আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২১ ● ১৬-২৯ ফাল্গুন, ১৪২৭

প্রবন্ধ

আজকের একুশে ফেব্রুয়ারির মূল্যায়ণ

গৌতম লাহিড়ী


সাল ১৯৫২। ২১ ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তানি শাসকদের পুলিশের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লুটিয়ে পড়লো তরতাজা সালাম-বরকত-জব্বর-শফিকুর। ওঁরা মাতৃভাষা বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছিল প্রতিরোধ।

৭০ বছর পর বিপরীত চিত্র। ২০২১। ২১ ফেব্রুয়ারি। ঢাকা শহরের অভিজাত ধানমন্ডি এলাকায় শহিদদের ম্যুরাল পড়ে রয়েছে অযত্নে। কয়েকহাত দূরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবাসস্থল। আজ সংগ্রহশালা। নিয়মিত যত্নের অভাবে শহিদদের ফলকগুলি হয় ভেঙ্গে গিয়েছে নয়তো ফলক দেখে বোঝাই সম্ভব নয় কার সম্পর্কে এই স্মৃতি ফলক। ধানমন্ডির এক নম্বর সড়কে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ গোলাম মওয়ালার নামাংকিত ফলক। পাথরের ফলকটি অযত্নে অস্পষ্ট। তিন নম্বর সড়কে রয়েছে মহম্মদ সুলতানের স্মৃতি ফলক। এখন আবর্জনার স্তুপ। এই এলাকার এইরকম হাল বাকি শহিদদের।

৫২ সালে পাকিস্তানের শাসক দ্বারা বাঙ্গালি সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্বপাকিস্তানের উপর জোর করে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন একদিন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের রূপান্তরিত হলো। পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে 'বাংলার ঘরে ঘরে গড়ে উঠলো দুর্গ'। বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা-সমাজতন্ত্র হলো স্বাধীন 'সোনার বাংলা' গড়ার সোপান। সুফি ইসলাম জীবন দর্শন।

কবি অন্নদাশংকর লিখেছিলেন - 'যতদিন রবে পদ্মা-যমুনা-গৌরী-মেঘনা বহমান ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।' ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকান্ডের পরে বাংলাদেশ এক অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির মুখোমুখি। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা দিয়ে বহু স্রোত বয়ে গিয়েছে। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে আধুনিক বাংলাদেশ ফের এক সন্ধিক্ষণে। মাতৃভাষার মর্যাদার দাবিতে একটা জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নজির বিশ্বে দ্বিতীয় নেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালনের বর্ষে বাংলা ভাষার প্রতি কতটা যত্নশীল হয়েছে বাঙ্গালি - আজ একুশের দিনে সেই পর্যালোচনার সময়। বাংলাভাষার মর্যাদার লড়াইয়ে শহিদদের শ্রদ্ধা জানাতে বাংলাদেশ আজ শহিদ দিবস রূপে পালন করে। অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটা কেবলমাত্র বার্ষিক শোক দিবস পালন ব্যতিত অন্য কিছু নয়। নিয়মরক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার প্রমাণ বাংলাদেশের সমাজের অভ্যন্তরে ভাষা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য পরিবর্তনের প্রয়াস চোখে পড়ছে।

১৯৯৯ সালে তদানীন্তন রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি ইউনেস্কোতে প্রথম প্রস্তাব পেশ করেন। তারপর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারি আর্ন্তজাতিক ভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। তারপরের বছর থেকে রাষ্ট্রসংঘ সেই প্রস্তাব স্বীকার করে। যে কারণে আজ সর্বত্র ভাষা দিবস উদযাপিত হয়। সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলির ভ্রাতুষ্পুত্র। দেশভাগের পর মুজতবা আলি পূর্বপাকিস্তানে চলে যান। ১৯৪৭ সালের ৩০ নভেম্বর তিনি সিলেটের কেন্দ্রীয় মুসলিমি সাহিত্য সংসদে প্রথম বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন। তারপর কলকাতার চতুরঙ্গ পত্রিকায় এক প্রবন্ধে বাংলাকে পূর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা তাঁর কাছ থেকে কৈফিয়ত দাবি করেন। কেন তিনি উর্দুভাষার বিরুদ্ধে প্রচার করছেন? মুজতবা আলি অধ্যাপনা থেকে ইস্তফা দিযে কলকাতা চলে আসেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম ভাষণে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা। বঙ্গভঙ্গর প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে গান রচনা করেছিলেন সেই 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' হবে জাতীয় সংগীত। দেশ ভাগের সময়ে বঙ্গবন্ধু বাংলা দ্বিখণ্ডিত হোক চাননি। তবুও হয়েছে। সেটা অন্য ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরে ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মেশানো নিষিদ্ধ করেছিলেন। তাঁর হত্যার পর সেনাশাসকরা সেই প্রতিবন্ধকতা বিলোপ করে। ধীরে ধীরে দক্ষিণপন্থী মৌলোবাদীদের উত্থান হতে থাকে।

গণআন্দোলনের জেরে ফের বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটে। ততদিনে সমাজের অভ্যন্তরে উদারবাদী ইসলামি চিন্তার স্থলে মৌলোবাদীরা প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। রাজনৈতিক লাভের কারণেই প্রথম বিএনপির খালেদা জিয়া পাকিস্তান পন্থি জামাত-এ ইসলামিদের শরিক করেন। এবং ঘোষণাও করেন, 'এটা ভোটের জোট। যেহেতু তাদের সাত শতাংশ ভোট রয়েছে।' এই জামাত-রা কোনোদিনই স্বাধীনতা মেনে নেয়নি।

খালেদা জিয়ার পরে শেখ হাসিনা ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ভিত্তি মজবুত করে তোলেন। বিএনপি একেবারে কোণঠাসা। পরপর তিনবার সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই ততদিনে বাংলাদেশের ইসলামিক সমাজে এক পরিবর্তন এসেছে। জামায়েতরা নির্বাচনের জন্য নিষিদ্ধ হলেও নানা নামে ছাতার মতো সংগঠন খুলে ফেলেছেন। কিছুটা শঙ্কার মধ্যেই পড়লেন শেখ হাসিনা। রাজনৈতিক স্থিরতার জন্য তিনি এঁদের একাংশের সঙ্গে সমঝোতা করে ফেললেন। এরা হেফাজত-ইসলামি। জামায়েতদের বিরোধী। তবে সুফি ইসলামের প্রবর্তক নয়।

একসময়ে এঁরা শেখ হাসিনাকে বলতেন নাস্তিক। ইসলাম বিরোধী। যেদিন শেখ হাসিনা এঁদের জমায়েতে হাজির হয়ে কার্যত সরকারি স্বীকৃতি দিলেন সেই দিন থেকে শেখ হাসিনা হেয় গেলেন কৌমি জননী। তার আগে থেকেই বাংলা ভাষায় উর্দুর প্রভাব বাড়তে থাকলো। খোদা হাফিজ হয়ে গেলো আল্লা হাফিজ। এর মূল কারণ মধ্য প্রাচ্যের ওয়াহাবি দর্শনের প্রভাব। কাশ্মীর এবং বাঙ্গালী মুসলিম কখনই মধ্যপ্রাচ্য দ্বারা প্রভাবিত ছিল না। এসবই অধুনা ঘটনা।

একসময়ে বাংলাদেশ থেকে কাজের সন্ধানে অনেকেই পাড়ি জমালো মধ্যপ্রাচ্যে। এঁরা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান ঘটালো 'রেমিটেন্সের' মাধ্যমে। কেবলমাত্র পেট্রো ডলারই নয়, এলো মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম সংস্কৃতি। যার সঙ্গে আউল-বাউল-লালন ফকিরের কোনো সম্পর্ক নেই। ধীরে ধীরে ভাষায় অনুপ্রবেশ করলো সেই সংস্কৃতি। বাংলাভাষায় অনুপ্রবেশ ঘটলো উর্দুর। যার প্রতিবাদে স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। হেফাজতের আবদার এতই বাড়লো যে পাঠ্যপুস্তকে রবীন্দনাথের 'ইসলাম বিরোধি' রচনা বিলোপ করা হলো।

পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বাংলাদেশের হৃদয় থেকে' বাদ দেওয়া হলো। হেফাজতদের মতে ঐ কবিতা হিন্দু ধর্মের প্রতি আত্মসমপর্ণ। ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ গেলো ওয়াজেদ আলির 'রাঁচি ভ্রমণ'। সপ্তম শ্রেণি থেকে শরতচন্দ্র চট্ট্যোপাধ্যায়ের 'লালু' গল্প। অষ্টম শ্রেণি থেকে উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরীর 'রামায়ণ'। লালনের 'সময় গেলে সাধন হবে না' কাঁচির কোপে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল -এর 'উমর ফারুক' ইসলাম বিরোধীর তকমা পেলো। হেফাজতের সাধারণ সম্পাদক মুফতি ফয়জুল্লা গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন - 'এমন কিছু করা হয়নি। ২০১০ সালের আগে পাঠ্যপুস্তক যেমন ছিল তেমনি করা হয়েছে।'

সুখের কথা গর্জে উঠলো শুভবুদ্ধি সম্পন্ন বাঙ্গালি। পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন নিছক পরিবর্তন নয়। এটা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার আদর্শ বিরোধী। বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক শাহরিয়ার কবীর সম্প্রতি মন্তব্য করেছিলেন, 'এই সব কটুবাদীদের বলা হয় ওয়াহাবি মুসলিম। এঁরা ইসলামের ব্যাখ্যা করে সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে যে সংবিধান তৈরি করেছিলেন সেই সংবিধানের প্রত্যাবর্তন করতে হবে।'

হেফাজতের দাবি ক্রমেই বাড়ছে। এরপর শেখ হাসিনা এবার শক্ত হাতে হাল ধরলেন। বললেন-আর নয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লঘু হতে দেওয়া যাবে না। কিছুদিন আগেই এই প্রথম সুপ্রীম কোর্টের যাবতীয় রায় বাংলায় প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত হলো। ভুল বাংলা বানান শুধরানোর উদ্যোগ হয়েছে। এটাই স্বস্তির বিষয়। একুশে পালনের দিনে আজ সকলকে দিনটির মাহাত্ম বোঝার প্রয়োজন রয়েছে। নইলে বিপদ। ভাষা না বাঁচলে জাতি বাঁচে না। বহু জাতির বিলোপ ঘটেছে ভাষার অপমৃত্যুর কারণে।