আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২১ ● ১৬-২৯ ফাল্গুন, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

চাকরির সন্ধানে রাজ্যের যুবসমাজ


“বাম যুবকর্মী মইদুল মিদ্যা মরিয়া প্রমাণ করিলেন পশ্চিমবঙ্গে সরকারী চাকরি পাইতে হইলে মৃত্যুবরণ করিতে হইবে”। রবীন্দ্রনাথের কাজে মার্জনা চেয়ে এই লাইনটি লিখতে বাধ্য হতে হল, কারণ এটাই সত্য। ১১ ফেব্রুয়ারি মইদুল মিদ্যা তাঁর কমরেডদের সঙ্গে কলকাতা এসেছিলেন চাকরির দাবিতে। বছরের পর বছর স্নাতক স্তরের পড়াশোনা করেও বেকার, টোটো-অটো চালিয়ে দিন গুজরান, সরকারী চাকরি হয় বন্ধ, নয়ত নেতার পরিবারের কুক্ষিগত, বেসরকারী ক্ষেত্রে মন্দাবস্থা, এই অসহ যন্ত্রণার থেকে মুক্তি চাইতে, নিজের হকের কথা বধির সরকারের কান অবধি পৌঁছে দিতে সেদিন দুপুরে কলকাতা এসেছিলেন মইদুল। কিন্তু তৃণমূলের পুলিশ তাদের প্রভুদের আজ্ঞাবহ দাসের মতন আচরণ করে মিছিলে হামলা করে এবং প্রবল আঘাতপ্রাপ্ত মইদুল মিদ্যা আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও, পরে প্রাণ হারান। রাজ্যের মানুষ এক দরিদ্র চাকরি প্রার্থীর এই ভয়াবহ পরিণতি দেখে তীব্র ধিক্কার জানান। ভোট আসছে, এই সময় বেকার যুবকের পুলিশের আঘাতে মৃত্যু জনগণের মধ্যে তীব্র বিরোধীতা তৈরি করতে পারে। তাই মুখ্যমন্ত্রী তাড়াতাড়ি ঘোষণা করলেন মইদুলের স্ত্রীকে সরকারী চাকরি দেওয়া হবে। খবরের কাগজের সংবাদ বলছে সরকারী চাকরিটি মইদুলের স্ত্রী পেয়েছেন। মইদুলের প্রাণের বিনিময়ে চাকরি পেল তাঁর পরিবার। রাজ্যের যুবসমাজ এবং মইদুলের জন্য এর থেকে বড়ো ট্রাজেডি আর কী হতে পারে!

চাকরি পাওয়ার অবশ্য আরেকটি উপায় আছে। বাবা-মা-কাকা-মামা-পিসি-মাসি-দাদা-দিদি ইত্যাদি যে কোনো একজনকে তৃণমূলের নেতা হয়ে যেতে বলুন। তাহলেই দেখবেন আপনার সরকারী চাকরি মোটামুটি পাকা। যদি আত্মীয়রা কেউ তৃণমূল না করেন, তবে পাড়াতুতো দিদির দামাল ভাইদের কিছু টাকা দিন, দিয়ে নেতার কাছে পৌঁছন। এবার নেতাকে কিছু টাকা দিন দিয়ে চাকরিটা যদি হাতিয়ে নিতে পারেন, তবে আপনার কপাল ভালো। কেননা, টাকা নিয়ে যে নেতা চম্পট দেবেন না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই।

অবস্থা কতটা ভয়াবহ চেহারা ধারণ করেছে তা বোঝা যায় কলকাতা হাইকোর্টের সাম্প্রতিক দুটি রায় দেখে। একটিতে ২০১৪ সালে টেট পাশ করা ১৬,৫০০ জন শিক্ষকের নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করে দিয়েছে মহামান্য আদালত। কারণ তালিকায় প্রচুর গড়মিল আছে। ভাবুন পরীক্ষা হয়েছিল আজ থেকে ৭ বছর আগে। তার নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হল এখন। কিন্তু তা বাতিল হল কারণ তীব্র স্বজন-পোষণ এবং দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন পরীক্ষার্থীদের একাংশ। আবার স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে আপার প্রাইমারিতে ১৫,০০০ শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াও হাইকোর্ট স্থগিত করে দিয়েছে একই কারণে। রাজ্যের শিক্ষিত যুবসমাজের কাছে সরকারী চাকরি ছিল একটি ভরসার জায়গা। বিশেষ করে স্কুলের মাস্টারমশাই হয়ে বহু সাধারণ শিক্ষিত মানুষ নিজেদের জীবন চালানোর স্বপ্ন দেখতেন এই রাজ্যে। সেই শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীদের সর্বনাশ করেছে তৃণমূল সরকার তার নিয়োগ প্রক্রিয়া হয় বন্ধ রেখে অথবা তাতে তীব্র দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে। এই বেকারদের ক্ষোভ যদি রাস্তায় আছড়ে পড়ে তবে পরিণতি হবে মইদুল মিদ্যার মতন। রাজ্যের বেকার যুবকদের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বর্তমান সরকার।

টুম্পা সোনা-খেলা হবে-পিসি যাও ইত্যাদি গান ও প্যারোডি নিয়ে নির্বাচনী ক্ষেত্র জমজমাট হয়ে উঠেছে। কিন্তু এখনও অবধি কোনো দল বেকারত্ব কীভাবে ঘুচবে, তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল কী হবে, তা নিয়ে বিশেষ কোনো আলোচনা করেনি। এই প্রসঙ্গে আলোচনা হলেই শুধু পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়নের সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। এই বিষয় কোনো সন্দেহ নেই যে রাজ্যে বৃহৎ শিল্প শুকিয়ে যাচ্ছে, নতুন কোনো শিল্প স্থাপিত হচ্ছে না। রাজ্যে অকৃষি ক্ষেত্রে কর্মরত মানুষের ৮২.৪ শতাংশ কাজ করে অসংগঠিত ক্ষেত্রে। গোটা দেশের ক্ষেত্রে এই অনুপাত ৭০.৫ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গের এই চিত্র বিগত বহু বছর ধরে অপরির্তিত থেকেছে। সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান প্রায় হচ্ছে না বললেই চলে। সংগঠিত শিল্প ক্ষেত্রে ২০০৪-০৫ সালে ভারতের মাত্র ৪.৫ শতাংশ কারখানা পশ্চিমবঙ্গে ছিল যা ২০১৭-১৮ সালে ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। আবার ২০০৪-০৫ সালে ভারতের ৬ শতাংশ সংগঠিত শ্রমিক এই রাজ্যে কাজ করত, ২০১৭-১৮ সালে যা কমে হয়েছে ৪ শতাংশ। ক্রমাগত হ্রাসমান এই সংখ্যাগুলি পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘদিনের সমস্যা। রাজ্যে শিল্পায়ন নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক হয়েছে, সরকার বদল হয়েছে কিন্তু সংগঠিত শিল্পে কর্মসংস্থানের চিত্রের কোনোরকম পরিবর্তন হয়নি।

এমনটা অবশ্য নয় যে গোটা দেশে কর্মসংস্থান, বিশেষ করে সংগঠিত ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বরং তথ্য ঘাটলে দেখা যাবে যে ভারতে সংগঠিত শিল্পক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ২০০৭ পরবর্তী সময় উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। যেই সময় দেশে সর্বাধিক আয় বৃদ্ধি হচ্ছিল, সেই সময়েও সংগঠিত শিল্প ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হয়নি। ২০১৪ পরবর্তী ভারতেও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হয়নি, বরং সাম্প্রতিক অতীতে বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ হয়েছে। শিল্পায়ন নিয়ে আলোচনায় আমরা ভুলে যাই যে পশ্চিমবঙ্গের ম্যানুফাকচারিং ক্ষেত্রে প্রায় ১৯ শতাংশ কর্মরত মানুষ কাজ করেন, যেখানে ভারতের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ১২ শতাংশ। সমস্যা হল যে ভারতেও শিল্পে কর্মসংস্থান হচ্ছে না, আর পশ্চিমবঙ্গে যা হচ্ছে তার অধিকাংশই ক্ষুদ্র এবং অসংগঠিত শিল্পে যেখানে মজুরি বা কর্মসংস্থানের মান অত্যন্ত কম।

এই পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেলের বিতর্ককে নতুন আঙ্গিকে দেখা উচিত। শিল্প আনতে হবে বলে রাজনীতি করা যেতে পারে। কিন্তু কোভিড পরবর্তী মন্দার বাজারে বিনিয়োগকারীরা এই রাজ্যে হঠাৎ বিনিয়োগ করবেন না, যেখানে ভারত তথা বিশ্বেই মন্দাবস্থা অনেক দিন বজায় থাকবে বলেই অনুমান। তদুপরি বড় শিল্পের মাধ্যমে রাজ্যের কর্মসংস্থানের সমস্যার সমাধান করা যাবে এই ধারণাটি ভ্রান্ত কারণ বড় শিল্পের বর্তমান প্রযুক্তিগত উন্নয়ন শ্রমিকের চাহিদা হ্রাস করছে প্রতিনিয়ত। বরং রাজ্যকে কৃষি এবং ক্ষুদ্র শিল্পে বেশি করে মনোনিবেশ করতে হবে। কমতে থাকা জমির উৎপাদনশীলতা, বাড়তে থাকা জনসংখ্যার চাপে কৃষি রাজ্যে আর খুব বেশি লাভজনক অবস্থায় নেই। এই পরিস্থিতিতে কৃষি সংগঠনের ক্ষেত্রে সমবায় ব্যবস্থার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা এবং আয় বাড়ানো যায় কি না তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা প্রয়োজন রয়েছে। রাজ্যের একটি বড় অংশের চাষি সবজি, ফুল ইত্যাদি উৎপাদন করে। এই উৎপাদনকে কেন্দ্র করে কৃষকদের সামনে রেখে খাদ্য ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের কথা ভাবা যেতে পারে। কৃষিতে আয় বাড়লে অকৃষি ক্ষেত্রের পণ্যের চাহিদা বাড়বে যা বিনিয়োগ টানতে পারে।

পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে ক্ষুদ্র ও হস্ত শিল্পের প্রচলন আছে। সেই সমস্ত পণ্য গ্রামেই আরো বড়ো আকারে তৈরি করা, তার বাজার ধরার কথা ভাবা যেতে পারে। এখানেও সমবায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে। গ্রামীণ শিল্পের মাধ্যমে এই প্রকারে কর্মসংস্থান করা সম্ভব। আবার বড়ো শিল্পেরও প্রয়োজন রয়েছে, যার জন্য জমি দরকার। রাজ্যেই বন্ধ কলকারখানায় হাজার হাজার একর জমি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে যা প্রমোটরদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে বিলাসবহুল আবাসন বানানোর জন্য। এই বন্ধ কলকারখানার জমিতে শিল্প গড়ে তুলতে হবে। আবার রাজ্যের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য জরুরি পরিষেবাকে সম্প্রসারণের মাধ্যমে, সরকারি দপ্তরে শূন্যপদ পূরণ করেও উল্লেখযোগ্যভাবে কর্মসংস্থান বাড়ানো সম্ভব। তদুপরি, সরকারী বিনিয়োগের মাধ্যমে চাহিদা না বাড়াতে পারলে রাজ্যে শিল্পমুখী কর্মসংস্থান হবে না। প্রশ্ন হল, রাজনৈতিক দলগুলির এই বিষয়ে সত্যিই কী কোনো ভাবনা রয়েছে, নাকি রাজনৈতিক ময়দানে কর্মসংস্থান নিয়ে কুস্তি লড়াই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য?

মইদুল মিদ্যার মতন হাজারো যুবক একটি নতুন পশ্চিমবঙ্গের স্বপ্ন দেখেন যেখানে শিক্ষান্তে কাজের সুযোগ পাওয়া যাবে। এদের মধ্যে একটা বিশাল অংশ সেই স্বপ্ন সফল করতে ব্যর্থ হয়ে পাড়ি দেন ভিন রাজ্যে চাকরির সন্ধানে। যারা রয়ে যান তাদের জীবনের মানোন্নয়ন রাজনৈতিক তরজার বিষয় হয় না। সরকার আসে, সরকার যায়, বেকার যুবকের জ্বালা জুড়োয় না।