আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২১ ● ১৬-২৯ ফাল্গুন, ১৪২৭

সমসাময়িক

অগ্নিমূল্য পেট্রোল-ডিজেল-রান্নার গ্যাস


লোকে আজকাল মজা করে বলছে যে দেশে দুটি জিনিস বাড়ছে, এক প্রধানমন্ত্রীর দাঁড়ি এবং দুই পেট্রো-পণ্যের দাম। বর্তমানে কলকাতায় একটি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ৮০০ টাকা ছাড়িয়েছে, পেট্রোলের দাম লিটার প্রতি ৯১ টাকার বেশি, ডিজেলের দাম ৮৪ টাকা অতিক্রম করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার সরাসরি বলছে যে দাম বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ছে। এই কথা বলে আসলে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের মানুষকে বোকা বানাতে চাইছে।

২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে করোনা সংকট দেশে শুরু হওয়ার আগে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারত যেই খনিজ তেল কেনে তার দাম ছিল ব্যারেল প্রতি ৬৪ ডলারের কিছু বেশি। লকডাউনের সময় আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা তলানিতে চলে যাওয়ার ফলে তেলের দাম ব্যাপকভাবে কমে যায়। কিন্তু তা লকডাউন বিধি শিথিল হওয়ার পর থেকে বাড়তে থাকলেও জানুয়ারি মাসে সেই দাম হয় ব্যারেল প্রতি প্রায় ৫৫ ডলার যা ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের তুলনায় বেশ কিছুটা কম। তবু, দিল্লি শহরে জানুয়ারি ২০২০ সালে এক লিটার পেট্রোলের দাম ছিল ৭৫ টাকা, যা বর্তমানে ৯১ টাকার বেশি হয়ে গেছে। অতএব আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ছে বললে এই প্রবণতার ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়।

আসলে সরকার পেট্রোল এবং ডিজেলের উপর ব্যাপকভাবে উৎপাদন শুল্ক বাড়িয়েছে। বর্তমানে আপনি যদি এক লিটার পেট্রোল কেনেন তবে তার মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারকে কর দিতে হচ্ছে ৩২ টাকা ৯০ পয়সা। লকডাউন চলাকালীন সরকার এই উৎপাদন শুল্ক বৃদ্ধি করে, যার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম যখন নিম্নগামী ছিল, সেই সময়েও ভারতের সাধারণ মানুষের জন্য আসলে পেট্রোল বা ডিজেলের দাম কমানো হয়নি, কারণ সরকার বাড়তি কর চাপিয়েছে সাধারণ মানুষের উপর। অতএব সরকারের আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির যুক্তি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিভ্রান্তিমূলক।

কিন্তু প্রশ্ন উঠবে কেন সরকার তেলের উপর এত কর ধার্য করছে। এর কারণ হল এই যে সরকার কর্পোরেট ক্ষেত্র থেকে কর সংগ্রহ করছে না। যেমন ২০১৮-১৯ সালে সরকার কর্পোরেট কর সংগ্রহ করেছিল ৬.৬৩ লক্ষ কোটি টাকা, যা ২০১৯-২০ সালে কমে হয় ৫.৫৯ লক্ষ কোটি টাকা, যা ২০২০-২১ সালে কমে হয়েছে ৪.৪৬ লক্ষ কোটি টাকা এবং ২০২১-২২ সালে তা হবে ৫.৪৭ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০২১-২২ সালে যত টাকা সরকার কর্পোরেট ক্ষেত্র থেকে সংগ্রহ করবে বলে বাজেটে ঘোষণা করেছে তা ২০১৮-১৯ বা ২০১৯-২০ সালের তুলনায় কম। একই সময় তেলের উপর উৎপাদন শুল্ক লাগাতার বাড়িয়েছে সরকার। ২০১৯-২০ সালে এই খাতে সরকার সংগ্রহ করেছিল ২.৩৯ লক্ষ কোটি টাকা, যা এই লকডাউনের মধ্যে বেড়ে হয় ৩.৬১ লক্ষ কোটি টাকা। বোঝাই যাচ্ছে যে কেন্দ্রীয় সরকার ধনীদের উপর কর ধার্য না করে সাধারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উপর কর চালু করে সাধারণ মানুষের উপর করের বোঝা বাড়াচ্ছে।

অনেকে আবার বলছেন রাজ্য সরকারগুলি যদি এতই চিন্তিত হয়, তবে তারা কেন তেলের দামে নিজেদের করের অংশ কমাচ্ছে না। যদিও পশ্চিমবঙ্গ-সহ কিছু রাজ্য এই কর কমিয়েছে, কিন্তু রাজ্যগুলির কর কমানোর যুক্তিটি ভ্রান্ত। এর দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, তেলের দামের মধ্যে রাজ্যের কর কেন্দ্রীয় করের তুলনায় অনেকটাই কম। দ্বিতীয়ত, জিএসটি চালু হওয়ার পর থেকে রাজ্যগুলি পণ্যের উপর করের হার ধার্য করার অধিকার হারিয়েছে। পেট্রো-পণ্য এবং মদের মতন কিছু সামগ্রীকে জিএসটি-র বাইরে রাখা হয়েছে, যার মাধ্যমে রাজ্য সরকারগুলি কিছু কর সংগ্রহ করে। সেই রাজস্ব সংগ্রহ প্রক্রিয়াকে কেন্দ্রীয় সরকারের কর না কমিয়ে কমালে রাজ্যের আরো ক্ষতি হয়ে যাবে।

বিগত বছরে কিছু সংগঠন এই দাবি তুলেছিল যে পেট্রো-পণ্যকে জিএসটি-র আওতায় নিয়ে আসা হোক, কারণ জিএসটিতে ২৮ শতাংশের বেশি কর ধার্য করা যাবে না, যেখানে বর্তমানে পেট্রোল বা ডিজেলের উপর করের হার ১০০ শতাংশের বেশি। এই দাবি সেই সময় কোনো রাজনৈতিক দল তোলেনি, তা নিয়ে আন্দোলন করেনি। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে পেট্রোল-ডিজেলকে জিএসটি-র আওতায় নিয়ে আসার কথা ভাবা হচ্ছে। আমাদের মতে দেরিতে হলেও কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রশ্নে সঠিক দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু আসল সমস্যা অন্য জায়গায় কর্পোরেটদের থেকে বেশি পরিমাণে কর সংগ্রহ না করে শুধুমাত্র পেট্রোল-ডিজেলকে জিএসটি-র আওতায় আনলে কেন্দ্রের কর সংগ্রহের পরিমাণ কমতে পারে। অতএব, একদিকে পেট্রোল-ডিজেলকে জিএসটি-র আওতায় আনার দাবির সঙ্গে সঙ্গে কর্পোরেটদের থেকে বাড়তি কর সংগ্রহের দাবি তোলা জরুরি হয়ে পড়েছে।