আরেক রকম ● নবম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ১৬-৩০ মাঘ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

শিক্ষার ভালো-মন্দ

পলাশ বরন পাল


বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে নানারকমের প্রশ্নের সম্মুখীন হই। কয়েক বছর আগে এক জায়গায় গেছি, বক্তৃতার পরে হঠাৎ একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আচ্ছা, আপনি যখন ছাত্র ছিলেন তখনকার কালের থেকে এখনকার শিক্ষাব্যবস্থায় কী ভালো হয়েছে আর কী খারাপ হয়েছে?’’

একটু থতোমতো খেয়ে বললাম, ‘‘আমার।ছাত্রজীবন তো অনেক আগেকার কথা, তার পর থেকে পরিবর্তন তো এক-আধটা হয়নি, হয়েছে অনেক। এ প্রশ্নের উত্তর তাই সহজে দেওয়া যাবে না - অনেক সময় লাগবে, অনেক প্রস্তুতিও লাগবে।’’

প্রশ্নকর্তা ছাড়বার পাত্র নন, তিনি বললেন, ‘‘আচ্ছা বেশ, উত্তরটা ছোটো করার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সমস্ত বদলের কথা থাক। যতো রকমের বদল হয়েছে, তার মধ্যে আপনার মতে কোনটা সবচেয়ে ভালো আর কোনটা সবচেয়ে খারাপ, শুধু সেটুকু বলুন।’’

বলা বাহুল্য, এ প্রশ্নেরও চটজলদি উত্তর দেওয়া সহজ নয়। অথচ এড়িয়েও যেতে পারলাম না। তখন ঝট করে ঝোঁকের মাথায় যা বলেছিলাম, সেই কথাগুলোই একটু বিস্তারিতভাবে লিখছি।

মন্দ কথা দিয়ে শুরু করি। ১৯৫০-এর দশকে আমার জন্ম, ইশকুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ধরলে আমার ছাত্রজীবনের পরিধি তার পরের দুটো দশক। প্রশ্ন হলো, সেই সময়ের তুলনায় এখনকার শিক্ষাব্যবস্থায় কোন পরিবর্তনটি সবচেয়ে খারাপ হয়েছে?

এক কথায় আমার উত্তর হলো - শিক্ষার বেসরকারিকরণ। আমরা ছাত্রজীবনে শিক্ষাব্যবস্থার যে কাঠামো দেখেছি, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ছিল পুরোপুরিই সরকারি। বেসরকারি কলেজ ছিল, তবে নামকরা কলেজগুলো প্রায় সবই ছিল সরকারি। আর ইঞ্জিনিয়ারিং বা ডাক্তারি পড়ার জন্য যে সব কলেজ ছিল, সেগুলোও ছিলো সরকারি। ইশকুল পর্যায়ে ব্যক্তিগত মালিকানা খুব বিরল ছিল না, তবে সরকারি ইশকুলের সংখ্যা খুব কম ছিল না - অন্তত শহর অঞ্চলে - এবং মোটের ওপর সেগুলোর মান ছিল বেশ উঁচুর দিকে। আমি যখন ইশকুলে ভর্তি হয়েছি, তখন বাপ-মায়েরা চেষ্টা করতেন ছেলেকে বা মেয়েকে সরকারি ইশকুলে ভর্তি করাতে। সেখানে না পেলে তখন অন্য চেষ্টা।

এই ছবিটা প্রায় পুরোপুরি বদলে গেছে। এখনও ভালো সরকারি ইশকুল নেই তা বলছি না। কিন্তু প্রাথমিকভাবে শহুরে বাবা-মায়েদের এখন লক্ষ্য অন্য দিকে। মফস্বলে, এমনকি গ্রামের দিকেও এই ভাবধারা ক্রমশ বিস্তার লাভ করছে। কলেজ পর্যায়েও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভিড়, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ তো প্রচুর। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থাপিত হয়েছে দেশের নানা জায়গায়, তার সংখ্যা খুব কম নয়।

এটাকে খারাপ বলছি কেন? তার একটা বড়ো কারণ, শিক্ষার খরচ। শিক্ষা ব্যাপারটা মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে গণ্য হওয়া উচিত। তার জন্য যা খরচ হয়, সেটা আসা উচিত সরকারি কোষাগার থেকে। সারা দেশের মানুষ নানা খাতে সরকারকে কর দেয়, শুল্ক দেয়। সেই অর্থ সরকার ব্যয় করে নানান সামাজিক প্রকল্পে, তার মধ্যে শিক্ষাখাতে ব্যয়ও থাকে। এই খাতে অর্থ আরো বেশি বরাদ্দ করা উচিত, যাতে শিক্ষা বিনামূল্যে দেওয়া যায়, বা অন্তত নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে দেওয়া যায়। তার বদলে যা হচ্ছে, তাতে শিক্ষালাভের জন্য ছাত্রকে, মানে ছাত্রের অভিভাবককে, যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে তাতে অনেক ছাত্র উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অনেকের অভিভাবকদের ধার করে পড়াতে হচ্ছে এবং সেই ধারের মনোকষ্টে ছাত্ররা তাদের পড়াশোনার সময়টা উপভোগ করতে পারছে না, ‘আমাকে এই ধার শোধ করতে হবে' এই চিন্তায় তারা অহরহ পীড়িত হচ্ছে। এটা কারুরই মানসিক স্বাস্থ্যের অনুকূল নয়। মানে, এতে কারুরই ভালো হচ্ছে না।

এই কথা বললেই দু দিক থেকে আক্রমণ ধেয়ে আসে। একদল বলেন, ‘‘উন্নত দেশগুলোয় কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য ছাত্রদেরকে অনেক পয়সা দিতে হয়। তাহলে আমাদের দেশেই বা সেরকম হবে না কেন?’’ অন্যদল বলেন, ‘‘বাঃ, যাদের কাঁড়ি কাঁড়ি পয়সা, তাদের ছেলেমেয়েদেরও বিনাপয়সায় পড়ানো হবে? এ তো বড়োলোকের জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা!’’

প্রথম দলের লোকজন যা বলেন, তাঁরা যে তথ্যের ভিত্তিতে বলেন, বা যে তথ্য অনুমান করে বলেন, তা একেবারেই ঠিক নয়। তাঁরা একটি বা দুটি ‘উন্নত' দেশের কথা জানেন, এবং সেটাও পুরোপুরি জানেন না। যে দেশের কথা প্রথমেই তাঁদের মাথায় আসে তা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ কথা সত্যি, সে দেশে উচ্চশিক্ষার খরচ বেশ চড়া, বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গেলে যা খরচ হয় তা শুনলে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। কিন্তু সেটা কি অন্য দেশের পক্ষে অনুকরণীয় আদর্শ হতে পারে? এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, শিক্ষা এতো বহুমূল্য করে রাখার ফলে মার্কিন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এক অর্থে দেউলিয়া হয়ে গেছে, প্রতি বছর ভারতের মতো দেশের থেকে অযুত-অযুত শিক্ষিত ব্যক্তি আমদানি না করলে তাদের স্বাস্থ্য-শিক্ষা-কারিগরিবিদ্যা ইত্যাদির যে সামাজিক কাঠামো, তা সচল রাখা যায় না। ইশকুল-কলেজ পাশ করা ভারতীয় তরুণেরা যখন মার্কিন দেশে পাড়ি জমান উচ্চশিক্ষা এবং অতঃপর চাকরির উদ্দেশ্যে, তখন তাঁরা মার্কিন দেশের এই বদান্যতায় পুলকিত বোধ করতে পারেন, মার্কিনীরা এতো বহিরাগতকে ‘আশ্রয়' দিচ্ছে ভেবে তাদের উদ্দেশে কৃতজ্ঞতায় নতমস্তক হতে পারেন, কিন্তু আসল ব্যাপারটার মধ্যে বিশ্বভ্রাতৃত্বের এ সব বড়ো বড়ো আদর্শ নেই, আসল ব্যাপার হলো এটা না করলে তাদের দেশ চলবে না। যে শিক্ষার এই পরিণতি, তা কি অন্য দেশের পক্ষে আদর্শ হওয়ার যোগ্য?

এবার অন্য দেশের কথা ভাবা যাক। জার্মানি যে উন্নত দেশ, তা আশা করি সবাই মানবেন।

২০১৪ থেকে শুরু করে সেই দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ লোপ করে দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ সম্পূর্ণ বিনা খরচে পড়াশোনা করার ব্যবস্থা হয়েছে। অবশ্যই, অন্য খরচ আছে - খাওয়ার খরচ থাকার খরচ ইত্যাদি। কিন্তু সেগুলো তো পড়াশোনা না করলেও থাকতো। কথা হচ্ছে, পড়াশোনা করার জন্য আলাদা কোনো খরচ নেই, পুরো খরচই বহন করছে সরকার। জার্মানিকে বছর বছর বাইরে থেকে ডাক্তার আমদানি করতে হয় না, ইঞ্জিনিয়ার আমদানি করতে হয় না। এই ব্যবস্থা কেন আদর্শ বলে গণ্য করবো না আমরা?

এমন নয় যে ২০১৪-র আগে জার্মানিতে পড়ার খরচ বিশাল ছিল। ছিল না। আমার মনে আছে, তার প্রায় এক দশক আগে আমার কর্মক্ষেত্রে জার্মানি থেকে একটি গবেষক ছাত্র এসেছিল মাসখানেকের জন্য। তাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওখানে ছাত্রদের খরচ কত হয়। তাতে সে খুব বিক্ষুব্ধভাবে বলেছিলো যে খরচ সম্প্রতি প্রচণ্ড বেড়ে গেছে। কত ছিল, কত হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তরে সে যা বলেছিলো তার সংখ্যাগুলো এতোদিন পরে আমার ঠিকঠাক মনে আছে কিনা জানি না, আশা করছি খুব বড়োসড়ো স্মৃতিবিভ্রম হয় নি। বলেছিলো, আগে ছিলো ৫০ ইউরো, বেড়ে হয়েছে ২৫০। মাসে ৫০? না, সেমেস্টারে ৫০। একলাফে বেড়ে গেলো পাঁচ গুণ, কেউ কিছু প্রতিবাদ করলো না? - এই প্রশ্নের উত্তরে সে স্বীকার করলো, অন্যদিকে কিছু কিছু সুবিধে দেওয়া হয়েছে, যেমন ছাত্রদের জন্য বাস-ট্রামে যাতায়াতের খরচ লাগবে না বলা হয়েছে, কলেজের কার্ড দেখালেই ভাড়া মকুব। ওখানে পরিবহন পুরোপুরিই সরকারি, তাই ছাত্ররা শহরের মধ্যে যত্রতত্র যেতে পারবে কোনো পয়সা খরচ না করে। মাসিক টিকিটের ব্যবস্থা আছে অন্য সবার জন্য, তার দাম মাসে ৫০ ইউরোর মতো। অর্থাৎ যে ছাত্রর মাসিক টিকিট কাটতে হয়, তার জন্য গোটা সেমেস্টারের খরচ কিছুই বাড়েনি। তবে এসব পুরোনো হিশেব, আগেই বলেছি ২০১৪-র পর থেকে পড়ার খরচ শূন্য হয়ে গেছে।

এবার দ্বিতীয় দলের আক্রমণকারীদের জন্য কিছু বলি। বিনামূল্যে শিক্ষাদানের প্রস্তাব দেখে যদি কারুর মনে হয় যে বড়োলোকদের তেলা মাথায় তেল দেওয়া হচ্ছে, তাহলে পুরো প্রস্তাবটাই তিনি ভুল বুঝেছেন। বড়োলোকদেরই বেশি করে খরচ করতে হবে এই ব্যবস্থায়, কিন্তু সেটা কলেজের ফি দিয়ে নয়, আয়কর সম্পত্তিকর এবং অন্যান্য শুল্ক বাবদ সরকারকে পয়সা দিয়ে। সেই টাকা সরকার খরচ করবে শিক্ষার জন্য, এবং অন্যান্য কাজের জন্য। কলেজে ছাত্রদের ফি দিতে হলেই বরং বড়োলোকেদের সুবিধে করে দেওয়া হয়, বাপমায়ের আয় নির্বিশেষে সবাইকে যদি সমান ফি দিতে হয় তাহলে গরিবদের ওপরেই চাপ পড়ে।

এর পরে দু দলই ঝাঁপিয়ে পড়ে বলবেন, শিক্ষা যদি অবৈতনিক করে দিতে হয়, তাহলে যে বিপুল পরিমাণ টাকা লাগবে তা আসবে কোত্থেকে? এর উত্তর খুবই সহজ। শিক্ষাখাতে ভারতের ব্যয় মোট রাষ্ট্রীয় আয়ের মোটামুটি ৩ শতাংশ। বেলজিয়াম, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি দেশের ক্ষেত্রে এই অনুপাতটা ৬ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে। এমনকি মার্কিন দেশেও তাই। কিউবার ব্যয় ১২ শতাংশের বেশি। বতসোয়ানার মতো দেশ যদি তাদের মোট খরচের ৭ ভাগের বেশি শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করতে পারে, বুরুন্ডি যদি ৬ শতাংশ করতে পারে, তাহলে ভারত ৩-এর বেশি করতে পারবে না কেন? অস্ত্রশস্ত্রের আমদানির অঙ্কে যে ভারত গত বহু বছর ধরে বিশ্বের সর্বাগ্রে থাকে, সে দেশ শিক্ষার জন্য আর একটু খরচ করতে পারে না, শিক্ষার্থীদের পকেটমারা ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা দেখতে পায় না?

নিঃশুল্ক শিক্ষার বদলে গত কয়েক দশকে যা হয়েছে, তা ঠিক উলটো। উচ্চশিক্ষার বহু প্রতিষ্ঠানেই ছাত্রদেরকে যা ব্যয় করতে হয়, তার পরিমাণ উত্তরোত্তর বাড়ানো হয়েছে, ‘উন্নত দেশেও এইরকমই হয়' এই ভ্রান্ত যুক্তির অবতারণা করে। বুনিয়াদি স্তরের শিক্ষাতেও খরচ বেড়েছে বহু গুণ। সব স্তরেই বেসরকারি বিনিয়োগ হয়েছে। এটা সবচেয়ে খারাপ বদল, শিক্ষাক্ষেত্রে।

প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার আগে এ কথাও বলে নিতে হবে যে, খরচের পরিমাণই বেসরকারি শিক্ষার বিপক্ষে একমাত্র যুক্তিনয়। আর একটা বড়ো যুক্তি হলো শিক্ষার বিষয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে লাভের কথা ভেবে চলতে হবেই, তাই তথাকথিত লাভজনক বিষয়গুলোই তারা শেখাবে, অন্য বিষয়গুলো হয় বাদ দেবে, নয়তো অন্তত অবহেলা করবে। সুস্থ সমাজ গড়তে গেলে কিন্তু শুধু বাজারদর দেখলেই চলে না। সমাজে ইঞ্জিনিয়ার যেমন দরকার, তেমনি সাহিত্য বা সঙ্গীতের বিশেষজ্ঞও দরকার, প্রাচীন ভাষা এবং ইতিহাসের চর্চাও হওয়া জরুরি। শুধুই ব্যাবসায়িক লাভের কথা ভাবলে এই অন্যান্য নানা দিকে উপেক্ষিত হবে, তাতেও শিক্ষার ক্ষতি।

গবেষণার ব্যাপারেও বেসরকারি মূলধন বেশি পরিমাণে ঢুকে পড়লে তার বিপদ আছে। অনেক ক্ষেত্রে বেসরকারি গবেষণা একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছোতে চায়, নির্মোহভাবে বিষয়টির পর্যালোচনা করে না। যে কোম্পানি বাজারে ডিম জোগান দেয়, তারা যখন খাদ্যগুণ পরীক্ষার জন্য গবেষণায় টাকা ঢালে তখন তারা এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছোতে চায় যে, বেশি করে ডিম খেলে স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। অনুসন্ধান যদি সেই সিদ্ধান্তের অনুকূল হয়, তাহলে তারা ঢাক পিটিয়ে তা প্রচার করে, কিন্তু উলটো ফল যদি পাওয়া যায়, তাহলে সে ফল গোপন রাখতেই সচেষ্ট হয়। অর্থাৎ প্রকাশিত ফল পক্ষপাতদুষ্ট হয়। গবেষণার ব্যাপারে এর ফলাফল যে ভালো নয়, তা বোধহয় ব্যাখ্যা করার দরকার নেই।

মন্দের কথা বললাম, এবারে ভালোর কথা বলি। গত কয়েক দশকে শিক্ষায় সবচেয়ে ভালো কী হয়েছে বলে আমার মনে হয়?

আমার মতে এ প্রশ্নের উত্তর রয়েছে ইশকুলপর্যায়ের শিক্ষায়। আমাদের বাবা-মায়ের বয়সীদের কাছে তাঁদের ছোটোবেলার যে সব গল্প শুনেছি, তাতে ইশকুলের শিক্ষক ছিলেন প্রচণ্ড কড়া, তাঁদের ভয়ে ছাত্রছাত্রীরা জড়োসড়ো হয়ে থাকতো। আমাদের ছোটোবেলাতেও এই রীতি চালু ছিল। পান থেকে চুন খসলেই ছাত্রাছাত্রীদেরকে কান ধরে বেঞ্চির ওপর দাঁড়াতে হতো, বেতের বাড়ি মারা হতো, ক্লাসের বাইরে বার করে দেওয়া হতো। আরো নির্মম শাস্তিও ছিলো। একটাকে বলা হতো চেয়ার। ঠিক চেয়ারের ওপর বসে থাকলে শরীর যেভাবে থাকে সেইভাবে থাকতে হতো দণ্ডিতকে, কেবল চেয়ারটা থাকতো না। শূন্যে ভর করে ত্রিভঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যে কী কষ্টকর, সে শাস্তি যারা পায়নি তাদেরকে সে কথা বোঝানো অসম্ভব।

সকলেই যে এরকম শাস্তি দিতেন, তা নয়। কেউ কেউ দিতেন। কিন্তু, এরকম শাস্তি দেওয়াটা কারুর চোখেই আশ্চর্য বা অন্যায্য মনে হতো না। এটাকে শিক্ষার অঙ্গ বলেই মনে করা হতো।

এ কথা ভেবে আমার খুব আনন্দ লাগে যে, এই ব্যাপারগুলো এখন অনেকটাই অতীত হয়ে গেছে। কোনো শিক্ষকই এখন শাস্তি দেন না, তা বলছি না। কিন্তু শাস্তির প্রকার এবং পরিমাণ, দুইয়েরই অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। মোটের ওপর এখন এইরকম একটা বিশ্বাস চালু হয়েছে যে বাচ্চাদেরকে যা শেখানো হবে তাতে তারা যেন আনন্দ পায়। হাতেকলমে নানা রকমের কাজ করা, নানা তথ্য সংগ্রহ করে প্রজেক্ট হিশেবে তার উপস্থাপনা করা - এই যে সব ব্যাপার চালু হয়েছে, এগুলো সবই এই আনন্দদানের অঙ্গ। সব সময়ে ব্যাপারটা আনন্দময় হয় তা বলছি না, যে কোনো জিনিশের বাহুল্যই খানিকটা বিরক্তি উৎপাদন করতে পারে, কিন্তু লক্ষ্যটা যে আনন্দ, সেটুকু আশা করি সকলেই মানবেন।

ভয় নয়, আনন্দ। এইটাই শিক্ষার প্রকৃত চালিকাশক্তি হওয়া উচিত। শিক্ষার একটা ব্যবহারিক মূল্য নিশ্চয়ই আছে, থাকবেও। অর্থাৎ জীবনে সাফল্য পেতে হলে তাতে শিক্ষার একটা ভূমিকা থাকে, সেই কারণে শিক্ষা লাভ করতে হবে - শিক্ষালাভ করতে আসার এটা একটা বড়ো কারণ হতেই পারে। কারুর কারুর ক্ষেত্রে যদি এটাই একমাত্র কারণ হয়, তাদের জন্যও শিক্ষা আকর্ষণীয় হওয়া উচিত, তাদের যেন দাঁতে দাঁত চেপে বন্দীশালায় দিন কাটানোর মতো করে ক্লাসঘরে পড়ে থাকতে না হয় তা দেখাটা শিক্ষকদের অবশ্যকর্তব্য। আর যাদের জ্ঞানলাভের উৎসাহ থাকে, তাদের সে উৎসাহ আরো বাড়িয়ে দেওয়ার কাজও শিক্ষকেরই। ভয় দিয়ে নয়, আনন্দ দিয়েই সে কাজ করতে হয়। আমার দেখে খুব ভালো লাগে, আমরা সেই দিকে চলেছি। ইচ্ছে থাকলেও প্রয়োগে মাঝে মাঝে ভুল হচ্ছে, বিচ্যুতি হচ্ছে, কিন্তু লক্ষ্যটা যে সেই দিকে, এটা একটা বিরাট রকমের পরিবর্তন, ভালো পরিবর্তন।