আরেক রকম ● নবম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ১৬-৩০ মাঘ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

আজকের রাজনীতি-রঙ্গঃ আসুন, একটু তলিয়ে দেখি

অনুরাধা রায়


আসুন, ব্যাপারটা একটু তলিয়ে বোঝার চেষ্টা করি। রাজনৈতিক দলগুলির পারস্পরিক হিংস্রতা (কায়িক ও ভাষিক) আর নেতাদের দলবদল নিয়ে উত্তেজিত না হয়ে, গণতন্ত্র বা ধর্মীয় সম্প্রীতির নামে আবেগে ভেসে না গিয়ে, ‘বাঙালি সংস্কৃতি রসাতলে গেল’ বলে বিলাপ না করে একটু বুদ্ধি খাটিয়ে বুঝি। হোয়াটস্যাপ, ফেসবুক, এমনকি বড় বড় মিডিয়া যতদূর পর্যন্ত বোঝা অনুমোদন করে, সেই সীমানাটাকে নাহয় একটু পেরিয়েই যাই। আমরা যাদের বিরোধিতা করছি সেই ‘ওরা’ কিন্তু অনেক বড় করে বুঝছে বাস্তবটাকে, বুঝে নিয়ে নিজেদের সুবিধেমত তাকে মুঠোয় পুরতে চাইছে। আর ওরা একেকটা ভয়ানক কাজ করছে, তারপর আমরা সেইসব কাজের বিরুদ্ধে পরিত্রাহি প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমাদের নিজস্ব রাজনীতি নেই, শুধুই প্রতিক্রিয়া।

ভুবনজোড়া বাজারের ফাঁদ আর ফাঁদে-পড়া মধ্যশ্রেণি

গল্পটা কিন্তু মূলত অর্থনীতির। এমনিতে দেখতে গেলে হিন্দুত্ব, জাতীয়তাবাদ আর উন্নয়নের ত্রিমুখী মন্ত্রে ভোলানো হচ্ছে মানুষের মন - হিন্দুত্ব আর উন্নয়ন দুটোকেই জাতীয়তাবাদী গর্বের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে। যাদের হিন্দুত্বের আবেগ ততটা আপ্লুত করে না, তারাও উন্নয়নের মন্ত্রে মোহিত - যে উন্নয়ন মানে রাস্তা, ব্রিজ, শপিং মল, রেস্তোরাঁ, জৌলুসময় জগত, বিলাসবহুল জীবন; যে উন্নয়নের কোনো ব্যক্তিক দায় নেই, ব্যক্তির বাঁচামরা যার চিন্তাভাবনার মধ্যেই আসে না। আসলে তো চাই বড়ো বড়ো কর্পোরেট ব্যবসাদারদের আরো আরো রমরমা। আর ক্রমবর্ধমান ভোগসুখে নিবেদিতপ্রাণ ক্রমপ্রসারমান মধ্যশ্রেণির মনের মধ্যে সযত্নে লালিত হচ্ছে কর্পোরেট-প্রোথিত মূল্যবোধ। রাজনীতিকরাও এই ব্যবসাদারদের প্রাণের বন্ধু।

দুনিয়ার নানা দেশেই যে জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে বেশ কিছু বছর ধরে, ভারতে যার ভিত্তি ঐ ত্রিমুখী মন্ত্র, তার মূলগত ব্যাখ্যা এটাই। এই রাজনীতিকে বলা হচ্ছে ‘নব্য-সুলতানবাদ’। একজন সুলতান-সম নেতা ছাতি ফুলিয়ে দাবী করেন - তিনিই হলেন সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি। বলেন, তিনি নিজে খুব সাধারণ মানুষ (সে অনেকদিন ধরে ক্ষমতায় থাকলেও, বড়ো ব্যবসায়ীদের বন্ধু বা নিজে বড়ো ব্যবসায়ী হলেও) এবং দুর্নীতিগ্রস্ত এলিট (যাদের মধ্যে সবরকম রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা আছে) আর প্রামাণিকতাহীন দুর্বৃত্তিপরায়ণ সংখ্যালঘুদের হাত থেকে তিনিই সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষদের পরিত্রাতা। নিজের রাজনৈতিক দলেরও ঊর্ধ্বে উঠে তিনি নিজের এই ভাবমূর্তিটি নির্মাণ করেন টিভি, সমাজ মাধ্যম ইত্যাদির সুকৌশলী ব্যবহারে। ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে বলে, সগৌরবে বলে, বারে বারে বলে তা মানুষকে বিশ্বাস করিয়েই ছাড়েন। এই নব্য সুলতানের রাজনীতি আধিপত্যবাদী, সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী, আর হ্যাঁ, জাতীয়তাবাদী। মার্কিন দেশে সে রাজনীতি অভিবাসী বা কালো মানুষদের বিরুদ্ধে ঘৃণা তৈরি করে, ইসরায়েলে আরবদের বিরুদ্ধে, ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে।

আজকের এই বহুব্যাপ্ত জনপ্রিয়তাবাদ গণতন্ত্রের মধ্যে, গণতন্ত্রের দৌলতেই বিকশিত। গণতন্ত্র মানে তো সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজত্ব। কোনো বিশেষ সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে অপ্রামাণিক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করলেই হল। আর মজার কথা, গণতান্ত্রিক জনপ্রিয়তাবাদ গণতন্ত্র থেকেই মানুষকে বিমুখ করে তুলছে। Centre for Studies in Developing Society একটি সমীক্ষায় দেখিয়েছে ২০০৫ থেকে ২০১৭-র মধ্যে ভারতে গণতন্ত্রের সমর্থনকারীর সংখ্যা ৭০% থেকে ৬৩%-এ নেমে গেছে। ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক সংস্থা PEW-এর প্রতিবেদনেও একই প্রবণতা ধরা পড়ে - ৫০%-র ওপর উত্তরদাতা নাকি নির্বাচিত প্রতিনিধির চেয়ে সামরিক শাসন বা প্রযুক্তিতান্ত্রিক শাসনের ওপরেই ভরসা রাখতে চায়। আর প্রতিবেদনে এটাও বলা হয়, ‘Support for autocratic rule is higher in India than in any other nation surveyed’. দুর্নীতি, সন্ত্রাস, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যে ভারতবাসীদের অধিকাংশই এখন একজন দাপুটে নেতা চাইছে, যিনি কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। আর এই দুর্নীতি সন্ত্রাস পাকিস্তান - সবটাই দেশের মুসলমানদের বৃহত্তম সমস্যা বানিয়ে তুলেছে। ওরা বিদেশি, ওরা আমাদের দুঃখদুরবস্থার জন্যে দায়ী, ওরাই উন্নয়নের পথে অন্তরায়। দেশদ্রোহীরা ওদের তোয়াজ করে। ওদের ধরে পিটিয়ে মারা দেশপ্রেমের কাজ।

আরেকটা বড় ব্যাপার শ্রেণি। তলার দিকে পিছিয়ে থাকা মানুষরা সমাজে উঠে আসছে - এটা উচ্চ বা মধ্যশ্রেণির বরদাস্ত হচ্ছে না। আমেরিকাতে গরিবদের জন্যে ব্যারাক ওবামার প্রকল্পগুলো অনেককে চটিয়েছিল। আমাদের এখানে সংরক্ষণপ্রথা অনেকের ক্ষোভের হেতু। যে সমাজে উচ্চ বা মধ্যরা প্রভূত সুযোগসুবিধে পেয়ে দিব্যি ছিল, সেটাকে এইভাবে বদলে যেতে দেওয়া যায় নাকি? সুতরাং এ শুধু হিন্দু নেশন তৈরির পরিকল্পনা নয়, উচ্চশ্রেণির (ও অনেকটাই উঁচু জাতির) নেশন তৈরিও উদ্দেশ্য বটে। ১৯৯০-এর দশক থেকে নব্য-উদার গোলকায়িত অর্থনীতি মধ্যশ্রেণির প্রসার ঘটিয়েছে, তাদের আরো ভোগবাদী করে তুলেছে। কিন্তু সব ভোগকামনা তো তৃপ্ত হচ্ছে না। বস্তুত অর্থনীতির বাস্তবতার প্রতিতুলনায় মানুষের পার্থিব উচ্চাকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছে অনেক বেশি করে - কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা (নানারকম মিডিয়া যার মধ্যে পড়ে) সে আকাঙ্ক্ষা সফলভাবে জাগিয়ে তুলেছে মানুষের প্রাণে। PEW-এর সাম্প্রতিক একটা রিপোর্ট এমনটা বলছে, খাঁটি অর্থনীতির মানদণ্ডে যদিও ভারতে মধ্যশ্রেণি জনসংখ্যার ৫%-র বেশি নয়, মূল্যবোধের দিক থেকে কিন্তু প্রচুর। বহুবাসনায় প্রাণপণে চাইছে সবাই, অথচ পাচ্ছে সামান্য, হয়ত ন্যূনতম পাওয়াটাও হ‍য়ে উঠছে না। ফলে রাগ হচ্ছে, প্রচণ্ড রাগ! ঐ হতচ্ছাড়া নিচু জাতের লোকগুলো আমাদের বঞ্চিত করছে, বা মুসলমানদের জন্যেই আমরা চাকরি পাচ্ছি না (অথচ নিচু জাত বা মুসলমানরা যে চাকরি বা অন্যান্য সুযোগসুবিধের ক্ষেত্রে আজও কত পিছিয়ে আছে তা প্রমাণিত সত্য)। প্রবল বঞ্চনাবোধে আর ক্রোধে প্রান্তিক মানুষদের ওপর হামলা করে তাদের আরো প্রান্তিকায়িত করে দেওয়া হচ্ছে এবং নিজেদের বেশ বাহাদুর মনে করে গর্বে বুক ফুলে উঠছে। এরাই জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতিকদের বীর-হনুমানবাহিনী। দেশে রোজই এদের দুচোখ ভরে দেখছি - দেখছি গোরক্ষার নামে, ‘লাভ জেহাদ’ ঠেকানোর জন্যে এদের ধর্মযুদ্ধ। ক্যাপিটলে ট্রাম্পের সমর্থনে এদেরই সম্প্রতি তাণ্ডব করতে দেখা গেল।

এই সাংস্কৃতিক নজরদারি ব্যাপারটা অনেকখানি মধ্যশ্রেণির নিজেদের সাংস্কৃতিক তাগিদ থেকেও আসে। একদিকে এই শ্রেণির হৃদয় জুড়ে বিশ্বব্যাপী বাজারের শামিল হবার, সেখানে শ্রেষ্ঠ আসন ল’বার তাগিদ; অন্যদিকে সেই বাজারলগ্ন অনেককিছু আছে যা এদের ঐতিহ্যিক নীতিবোধের সঙ্গে একেবারে মেলে না! দু’টো ভিন্ন নৈতিক সময়ের মধ্যে টানাপোড়েন চলে এদের মনে। তাই নীতি-পুলিশি করে ভারসাম্য আনতে হয়।

একটু ইতিহাসের দিকে তাকাই। আমাদের দেশে হিন্দুত্ব ব্যাপারটা গোড়া থেকেই মধ্যশ্রেণির অবলম্বন হয়ে বিকশিত হয়েছে। আধুনিকতার ফসল মধ্যশ্রেণি, যে আধুনিকতা সাবেক কৌমসমাজকে ভেঙে মানুষের ব্যক্তিত্বায়ন ঘটায়, তার মধ্যে নিরাপত্তাবোধের অভাব জাগিয়ে তোলে। তখন তাদের অন্যরকম একটা সামূহিকতার অনুভব দরকার হয়। নেশন অর্থে জাতির উদ্ভবও এইভাবে। আর ভারতীয় জাতির ভিত্তি হিসেবে ‘হিন্দু’ ধারণাটা গোড়া থেকেই, মানে উনিশ শতক থেকেই, প্রাধান্য পেয়েছিল, যদিও মুসলমানদের জাতির অন্তর্গত করে নেবার তাগিদও যে সেখানে ছিল না তা নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আধুনিকতা একেবারে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল মধ্যশ্রেণির জীবনে, ফলে আরো বেশি নিরাপত্তাবোধের অভাব। যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়া, গ্রাম থেকে শহরে চলে আসা আরো বেশি করে। উপরন্তু মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব। ঔপনিবেশিক দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতার জায়গাটাতে তো মধ্যশ্রেণি একেবারেই অসহায়। গত শতকের বিশের দশক থেকে তুমুল রাজনৈতিক মন্থনে অনেকরকম প্রবণতাই মাথা তোলে, যেমন সমাজবাদ। পাশাপাশি কিন্তু সেই পটভূমিতেই শহরাঞ্চলে উঁচু জাত আর বানিয়াদের মধ্যে আর.এস.এস. শিকড় গাড়ে। অন্য বিনোদনের অভাবে খেলাধুলো, ব্যায়াম, ধর্মচর্চা বেশ আরাম দেয় মানুষকে। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও প্রতিযোগিতার আবহে একধরনের সামূহিক আত্মপরিচিতিও তারা খুঁজে পায়। আর অহিন্দু তথা মুসলমানদের দানবায়ন এদের এই ধর্মচর্চার কেন্দ্রীয় ভাবনা। তারপর উত্তর-ঔপনিবেশিক কালে নতুন জাতিগঠনের আর্থসামাজিক প্রক্রিয়ায় মধ্যশ্রেণি আরো ব্যাপক হল, তার নিরাপত্তা খোঁজার তাগিদও বাড়ল। ধর্ম ব্যাপারটার গুরুত্বও বাড়ল সেইসঙ্গে, আরো বেশি করে বিদ্বেষমূলক হয়ে উঠল সেই ধর্ম। সেই পথেই আর.এস.এস.-এর নেতৃত্বে, বিশ্বহিন্দু পরিষদের গণ-আন্দোলনমুখী কৌশলে, জনসংঘ ও পরে বিজেপি-র রাজনৈতিক অংশগ্রহণে নতুন করে হিন্দুত্বের উত্থান। বাবরি মসজিদ থেকে তার জয়যাত্রার শুরু। বিশ্ব জুড়েই সমাজবাদের আদর্শ, বলতে গেলে গঠনমূলক আদর্শের ব্যাপারটাই এই সময় থেকে মুছে গেল। আদর্শ বলতে যা রইল তা শুধু ঘৃণার বিষ। এমন বলা হয়েছে - ‘Ayodhya is a refraction of ethnic cleansing in Serbia, the moral majority in the United states and other movements that define nations by ethnicity and religion.’ আর এই সময় থেকেই ধনতন্ত্র নতুন অবতারে দেখা দিল - নব্য-উদার অর্থনীতি জাঁকিয়ে বসল পৃথিবীর সর্বত্র। ‘নব্য মধ্যশ্রেণি’ও খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, যে শ্রেণির প্রধান পরিচয় ক্রেতা হিসেবে - দুনিয়ার যাবতীয় পার্থিব সুখসমৃদ্ধির ক্রেতা। একদিকে তারা বিশ্বমঞ্চে বিচরণ করে, অন্যদিকে ঘরের পাশের প্রতিবেশীকে সহ্য করতে পারে না।

একটা কথা বলাই বাহুল্য। এই নব্য-উদার অর্থনীতিকে রেড কার্পেট বিছিয়ে এদেশে আবাহন করে নিয়ে এসেছিল বিজেপি নয়, কংগ্রেস। বস্তুত অন্য কোনো রাজনৈতিক দলই - মায় কমিউনিস্টরা পর্যন্ত - এর প্রভাবের বাইরে নয়। কিন্তু বিজেপিই ‘নব্য মধ্যশ্রেণি’র নাড়ির খবর অন্য সব রাজনৈতিক দলের চেয়ে বেশি ভাল করে নিতে পেরেছে। ২০০৪ সালে ক্ষমতায় ফেরার জন্যে ‘Shining India’ স্লোগান দিয়ে একটু তাড়াহুড়ো করে ফেলেছিল অবশ্য। কিন্তু হেরে গিয়েও উজ্জ্বল কল্পচিত্রটি আঁকড়েই রইল। ২০১৪ থেকে সেই কল্পদর্শনই নানাদিকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে, মানুষ আরো আরো মোহিত হয়ে যাচ্ছে। জেগে জেগে ‘অচ্ছে দিন-এর স্বপ্ন দেখছে। এখনো ‘অচ্ছে দিন’ যদি না এসে থাকে, শিগগিরি আসবে, শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে - চিন্তা নেই!

তাহলে এ হল মূলত একটা এলিট প্রকল্প। অবশ্য যত তা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলে মন দিয়েছে, ততই সমাজের সর্বস্তরে চারিয়ে যাবার মত কৌশল তাকে রচনা করতে হয়েছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধতা তো ঘোষিত আদর্শ, কিন্তু তার বিপরীতে হিন্দু সমাজকে সংহত করতে হবে তো! নিচু জাত, জনজাতিদের সমর্থন পাবার জন্যে তাদের হিন্দুসমাজের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে হবে, সে মনের মধ্যে তাদের ওপর যতই ঘৃণা বা রাগ থাক! আর মধ্যশ্রেণির মূল্যবোধ তো নিচুতলাকেও অনেক ক্ষেত্রে আচ্ছন্ন করেছে, সেটা সুবিধাজনক। প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষ যারা অনেক বাধা ঠেলে সমাজে উঠে আসতে চাইছে, তাদের অনেক ক্ষেত্রে এটা বুঝিয়ে দেওয়া বোধহয় সহজ যে অন্য কোনো প্রান্তিক গোষ্ঠীই তাদের উন্নতির পথে বাধা। কিন্ত এই হিন্দু সংহতির মধ্যে অনেক সমস্যা আছে। দলিত ও নিচুজাতির প্রতি বিরূপতা আসলে হিন্দুত্বের মজ্জাগত। সংরক্ষণপ্রথা নিয়েও আছে অনেক আপত্তি। বস্তুত মহারাষ্ট্রের নাগপুরেই যে আর.এস.এস.-এর সূচনা হল ১৯২৫ সালে, সেখানে মুসলমানদের তেমন কোনো গুরুত্ব ছিল না, কিন্তু নিচু জাতিগুলির আন্দোলন উঁচু জাতের হিন্দুদের ভয় পাইয়েছিল। মনে হয়েছিল, এমন কৌশল করতে হবে যাতে এরা হিন্দুজাতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে তাকে শক্তিশালী করে তুলবে, কিন্তু একইসঙ্গে স্বস্থানে মানে পায়ের তলাতেই থেকে যাবে। জনজাতিদের মধ্যে কাজ করে আর.এস.এস.-এর যে বনবাসী কল্যাণ আশ্রম সেখানে প্রতীক হিসেবে একটা ছবির খুব কদর - রাম জড়িয়ে ধরেছেন সুগ্রীবকে, যে সুগ্রীব বানর বই নয় - নিতান্ত অবমানব। প্রসঙ্গত, হিন্দুত্বের নারীচিন্তাতেও অনেক সমস্যা। কিন্তু সেসব আলোচনা আপাতত তোলা থাক।

নব্য-উদার অর্থনীতি তথা বুর্জোয়া আধিপত্যের সংকট

২০০৮ সাল থেকে নব্য-উদার অর্থনীতি মন্দার কবলে পড়লে জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির প্রয়োজন আরো বেশি করে অনুভূত হয়। পার্থ চ্যাটার্জির ‘I am the People’ বই্টি বুর্জোয়া আধিপত্যের সংকট মোচনের ব্যাখ্যা দিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে জনপ্রিয়তাবাদ ব্যাপারটি বোঝার চেষ্টা করেছে। আসলে কিছু মানুষের অনেক অনেক ভোগ করাই যদি সমাজকাঙ্ক্ষিত হয়, তবে অনেক মানুষের বেঁচেবর্তে থাকার রসদে টান পড়বেই। কারণ পৃথিবীর সম্পদ সীমিত। অথচ সেই অনেক মানুষের সমর্থন ছাড়া তো রাজ্যপাট টেকে না। তার জন্যে জনপ্রিয়তাবাদকে নানান কৌশল বের করতে হয়। কিন্তু ব্যাপারটা তো আদতে স্ববিরোধী, তাই শেষরক্ষা হয় না। তখন কৌশল বদলাতে হয়। মহামন্দা আর ফ্যাশিজম-রূপ জনপ্রিয়তাবাদের পর্ব পেরিয়ে এসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমি দেশগুলিতে ওয়েলফেয়ার স্টেট-এর কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল। সেটা যখন ধোপে টিকল না, তখন এল নব্য-উদারতন্ত্র। ভারতের মত উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে অবশ্য তার চেহারা একটু অন্যরকম। এখানে তো ‘নাগরিক সমাজে’র চেয়ে ‘রাজনৈতিক সমাজে’রই গুরুত্ব বেশি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ‘প্রতিযোগিতামূলক জনপ্রিয়তাবাদ’‘রাজনৈতিক সমাজ’ তৈরি করে নানান সুবিধে করে দেয় যেযার রাজনীতির অনুগত মানুষদের। রাজনৈতিক নেতা আর সাধারণ মানুষের মধ্যে পৃষ্ঠপোষক-পোষিতের সম্পর্ক তৈরি হয়। সাধারণ মানুষ মোটামুটি সন্তুষ্ট থাকে, আর সেই সুযোগে কিছু লোকের হাতে প্রভূত সম্পদ জমা হয়, নেতারাও আখের গুছিয়ে নেন (আবার ‘মানুষের জন্যে কাজ করতে চাই’ বলে এক রাজনৈতিক দল ছেড়ে অন্য দলে যোগও দেন অনায়াসে - ‘মানুষের জন্য কাজ করা’ মানে কিছু পাইয়ে দেওয়া, প্রায়শই নিয়মকানুন-বহির্ভূত পথে; তার সঙ্গে ব্যক্তিগত লাভের হিসেবও জুড়ে থাকে)। বেশি চালাক যারা, তাদের রাজনীতিতে খাঁটি নাগরিক আর তাদের ‘অপর’-এর ধারণাটাও তৈরি করা হয় একই সঙ্গে, যাতে অসন্তোষ যখন যেটুকু তৈরি হবে তার তীরটা ঘুরিয়ে দেওয়া যায় সেই ‘অপর’দের দিকে। দানবায়িত মুসলমানগোষ্ঠীকে তাই আমাদের দেশে নব্য-উদারতন্ত্রের জন্য খুবই দরকার ছিল। তারপর একটা সময়ে ধনতন্ত্রের সেই নতুন অবতারও যখন মুখ থুবড়ে পড়ল, তখন জনপ্রিয়তাবাদের প্রয়োজন আরোই বাড়ল, পৃথিবীর সর্বত্রই - যা অনেককেই সেই গত শতকের ফ্যাশিবাদের উত্থান মনে করাচ্ছে। এইভাবেই বেঁচে থাকার মূল সমস্যাগুলো ভুলিয়ে দিয়ে ধর্ম, জাত ইত্যাদি দিয়ে মানুষের ক্ষোভকে অন্যপথে চালনা করা হচ্ছে।

আর সেই সুযোগে দেখুন, আমাদের রাষ্ট্রচালকরা কাজের কাজগুলো দিব্যি করে যাচ্ছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে সব কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিচ্ছেন - শেষপর্যন্ত শুধু রাম মন্দিরটাই জাতীয় সম্পত্তি হিসেবে থেকে যাবে বলে মনে হয়! একের পর এক কৃষি ও শ্রম বিলগুলো পাশ করা হল - কৃষক-শ্রমিকদের কোণঠাসা করে দিয়ে কর্পোরেটদের হাত শক্ত করার জন্যে। একটা শিক্ষাত্রস্ত, ঐতিহ্যভজা, পশ্চাৎমুখী আদর্শ, অহিন্দুদের দমন করে শক্তিশালী হয়ে ওঠাই যার একমাত্র নীতি, তার তো নিজস্ব কোনো অর্থনীতি থাকতেই পারে না। ওদের দত্তোপংত ঠেংগডি যতই পুঁজিবাদ আর সমাজবাদের বাইরে ‘তৃতীয় পন্থা’অনুসরণের কথা বলুন, বা ‘আত্মনির্ভরতা’র জন্য সওয়াল করুন (যে বুলি ইদানীং মোদির মুখে), আসলে ধনতন্ত্রের মদতই যে ওদের অর্থনীতি সেটা বুঝতে অসুবিধে নেই। সামাজিক বৈষম্যই তো ওরা চায়। ওদের ‘হিন্দু ইকনমিকস’ বলে সবাই স্বধর্ম অনুযায়ী পেশা নির্বাচন করুক - মানে মুচির ছেলে মুচি হোক, ডোমের ছেলে ডোম। তাতে এলিটদের আরো সুবিধে। সব মিলিয়ে বিপন্ন নব্য-উদারতন্ত্রের সুরক্ষার প্রকল্পে ওদের অর্থনীতি বেশ ভালই খাপ খেয়ে গেছে।

কোনো বিকল্প আছে কি?

আগামী নির্বাচনের কথা ভেবে বিজেপির বিকল্পের সন্ধান চলছে বটে রাজনীতিতে। কিন্তু মূল সমস্যা তো কাঠামোতে। কাঠামোগত বিকল্পের কথা কেউ ভাবছেন কি? এটা না ভাবলে, বিজেপিকে যদিও বা কোনো নির্বাচনে কোনোক্রমে পরাস্ত করা গেল, তাকে নির্মূল করা যাবে না কিন্তু। কারণ কাঠামোটাকে টিকিয়ে রাখা, আরো শক্তপোক্ত করার কৌশলটা ওরাই সবচেয়ে ভাল আয়ত্ত করেছে। উপরন্তু বিজেপির মাতৃসংস্থা আর.এস.এস. বহুদিন ধরে নানারকম মানুষের মধ্যে স্কুল-চালানো-সেবা-সংস্কৃতিচর্চা ইত্যাদি কাজ করে আসছে নিজের মত করে এবং এইভাবে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছে সামাজিক স্তরে। অন্য কোনো রাজনৈতিক দলেরই এই সামাজিক প্রভাব নেই - না কমিউনিস্টদের, যদিও তাদের আদর্শই সমাজবাদ; না কংগ্রেসের, যদিও নেতা হিসেবে তাদের গান্ধী বলে একটা লোক ছিল যে গ্রাম পুনর্গঠন, চরিত্রগঠন ইত্যাদি কথা বলত (যাকে, মজার কথা, ইদানীং বিজেপিই আত্মসাৎ করে নিয়েছে)। আজ অ-বিজেপি কোনো রাজনৈতিক দলেরই কোনো সর্বর্ভারতীয় কল্পনা নেই। সেই তো উন্নয়ন আর জাতীয়তাবাদ - তার বেশি আর কি? হ্যাঁ, মুসলমান-বিদ্বেষটা নেই, অন্তত আপাতদৃষ্টিতে। কিন্তু ওটুকুতে আর ক’জন ভুলবে? বরং বিদ্বেষটাই তো অনেকের কাছে স্বাদু মনে হচ্ছে। কংগ্রেসের ওপর-থেকে-চাপানো রাষ্ট্রীয় অতিকেন্দ্রিকতা বিজেপির থেকে খুব আলাদা নয়; এবং একটি পরিবার-কেন্দ্রিক অতিকেন্দ্রিকতার চেয়ে হিন্দুত্বকেন্দ্রিক অতিকেন্দ্রিকতা অনেকেরই প্রেয়। এর উল্টোদিকে আছে নেহাত আঞ্চলিক বা গোষ্ঠীস্বার্থের লালন। আর সেও তো প্রায়শ জনপ্রিয়তাবাদী, আমাদের পশ্চিমবঙ্গেই তো। তাছাড়া স্বজনপোষণ, দুর্নীতি, অশিক্ষা-কুশিক্ষায় সব দলই একে অপরকে টেক্কা দেয়! বিজেপি-র হিন্দুত্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেদের নিষ্ঠাবান হিন্দু প্রমাণ করার জন্য মরিয়া অধিকাংশ দল, কোনো তীক্ষ্ণ প্রতিযুক্তি তাদের ভাবনার বাইরে। বিজেপি-বিরোধিতাতে দলগুলি সত্যি করেই কতটা আন্তরিক? তাহলে একটা বিজেপি-বিরোধী জোট তো অন্তত এরা করত নির্বাচনের আগে, তাতে সাধারণ বিজেপি-বিরোধী মানুষেরও ভোট দিতে সুবিধে হত।

বুদ্ধিজীবীদের কাছেও কি কোনো বিকল্প আছে? বিজেপি-বিরোধিতা যতই করুন, তাঁদেরও তো টিকি বাঁধা বাজারের কাছেই, বাজারি মূল্যবোধেরও শামিল অনেকেই। কাজেই বিরোধিতাও সীমাবদ্ধ। সমস্যাটার মূলে যাওয়াতেই তাঁদের অনীহা আছে মনে হয়, তাতে নিজেদের দিকে আয়না ঘোরাতে হয় যে! ফলে বর্তমান বাজারি ব্যবস্থাটাকেই অবিকল্প আর অপরিবর্তনীয় বলে মেনে নিতে হয়। বাংলায় দেখছি, বহুদিন ধরে আধিপত্য-করা যে বামেরা একদা অর্থনৈতিক কৈবল্যবাদের বশবর্তী হয়ে কাব্যচর্চা করতেও ‘বুর্জোয়া’, ‘ফিউডাল’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার না করে পারত না, তারাও সমাজবিশ্লেষণের অর্থনৈতিক প্যারাডাইমটাকে ক্রমে বরবাদই করে দিল।

বিদেশে অবশ্য অর্থনীতি নিয়ে কিছু নতুন রকম ভাবনাচিন্তা হচ্ছে। গত বছর দশেকের মধ্যে তিনজন ফরাসি অর্থনীতিবিদের প্রভাব খুব বেড়ে গেছে, যাঁরা নিওলিবারেল ক্যাপিটালিজমকে তুলোধোনা করছেন। এক, Thomas Piketty যিনি কিনা দেখিয়েছিলেন ১% লোক কীভাবে পৃথিবীর বেশিরভাগ সম্পদ দখল করে রেখেছে, ৯৯%কে বঞ্চিত করে (ভারতেও অবস্থাটা খুব অন্যরকম নয়)। পিকেটিরই প্রেরণায় ‘Occupy Wall Street’ আন্দোলন হয়েছিল, ‘We are the 99%’ বলে। দুই, তাঁরই বন্ধু Emmanuel Saez আর তিন, Gabriel Zucman। এঁরা ধনীদের কর ফাঁকি দেওয়া নিয়েও খুব হৈচৈ তোলেন, তাদের ওপর বেশি করে সম্পদ কর চাপানোর দাবি করেন। Mariana Mazzucato-র মত কয়েকজন মহিলা অর্থনীতিবিদও উঠে এসেছেন, যাঁরা বলছেন - জরুরি পরিষেবাটা কারা দেয় সেটা বুঝে নাও। দেয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার, শিক্ষাব্যবস্থার লোকজনরা, দেয় মুদি, বাস ড্রাইভাররা। ফিনান্স আর ম্যানেজমেন্টের লোকদের আসলে হল গিয়ে ‘bullshit jobs’. ‘The Entrepreneurial State’ বইটিতে মাজুকাটো আরো দেখাচ্ছেন, সম্পদ তৈরির ক্ষেত্রে কাজের কাজ কিন্তু হয় সরকারি সাহায্যেই। প্রযুক্তিই যদি ধরি - যেমন, স্মার্টফোনের প্রযুক্তি, পরে যেটা নিয়ে ব্যবসা করে ফুলে ফেঁপে উঠল আপেল; কিম্বা সার্চ ইঞ্জিনের প্রযুক্তি, যার সুযোগ নিল গুগল। তেমনি ওষুধের ক্ষেত্রে সরকারি অনুদানে সম্ভব-হওয়া নতুন আবিষ্কারের পেটেন্ট নিয়ে ব্যবসা করে Roche, Pfizer-মত কোম্পানি। রাষ্ট্রই তো নতুন ধরনের গবেষণার ঝুঁকি নিতে পারে, প্রাইভেট কোম্পানি কক্ষনো নেবে না! সমাজতন্ত্রকে তো একদা এই বলে সমালোচনা করা হত - ‘খালি সম্পদ বণ্টনের কথা ভাবলে চলবে নাকি, সম্পদ তৈরি করতে হবে তো! আর সেটা সরকারি আওতায় হয় না, প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজেই হয় সবচেয়ে ভাল।‘ এখন সেই সমালোচনাটা ধসে গেছে। তবে এইসব অর্থনীতিবিদ পুরোনো ধাঁচের সমাজতন্ত্রেও ফিরে যেতে বলছেন না। বলছেন, ঠিক আছে, ইন্ডাস্ট্রি নাহয় এইসব ইনোভেশন সরকারের কাছ থেকে নিয়ে ব্যবসা করল; কিন্তু ট্যাক্সটা যেন সরকার তাদের কাছ থেকে কড়ায়গণ্ডায় বুঝে নেয়।

এইসব বিপজ্জনক অর্থনীতিবিদদের হাত আরো শক্ত করল করোনা। অতিমারীর গোড়ার দিকে একটা লেখা পড়েছিলাম। লেখক Rutgar Bregman বলছেন, নিওলিবারেল অর্ডার কিন্তু শেষ হতে চলেছে, কারণ করোনা সংকট মনে হচ্ছে অনেকদিন ধরে চলবে, ফলে এই সংকট মোকাবিলায় নেওয়া পদক্ষেপগুলো স্থায়ী হয়ে যাবার সম্ভাবনা। ২০০৮-এর রিসেশনের পরেও নিওলিবারেল মতাদর্শ পার পেয়ে গেছিল। ব্যাঙ্কাররা ঋণ-গ্রহীতাদের ওপর দোষ চাপিয়েছিল। ‘Collateralised debt obligations’, ‘credit default swaps’ - এইসব দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল, যার কিছুমাত্র লোকে বোঝে নি। ২০২০-র সংকটের কারণটা কিন্তু কারোরই বুঝতে অসুবিধে হয়নি। কারণটা হল একটা ভাইরাস। বোঝাই গেল নিওলিবারেল অর্ডার এমন সংকটের মোকাবিলায় একেবারেই অপারগ। ব্রেগম্যান দেখিয়েছেন, এটাই অনেককে, কোনো কোনো দেশে বেশ রক্ষণশীল নেতাদেরও, অন্যভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে। তাই ক’বছর আগেও যা অভাবনীয় ছিল করোনাকালে তা ভাবা গেল - বেসিক মিনিমাম ইনকাম, ওয়েলথ ট্যাক্স, সোশাল ওয়েলফেয়ার স্কীম, হেলথ কেয়ার তো বটেই। করোনা তো ম্যাগনিফাইয়িং গ্লাস দিয়ে সামাজিক বৈষম্যের ভাইরাসটাকে ভাল করে দেখিয়ে দিল। যেমন Journal of American Medical Association-এর বক্তব্য - ‘Low socio-economic status alone is a risk factor for total mortality independent of any other risk factors.’ আমাদের দেশে সৌভাগ্যবশত রোগটা সমাজের তলার দিকে খুব একটা ছড়ায় নি। কিন্তু করোনা মোকাবিলার নীতিই বুঝিয়ে দিল গরিব মানুষদের, পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রাণের কতটা দাম আমাদের রাষ্ট্রনেতাদের কাছে। আর আমরা এইসব রাষ্ট্রনেতাদের অমানবিক আচরণকে বাধা দেবার জন্যে, তাদের ওপর চাপ তৈরির জন্যে বিশেষ কিছু করে উঠতেও পারলাম না। আমাদের সরকার যদি নীতিগতভাবে স্বাস্থ্যপরিষেবাকে ধনীর বিলাসে পরিণত করে থাকে, আমরাও তো খাদ্যদ্রব্যকে পেট-ভরানো ও পুষ্টির সামগ্রী হিসেবে আর দেখি না, ভাত-ডালের চেয়ে আমাদের কাছে এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ ঝকমকে দোকানের শেলফে পাস্তার বা এক্সটিক মশলার ভ্যারাইটি। উপোসী শ্রমিকদের খিদের জ্বালা আমরা কি করে বুঝব!

বিদেশে যাই ভাবনাচিন্তা হোক (সত্যি করেই তা কতটা পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে জানি না), এদেশে বসে করোনাকালের প্রায় এক বছর অতিক্রান্ত করে কাঠামোগত পরিবর্তনের ব্যাপারে কোনো ভরসা পাবার কারণ আছে কি? তাহলে আমরা বিজেপিকে মূলগতভাবে চ্যালেঞ্জ করব কী করে? বিজেপি যদি বা ক্ষমতাচ্যুত হয়, তার রাজনীতিটা তো থেকে যাবে। ঘৃণা দিয়েই সাম্য, ভালবাসা আর পারস্পরিকতার ফাঁকটা ভরাট হবে। একটা সংবেদনশীল সুন্দর পৃথিবীও অধরাই থাকবে।

আমরা কি শত্রুকে চেনার যথেষ্ট চেষ্টা করেছি?

আমি অর্থনৈতিক কৈবল্যবাদে বিশ্বাসী নই। অবশ্যই সমাজসংস্কৃতির নানা অন-অর্থনৈতিক জটিলতা আজকের পরিস্থিতির জন্যে দায়ী। হিন্দুত্বের বিপদকে খাটো করে দেখছি না মোটেই। আর মুসলমান-বিদ্বেষের ভয়াবহতা রোখা তো আশু প্রয়োজন - আর্থসামাজিক কাঠামো বদল পর্যন্ত অপেক্ষা করা যায় না তার জন্যে। আমি শুধু ব্যাপারটাকে একটা সামগ্রিক উপলব্ধিতে নিয়ে আসতে চাইছি। শত্রুর সঙ্গে লড়াই করতে গে্লে শত্রুকে জানতে হয়। আমরা কি সেটা পর্যাপ্তভাবে করে উঠতে পেরেছি? একটা স্ববিরোধিতায় ভর্তি নড়বড়ে আদর্শ কীভাবে শুধু অহিন্দু-বিরোধিতার ওপর দাঁড় করানো হল, তারজন্য হিন্দুধর্মকে কীভাবে একটা আগ্রাসী সাম্প্রদায়িক শক্তিতে পরিণত করা হল, অর্থনীতির বঞ্চনাগুলোকেই বা কীধরনের কলাকৌশলে চাপা দেওয়া হচ্ছে - এগুলো কি আমরা ভাল করে বোঝার চেষ্টা করেছি? অন্যদিকে সাধারণভাবে মানুষও তো খুব বদলে যাচ্ছে। মস্তিষ্ক আর শরীর রসায়ন দিয়ে তৈরি তার যে মন, সেটাকে বদলে দিচ্ছে ইতিহাসের এই উত্তর-আদর্শ, উত্তর-সত্য পর্ব। তাই তো গণতন্ত্র দিয়ে গণতন্ত্র ভুলিয়ে দেওয়া, বুদ্ধি খাটিয়ে বুদ্ধি গুলিয়ে দেওয়া, বাস্তববিচক্ষণতা বশত অলীক কল্পনাকে বাস্তব বলে চালানো, মিথকে ইতিহাস বলে বিশ্বাস করানো সম্ভব হচ্ছে। ভোগবাদ যত মানুষের চেতনা-চৈতন্যকে আচ্ছন্ন করছে, ততই আলগোরিদম দিয়ে তাকে সহজেই বুঝে ফেলা যাচ্ছে। এও কিন্তু এক বাজারি ব্যবস্থা। বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাকে দিয়ে মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ আর বিশ্লেষণ করে বাজারে জিনিস বিক্রির কৌশলের মতই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকরা একটা মোহিনী-প্যাকেজ তৈরি করে মানুষের কাছে বিক্রি করছেন, সমর্থন কিনছেন। বস্তুত ব্যক্তিমানুষের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচরণকেও তো বদলে দিচ্ছে বাজার, বিশেষত ডিজিটাল মিডিয়া। সেটাও হিন্দুত্ববাদীদের রাজনীতি-ব্যবসায় সাহায্য করছে। আদর্শত্যাগী মধ্যশ্রেণির একটা বৃহৎ অংশ থেকে তো বটেই, আরো তলার দিক থেকেও হু হু করে সমর্থন আসছে।

তবু হয়ত বিজেপির পতন হবে। কিন্তু সেটা বিরোধীদের জন্যে ততটা নয়, নিজেদের জন্যেই হবে। অনেক দিক থেকেই বিজেপির বিপদ ঘনিয়ে আসছে মনে হয়। সবচেয়ে বড় বিপদ - দলটি যে অন্য কোনো দলের চেয়ে কম সুবিধাবাদী আর দুর্নীতিগ্রস্ত নয়, বরং বেশি, সেটা রোজ রোজ নতুন করে ওরা নিজেরাই প্রমাণ করে দিচ্ছে। কথায় আর কাজে কদর্যতার বাড়াবাড়িও অনেক সাধারণ মানুষের বিরূপতার কারণ হচ্ছে। এবং বিজেপির পতনে অর্থনীতিরও একটা বড় ভূমিকা থাকার সম্ভাবনা। বিজেপি জনসমর্থনের ভিত তৈরি করার জন্যে আর.এস.এস.-এর ওপর নির্ভরশীল। আর.এস.এস.-এর স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ, ভারতীয় মজদুর সংঘ ইত্যাদি ফ্রন্ট যে ধরনের অর্থনীতির কথা বলে - বিদেশি লগ্নির বিরোধিতা, উৎপাদনে স্বদেশিয়ানা, শ্রমিকদের সুযোগসুবিধে - তা বিজেপির নেতাদের কাছে কোনোদিন পাত্তা পায় নি, বড়জোর কিছু মুখরোচক স্লোগান হয়ে রয়েছে। অথচ আর.এস.এস.-এরও তো বিজেপি, বিশেষত মোদিকে, দরকার ক্ষমতার জন্য। তাই এইসব অধীনস্থ সংগঠনকে আর.এস.এস বলে রেখেছে, একটু আধটু বিরোধিতা কর, কিন্তু বেশিদূর যেও না। মোদির শ্রমিক-বিরোধী নীতি নিয়ে একটা সময়ে বড় আন্দোলন করবে ভেবেছিল ভারতীয় মজদুর সংঘ, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। সম্প্রতি কৃষি বিল নিয়েও একই ব্যাপার করল স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ। বিলের ফলে কর্পোরেটরা সুবিধে পাবে এবং চাষিরা অসহায় হয়ে পড়বে স্বীকার করেও সরকারের সদুদ্দেশ্যে তারা আস্থা প্রকাশ করল, আর বলল বিল প্রত্যাহারের দরকার নেই, একটু পরিবর্তন করলেই চলবে। তাছাড়া সাধারণ মানুষই বা মোদি-ডেমাগগির ‘অচ্ছে দিন’-এর প্রতিশ্রুতিতে কতদিন ভুলে থাকবে - কোনো প্রতিশ্রুতিই যখন পালিত হচ্ছে না, ‘অচ্ছে দিন’ যখন দূর থেকে দূরতর দিগন্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে! কোনো জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতিই খুব বেশিদিন টিকতে পারে না। কারণ মূলগত আর্থসামাজিক বৈষম্যের ব্যাপারটা এই রাজনীতি শুধু চাপাই দিতে পারে, বৈষম্যের মোকাবিলার ক্ষমতা তার নেই। এটুকুই যা আশার কথা! কিন্তু ঐ যা বললাম, এতে লাভ খুব দীর্ঘায়িত হবে বলে মনে হয় না।