আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২১ ● ১৬-২৯ ফাল্গুন, ১৪২৭

সমসাময়িক

দেশ নতুন দিশা চায়


নাবিক হাল নিজে ভেঙে দিশা হারিয়ে ফেলছেন, দেশ বেচে দিচ্ছেন, সরকারি শিক্ষা স্বাস্থ্য পরিবহণ ব্যাঙ্ক বীমা বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে, গ্যাস তেল খাদ্যদ্রব্য পরিবহণে চরম মূল্য বৃদ্ধি ঘটানো হচ্ছে - সেই সময় দেশকে দিশা দেখাচ্ছেন ভারতের কৃষকরা। ৯৫ দিন ধরে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করছেন রাস্তায়। তাঁদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। খাবার, জল, শৌচাগার - সব সুবিধা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তবু লড়ছেন লাখ লাখ মানুষ। পাঞ্জাব হরিয়ানা উত্তরপ্রদেশের হাজার হাজার মানুষ রাস্তায়। আমরা অনেকটা ইভেন্ট করার মতো আন্দোলনের পক্ষে সহমত পোষণ করে ফেসবুকি দায় খালাস করেছি। কিছুটা মিছিলে হেঁটেছি। তারপর প্রথম সুযোগেই ইস্যু ঘোরাতে অন্য আওয়াজে ব্যস্ত হয়েছি। ইতিহাস এ-সব মনে রাখবে।

লেখা থাকবে ফ্যাসিবাদের বিপদের দিনে আমাদের ঐক্যবদ্ধতার বদলে পরস্পরের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছি। সেই সময় ছয় বছরের শিশু থেকে ৮৮ বছরের বৃদ্ধ বৃদ্ধা সামিল হয়েছেন কৃষকদের পক্ষে অবস্থান আন্দোলনে। প্রবল শীতেও। ১৭০ জনের বেশি শহিদ। এই মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এক পরিবেশ আন্দোলন কর্মী দিশা আপ্পান‌ রবি। ২১ বছর বয়স। মনে তীব্র আবেগ। মস্তিষ্কে যুক্তিবোধ। বাঙ্গালোরের মাউন্ট কারমেল কলেজের ছাত্রী। লেখেন। বলেন। সভা করেন। গড়েছেন সংগঠন ফ্রাইডে ফর ফিউচার। কার্বন নিঃসরণের বিপদ সম্পর্কে সচেতন করেন। 'ভোগ' পত্রিকা চারজন প্রভাবশালী তরুণীকে নিয়ে ২০২০ এর সেপ্টেম্বরে একটি প্রচ্ছদ নিবন্ধ করে। দিশার ঠাকুরদা কৃষক। দিশার সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন নৌদীপ কাউর। তাঁকে নিয়ে আলোচনা অনুপস্থিত। তিনি দলিত শ্রমিক আন্দোলনের নেত্রী। বাবা মা কৃষিশ্রমিক খেতমজুর।

এদের অপরাধ? একটা টুল কিট সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো।

তা দেখে বিশ্বে পরিবেশ আন্দোলনের জনপ্রিয় মুখ গ্রেট থুনবার্গ তা শেয়ার করেন। তিন ফেব্রুয়ারি জনপ্রিয় গায়িকা রিহানা টুইট করেন। টুইট করেন মিয়া খলিফা। টুইটারে লেখেন মার্কিন উপরাষ্ট্রপতি কমলা হ্যারিসের ভাইঝি। তাই তাঁদের বিরুদ্ধে আক্রমণ। এফ আই আর। সেই অভিযোগে গ্রেপ্তার দিশা আপ্পানা রবি।

শুরু হয় কুৎসাও। যে-কোনো রেজিমেন্টেড দল দুটো কাজ করে। একটা শারীরিক বা আর্থিক আক্রমণ। অন্যটা সামাজিক আক্রমণ। চরিত্র হনন। দিশার ক্ষেত্রেও তাই হয়। আর অন্য ধর্মের বলে তো আর কোনো অপরাধ লাগে না। তাই রটিয়ে দেওয়া হলো প্রথমে খালিস্তানি পরে খ্রিস্টান। শেষে লেলিয়ে দেওয়া হলো পুলিশ। প্রথমে দিল্লির এক আদালত পাঁচ দিন জেল হেফাজতে পাঠাল। ১৩ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার ২৩ ফেব্রুয়ারি মিলল জামিন।

আর আদালতে কী বললেন, দিশার আইনজীবী? জামিন পেলেও জামিনের শর্ত মেটানোর সামর্থ নেই দিশা রবির।কৃষক আন্দোলন সংক্রান্ত ‘টুলকিট’ মামলায় দিশাকে জামিন দেয় দিল্লির আদালত। শর্ত হিসাবে ১ লক্ষ টাকার ব্যক্তিগত বন্ড এবং দু’টি অতিরিক্ত ‘সিওরিটি’ দিতে বলা হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু দিশার আইনজীবী জানিয়েছেন, এত টাকা দেওয়ার সামর্থই নেই দিশার পরিবারের। ফলে এখন প্রশ্ন, জামিনের শর্তের টাকা মেটাতে না পারলে কি পুলিশ হেফাজতেই থাকতে হবে দিশাকে? পরে তিনি মুক্তি পান।

দিশার জামিনকে সমর্থন করে মঙ্গলবার নেটমাধ্যমে স্বস্তি ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন দিশার সমর্থনকারীরা। কৃষক আন্দোলনের সমর্থনকারী ২২ বছরের এই পরিবেশবিদকে যে ষড়যন্ত্র করে এতদিন আইনি হেফাজতে রাখা হয়েছিল, সেই অভিযোগও করেন অনেকে। এক সাংসদ মহুয়া লেখেন, ‘যখন কোনও প্রমাণ থাকে না, তখন চক্রান্তের আশ্রয় নাও - এই পুরনো তত্ত্বকে হাতিয়ার করেই অকারণ দীর্ঘায়িত করা হচ্ছিল দিশা রবির মামলাটিকে। দিশার আইনজীবী সেই চক্রান্তের তত্ত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করেই জেতেন।

টানা ১০ দিন হেফাজতে থাকার পরও দিশাকে আরও ৪ দিন পুলিশ হেফাজতে রাখতে চেয়ে আদালতে আবেদন করেছিল দিল্লি পুলিশ। আদালত কী বলল? ‘দিশাকে পুলিশি হেফাজতে রাখার পক্ষে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ প্রদর্শন করতে পারেনি। খুব সামান্য যে প্রমাণ দিল্লি পুলিশ আদালতে পেশ করেছে, তা অসম্পূর্ণ। শুধু তার ভিত্তিতে কোনও পূর্ব অপরাধের রেকর্ড না থাকা এক ২২ বছরের তরুণীকে জামিনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।’

দিশাকে ২৬ জানুয়ারির কৃষক র‌্যালির ষড়যন্ত্রকারী বলে অভিযোগ করেছিল দিল্লি পুলিশের সাইবার সেল। আদালত জানিয়েছে, পুলিশ তার অভিযোগের সমর্থনে যথেষ্ট প্রমাণ পেশ করতে পারেনি আদালতে। মামলাটিতে রায়দান স্থগিত রেখেছিল আদালত। ২৩ ফেব্রুয়ারি দুপুরে টুলকিট মামলায় দিশাকে জামিন দেয় আদালত। একই মামলায় অভিযুক্ত সমাজকর্মী নিকিতা জেকব এবং শান্তনু মুলুক আপাতত শর্তসাপেক্ষ জামিনের আওতায় রয়েছেন।

দিশার আইনজীবী জানিয়েছেন, দিশা কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। তাছাড়া ‘পোয়েটিক জাস্টিস ফাউন্ডেশন’ কোনও নিষিদ্ধ সংগঠনও নয়।

আর আদালতের বক্তব্যঃ সরকারের অহংয়ে আঘাত লাগলেই দেশদ্রোহের মামলা করা যায় না। জওহরলাল নেহরু সতর্ক করেছিলেন ১৯৪৮-এ সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে। বলেছিলেন, আমাদের বিরোধিতা করলেই পুলিশ লেলিয়ে দেবেন না। নাগরিক অধিকার বজায় থাকে। পুলিশের হাতে বাড়তি ক্ষমতা দিলে বিপজ্জনক হবে। তাঁর স্পষ্ট কথাঃ আমরা যাঁদের পছন্দ করি না তাঁদের বিরুদ্ধে অবাঞ্ছিত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে'। পূর্ণস্বাধীনতা পুলিশকে দিলে পুলিশ বাড়াবাড়ি করবে - আশঙ্কা ছিল নেহরুর। বাস্তবে হচ্ছে তাই।

ভারত এখন এক পুলিশ রাষ্ট্র। তবে পুলিশ সঙ্ঘী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে চুপ। নীরব। ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে খুন হন কলেজের মধ্যে অধ্যাপক সাবরেওয়াল। কেউ জানেন না। গোবিন্দ পানেসর, কালবুর্গি, গৌরী লঙ্কেশ খুনের বিচার হয় নি।কাশ্মীরে হাজার হাজার মানুষ জেলে। খুন করা হচ্ছে বদনাম দিয়ে। আমরা জানি না। জানতে চাই না। ওদিকে বাংলাদেশ। সেখানে অভিজিৎ রায় খুনের বিচার হয়েছে। ছয়জনকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড সমর্থন না করেও বলা চলে, কঠোর শাস্তি চাই উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির হত্যাকারীদের। অভিজিৎ রায় সহ আরো ১৩ জন ভিন্ন মতাবলম্বী খুন হয়েছেন মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে।

ভারতেও একধরনের অপরাধ বাড়ছে। দ্রুত ব্যবস্থা ও বিচার চাই। বিলম্বিত বিচার অবিচারের সামিল। দেশ নতুন দিশা চায়। পৃথিবীও। নাবিক বদলাতে হবে। তাই।