আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২১ ● ১৬-২৯ ফাল্গুন, ১৪২৭

সমসাময়িক

প্রচার না হলেও আন্দোলন কিন্তু চলছে


মন কী বাত আছে।

পাতাজোড়া সরকারি বিজ্ঞাপন আছে।

নেতা-মন্ত্রীদের হুঙ্কার-চিৎকার আছে।

বেলাশেষে নিয়ম মেনে গরিবের ঘরে ঘটা করে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন আছে।

নেতা-মন্ত্রীদের আকথা-কুকথার আকছাআকছি লড়াই আছে।

সেইসব আকথা-কুকথা কাটাছেঁড়া করার জন্য টিভির পর্দা আছে।

সাম্প্রদায়িকতা-বিভাজনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে।

প্রতিদিন ডিজেল-পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি আছে।

রাতবিরেতে জ্বালানি গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া বহাল আছে।

প্রায় প্রতিদিন নতুন নতুন প্রকল্পের ঘোষণা আছে।

প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি দ্বিতীয় বর্ষ পূর্তির সংবাদ আছে।

আর আছে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। নির্বাচনের পর হাসিমুখে নেতা বিবৃতি দিয়ে বলেন, উও তো জুমলা থী। অর্থাৎ ওসব তো ধোঁকা ছিল।

এইসব কীর্তিকলাপের খবর সংবাদমাধ্যম ও অন্যান্য প্রচারমাধ্যমে ছেয়ে আছে।

কিন্তু চলমান কৃষক আন্দোলনের খবর নেই। রাজধানীর সীমান্তে অবস্থানরত কৃষক আন্দোলন প্রায় একশো দিন ধরে চলছে। আন্দোলনে শামিল দুশো জনের বেশি কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। এবং খবরেরকাগজ থেকে শুরু করে টিভির পর্দায় কৃষকের আন্দোলনের খবর সন্তর্পণে অন্তর্হিত হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকদের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে যাতে তারা কৃষক আন্দোলন নিয়ে ভুয়ো খবর তৈরি করেন। কৃষকদের মহাপঞ্চায়েতের মঞ্চে দাঁড়িয়ে এই তথ্য পরিবেশন করে সর্বভারতীয় প্রচারমাধ্যম থেকে পদত্যাগ করেছেন জনৈক সাংবাদিক। যথারীতি সেই খবরও প্রচারিত হয়নি।

২৬ নভেম্বর, ২০২০ দিল্লির সীমানায় তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। তারপর তিন মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু সিংঘু-টিকরি-গাজিপুর সীমান্তের অবস্থান আন্দোলন এখনও অবিচল। পঞ্জাব-হরিয়ানায় চাষের জমিতে গম তোলার মরসুম এসে গিয়েছে বলে আপাত দৃষ্টিতে ভিড় কমেছে। আর শীতের পরে গরমের প্রস্তুতি নিতেও কিছুটা হলেও জনসমাগম কমেছে। তার মানে এই নয় যে আন্দোলনে ভাটার টান পড়েছে।

টিকরির মেট্রো লাইনের নীচে রাস্তা ধরে ১০-১৫ কিলোমিটার শুধুই ট্র্যাক্টর-ট্রলি, তাঁবু। টিকরি বর্ডার মেট্রো স্টেশনের নীচে প্রতিবাদের মঞ্চ। তার পর রোহতক বাইপাসে পড়লে ফের প্রতিবাদের মঞ্চ। বাইপাস ধরে মাইলের পর মাইল শুধুই ট্র্যাক্টর। খান দশেক ট্র্যাক্টর-ট্রলি ঘিরে এক একখানি ‘পিন্ড’ বা গ্রামের নাম। তার সঙ্গে ট্রলিতে মাথা গুঁজে থাকা এক একটি বড় পরিবার বা ‘কুনবা’-র নাম।

বয়স্ক এবং প্রবীণ কৃষকরা এখন অবস্থান স্থলে রয়েছেন। অল্পবয়সীরা চাষের কাজ করতে গ্রামে ফিরেছেন। গ্রামে গ্রামে কমিটি তৈরি হয়েছে। টিকরি, সিঙ্ঘু সীমান্তে যাঁরা অবস্থান করছেন অন্য গ্রামবাসীরা তাঁদের ফসল কেটে ঘরে তুলে দেবে। এক পয়সাও নেবে না। ট্র্যাক্টরের ডিজেল খরচও না। প্রতিটি কুনবার অন্তত একজন বিক্ষোভে থাকবেন। অবস্থানরত কৃষকের মনে গভীর প্রত্যয়, সরকার যদি ভাবে, আমরা ক্লান্ত হয়ে ফিরে যাব, তা হলে ভুল ভেবেছে।

কয়েকদিন আগে টিকরির প্রতিবাদ মঞ্চের আশেপাশে পুলিশের নোটিস পড়েছে। পুলিশের হুঁশিয়ারি, জমায়েত তুলতে হবে। এই জমায়েত বেআইনি। অবস্থানকারীরা হাসতে হাসতে বলেন, - পুলিশ তো আমাদেরই ছেলেপিলে। উপরওয়ালার নির্দেশ। তাই নোটিস টাঙিয়েছে। ওরাও জানে, আমরা হঠব না।

গরম পড়তে শুরু করেছে দিল্লি, পঞ্জাব, হরিয়ানায়। নভেম্বরে যখন কৃষকদের বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তখন তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি ছিল। এখন তা ৩০ ডিগ্রি ছুঁয়েছে। শীত না হয় লেপ-কম্বল জড়িয়ে, আগুন জ্বালিয়ে কেটে গেল। চাঁদিফাটা রোদে কী ভাবে দিনের পর দিন বসে থাকবেন? ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ফ্যান, কুলার, এসি, সব চলে এসেছে। রাস্তার মাঝখানে তাঁবু তৈরি হচ্ছে। গমের খেতে মাথায় রোদ নিয়ে বসে থাকা কৃষকের পক্ষে মেট্রো লাইনের নীচে বসে থাকা মোটেও কঠিন কাজ নয়। তাঁদের স্থির সিদ্ধান্ত মৃত্যু পরোয়ানা প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত এইভাবেই চলবে দৈনন্দিন জীবনযাপন অথবা অবস্থান আন্দোলন।

কৃষক আন্দোলনের তিন মাস পূর্তি উপলক্ষে, ২৬শে ফেব্রুয়ারি ‘যুব কিসান দিবস’ পালন করা হয়েছে। সিঙ্ঘু-টিকরি-গাজিপুরে তরুণরাই প্রতিবাদের মঞ্চ সামলালেন। কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রীকে ঘেরাওয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে একটি কৃষক সংগঠন। অন্য একটি সংগঠনের উদ্যোগে ২৭ ফেব্রুয়ারি ৫০ হাজার কৃষক পঞ্জাব-হরিয়ানা থেকে দিল্লির সীমানায় আসতে শুরু করেছেন। দক্ষিণ ভারতের চারটি রাজ্য থেকে কয়েক হাজার কৃষক সিঙ্ঘু-টিকরি-গাজিপুরের দিকে রওনা দিয়েছেন।

রাজস্থানে আয়োজিত কৃষক মহাপঞ্চায়েত থেকে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিন কৃষি আইন বাতিল ও নূন্যতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত না করলে, ৪০ লক্ষ ট্র্যাক্টর নিয়ে সংসদ ভবন ঘেরাও করার কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা চলছে। যে কোনও সময় এই কর্মসূচির দিন ঘোষণা করা হতে পারে।

এতকিছুর পরেও সরকার উদাসীন। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা আন্দোলনকে উপেক্ষা-অবজ্ঞা করে ঔদ্ধত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হচ্ছে। সমাধানের কোনো চেষ্টাই নেই।

স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ক্ষমতাসীন দলের অংশগ্রহণের কোনো দৃষ্টান্ত নেই। পক্ষান্তরে, দিল্লির সীমান্তে যাঁরা রাজপথে অবস্থান আন্দোলন করছেন তাঁরা প্রকৃত অর্থেই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উত্তরসূরী। শহীদ ভগৎ সিংহের নিকটাত্মীয় আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। আসলে মসনদে অসীনদের খেয়াল থাকে না সকলেরই ধৈর্য্যের সীমা আছে। সীমা অতিক্রম করে গেলে কী হতে পারে তা অনেকদিন আগে শেক্সপীয়রের 'ম্যাকবেথ' নাটকে লিপিবদ্ধ আছে। ভবিষ্যদ্বাণী ছিল ডারহাম জঙ্গল রাজধানীর দিকে এগিয়ে এলে সিংহাসনচ্যুত হতে হবে। একবিংশ শতাব্দীর ভারতেও কী সেইরকম কোনো নাটক বাস্তবে পরিবেশিত হতে চলেছে?