আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২১ ● ১৬-২৯ ফাল্গুন, ১৪২৭

প্রবন্ধ

দেশ চালাবার টুলকিট

অর্ধেন্দু সেন


টুলকিট দেখে হঠাৎ এতো ভয় পেলেন কেন পিএম মোদী? টুলকিট মানে তো ইন্সট্রাকশন ম্যানুয়াল। সবার কাছেই থাকে। ম্যানুয়াল না দেখে কোনও ডিএম নির্বাচনের কাজ সম্পন্ন করতে পারে? আমরা দেখেছি রিলিফ ম্যানুয়ালে লেখা থাকত বন্যায় বা খরায় কখন কী কী করতে হবে। এগুলো টুলকিট ছাড়া কী? বিয়ের কার্ডে যে দুলাইন লেখা থাকে কোন রুটের বাস নিয়ে কোন স্টপেজে নামতে হবে তাতে কেউ আপত্তি করে? নাগরিক আন্দোলন সমর্থন করতেও সর্বাগ্রে সেটাই জানতে হয়। আজকের জমায়েত কোথায়? সেখানে কিভাবে পৌঁছনো যায়? কোন কোন মেট্রো স্টেশন বন্ধ? কাছেপিঠে অন্য স্টেশন আছে কি?

একই সফটওয়্যার কাজে লাগে অ্যামেরিকায় হংকং-এ আর দিল্লিতে। তাই বোধহয় মাঝে মধ্যে এডিট করে নিতে হয় কয়েক লাইন। দিশা যেমন করেছিল। কৃষক দরদি নাগরিক টিকরি বর্ডারে না গিয়ে ওয়াল স্ট্রিট চলে গেলে কী করে হবে? তাতেই এফআইআর হয়ে গেল? টুলকিট তৈরি করেছে নাকি এক খালিস্তানি সংস্থা। টুলকিটে কী আছে তা কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে তা যখন অপ্রাসঙ্গিক তখন সেই টুলকিট কে তৈরি করেছে তা তো প্রাসঙ্গিক হবেই। কিন্তু টুলকিট কে পয়সা দিয়ে তৈরি করিয়েছে কাকে দিয়ে লিখিয়েছে তা কজন জানতে পারে? আজকাল তো অ্যাপ ছাড়া কোনও কাজই হয়না। দেখে নিতে হবে কোন অ্যাপ কার তৈরি? নাকি কর্পোরেটদের ছাড় দেওয়া আছে?

সমস্যা হল দেশ চালাতে যেসব টুলকিট ব্যবহার করা হচ্ছিল অর্ধ শতাব্দী ধরে সেগুলোর ডেট পেরিয়ে গেছে। পণ্ডিত নেহেরুর ফ্যাবিয়ান সোশ্যালিজম চালাতে চেষ্টা করুন। চলবে না। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা চলল ছয় দশক ধরে। সেও বন্ধ হয়ে গেল। অর্থনীতির কৈলাস পর্বতগুলো ছিল সরকারের হাতে। ওনাদের পছন্দ হল না সেটা। বৃদ্ধির হার কম থাকলেও বেলাগাম অসাম্য ছিল না। বৃদ্ধির স্বার্থে অর্থনীতিকে মুক্ত করা হল। অভিভাবকেরা বললেন এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। তাই হল কি? দেখলাম উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত খুশি। বিদেশ যাবার জন্য যতো ডলার দরকার পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু লোকচক্ষুর আড়ালে ক্ষোভও কম ছিল না।

অর্থনীতি না রাজনীতি? কোনটা চালায় আর কোনটা চলে? এ প্রশ্ন উঠলে মনে পড়ে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের বিখ্যাত উক্তি - ইট ইজ দি ইকনমি স্টুপিড। নব্বইয়ের দশক ছিল নয়া উদারনীতির যুগ। ওয়াশিংটন কনসেন্সাসের যুগ। মুক্ত বাণিজ্যের বিরুদ্ধে কেউ একটা কথা বললে তাকে বেঞ্চির উপর দাঁড় করিয়ে দেওয়া হতো। সেই তত্ত্ব মার খেল ওয়াশিংটনেই। ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে। আমেরিকান ছেলেমেয়েরা চাকরি পাবেনা চাকরি পাবে ভারতীয়? নিকুচি করেছে এমন উদারবাদের। ব্রিটেন বেরিয়ে গেল ইউরোপ ছেড়ে। ভারতে তখন যারা উদারনীতিতে স্বচ্ছন্দ ছিল তারা এখন আত্মনির্ভরতায় স্বচ্ছন্দ। একসময় এটা নেহেরুর মন্ত্র ছিল। সে আর কতজন মনে রেখেছে? অনেকে রাজনীতি অর্থনীতি দুই বর্জন করে দুর্নীতির আশ্রয় পেয়েছেন। তাঁদের কথা আলাদা। কিন্তু কিসের প্রভাবে অর্থনীতি সারেন্ডার করল রাজনীতির কাছে? লিবারালিজম সারেন্ডার করল গোঁড়ামির কাছে?

ব্যাপারটা ঘটেছে গোটা বিশ্বে। কোনও একজন দুজন লিডার এর জন্য দায়ী নন। তবে আমাদের দেশে একটা বড় কারণ ছিলেন পিএম মোদী নিজেই। আরএসএসের প্রচারক ছিলেন। ঘোর জাতীয়তাবাদী। হিন্দু-মুসলিম বাইনারি ছেড়ে ভাবতে শেখেননি। হিটলার মুসোলিনির ভক্ত। কংগ্রেস সরকার ইসলাম ধর্মীদের হজের খরচ দিত। মোদী বড়জোর যাবারটা দিতে রাজী ছিলেন। ফেরারটা নয়। অযোধ্যা ৩৭০ ধারা ইউনিফরম সিভিল কোড এইসব স্বপ্ন নিয়ে সিংহাসনে বসলেন তিনি।

ভক্ত জুটে গেল প্রচুর। কিন্তু ভক্তের পয়সায় নির্বাচন লড়া যায়না। তাই শিল্পপতির সাহায্য নিতে হল। প্রতিদানে তাঁরা পেলেন মেক ইন ইন্ডিয়া। সে প্রোগ্রাম জমল না। কারণ পিএম মোদীর মন পড়ে রইল অন্যত্র। একটা পুরনো গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে। অফিসারদের মিটিং চলছে। মমতা যথারীতি ছবি আঁকছেন। একসময়ে মিটিং শেষ হল। বিদায় নেবার পালা। এক এক জন কাছে এসে ছবি দেখছেন আর ভূয়সী প্রশংসা করছেন। মমতা শুনছেন অথচ শুনছেন না। এক বিশেষ পেয়ারের অফিসার আসাতে উনি আর চুপ থাকতে পারলেন না। বললেন 'অথচ দেখ আমার মন তো ছিল মিটিং-এ'। পিএম মোদীর মন উন্নয়নে থাকলে কি হতো?

কিন্তু প্রভু মন্দির না হয় হল। অযোধ্যায় হল কাশিতে বৃন্দাবনে হল। গরীব মানুষের আর মধ্যবিত্তের দুর্দশার তো শেষ নেই। রান্নার গ্যাসের দাম বেঁধে রাখা যাচ্ছে না। অবসর পেয়ে লোকে ব্যাঙ্কের ইন্টারেস্ট নিয়ে কোনওরকমে বাঁচতে চাইছে। আমরা ইন্টারেস্ট কমাতে বাধ্য হচ্ছি। এরা রুখে দাঁড়াবে না তো? যুবক যুবতি চাকরির জন্য মিছিল করবে না তো? কিছুদিন আগেও ট্রাম্পকে দেখে মনে হচ্ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সেও তো প্রভু তোমার টুলকিট ব্যবহার করছিল। উইপোকার অঙ্কটা তো ভালই বুঝেছিল। তাকে বিদায় নিতে হল কেন? সে এক কাহিনি বুঝলি। জিজ্ঞেস করে ভালই করেছিস। যখন শুনলাম যে ব্যাটা টুলকিট ব্যবহার করে কিন্তু পয়সা বাকি রাখে তখন ইউএপিএ আর সিডিশনের চ্যাপ্টারটা কেটে রেখে দিয়েছিলাম। ও ভাবল সুপ্রিম কোর্টে লোক ঢোকালেই হবে।

আমাদের দেশে গণতন্ত্রের প্রতিটি স্তম্ভ উপড়ে ফেলা হয়েছে। আমরা এর জন্য মোদীকেই দায়ী করি। সেটা ঠিক নয়। অ্যামেরিকার পিউ সেন্টার নামক থিংক ট্যাঙ্ক ২০১৭ সালে একটা সমীক্ষা করে। ৩৮টা দেশে ৪৫ হাজার লোকের মতামত নেওয়া হয়। স্যাম্পল সাইজ খুবই ছোট। কিন্তু দেখা যায় সব দেশেই লোকজন গণতন্ত্রের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। অনেকেই মিলিটারি শাসনের জন্য তৈরি। ভারতীয়রা বিশেষ করে কম বয়েসিরা চায় শক্তিশালী নেতা।

পিএম মোদী নিশ্চয়ই জানতেন যে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁকে ক্ষমতায় আনা হয়নি। সময় কম। অনেক পথ চলতে হবে। চিনকে ডিঙ্গিয়ে যেতে হবে। নির্বাচন লেগে থাকলে কাজ হবে কখন? একজন কৃষকের আপত্তিতে একশ মাইল লম্বা রাস্তা আটকে থাকবে? হস্তিনাপুর তৈরির কাজেও টেন্ডার ডাকতে হবে? ময় দানবকে ডেকে কাজ দিলে হবেনা? তাই মোদীর সমর্থনে হাত মিলিয়েছে গোঁড়া ধর্মান্ধ আর 'যে কোনও মূল্যে উন্নয়ন'-পন্থী মধ্যবিত্ত। কংগ্রেস আর একটা গোরু বললে কি সবটা পরিষ্কার হয়?

এই যে দিল্লি থেকে পুলিশ পাঠিয়ে দিশা রবিকে তুলে আনা হল দেশের মানুষের উপর এর কী প্রভাব হল? এক তো যারা মোদী বিরোধী যারা সুযোগ পেলে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করতে চান তারা একটা পরিষ্কার মেসেজ পেলেন যে কাউকে ছাড়া হবেনা। দিশার বেল পাওয়া যে ব্যতিক্রম তা সবাই জানে। তাতে কারও উৎসাহিত হবার কথা না। এর আর একটা প্রভাবও নিশ্চয়ই আছে। সরকারের কঠোর মূর্তি দেখে অনেকেই ভাববে দেশের বড় বিপদ। বাইরে শত্রু ভিতরে শত্রু। এমতাবস্থায় সরকার বাহাদুরের বিরোধিতা হবে নিজের পায়ে কুড়ুল মারার সামিল।