আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২১ ● ১৬-২৯ ফাল্গুন, ১৪২৭

প্রবন্ধ

বিপন্ন ‘দেবভূমি’

মালবী গুপ্ত


কেউ কথা শোনেনি, কেউ কথা শোনে না। শুনলে হিমালয়ান রাজ্য উত্তরাখন্ডের পাহাড় ভেঙে ভেঙে, তার অরণ্যকে নির্মূল করতে করতে সেখানে ‘উন্নয়ন’র এমন বুলডোজার চালানো হত না। পৃথিবীর এই নবীনতম পর্বতমালা যে অত্যন্ত ভঙ্গুর, ভূমিকম্প প্রবণ, ক্ষয় প্রবণ, ধস প্রবণ এবং যার বাস্তুতন্ত্রও খুবই স্পর্শকাতর, তার বুকের ওপর এমন নৃশংস ধ্বংস যজ্ঞ চালানো হত না। এবং গত কয়েক দশক ধরে পরিবেশ-বিজ্ঞানী, ভূ-বিজ্ঞানী, জীব-বিজ্ঞানীদের বারবার উচ্চারিত সতর্কবার্তাকেও কিছুমাত্র গুরুত্ব ও মান্যতা দিলে, গত ৭ ফেব্রুয়ারি চামোলীতে মর্মান্তিক বিপর্যয়ও হয়তো ঘটত না। হিমালয়ের অন্দরে কন্দরে হারিয়ে যেত না অসহায় অত মানুষের প্রাণ।

অথচ সেই কোন যুগ থেকে মানুষের বিশ্বাসেই এই হিমালয়ান রাজ্যটি অধুনা উত্তরাখন্ড ‘দেবভূমি’র মাহাত্ম্যে উজ্জ্বল। যেখানে স্মরণাতীত কাল থেকে কেদারনাথ সহ চারধাম, পঞ্চকেদার তার দুর্গম অন্তঃপুরে লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রীকে আকর্ষণ করে চলেছে। যেখানে জীবনের ঝুঁকি, পথের ক্লান্তি আর কষ্ট উপেক্ষা করে আবহমান কালের সেই তীর্থযাত্রায় কখনও ছেদ পড়েনি। কিন্তু আজ সেই ‘দেবতাত্মা হিমালয়’র অন্তরাত্মাটিকেই যেন প্রচন্ড ঔদ্ধত্যে উপড়ে ফেলার চেষ্টা চলেছে।

সেই আশির দশকেই হিমালয়ের বুকে আওয়াজ উঠেছিল ‘বাঁধ নেহি চাহিয়ে, বাঁধ পাহাড় কা বিনাশ হ্যায়’। সুন্দরলাল বহুগুণার নেতৃত্বে বহু বিতর্কিত তেহরি ড্যাম নির্মাণের প্রতিবাদ আন্দোলনে সোচ্চার হয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পরেও বারবার পরিবেশকর্মী সহ পাহাড়বাসীরা ব্যাসী জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, পঞ্চেশ্বর ড্যাম, অলকানন্দা, মন্দাকিনী, ভাগীরথী ইত্যাদির ওপর ড্যাম ও নানা জল বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। প্রতিবাদে অনশনে জীবনও দিয়েছেন ৮৬ বছরের পরিবেশ কর্মী জি ডি আগরওয়াল। এখনও কান পাতলেই উত্তরাখন্ডের পাহাড়ে পাহাড়ে সেই প্রতিবাদের প্রতিধ্বনি শোনা যায়।

প্রসঙ্গত, ২০১৩’র ওই বিপর্যয়ের পর ২০১৪ তে সুপ্রিম কোর্টের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শই ছিল, এমন স্পর্শকাতর বাস্তুতন্ত্র ও ভঙ্গুর এই পার্বত্য অঞ্চলকে বাঁচাতে হলে অন্তত ২৩ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প খারিজ করতে হবে। এবং ২০১৬ তেও কেন্দ্রীয় জলসম্পদ, নদী উন্নয়ন ও গঙ্গা পুনরুজ্জীবন মন্ত্রক সুপ্রিম কোর্টে একটি এফিডেভিট দাখিল করেছিল। এই মর্মে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঠেকানো, জীববৈচিত্র্যকে অক্ষত রাখা এবং গঙ্গা নদীর উৎস স্থলের সংরক্ষণের জন্য উত্তরাখন্ডের বিশেষ কিছু উপত্যকাতে কোনোভাবেই হাত দেওয়া উচিৎ নয়।

কিন্তু সেই সতর্কবাণীকে কি কোনো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে? দিলে সেখানে এমন নির্বিচারে অসংখ্য ড্যাম, জল বিদ্যুৎ প্রকল্প, যথেচ্ছ নগরায়ন হত না।এবং সর্বশেষ দ্রুত গতিতে ‘চারধাম যোজনা’ প্রকল্প (১২,০০০ কোটি টাকার প্রকল্প) রূপায়ণের জন্য ৯০০ কিলোমিটার রাস্তা চওড়া করার কাজও তো চালু থাকত না। তাতে কনট্রাক্টর ও ধর্মব্যবসায়ীরা অবশ্য উল্লসিত হচ্ছেন। তবে বলা বাহুল্য যে, সেই উল্লাস হয়তো দীর্ঘস্থায়ী হবে না। নাই বা হল। আপাতত তো পাহাড়ে ‘উন্নয়ন’ ও ‘বিকাশ’ তাদের দুধে ভাতে রাখছে।

এবং দেখা যাচ্ছে সেই ১৯৯১ থেকে ২০২১, ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত তিন দশক ধরে বারবার গাঢ়বাল হিমালয়বাসীর জীবন গভীর সঙ্কটে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। তবে এই হিমালয়ান রাজ্যটিতে যে ৫টি বৃহৎ প্রাকৃতিক বিপর্যয় আছড়ে আছড়ে পড়েছে, তার সলতেটি কিন্তু পাকানো শুরু হয়েছিল বহু আগেই। তাতে রাজ্যের স্থানীয় পাহাড়বাসীদের তাতে কোনো ভূমিকা না থাকলেও সরকারি নানা উদ্যোগ তাঁদের জীবন জীবিকাকে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ধ্বস্ত করে চলেছে।

বিগত এক দশক ধরে উত্তরাখন্ডে ঘোরার সুবাদে যার কিছুটা জানার সুযোগ হয়। যেমন হয়েছিল রেনিতে। গাঢ়বাল হিমালয়ে চামোলীর রেনি ভিলেজে একবার অন্তত পৌঁছনোর বহুদিনের স্বপ্ন ছিল। ২১শে নভেম্বর, ২০১৯ এ সেখানে হাজির হলাম। নীচে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঋষিগঙ্গা। কে জানত বছর খানেক পরেই তার ওই শান্ত নীল জলরাশি হঠাৎ চামোলীর জীবনে দুঃখের নদী হয়ে উঠবে।

সেই রেনি গ্রাম, যেখানে সত্তরের দশকের শেষ দিকে প্রথম যোশীমঠের গোবিন্দ সিংহ রাওয়াতের হাত ধরে, গৌরা দেবীর নেতৃত্বে গাছ কাটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠেছিল। যিনি বেশ কিছু মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গলে ছুটে গিয়েছিলেন গাছ বাঁচাতে। দু’হাতে তাঁরা জড়িয়ে ধরেছিলেন গাছ। এবং তাঁদের সেদিন অহিংস সেই প্রতিবাদের সামনে বাধ্য হয়েই উদ্ধত কুঠার নামিয়ে ঠিকেদারদের ফিরে যেতে হয়েছিল। রেনি গ্রামই সেদিন হয়ে উঠেছিল চিপকো আন্দোলনের আঁতুড় ঘর।

ইচ্ছে ছিল, সেই রেনিতে গৌরা দেবীর মুখোমুখি হয়ে তাঁর আন্দোলনের কথা, তাঁর অতীত বর্তমানের আশা নিরাশার কাহিনী শুনবার। নাহ, সেই স্বপ্নটি পূরণ হয়নি বটে, কিন্তু নীচে বয়ে চলা ঋষিগঙ্গাকে পেছনে রেখে ‘চিপকো আন্দোলন কী জননী স্বর্গতা শ্রীমতী গৌরা দেবী স্মৃতি দ্বার’ পেরিয়ে, খাড়াই পাহাড়ি ভাঙাচোরা পথ ধরে শেষপর্যন্ত তাঁর ঘরের দরজায় হাজির হতে পেরেছিলাম।সুযোগ পেয়েছিলাম তাঁর পুত্র ও তাঁর সহযোদ্ধোদের সঙ্গে কথা বলার।

পথেই পরিচয় হয়েছিল রঘুবীর সিং’র সঙ্গে। পাহাড় কাঁপিয়ে গাছ বাঁচানোর সেই চিপকো আন্দোলনের জন্মের সময় যাঁর বয়েস ছিল ১৩/১৪। যাঁর মা মালমতী দেবী, বাবা দয়াল সিংহ ছিলেন গৌরা দেবীর সহযোদ্ধা। সেদিন শৈশব স্মৃতি হাতড়ে রঘুবীর বলছিলেন, সেই সময় রেনিতে চির, দেওদার, বাঞ্জ, রাগা ইত্যাদি গাছের ঘন জঙ্গল ছিল। যে জঙ্গলের গাছ বাঁচাতে তপোবন থেকে সেদিন রেনিতে বহু লোক এসে যোগ দিয়েছিলেন আন্দোলনে। মনে হচ্ছিল সেই অরণ্যের স্মৃতি নিয়ে চারপাশের পাহাড় যেন আজ স্তব্ধ হয়ে আছে। আশ্চর্য, সম্প্রতি সেই তপোবনের বুকেই হঠাৎ আছড়ে পড়ল ধ্বংসের প্রবল ঢেউ। এখনও তার জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের অন্ধকার সুড়ঙ্গের জল কাদায় কত শ্রমিকের নিথর দেহ যে আটকে আছে কে জানে।

গৌরা দেবীর উত্তরসূরি এবং তাঁর সেদিনের সহযোদ্ধারা আজকের ‘উন্নয়ন’এ প্লাবিত গাঢ়বাল হিমালয়ে কেমন আছেন। তাঁদের আশা আকাঙ্খা কতটা পূরণ হল তা জানার কৌতূহলই আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল রেনি গ্রামে। প্রায় গাছহীন গ্রামের পাহাড়ি পথ ভাঙতে ভাঙতে সেদিন মনে হচ্ছিল, গৌরা দেবীরা একদিন যে পাহাড় অরণ্যের গাছ পালা সহ তার সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, তাঁদের বননির্ভর সনাতনী জীবন ও জীবিকা রক্ষার লক্ষ্যে যে আন্দোলনের মশাল জ্বেলেছিলেন, পরে চন্ডীপ্রসাদ ভাট, সুন্দরলাল বহুগুণাদের নেতৃত্বে সেই আান্দোলনের বীজই তো ছড়িয়ে পড়েছিল সমস্ত হিমালয়ের প্রত্যন্ত কোণেও। যে আন্দোলনের ঝোড়ো হাওয়া তৎকালীন উত্তরপ্রদেশ ও ভারতের গন্ডী ছাড়িয়ে পৌঁছেছিল পৃথিবীর নানা প্রান্তে।

কিন্তু রেনির পথে সেদিন মনে হচ্ছিল তাঁদের হিমালয় বাঁচানোর সেই প্রতিবাদ-আন্দোলন, তাঁদের সেই উদ্যোগ সবই যেন বৃথা গেল। আজ সেখানে তথাকথিত ‘উন্নয়ন’র চাকার দানবীয় শব্দের নীচে তাঁদের সেই স্বর চাপা পড়ে গেছে। কিন্তু সেই রুদ্ধ স্বর থেকেও বেদনা ঝরে পড়ছিল প্রয়াত গৌরা দেবীর ৭৭ বছরের পুত্র চন্দর সিংহ রাণার কথায়।

ঋষিকেশ থেকে রেনি গ্রাম যাওয়ার দীর্ঘ পথেই মাইলের পর মাইল জুড়ে কেবলই যে ধ্বংস চিত্র প্রত্যক্ষ করছিলাম। পাহাড় গুঁড়িয়ে দৈত্যাকার সব যন্ত্রদানবের সাঁড়াশির টানে বড় বড় পাথরের চাঁই গড়িয়ে পড়ছিল গিরিখাদে, কখনো নদী তটে। আকাশ ঢেকে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষদের শিকড় উপড়ে টেনে নামানোর কাজ চলেছিল অবিরত। এবং রাজ্য জুড়ে পাহাড়ের ওই আরণ্যক আচ্ছাদনটিকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে তাকে ক্রমশ বেআব্রু করার প্রক্রিয়ার শিকার তাঁরা স্থানীয় বাসিন্দারা, কীভাবে হচ্ছেন চন্দর সিং বলছিলেন সে কথা।

‘দেবভূমির বাসিন্দা হিসেবে গর্বিত’ চন্দর সিং’র কথায় কথায় বিপুল ক্ষোভও প্রকাশ পাচ্ছিল। কারণ পুরুষাণুক্রমে যে পাহাড় ও অরণ্য তাঁদের তাবৎ প্রাত্যহিক চাহিদা মিটিয়ে এসেছে। প্রজন্ম ধরে যাকে তাঁরা আগলে রেখে, জীববৈচিত্রের ভারসাম্য বজায় রেখেছেন, দেশের সরকার আজ সেই পাহাড় অরণ্যকেই তাঁদের কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে।কোনো ক্ষতিপূরণ না দিয়ে, বিকল্প জীবিকার প্রতিশ্রুতি মাড়িয়ে সরকার ক্রমাগত তাঁদের অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

পাহাড় ভাঙায় একদিকে জমি হারাচ্ছেন তাঁরা। অন্যদিকে ক্রমশ জঙ্গল সঙ্কুচিত হওয়ায় খাদ্যের অভাবে বন ছেড়ে বেরিয়ে আসছে প্রাণীরা।তাদের হাত থেকে অবশিষ্ট শস্য ক্ষেতের নামমাত্র ফসলটুকুও যে আজ তাঁরা ঘরে তুলতে পারছেন না। গ্রামে স্কুল না থাকায়, কাজ কর্ম না মেলায়, তাঁদের ছেলে পুলেরাও যে সব বাইরে চলে যাচ্ছে, সেই অসহায়তা, সেই বিপন্নতা ধরা পড়ছিল গৌরা দেবীর সহযোদ্ধা কলাবতী, বচন সিংহদের কথায়।

মনে পড়ছে, ২০১১’র ফেব্রুয়ারির কথা। সেসময় দেবপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ, উখিমঠ যাতায়াতের পথেও দীর্ঘ সময় ধসে আটকে থেকে, প্রায় প্রাণ হাতে নিয়ে অসংখ্য ল্যান্ডস্লাইড, ও ‘রক ফল’ জোন পেরতে হয়েছিল। দু’পাশে সবুজহীন ন্যাড়া পাহাড় দাঁড়িয়ে। যে পাহাড়ের ঢাল গড়িয়ে সব সময় নেমে আসছে ধস আর মারণ পাথরের চাঁই। যার ধাক্কায় কত যাত্রী-গাড়ি মন্দাকিনী, অলকানন্দার প্রবাহে বছর বছর তলিয়ে যায়, আমাদের গাড়ি চালক অমিয় চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শুনেছিলাম সে কথা। কোকড়াগাডে মন্দাকিনীর ধারে যশপাল সিং নেগির বাড়িতে বসেও শুনেছিলাম গাঢ়বালের পাহাড়, প্রকৃতি ক্রমশ বদলে যাওয়ার কাহিনী। পরে জেনেছিলাম ২০১৩ সালে কেদারনাথ’র ভয়ঙ্কর প্লাবন-ধসে সেখানকার অন্যান্য ঘর বাড়ির মতো নেগির বাড়িটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।নেগিকে সরে যেতে হয়েছে অন্যত্র।

একদিকে নির্মাণ আর একদিকে জলবায়ু পরিবর্তন - দুইয়ের প্রভাবে এই দেবভূমির ভবিষ্যৎ যে কেবলই অনিশ্চিৎ হয়ে পড়ছে, গবেষকদের রিপোর্ট যেন সে কথাই বলেছে। ২০১৯ এ হিমালয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে প্রকাশিত ২০০’র বেশি বিজ্ঞানীর যৌথ গবেষণা রিপোর্ট আমাদের জানিয়ে দিয়েছে, কী হারে সেখানে তাপমাত্রা বাড়ছে ও হিমবাহগুলি গলছে। এবং ১৯৭৭ সাল থেকেই নেপাল হিমালয়ে গ্লেসিয়াল লেকের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে।সংলগ্ন ভারতের রাজ্যগুলিতে যার প্রভাব তো অনিবার্য। বলা হয়েছে, ক্রম বর্ধমান বিশ্ব উষ্ণায়নে সেখানে দ্রুত সঙ্কুচিত হতে থাকা হিমবাহর তুষারগলা জলে তৈরি লেকগুলি উপচে বিধ্বংসী প্লাবন আর ধসে হিমালয়ের নদী পাহাড় অরণ্য জনপদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে।

পারে না, পারছে। কারণ উত্তরাখন্ডে ঠিক তেমনটাই যে ঘটে চলেছে, বিগত কয়েক দশকের ঘটনায় তারই সমর্থন মেলে। যেমন ১৯৯১ এর অক্টোবরে উত্তরকাশী প্রবল ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল। ৭৬৪ জন মানুষ মারা গিয়েছিলেন। ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল হাজার হাজার বাড়ি। ১৯৯৮ এ পিথোরাগড় জেলার মালপা গ্রামটি ধসে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তাতে যে ২৫৫ জন মারা গিয়েছিলেন, তার মধ্যে ৫৫ জনই ছিলেন কৈলাস-মানসরোবরের তীর্থযাত্রী। ১৯৯৯ এ চামোলীর ভূমিকম্প প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল ১০০ জনের। সংলগ্ন রুদ্রপ্রয়াগ জেলাতেও সেই বিপর্যয়ের ধাক্কা এসে লেগেছিল।

আর সরকারি হিসেবেই উত্তরাখন্ডে প্রায় ৯০ লক্ষেরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ২০১৩ সালের বিধ্বংসী হড়কা বান ও ধসে। যাতে প্রায় ৬০০০ মানুষের প্রাণ যায়। মারা পড়ে ৯২০০ গবাদি পশু। নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ৩৩২০ বাড়ি। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৪২০০ গ্রাম। আর কত রাস্তা, সেতু ধ্বংস হয়েছে, কত মানুষ যে তাতে আজও নিখোঁজ রয়েছেন তার কোনো সঠিক হিসেবই মেলা ভার। তাই প্রশ্ন - উন্নয়ন তবে কিসের? উন্নয়ন তবে কাদের জন্য? প্রশ্ন, বছরের পর বছর ধরে উত্তরাখন্ডে এই যে বিপুল প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদ এবং পরিবেশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটছে, বিশেষজ্ঞ ও পন্ডিতেরা তার সামগ্রিক আর্থিকমূল্য কষে ফেলতে পারবেন তো?

কারণ, দেবভূমিতে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের নানা উদ্যোগ যে ‘উন্নয়ন’র গাজর ঝুলিয়ে তাকে ক্রম ধ্বংসের কিনারে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, তাতে বুঝি আজ কারো দ্বিমত হবে না। হিমালয়ের বিপুল পরিমাণ বরফ, যা উত্তর দক্ষিণ মেরুর পর সর্বাধিক, হিমবাহ, যা আমাদের গঙ্গাসহ অসংখ্য নদ নদীকে জলের জোগান দেয়, সেই হিমবাহ ঢাকা পড়ছে সেখানে লাগাম ছাড়া নির্মাণ কাজের ব্যাপক দূষণে। ক্রমশ গাছহীন পাহাড়ে উষ্ণতা বাড়ছে দ্রুত হারে। কিন্তু সব মিলিয়ে এই ভঙ্গুর হিমালয়ের তাবৎ স্বাভাবিক প্রবণতা সম্পর্কে গত কয়েক দশক ধরেই বিশেষজ্ঞরা সাবধানও তো করছেন। এবং তাঁদের দ্বারা পরিচালিত বহু কমিটিও সতর্কতার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এক নির্লজ্জ ঔদ্ধত্য ও অহমিকায় সেই সবই উপেক্ষা করে চলেছে দেশের সরকার।

যার অমোঘ অনিবার্য পরিণতিতে বারবার বিপর্যয় নেমে আসছে দেবভূমি’তে। কিন্তু সরকার দেশবাসীর হাতে ‘উন্নয়ন’র ললিপপ ধরিয়েই যাচ্ছে। আর সেই ললিপপ ধরা হাতে, ‘উন্নয়ন’র মায়াঞ্জন চোখে আমরা কেউ কেউ আগামী দিনে নিজেদেরকে স্বর্গরাজ্যের বাসিন্দা হিসেবে দেখতে চাইছি। যার মূল্য চোকাতে হচ্ছে সেই পাহাড়বাসীদের। দেবভূমিতে যাঁদের কন্ঠস্বর দেবালয়ের চৌকাঠ পেরিয়ে কখনোই তার অন্দরে প্রবেশের সুযোগ পায় না।


ঋণ স্বীকারঃ ন্যাশনালজিওগ্রাফিক.কম, ইন্ডিয়া.মোঙ্গাবে.কম, দ্যলজিকালইন্ডিয়ান.কম