আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২১ ● ১৬-২৯ ফাল্গুন, ১৪২৭

প্রবন্ধ

ব্রাহ্মণ্যবাদ-হিন্দুত্ব

সুখবিলাস বর্মা


ভারতের সমাজ ধর্ম ইতিহাস আলোচনা শুরু হয় সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে। সিন্ধু সভ্যতার একেবারে গোড়ার দিকে তথাকথিত বৈদিক ঋষিগণ সংস্কৃত ভাষায় যে শাস্ত্র সমূহ সৃষ্টি করেছেন তা থেকে যে ধর্মমত বা দার্শনিক মতের উদ্ভব হয়েছে তাঁর নাম বেদ। বেদ কোনো ব্যক্তির দ্বারা প্রণীত হয়নি। এই জন্য বেদ অপৌরুষেয়। সুপ্রাচীন কাল থেকে ঋষিকুলের উপলব্ধ সত্য শিষ-পরম্পরায় কথিত হয়েছে। তারই শাস্ত্ররূপ হল বেদ।

খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ পর্যন্ত কাল বৈদিক যুগ নামে পরিচিত। খ্রিস্ট জন্মের তিন হাজার বৎসর পূর্বে কেন্দ্রীয় এশিয়া থেকে আগত তথাকথিত আর্য (Aryan) যাযাবর গোষ্ঠীর মানুষ উত্তর ভারতে সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলে সিন্ধু নদের উভয় তীরে যে সভ্যতার প্রসার ঘটায় তাকেই উন্নত আর্য (Aryan) সভ্যতা বলে দাবি করা হয়েছে। অথচ মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার নগরের ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রমাণিত যে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ বছর মধ্যেই সিন্ধু উপত্যকা এবং হরপ্পা সভ্যতা একটি অতি উন্নত সভ্যতায় পরিণত হয়েছিল। এবং আর্য (Aryan)রাই সেসব ধ্বংস করেছে। কিন্তু আর্য জয় গানে সে সত্য ম্লান হয়ে গেছে। প্রাচীন ভারতের সিন্ধু সভ্যতার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সত্বেও ভারতীয় কৃষ্টি সংস্কৃতি সত্ত্বাকে বোঝার এবং জানার জন্য বেদ-কেই প্রামাণ্য হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। বেদ-প্রামাণ্যে বিশ্বাসের ইতিহাস থেকে কালক্রমে উদ্ভব হয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদ। আর্য ঋষিদের মধ্যে যারা বেদোক্ত কর্মকাণ্ডের বাহ্যসর্বস্বতায় বিরক্ত হয়ে এক আত্মতত্ত্বের অনুসন্ধানে অন্তর্মুখী হয়েছিলেন, ক্রমে তাঁরা ব্রহ্ম ও আত্মার অভিন্নত্ব উপলব্ধি করেছিলেন।

ব্রহ্ম বা পরব্রহ্ম কী? দাবি করা হয়ে থাকে যে পরব্রহ্মের ধারণার উন্মেষ ঘটেছিল বৈদিক যুগের অবসান পর্বে। এ ধারণার মর্মমূলে ছিল বেদোক্ত কর্মকাণ্ডে স্বীকৃত এবং বৈদিক স্তব-স্তুতিতে উল্লিখিত দেবদেবীকে একসূত্রে গ্রথিত করবার প্রয়াস। এই পরব্রহ্মই হলেন অসীম-অনন্ত-ভূমা। বেদ প্রণীতকার/সংকলনকারী ঋষিকুলের উপলব্ধির মাধ্যমে উন্মেষ ঘটেছে এই নিখিল-সৃষ্টি-সংক্রান্ত বুদ্ধি (universal intellect) এবং আরোপিত অঙ্গ-গুণ-ধর্ম-ক্রিয়া প্রভৃতি হীন উপকরণ বা আদিকারণ (attributeless element) ধারণার। কেন উপনিষদ অনুসারে পরব্রহ্ম হল "That which existed before creation, that which constitutes the existent whole, and that into which all creation dissolves is the all pervading Brahman, and the cycle of creation, sustenance and destruction of the universe is endless". এই পরব্রহ্ম হল সৃষ্টি ও জ্ঞান সংক্রান্ত আদ্য-মধ্য-অন্তবিহীন এক চূড়ান্ত সত্যের ধারণা যার উপরই প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ্যবাদ। ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রবর্তক প্রাচীন ঋষিগণ অনুভব করেছিলেন যে দৃশ্যমান জগৎ কিছু ঋত বা নিয়ম মেনে পরিচালিত হয়। নিয়ম থাকলে সেই নিয়মের স্রষ্টা ও পরিচালক থাকবেন। অসীম শক্তিশালী সেই নিয়ামককে ঋষিকুল খুঁজে পেয়েছেন ব্রহ্মের মধ্যে - যে সত্তা মানবীয় বিচারবুদ্ধির ঊর্ধ্বে, যার বাস্তব বা বাস্তব বহির্ভূত অস্তিত্ব নেই কারণ তিনি নিজেই প্রকৃত বাস্তব। মানুষের চোখ রং দেখতে পায়, কান শুনতে পায়, মন চিন্তা করতে পারে কীসের শক্তিতে? এই প্রশ্নের উত্তরে ঋষিগণ খুঁজে পেয়েছেন এক অন্তরতর পরিচালক (inner director)কে যার নাম আত্মা যা ব্রহ্মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত। তাই ব্রাহ্মণ্যবাদের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হল আত্মা। আত্মা অমৃতস্বরূপ, তা অজর অমর বিকাররহিত। অমর আত্মা পরব্রহ্মের অংশ হিসাবে সদা বিরাজমান। ছান্দোগ্য উপনিষদে রয়েছে 'তৎ ত্বম অসি'(Thou Art That)।

এই তত্ত্ব অনুসারে, আত্মা ও ব্রহ্মের অভেদত্ব না বুঝলে মানবাত্মার স্বরূপটি কারো কাছেই উন্মোচিত হবে না। জীবাত্মা ও পরমাত্মার ঐক্যবোধ যতক্ষণ না উপলব্ধ হয়, ততক্ষণ জীবের মুক্তি হয় না এবং পুনর্জন্ম বন্ধ হয় না। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে অবতারণা হয়েছে নানাবিধ ধর্মীয়/শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠান যার মাধ্যমে শুধুমাত্র ব্রহ্মের উপাসনা উদযাপন নয়, সমস্ত সৃষ্টির পুনরাভিনয় সংঘটিত হয়। এই পরম আরাধ্য (ultimate divine)-কে জাগিয়ে তোলার কাজটি ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত শ্রেণির মানুষেরা করতেন বেদের স্তোত্র আবৃত্তি করে, স্তবস্তুতি করে এবং গান করে। ব্রহ্ম বা পরব্রহ্মের ধারণা ছাড়াও ব্রাহ্মণেরা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন বলে এই বিশ্বাসকে ব্রাহ্মণ্যবাদ নামে অভিহিত করা হয়েছে বলেও মনে করা হয়।

সিন্ধু নদের নাম থেকে গৃহীত শব্দ 'হিন্দু' থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদের উপাসকরা প্রবর্তন করেছেন হিন্দুত্ব। সুতরাং আজকের হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠিত তার পূর্বপুরুষ বা পূর্বগামী ব্রাহ্মণ্যবাদের উপর। উপরে উল্লিখিত ব্রাহ্মণ্যবাদের সব বিশ্বাসই গ্রহণ করেছেন হিন্দুত্ববাদিরা, হিন্দুরা। ব্রাহ্মণ্যবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত এই হিন্দু ধর্মকে বলা হয় 'সনাতন বা শাশ্বত ধর্ম' (eternal order)।

সনাতন ধর্মের ধারণাটি পরিষ্কার হয়ে ওঠে প্রধানত শ্রুতি ও স্মৃতি এই দুই শ্রেণির হিন্দু শাস্ত্র সম্পর্কে আলোচনা থেকে। শ্রুতি মানে যা কিছু শ্রুত হয়েছে - প্রাচীন ঋষিগণ জীবের অস্তিত্বের প্রকৃতি বিষয়ে শুনে শুনে যে জ্ঞান লাভ করেছেন তাইই বেদ-এ নথিভুক্ত করেছেন। শ্রুতির অন্তর্ভুক্ত চার বেদঃ ঋক- সবচেয়ে পুরনো বেদ, স্তোত্র-সমগ্র; সাম-ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও পদ্ধতি, আবৃত্তি ও গান; যজু-ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির অনুমোদিত বিধি, মন্ত্র, আবৃত্তির সংকলন; অথর্ব-জাদুমন্ত্র, আবৃত্তি, স্তোত্র, প্রার্থনা ইত্যাদির সংকলন। বেদের প্রধান বিষয়বস্তু হোল যজ্ঞ (sacrifice), পূজাপার্বণ। আবার এই শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেকটির রয়েছে কয়েকটি ভাগঃ আরণ্যক-অনুষ্ঠানাদির উদযাপন; ব্রাহ্মণ-সেইসব ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির উপর মন্তব্য ও তাঁর ব্যাখ্যা; সংহিতা-আশীর্বাদ, মন্ত্র, প্রার্থনা; উপনিষদ-জীবনের গূঢ়ার্থ সম্পর্কিত দার্শনিক টীকা /মন্তব্য।

স্মৃতি শাস্ত্র হল যা কিছু স্মৃতিতে রয়েছে - স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। অতীতের মহান বীরপুরুষ, বীরাঙ্গনাদের বীরগাথা স্মৃতির বিষয়বস্তু। স্মৃতি অন্তর্ভুক্ত শাস্ত্রগুলি হল পুরাণ-লোককথা, উপকথা, সুদুর অতীতের নীতিকথা; রামায়ন-রাম সীতা লব কুশের মহাকাব্যিক কাহিনি; মহাভারত-পঞ্চপাণ্ডব ও কৌরবদের সাথে তাদের মহাযুদ্ধ ইত্যাদির কাহিনি; ভাগবদ গীতা-কৃষ্ণের অর্জুনকে ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান দান এবং জ্ঞাতি কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করার বর্ণনা; যোগসূত্র-যোগের নানা বিষয় ও শৃঙ্খলা নিয়ে টীকা। স্মৃতি অন্তর্ভুক্ত এই সব শাস্ত্রও হিন্দুর ধর্ম জীবনকে পরিচালিত করে।

সৎ-চিৎ-আনন্দ আত্মারই স্বরূপ। এর উপলব্ধিই হল হিন্দুর পরম ও চরম লক্ষ্য। ভূমার উপলব্ধিই পরম পুরুষার্থ-মোক্ষ। মোক্ষ অর্থাৎ সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্তি হিন্দু নরনারীর প্রধান লক্ষ্য। হিন্দুধর্ম অসীম অনন্ত আত্মাকেই একমাত্র সত্য বলে স্বীকার করে। আত্মা স্বরূপত অসীম, সুতরাং জীবন অনন্ত। এই ধর্মে মৃত্যুই জীবের শেষ, এই ধারণা ভ্রান্ত-মায়া। মোক্ষ লাভে অসমর্থ হলে মৃত্যুতে আত্মা দেহকে পরিত্যাগ করে পুনর্জন্ম গ্রহণ করে- নতুন দেহে প্রবেশ করে। মোক্ষ লাভে সমর্থ আত্মা ব্রহ্মের সঙ্গে বিলীন হয়ে শাশ্বত গৃহে ফিরে যায়। এইভাবে পুনর্জন্ম-মৃত্যুর চক্র, যাকে বলা হয় সংসার চক্র ক্রমাগত ঘুরতে থাকে যতদিন না আত্মা সর্ব প্রকার আনন্দ উপভোগের মাধ্যমে সম্পূর্ণ সন্তুষ্টি বা মোক্ষ লাভ করতে সমর্থ হয়।

হিন্দুধর্মের কেন্দ্রীয় ফোকাস হোল আত্মজ্ঞান; নিজেকে জানার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরকে জানা। মানব জীবনের অপূর্ণতা হল অজ্ঞান। ভাল-সৎ-শুভ ইত্যাদির অজ্ঞানতা থেকে আসে মন্দ-অসৎ-অশুভ। এই অজ্ঞান দূর করার পরম জ্ঞান রয়েছে উপনিষদে। মন্দ থেকে ভালো, অসৎ থেকে সৎ-কে চেনা, জানা এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছনো হিন্দুর জীবনের লক্ষ্য। এবং সে জন্য প্রত্যেককে নিজ নিজ ধর্ম অনুসারে কর্ম করে এগোতে হয়। মানুষ আপন আপন ধর্মানুসারে যত নিষ্ঠাসহ কর্ম করবে, ততই আত্ম-উপলব্ধির কাছাকাছি, ঈশ্বর লাভের কাছাকাছি পৌঁছবে। কাউকে এই লক্ষ্যে এগোতে সাহায্য করে বা বাধা দেয় আত্মার সহজাত তিনটি গুণ বা বৈশিষ্ট্যঃ সত্ত্ব-জ্ঞান, উত্তম; রজঃ আবেগময়তা, আগ্রাসন; তমঃ অন্ধকার, অসহায়তা, বিশৃঙ্খলতা। প্রত্যেক আত্মায় অর্থাৎ মানুষের মধ্যে এই গুণগুলি রয়েছে কমবেশি পরিমাণে। অত্যন্ত সৎ জীবন যাপনের মানুষকেও কখনও কখনও আবেগচালিত হয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়তে দেখা যায়। তাই গুণগুলি সম্পর্কে অবহিত থাকলে এবং ক্ষতিকর গুণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে মানুষ আপন ধর্মানুসারে কর্ম করতে সক্ষম হয়। বর্তমান জীবনে এই কাজ ঠিক ঠিক না করতে পারলে তাকে আবার জন্ম নিতে হবে এবং এভাবেই চলবে তাঁর পুনর্জন্ম।

এই ক্রমাগ্রসরণে সম্বন্ধযুক্ত হয়ে আছে হিন্দুধর্মের জাত-ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় কারুর জন্ম যে জাতেই হোক না কেন তার পরিবর্তন কোনক্রমেই সম্ভব নয়। সুতরাং তাকে ঐ জাতের জন্য নির্দিষ্ট কর্তব্য পালন করতে হয় এবং তা ঠিকমত পালিত না হলে তাকে পুনর্জন্ম ভোগ করতে হয়। এই ধারণার অবতারণা সর্বপ্রথম হয়েছে ভাগবদ গীতায়। গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে জ্ঞানযোগে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন, 'caturbornyong moya sristong gunokormo bibhagoshoh'. সত্ত্বাদি গুণ ও শমাদি কর্ম অনুসারে আমি ব্রাহ্মণাদি চারি বর্ণের সৃষ্টি করিয়াছি। বর্ণ বা জাত ব্যবস্থার উল্লেখ করে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন যে কোনো ব্যক্তি তার জাত নির্দিষ্ট পন্থার বাইরে জীবন যাপন করতে পারে না। ভাগবদ গীতার এই জাত বিভাগ পরবর্তী কালে আরও কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে সংকলন করা হয়েছে মনুস্মৃতিতে। মনুস্মৃতি মতে জাত ব্যবস্থা ঈশ্বরের সৃষ্টির অঙ্গ - ইশ্বর সৃষ্ট সমাজ ব্যবস্থার অঙ্গ; সুতরাং যার যে যাতে জন্ম তার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা কারুর নেই।

উপরের আলোচনা থেকে কাউকে বোঝানোর প্রয়োজন নেই যে ব্রাহ্মণ্যবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত হিন্দুত্ব ব্রহ্ম, আত্মা, পুনর্জন্ম, কর্মফল, পাপ-পুণ্য, ভালো-মন্দ ইত্যাদি অনুমানগত কিছু অবৈজ্ঞানিক ধারণার অবতারণা করে সাধারণ মানুষকে যথা সম্ভব বিপথগামী করে। এরই সঙ্গে জাত ব্যবস্থাকে যুক্ত করে এই বিভ্রান্তির কাজ অনাদি অনন্ত কাল থেকে চলছে বেদের এবং পরবর্তীতে বেদান্তের দোহাই দিয়ে।