কারণে দেশীয় মানুষের কিছু সুবিধা হলেও এর পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজদের স্বার্থ।

ভারতের নিরিখে বলতে পারি যে এই ‘স্বদেশ ভাবনা’ বা ‘দেশ’ ভাবনা বলতে যা আমাদের চেতনায় আজ ধারণ করছি তার আমদানি খুব যে প্রাচীন তাও নয়। দেশভক্তি বা প্যাট্রিয়াটিজম আমাদের ছিল কিনা বিবেচ্য। এই দেশভক্তির দুটো চেহারা আছে, একটি চেহারা উপনিবেশবাদের রূপে এসেছে, পরদেশ অধিকার ও তার উপর অবদমন, অন্যটি নিজের দেশের সমৃদ্ধি ও স্বজাতিয় প্রেম। ব্রিটিশদের নিজের দেশের প্রতি প্রেম ছিল, স্বদেশ প্রেম ছিল কিন্তু পরদেশ দখল ও উৎপীড়নে তারা পিছু পা ছিলেন না। তাদের ‘দেশপ্রেম’ পর দেশ পীড়নে বাধা দেয় নি। আমাদের দেশকে মাতৃভাবে দেখার সূচনাও এক ইংরেজের হাতেই, ডিরোজিও প্রথম ভারতবর্ষকে ‘mother’ বলে সম্বোধন করেন। সেই সময় উদ্বেল করা গান ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে’তে স্বাধীনতার স্পৃহা আছে কিন্তু মা রূপ নেই। মধুসূদন থেকে দ্বিজেন্দ্রলাল, বঙ্কিম চন্দ্র ক্রমশ দেশের মাতৃ ভাবে উন্মোচন ঘটে, রবীন্দ্রনাথেও গানেও দেশ ‘মা’ হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু এসব এক দেড়শো বছরের আগের ভাবনা নয়। এদেশে ‘জাতি’র কথাও উনবিংশ শতকের আগে শোনা যায়নি। মহাজাতী সদন বা ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নামে এর উচ্চারণ। পরবর্তীতে এই রূপটিই, শব্দগুলোই প্রধান হয়ে উঠেছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে, এদেশের প্রত্যক্ষ উপনিবেশবাদ বিরোধী আন্দোলন। এখানে স্মরণ করা যায় যে আমাদের যাকিছু আন্দোলন কৌশল, তার অধিকাংশই বিলাতী ধারণা জাত। আমাদের জাতি ভাবনা মনু, যাজ্ঞবল্কের জাতি নয়, ন্যায় সূত্রকার গৌতমের জাতিও নয়। আমাদের সভাসমিতি ভারতীয় পরিষদ নয়, বয়কট বা আমরণ আনশন কথাটিও আয়ার্ল্যান্ড থেকে আমদানীকৃত। তবে বিলাতি বলেই পরিত্যজ্য তা কিন্তু নয়। যা আমাদের অবদমিত করে, আমাদের অধিকৃত করে তাই প্রতিরোধ যোগ্য। ‘ন্যাশালিজম’ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অবস্থানে কোনো ধোঁয়াশা রাখেন নি, উপনিবেশবাদ বিরোধিতায় তাঁর ভাবনা তৎকালীন দেশীয় নেতৃত্বের থেকে স্বতন্ত্র ছিল একথা তিনিও উচ্চারণে দ্বিধা রাখেননি। জালিয়নাওয়ালাবাগ বা বঙ্গ বিভাজনের বিরুদ্ধে তাঁর ভূমিকা এদেশের উপনিবেশবাদ বিরোধী আন্দোলনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁর জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নিয়ে তাঁর অবস্থান ছিল আলাদা। তাঁর স্বপ্ন ও আদর্শের বাস্তবরূপ ‘শান্তিনিকেতন’-কে তিনি এই ঘটনা প্রবাহের বাইরে রাখতে চেয়েছিলেন তাই। ‘ন্যাশনালিজমের অপদেবতা’ সমস্ত পৃথিবীর মত শান্তিনিকেতনকেও গ্রাস করুক, এটা কোনো মতেই কবির অভিপ্রায় ছিল না। তিনি স্পষ্ঠ ভাবেই বলেছেন, ‘‘...Nationalism হচ্ছে একটি ভৌগলিক অপদেবতা, পৃথিবীর সেই ভূতের উপদ্রপে কম্পন্বিত; সেই ভূত ঝাড়াবার দিন এসেছে।... সেদিন খবরের কাগজে দেখলাম মহাত্মা আমদের মেয়েদের বলেছেন তোমরা ইংরাজী পড়া বন্ধ কর, সেই দিন বুঝেছি আমাদের দেশে দেয়াল গাঁথা শুরু হয়েছে... এ কথা ভুলেচি, যে সব দুর্দান্ত জাতি পরকে আঘাত করে বড়ো হয়ে উঠতে চায় তারাও যেমন বিধাতার ত্যাজ্য, তেমনি যারা পরকে বর্জন করে স্বেচ্ছাপূর্বক ক্ষুদ্র হতে চায় তারাও তেমনি বিধাতার ত্যাজ্য’’। (রবীন্দ্রজীবিনী/প্রভাত মুখোপাধ্যায়) অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা পত্রপ্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন যে ‘সামাজিক ভিত্তির কথা বাদ দিয়ে রাষ্ট্রিক ইমারতের কল্পনায় মুগ্ধ হয়ে লাভ নেই’। বহু আলোচিত ‘গোরা’, ‘ঘরে বাইরে’ ছিল তাঁর স্বদেশ চেতনা ঋদ্ধ আখ্যান। ‘গোরা’য় রবীন্দ্রনাথের ঔপনিবেশিক পর্বের যুগচেতনা ও ভাবাদর্শের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছে। এখানে তিনি দেখিয়েছেন পরশাসনের মর্মান্তিক নিগ্রহের পাসাপাশি হীনমন্যতা জাতির ক্ষেত্রে আত্মবিনাশকারী হয়। এই হীনমন্যতার প্রতিবাদী চরিত্র ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকের ধনঞ্জয় বৈরাগী। এই চরিত্রটি ‘মুক্তধারা’য় পরিপূর্ণ রূপ নিয়েছে। সে অত্যাচারিত হয়েও দৈহিক বলের আশ্রয় নেননি, প্রজাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন ‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব, বিষম ঝড়ের বায়ে, আমার ভয়ভাঙা এই নায়ে’। তাঁর শেষপর্বের উপন্যাস ‘মালঞ্চ’এর সময় পরিধি প্রায় ৫০ বছর, এই সময়কালের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের ফলে যে অভিঘাত সৃষ্টি হয়েছিল, ভারতবর্ষের ব্যক্তি ও সমাজকে প্রভাবিত করেছিল ‘মালঞ্চ’ সেই অভিঘাতের প্রতিফলন ধরে রেখেছে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধি আন্দোলনের আবহে তিনি বেশ কিছু কবিতা ও ছোটগল্প লিখেছিলেন, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘মেঘ ও রৌদ্র’, যেখানে বিদেশী শাসককুলের অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। ইউরোপিয় ধরনের ব্যক্তি কেন্দ্রিকতা নয় ব্যক্তির জন্য অকুতভয় আত্মসম্মান ও আত্মপরিচয়ের পথেই বি-উপনিবেশিকিকরণ একমাত্র পথ। যে বিশ্বায়ন এবং ভোগবাদের মোহনীমায়ায় সমগ্র সমাজ আচ্ছন্ন তাও তো উপনিবেশবাদেরই আর এক রূপ। এই নয়া উপনিবেশবাদ শুধু জাতীয় অর্থনীতি, সংস্কৃতিকেই নয় সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনগুলোর উৎসে আঘাত হানছে। আমারাও উপনিবেশবাদ বিরোধিতার ক্ষেত্রে এই সামাজিক ভিত্তির স্থিতি ও তার পরিবর্তনকে এড়িয়ে গেলে চোরা বালুতে পথ হারাবো।