আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২১ ● ১৬-২৯ ফাল্গুন, ১৪২৭

প্রবন্ধ

‘ডবল ইঞ্জিন’-এর বিপদ-আপদ

প্রবুদ্ধ বাগচী


বেশ মনে আছে, ছোটবেলায় মা-বাবার মুখে ‘ডবল ইঞ্জিন’ কথাটা শুনতাম সম্পূর্ণ অন্য একটা প্রসঙ্গে। কোনো পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই যদি চাকরি করতেন তখন তাদের সম্বন্ধে বলা হত, ওরা তো ‘ডবল ইঞ্জিন’ অর্থাৎ আর্থিক বিচারে তাদের অবস্থা একটু ভাল। আমাদের পরিবারে বাবাই ছিল একমাত্র চাকুরে ফলে হয়তো এটা নিয়ে অভাববোধ থাকলেও থাকতে পারে। সেই প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর। কারণ এই বিশেষ সময়কালে রাজ্যের রাজনীতির উঠোনে একটা ভিন্ন প্রসঙ্গে শোনা যাচ্ছে এই ‘ডবল ইঞ্জিনে’র প্রসঙ্গ। রাজ্যের বর্তমান শাসকদল থেকে কিছু নেতা-নেত্রী সম্প্রতি ভারতীয় জনতা পার্টিতে যোগ দিয়েছেন যার ভিতরের উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের কাছে খুব স্পষ্ট নয়। সেই আবছা অংশটা আলোকিত করার জন্য এই দলবদলুরা বলে বেড়াচ্ছেন তাদের পুরোনো দলে ‘দমবন্ধ’ অবস্থার কথা। আর তারই ব্যাখ্যান সূত্রে উঠে আসছে তাদের এই প্রতীতির কথা যে রাজ্যে ও কেন্দ্রে একই দলের সরকার নাকি প্রয়োজন - এই ‘ডবল ইঞ্জিনে’র জোরে নাকি রাজ্যের উন্নয়নের কামরাগুলি আরো দ্রুতগতি হতে পারে। এই বক্তব্যের কিছুটা তাদের দল পালটিয়ে মানুষের সামনে আসার একটা নৈতিক কৈফিয়ত। তার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে, কারণ এই বিশ্বাস যদি তাদের গোড়াতেই থাকত, তাহলে সেই ২০১৪ সালেই তো তারা ওই কেন্দ্র শাসন-করা দিল্লির দলে গিয়ে ভিড়তে পারতেন, তা তারা করেননি। পরিবর্তে, গত সময়সীমায় তারা রাজ্যের মন্ত্রী হিসেবে অনেক উন্নয়নের কাজ করেছেন বলে প্রচার করেছেন, ২০১৬ সালের বিধানসভায় সেই প্রচার কাজে লাগিয়ে ভোটেও জিতেছেন। তাহলে সেই উন্নয়ন কী করে হল ? বুঝতে অসুবিধে নেই, এগুলো আসলে পাশ কাটানো কথা। কিন্তু রাজ্যে কেন্দ্রে একই সরকার অর্থাৎ ‘ডবল ইঞ্জিন’ হলে রাজ্যের উন্নয়ন হবে এই প্রচারের মধ্যে একটা বিষাক্ত ইশারা আছে, সেটা বিবেচনা করা দরকার।

প্রাক-স্বাধীনতা যুগে যখন ভারত সরকার আইন (১৯১৯) প্রণয়ন করা হয় তখন বলা হয়েছিল দশ বছর পরে এই আইনের পুনরায় বিচার বিবেচনা করা হবে। দশ বছর পূর্ণ করার আগেই ১৯২৭ সালে সেই আইনের নতুন করে মূল্যায়ন করার জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের পক্ষ থেকে কমিটি গঠন করা হয়। ১৯১৯ এর আইনে দেশের মধ্যে প্রাদেশিক আইনসভা ও কেন্দ্রীয় আইনসভার কাজ করার সুযোগ সমানভাবে রাখা হয়। যদিও সেই সময়কার ব্রিটিশ ভারতবর্ষের মধ্যে প্রদেশগুলির জন্য পৃথক আইনসভা তৈরির ভাবনা শুরু হয়েছিল আরেকটু আগে। সেই সুযোগ থেকে জাতীয় কংগ্রেস নেতারা প্রাদেশিক আইন সভাগুলিতে অংশ নিতে আরম্ভ করেছিলেন। খেয়াল রাখা দরকার এই আইনসভাতে অংশগ্রহণের প্রশ্নেই গান্ধীজির সঙ্গে চিত্তরঞ্জন দাশের মত বিরোধ হয় যার পরিণামে চিত্তরঞ্জন দাশ পৃথক ‘স্বরাজ দল’ তৈরি করেন যারা আইনসভায় অংশ নেওয়ার পক্ষে ছিলেন। ১৯২৭ সালের আগে থেকেই জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে থেকে একটি সম্ভাব্য সংবিধান রচনার কথা ভাবনা চিন্তা করা হয়েছিল। তারই সূত্রে মতিলাল নেহেরুর অধিনায়কত্বে যে সাংবিধানিক কাঠামো রচিত হয় (নেহেরু রিপোর্ট) ডিসেম্বর ১৯২৮-এ কলকাতায় সর্বভারতীয় সর্বদলীয় কমিটি সেই সংবিধান অনুমোদন করেন। সেখানেও প্রদেশ ও কেন্দ্রীয় দুটি আইনসভা ও তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ের আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়, প্রস্তাব করা হয় নতুন কিছু কিছু রাজ্য গঠনের। কাজেই আমাদের দেশের সংবিধানে পরবর্তী সময়ে যে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার কথা বলা হয় তার একটা সামাজিক ও ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত ছিল। ভারতের মতো বহু ভাষা বহু ধরনের সমাজ-সংস্কৃতি সমন্বিত দেশের পক্ষে এই যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার যে বিকল্প নেই এটা আমাদের সংবিধান প্রণেতারা ঠিকই বুঝেছিলেন। রাজ্যগুলি সবলভাবে বিকশিত না হলে যে দেশের সমৃদ্ধি অধরা থেকে যাবে এটা দূরদর্শী নেতাদের ভাবনায় প্রতিফলিত হয়েছিল।

স্বাধীনতার পর এই যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় প্রথম অনিয়মের ছড়ি ঘোরানো শুরু হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর আমলে। কোনো রাজ্যে তাঁর বিরোধীদল সরকার গঠন করলেই তাদের নানাভাবে উত্যক্ত করা, আর্থিক অনুদান থেকে বঞ্চিত করার এক ঐতিহ্য তাঁর হাতেই পুষ্ট হতে থাকে। যদিও এখানে উল্লেখ করা দরকার, কেরালায় যখন প্রথম বামপন্থীদের সরকার তৈরি হয় (১৯৫৭) তখন কেন্দ্রের নেহেরু সরকারও তাদের আঁতুড়ে মেরে ফেলার কম চেষ্টা করেননি। সেই সরকারের প্রথম বাজেট তৈরিতে সহায়তা করার জন্য কীভাবে শ্রদ্ধেয় অশোক মিত্র তিরুবন্তপুরমে গোপনে গিয়ে পৌঁছেছিলেন তার রুদ্ধশ্বাস বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর লেখায়। গত শতকের আশির দশকে রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বারবার যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে সরে আসার ও রাজ্যগুলির প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ তোলা হয়। বিশেষ করে আর্থিক বরাদ্দের ক্ষেত্রে অভিসন্ধিমূলক ভাবে উপযুক্ত অনুদান না দেওয়া বা টালবাহানা করা এইসব ছিল খুব চেনা বিষয়। মূলত রাজ্যের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্রের অধিনায়কত্বে কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে সোচ্চার হওয়া, কেন্দ্র-রাজ্য ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস, রাজ্যের হাতে আরো ক্ষমতা দেওয়ার দাবি তখন সর্বভারতীয় স্তরে মান্যতা পেতে থাকে। বিভিন্ন বিরোধী দলগুলিও এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে গলা চড়াতে থাকেন। সেই সময় এই রাজ্যের অধিকাংশ সংবাদপত্র রাজ্যের এই দাবি নিয়ে বিদ্রূপ ও সমালোচনা করলেও আদপে এই দাবির প্রতিটিই ছিল যৌক্তিক। বিভিন্ন প্রবন্ধে-নিবন্ধে নানা পরিসংখ্যান তুলে ধরে তা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়েছিল, সাংবাদিক বা কলমচিরা সেগুলো তেমনভাবে পড়ে দেখেছিলেন বলে মনে হয় না। মূলত বামপন্থীদের উদ্যোগে জোরালো হওয়া এই দাবির মুখে কেন্দ্রীয় সরকার সারকারিয়া কমিশন তৈরি করেন (১৯৮৩), যে কমিশন তাদের বিস্তারিত রিপোর্টে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে ২৪৭টি বিষয় প্রস্তাব করেন। সারকারিয়া কমিশনের রিপোর্টের সমস্ত প্রস্তাব কেন্দ্র মেনে না নিলেও অন্তত একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কথা লিখিত থাকলেও তা পালন করার ক্ষেত্রে স্বাধীনতার সাড়ে তিন দশক পরেও কেন্দ্রের সরকার উদাসীন এবং আরো অনেক কিছু সংস্কার করে রাজ্যগুলির হাতে বেশি ক্ষমতা দেওয়ার সুযোগ অন্তত থেকেই গেছে। অর্থাৎ, রাজ্যে একটা ইঞ্জিন আর কেন্দ্রে একটা ইঞ্জিন থাকবে এটা সাংবিধানিকভাবেই অনুমোদিত এবং শক্তিশালী যদি করতেই হয় তাহলে রাজ্যের ইঞ্জিনকেই বেশি অশ্বশক্তি প্রদান করতে হবে।

দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামো বিধেয় হলেও অনেকদিন অবধি তার মধ্যে একটা কেন্দ্রীয় ঝোঁকের কথা অনেক সমাজবিজ্ঞানীই বলে এসেছেন। আশির দশকে এটা নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ চর্চা হওয়ায় তা অনেকটাই উন্মোচিত হয়েছিল, সন্দেহ নেই। তবে এটাও আক্ষেপের কথা আশির দশকের দ্বিতীয় অর্ধে এই আন্দোলন প্রায় একরকম হারিয়েই গেল। জাতীয় রাজনীতিতে ইন্দিরা গান্ধীর অনুপস্থিতি এর একটা কারণ হতে পারে। তাঁর শূন্যতায় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বের মধ্যে নানা রাজ্যের নেতারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে এসে পড়লেন, তাদের নিজেদের রাজ্যের স্বার্থে কম-বেশি সোচ্চার না হয়ে পারেননি। তাছাড়া এই সময়েই রাজ্যে রাজ্যে নানা আঞ্চলিক শক্তি ক্ষমতায় আসতে আরম্ভ করে - তাঁরা অনেকেই নিজেদের রাজ্যের স্বার্থকে বাজি রেখে কেন্দ্রের থেকে নানা সুযোগ-সুবিধে আদায় করে নিতে সফল হয়। নব্বই দশকে উদার অর্থনীতির প্রবর্তন ও বিশ্বায়নের চাপে আমাদের দেশেও রাজ্য সরকারগুলি কেন্দ্রের কিছু কিছু নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়, বিশেষ করে শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের লাইসেন্স রাজের অবসান হয়। অবশ্য তার মানে এই নয় যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ক্ষমতার অবমাননার প্রসঙ্গটা উহ্য হয়ে গেল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা রাজ্যের বাম সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টা একসময় যে সারা দেশে প্রাসঙ্গিক করে তোলার চেষ্টা হয়েছিল, সেই উদ্যোগে দেখা গেল ভাটার টান। পরবর্তী সময় আমরা দেখলাম, ভ্যাট বা মূল্যযুক্ত করের দেশজোড়া প্রচলন - আদপে যা ছিল রাজ্যের রাজস্ব আদায়ের নিজস্ব ক্ষমতার ওপর সরাসরি আক্রমণ এবং রাজ্যগুলির আর্থিক স্বয়ম্ভর হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। কিন্তু ভ্যাট সংক্রান্ত সর্বভারতীয় কমিটির চেয়ারম্যান পদে আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেলাম এই রাজ্যেরই তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে, কার্যত তাঁর অধিনায়কত্বে রাজ্যগুলির স্বাধিকারের বিরোধী এই নীতি মান্যতা পেল। পরের সময়কাল নতুন কিছু দিশা দেখাতে পেরেছে এমন নয়। বর্তমান রাজ্য সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই পূর্বতন সরকারের ঋণ নিয়ে রাজনৈতিক ভাবে যতটা সোচ্চার হয়েছে, কেন্দ্র-রাজ্য ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস নিয়ে সেইভাবে কিছু বলেনি। কেন্দ্রের বঞ্চনা ইত্যাদি প্রসঙ্গ যে ওঠেনি তা নয় তবে সেটা কোনো তাত্ত্বিক কাঠামো পায়নি, যা পেয়েছিল আশির দশকে। একইভাবে কেন্দ্রের পক্ষপাতিত্ব নিয়ে প্রতিবাদ করলেও সেটার পেছনে যে যুক্তরাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মূল প্রতিপাদ্য নিয়ে ছেলেখেলা করা হয়েছে, এই প্রসঙ্গ সুনির্দিষ্ট ও জোরালোভাবে তুলে ধরার অভাব ছিল। তাছাড়া, ভ্যাট বাতিল করে সারা দেশে যখন জিএসটি চালু করা হল তা ছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় কর ব্যবস্থার সাংবিধানিক দায়বদ্ধতাকে সরাসরি অস্বীকার করা। এই প্রকল্পেও আমরা দেখলাম রাজ্যের বর্তমান অর্থমন্ত্রী সেই উদ্যোগের শরিক হয়েছেন। অথচ জিএসটি যে রাজ্য সরকারগুলিকে আরো বেশি কেন্দ্রীয় সরকারের মুখাপেক্ষী করবে এই কথা আমৃত্যু বলে এসেছেন শ্রী অশোক মিত্র - তিনি শেষদিন অবধি চেয়েছিলেন এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে একটি মামলা দায়ের করা হোক। তাঁর স্মরণসভায় অধ্যাপিকা জয়তী ঘোষ অশ্রুভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমাদের সেই কথা জানিয়েছিলেন।

এখন এই যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ক্ষমতার কাঠামোকে বিশেষভাবে আক্রমণ করার নতুন প্রবণতা ভাজপা আমলে পেয়ে গেছে এক নতুন মাত্রা। কারণটা আমাদের অজানা নয়। আরএসএস তাদের নীতিতে ভারতের বহুত্বকে আদৌ স্বীকার করে না। সংবিধান রচনার সময় যখন দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব বিবেচনা হচ্ছিল তখন সেটা তাদের মনঃপুত ছিল না কিন্তু সেই সময় যেহেতু তাদের কোনো সুগঠিত রাজনৈতিক শক্তি ছিল না তাই তারা বিষয়টাকে নিয়ে এগোতে পারেনি। পরে রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি সরকার তৈরি হওয়ার সময়েও কেন্দ্রে তাদের শক্তি ছিল সীমিত ফলে এটা নিয়ে তারা বেশি সাড়াশব্দ দেয়নি, কিন্তু গোপন অ্যাজেন্ডা হিসেবে তা জীবিত ছিল। আজ কেন্দ্রে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় এখন তারা প্রকাশ্যে এনিয়ে কথা বলছে। নতুন করে তারা প্রস্তাব করছে ‘এক দেশ এক ভোট’ যা আসলে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ভূলুণ্ঠিত করার ঘৃণ্য প্রয়াস। তাদের কাজেকর্মের প্রতিটি স্তরে কেন্দ্রীয়ভাবে সব কিছু দখল নেওয়ার মানসিকতা আজ স্পষ্ট। শিক্ষার মতো যৌথ তালিকায় থাকা বিষয় নিয়ে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ ঘোষণা করে তা চালু করার জন্য রাজ্যে রাজ্যে তারা চাপ তৈরি করছে। কৃষির মতো রাজ্য-তালিকায় থাকা বিষয়ে কেন্দ্রীয়স্তরে আইন এনে তা সারা দেশে লাগু করতে তারা মরিয়া। আইনশৃঙ্খলার মতো বিষয়ে রাজ্যের অনুমতি না নিয়ে একতরফাভাবে জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ)-কে রাজ্যে তদন্ত করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এই কথাটাও ভেবে দেখা দরকার জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য সাংবিধানিক রক্ষাকবচ (৩৭০ ধারা) সেখানকার রাজ্য সরকারকে নাকচ করে যেভাবে তারা বীর বিক্রমে বাতিল করে দিলেন তার মধ্যেও একটা উগ্র আগ্রাসনের ছাপ প্রকট। ৩৭০ ধারার মতো এই ধরনের রাজ্যভিত্তিক কিছু বিশেষ ধারা কিন্তু অন্য অনেক রাজ্যেই আছে, ক্রমশ ক্ষমতার মদমত্ততায় সেগুলির কী ভবিষ্যৎ সেই প্রশ্নও আজ অপ্রাসঙ্গিক নয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কেন্দ্রের সরকারের ভূমিকা যেন একটা নিয়ন্ত্রণকারী অভিভাবকের - যা যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ক্ষমতার সম্পূর্ণ বিপরীত। কথাটা এই রাজ্যের ক্ষেত্রেও সত্যি। সদ্য ঘটে যাওয়া আম্ফানের ত্রাণে আর্থিক সাহায্য করার ক্ষেত্রে তারা বৈষম্য করেছে - বহুবার কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দল ঘুরে যাওয়া সত্ত্বেও উপযুক্ত আর্থিক প্যাকেজ থেকে রাজ্যকে বঞ্চিত করা হয়েছে। কোভিড মোকাবিলায় মূল ভূমিকা ছিল রাজ্য সরকারগুলির, কিন্তু সীমিত আর্থিক ক্ষমতার মধ্যে তারা কাজ করলেও কেন্দ্র এই বিষয়ে কোনো বাড়তি সাহায্য তাদের করেনি। এই কেন্দ্রীকরণের সুযোগেই আজ জিএসটি থেকে রাজ্যের প্রাপ্য অর্থ দিতে কেন্দ্র অস্বীকার করছে শুধু নয় রাজ্যকে নতুন ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে নানা আপত্তিকর শর্ত চাপিয়ে দেওয়ার স্পর্ধা দেখাচ্ছে। সদ্য পাশ হওয়া কেন্দ্রীয় বাজেটে বাড়তি কর সংগ্রহ করার লক্ষ্যে তারা দেদার সেস বসিয়েছেন কারণ সেস থেকে আয় করা অর্থ রাজ্যকে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকে না - অর্থাৎ বাড়তি যা কিছু সবই একচেটিয়া কেন্দ্রের ঘরে ঢুকবে। সব মিলিয়ে তাদের ভাবভঙ্গি এমন যে রাজ্য সরকারগুলি যেন তাদের প্রজা, তারা যা বলবেন, যা ভাববেন তাতে তারা সায় দিতে না পারলেই তাদের ভাতে মারার ব্যবস্থা হবে।

বস্তুত এই জায়গা থেকেই ‘ডবল ইঞ্জিনে’র বিপজ্জনক তত্ত্ব হাওয়ায় ভাসানো হচ্ছে। অর্থাৎ, কেন্দ্রে ও রাজ্যে একই দলের সরকার থাকলে তবেই কেন্দ্রীয় প্রভুরা দরাজ হস্তে রাজ্যে দানধ্যান করবেন, রাজ্যের জনগণের কথা মাথায় রাখবেন - নইলে লবডঙ্কা! তার মানে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ধারনাটাই এখানে আক্রান্ত। কোনো রাজ্যে যদি কেন্দ্রীয় শাসকদলের প্রতিস্পর্ধী কোনো রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় এসে সরকার গড়ে, তাদের প্রতি বর্ষিত হবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ! আর সেটা সংবিধানকে সরাসরি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। আজ ‘ডবল ইঞ্জিনে’র ধুয়ো তুলে এই মোদ্দা কথাটাই আড়াল করে দেওয়া হচ্ছে। অথচ দেশের করব্যবস্থায় কেন্দ্র নানা সূত্রে সবথেকে বেশি কর সংগ্রহ করে, আর তা আসে রাজ্যগুলো থেকেই। এই সংগৃহীত করের একটা অংশ সাংবিধানিক নিয়ম মেনেই রাজ্যকে ফেরত দেওয়ার কথা, দশকের পর দশক এই বিষয়ে অনাচার হয়ে এসেছে। সকলের মনে থাকতে পারে কংগ্রেস আমলে কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের প্রাপ্য অর্থ থেকেও একসময় এই রাজ্যকেও অভিসন্ধি করে বঞ্চিত করা হয়েছিল। অস্বীকার করে লাভ নেই, আজ সারা দেশেই এই অতিকেন্দ্রিকতার ঝোঁকের মাত্রাহীন বিকাশ ঘটেছে আর সেটা ক্রমশ বিপজ্জনক বাঁক নিতে চলেছে। এই ক্রান্তিকালে উচিত কথাটা ছিল দেশের সামগ্রিক স্বার্থে রাজ্যের বিকাশ জরুরি আর তার জন্য রাজ্যগুলোকে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ করা দরকার। কেন্দ্রের ইঞ্জিন রাজ্যের ইঞ্জিনের বিপরীত দিকে চলবে কেন ? যদি দেশপ্রেমিক সরকার হয় তাহলে প্রতিটি রাজ্যের ইঞ্জিনকে বাড়তি শক্তি জোগাবে কেন্দ্রীয় ইঞ্জিন কারণ সংবিধানের সেটাই নির্দেশ - আর কী রাজ্য কী কেন্দ্র আমাদের দেশটা চলে সংবিধানকে মান্যতা দিয়ে। অথচ নির্বাচনের বাজারে জোরালো করে দেওয়া হচ্ছে ঠিক এর বিপরীত একটা স্লোগান। এনআরসি ও সিএএ নিয়ে আন্দোলনের সময় আমরা দেখেছি দেশের সংবিধান সাক্ষী রেখে ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রশ্নে সবাই কথা বলছেন। শুধু ধর্মনিরপেক্ষতা নয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোও আজ বিপন্ন। তবু এই রাজ্যের একদা মন্ত্রী সান্ত্রী রা ‘ডবল ইঞ্জিনে’র দাবি তুলে সেই বিপদকে ইচ্ছাকৃত ভাবে আড়াল করছে - তাদের সঙ্গে কী লেনদেন হয়েছে, তা দিল্লীশ্বরই জানেন!