আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২১ ● ১৬-২৯ ফাল্গুন, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

এ কোন বামপন্থা?


যখন একের পর এক মুসলমান প্রধান দেশে, পাশের বাংলাদেশ-সহ, সিআইএ-র মদতে কমিউনিস্ট ও প্রগতিশীল রাজনীতির বিরুদ্ধে মৌলবাদকে উৎসাহ দিয়ে মসনদে বসানো হয়েছে, ঠিক সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান সমাজের মানুষেরা বাম রাজনীতির পক্ষে থেকেছেন দীর্ঘ ৩৪ বছরের বেশি সময়। মুজফ্‌ফর আহমেদ, মহম্মদ ইস্‌মাইল, আব্দুল হালিম, মনসুর হাবিবুল্লাহ, হাসিম আব্দুল হালিম, মহম্মদ আমিন কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এসেছেন, শ্রেণি আন্দোলন করেছেন, নির্বাচন জিতেছেন। এর জন্য কোনো ধর্মগুরুর প্রয়োজন পড়েনি। একদিকে মুসলমান সমাজের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি দায়বদ্ধতা, অন্যদিকে বামপন্থীদের শ্রেণি আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের পাশে থাকার রাজনীতিই যথেষ্ট ছিল।

কিন্তু তারপরে গঙ্গা দিয়ে বহু জল বয়ে গেছে। বামপন্থীদের আন্দোলনের ধার কমেছে, সাচার কমিটি রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের পশ্চাদপদতার তথ্য ও অন্যান্য ঘটনাবলী বহু মানুষকে বামপন্থীদের থেকে সরিয়ে দিয়েছে। সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে তৃণমূল। কিন্তু তৃণমূল ক্ষমতায় এসে মুসলমান সমাজের সার্বিক উন্নয়নের পক্ষে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বাড়তে থাকা বেকারত্ব, বেলাগাম দুর্নীতি রাজ্যের মুসলমানদের মনে তৃণমূলের প্রতি ক্ষোভ তৈরি করেছে এই বিষয় সন্দেহ নেই। অন্যদিকে, এনআরসি-সিএএ-এনপিআর-এর মাধ্যমে মুসলমানদের বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার ছক কষছে বিজেপি। এই পরিস্থিতিতে ২০২১ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে বামপন্থীরা ফুরফুরা শরীফের পীরজাদার সঙ্গে জোট করে কী বার্তা দিতে চাইছেন?

বিজেপির মত সাম্প্রদায়িক অন্ধকারের শক্তিকে রুখতে গেলে যদি আব্বাস সিদ্দিকির মত গোঁড়া রক্ষণশীল ধর্মগুরুর সহায়তা লাগে, তাহলে নীতিগত জায়গাটা যে বামেদের পক্ষে নড়বড়ে হয়ে যায়, এই তেতো সত্যিটা আর অস্বীকার করা যাচ্ছে না। রাজনীতি, শুধুই কৌশলের খেলা নয়। তার মধ্যে একটা দৃঢ় নীতিগত অবস্থান না রাখলে শুধুমাত্র কৌশল হিসেবে যা দাঁড়ায়, তাকে বলে সুবিধাবাদ। কংগ্রেসকে নিয়ে কিছু বলা নিরর্থক, কিন্তু বামপন্থী অবস্থানের সঙ্গে সুবিধাবাদকে মেলালে সমস্যা হবারই কথা।

কেন আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে জোট নিয়ে প্রশ্ন থাকছে, সেটা জানতে গেলে একটু পুরনো কথায় যেতে হবে। জানতে হবে আব্বাসের উত্থান। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২০১৮ সালে কেরালাতে যখন বন্যা চলছে, সেখানকার ত্রাণকার্যে যোগ দিতে আব্বাস গিয়েছিলেন, এবং জড়িয়ে পড়েন ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগের কার্যকলাপের সঙ্গে। সেখানে প্রায় ৬ মাস থেকে তাদের কাছে প্রশিক্ষণ নেন আব্বাস। লিগের প্রতিষ্ঠাতা পরিবার, পানাক্কার থাংগালদের দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে আব্বাস চেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে লিগের শাখা খোলা হোক, যাদের সঙ্গে জোট বেঁধে তিনি কাজ করবেন। মুসলিম লিগ আব্বাসের সেই প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছিল। প্রসঙ্গত, এই মুসলিম লিগ কেরালাতে তাদের অন্ধ কমিউনিস্ট বিরোধীতার জন্য সুপরিচিত, এবং বহু বছর ধরেই এই দুই পার্টির মধ্যে খুনোখুনির ইতিহাস রয়েছে। নাম্বুদিরিপাদ সরকার ফেলে দেবার পেছনে এদের ভূমিকা ঐতিহাসিক হয়ে আছে। যাই হোক, আব্বাস একই সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালিয়েছিলেন আসাদউদ্দিন ওয়াইসির মীম নামক দলটির সঙ্গেও - যুক্তিটা দুই ক্ষেত্রেই এক - সব মুসলিমদের এক ছাতার তলায় নিয়ে আসা। আব্বাসের নবগঠিত দলের স্পষ্ট বক্তব্য হল, অতীতের কংগ্রেস, বামফ্রন্ট বা বর্তমানের তৃণমূল, কোনও সরকারই এ রাজ্যের মুসলমানদের জন্য কিছু করেনি। তাই জোট বেঁধে গোষ্ঠী হিসেবে এখন পথে নামার সময়। আব্বাস এই সাবধানবাণীও দিয়ে রেখেছেন যে, এর আগে বামফ্রন্টকে যেভাবে ফেলে দিয়েছেন তাঁরা, এখন তৃণমূলকেও ফেলবেন।

এহেন আব্বাসের সঙ্গে জোট করবার হিসেবে যে কৌশলগত যুক্তিগুলো শোনা যাচ্ছে, তার মধ্যে এক নম্বর হল, এই জোট দক্ষিণ ও উত্তর চব্বিশ পরগণার সংখ্যালঘু ভোট আনবে। দুই নম্বর যুক্তি, জোট না হলে আব্বাস মীমের সঙ্গে জোট করে মুসলিম ভোট কেটে বিজেপির সুবিধে করে দেবেন। দুটি যুক্তির মধ্যেই প্রচুর ফাঁকফোকর আছে। প্রথমত, আব্বাস মীমের বিরোধী কোনো অবস্থান এই সম্পাদকীয় লেখার সময় অবধি নেননি। ফলত, মীমের সঙ্গে লিখিত জোট না হলেও কার্যক্ষেত্রে আব্বাস কী করবেন সেটা খুব স্পষ্ট নয়। নীতিগতভাবে তিনি যে কমিউনিস্ট বিরোধী মুসলিম লিগের সহযাত্রী, এই সত্যটুকুর কারণেই কার্যক্ষেত্রে কতটা আন্তরিক হবেন জোটের দায়িত্ব পালনে, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। দ্বিতীয়ত যদি মেনেও নেওয়া হয় যে আব্বাস দুই পরগণার ভোট আনবেন, কিন্তু সেটা হল তাঁর নিজস্ব ভোট। যেদিন তিনি এই জোট ছাড়বেন, ভোটও তাঁর সঙ্গেই আবার চলে যাবে। এর ফলে বামেদের নিজস্ব লাভটা কী হবে? মনে রাখতে হবে, সংখ্যালঘু ভোটে কিন্তু বামেদের ভাগ আর বিশেষ নেই। কংগ্রেসের আছে, মালদহ ও মুর্শিদাবাদে। কিন্তু বামেদের যেহেতু নেই, তাই আব্বাসের পিঠে ভর করে তাঁরা নিজেদের ভোটব্যাংক ভরাতে চাইছেন। কিন্তু নিজস্ব সংগঠন না থাকলে, যেটা এই মুহূর্তে দুই চব্বিশ পরগণায় বামেদের বিশেষ নেই, অন্যের উপর সওয়ার হলে যে ভোট আসবে, সেই ভোট টিকবেও না। কংগ্রেসের এই ধর্মসংকট নেই কারণ এই দুই জেলায় তাদের পাবার বা হারাবার কিছু নেই, তাদের নিজস্ব ভোটব্যাংক মালদহ ও মুর্শিদাবাদে। কিন্তু ত্বহা বনাম আব্বাসের বিরোধীতার সুযোগ নিয়ে আব্বাসকে যদি বামেরা জায়গা করে দেয় যাতে তৃণমূলের ভোট রাজনীতিকে ধাক্কা দেওয়া যায়, তাহলে সেটাও একটা ভোট রাজনীতিই, এবং নিম্নস্তরের রাজনীতি, হয়ে যায়। আব্বাস কিন্তু নিজেই বলেছেন যে ২০২১ এর কথা ভেবে বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে তিনি জোট করছেন, কিন্তু বেশিদিন থাকবেন না, কারণ তাদের বিরুদ্ধেও বদলা নিতে হবে। তার মানে জোটকে ব্যবহার করে ভোট নিয়ে সরে যাবেন আব্বাস, তাঁর হাতে থাকবে একটা সংগঠিত সংখ্যালঘু ভোট। কংগ্রেসের হাতে থাকবে আগের ভোটই। তৃণমূল সরকার হয়ত বেঁচে যাবে। আর যদি বেঁচে না যায়, যদি বিজেপি সরকার হয়, তাহলে পরবর্তী ভোট সবই হবে ধর্মীয় মেরুকরণের প্রেক্ষিতে। বিজেপি পাবে হিন্দু ভোট, আব্বাস, মীম এবং কিছুটা কংগ্রেস পাবে মুসলিম ভোট। শ্রেণি রাজনীতি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে, ঠিক যেরকম হয়েছে গোবলয়ে জাতপাতের রাজনীতির প্রেক্ষিতে। মানে দিনের শেষে সবাই সব কিছু পাবে, শুধু বামফ্রন্ট বাদে। এরকম আত্মঘাতী রাজনীতির অর্থ কী?

এ তো গেল রণকৌশলের প্রশ্ন। রণনীতির প্রশ্নে আপত্তি আরো প্রবল। নুসরাত জাহানকে নিয়ে আব্বাসের নারী বিদ্বেষী মন্তব্য, ফ্রান্সে শিক্ষকের গলাকাটার পর সন্ত্রাসবাদীর জান্নাতপ্রাপ্তি বিষয়ক তাঁর কথা, সবই ভিডিও হয়ে বাজারে ঘুরছে। কিন্তু এসবের বাইরেও যেটা থেকে যায়, তা পরিচিতির প্রশ্ন। মুসলিম সমাজ যখন এগোচ্ছে, বিভিন্ন মিশনগুলোর হাত ধরে দিনমজুরের ছেলেমেয়েরাও ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-গবেষক-অধ্যাপক হিসেবে নিজেদের মেলে ধরছেন, এঁদের মধ্যে অনেকেই আরেকটি দরিদ্র ছেলেমেয়ের দায়িত্ব নিচ্ছেন, যাতে আরও কিছু দরিদ্র-মেধাবীকে সঠিক প্ল্যাটফর্ম দেওয়া যায়, যখন মুসলমান মহিলারা সিএএ-এনআরসি-র বিরুদ্ধে দেশ কাঁপানো আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তখন তাঁদের সরিয়ে রাজনীতির মুখ হচ্ছেন আব্বাসরা৷ আব্বাসকে প্রমোট করার কথা ভাবছেন বামপন্থীরা!

পশ্চিমবঙ্গে সুদীর্ঘ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ইতিহাস রয়েছে। ধর্মের নামে বাংলা ভাগ হয়েছে কিন্তু ধর্মের রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষ প্রত্যাখান করেছেন। তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে সমস্ত স্তরের মানুষের মতন মুসলমান মানুষেরও ক্ষোভ রয়েছে, সেই ক্ষোভ বামপন্থীরা ভাষা দিতে ব্যর্থ হয়ে এখন হাত ধরছেন একজন মৌলবাদী ধর্মগুরুর? আজ যখন বিজেপি উগ্র-হিন্দুত্ববাদকে সম্বল করে রাজ্যে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখছে, তখন বামপন্থীরা একজন গোঁড়া ধর্মগুরু, যার দলের বয়স ১ মাস, তার সঙ্গে জোট করছেন! বামপন্থীরাও যদি পরিচিতিসত্ত্বা-র রাজনীতির কদর্য বাস্তবায়ন রাজ্যের মাটিতে করেন, তবে পশ্চিমবঙ্গের প্রগতিশীল আন্দোলন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একদিকে তৃণমূলের নেতৃত্বে সিদ্দিকুল্লা অথবা ইদ্রিশ আলির মতন সাম্প্রদায়িক নেতা আর অন্যদিকে বাম-কংগ্রেসের জোটে একজন গোঁড়া ধর্মগুরু, আর তার বিপরীতে দিলীপ ঘোষ এবং রাজ্য বিজেপি। এই সমীকরণ যদি পশ্চিমবঙ্গে একবার জমি পায়, তবে বাম রাজনীতির কী হবে, সেই চিন্তা কি বাম নেতাদের আদৌ রয়েছে? বামপন্থী নেতাদের মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে তাদের রাজনীতি সাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদের বিরুদ্ধে, শুধুমাত্র হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে নয়। সংখ্যালঘুর রক্ষণশীল, মৌলবাদী এবং সাম্প্রদায়িক অংশের দ্বারা বিজেপি-র হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতার মোকাবিলা করা সম্ভব নয়, বরং তা একে অপরের পরিপূরক হিসেবেই কাজ করে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে হারাতে হলে একমাত্র উপায় আপসহীন ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি যার ভিত্তি হবে গরীব খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষ। পরিচিতি-সত্ত্বার রাজনীতির বাজারে কথাটি তামাদি হলেও সত্য। এর প্রমাণ কৃষক আন্দোলন, যার মাধ্যমে উত্তর প্রদেশের জাট এবং মুসলমানরা এক সঙ্গে বিজেপি-র বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়েছেন।

গোটা লকডাউন জুড়ে বামকর্মীরা যেভাবে রাস্তায় থেকে কাজ করেছেন, নবান্ন অভিযানের মধ্যে দিয়ে যেভাবে বেকারত্বের প্রশ্নটিকে সামনে এনেছেন, তারপরেও কি নিজের জোরে লড়বার সাহস হল না? এই গোটা সময়টা জুড়ে আব্বাসের কী ভূমিকা ছিল? এনআরসি-সিএএ প্রশ্নে হোক, কৃষিবিল বিরোধী আন্দোলনে হোক অথবা নবান্ন অভিযান, একবারও কি বামেদের সহযোগী হিসেবে রাস্তায় দেখা গিয়েছিল তাঁকে? কোনো গণ-আন্দোলনে যাকে দেখা যায়নি, রাজ্য তথা দেশের গুরুতর রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে যাকে কোনো কথা বলতে শোনা যায়নি, যিনি শুধু ধর্মীয় সমাবেশে এক মাস আগে অবধি ভাষণ দিয়েছেন, সেই ধর্মগুরুকে স্রেফ কিছু ভোটের জন্যই নিয়ে আসা হল? একে কি বামপন্থী রাজনীতি বলা যায়?