আরেক রকম ● নবম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ১৬-৩০ মাঘ, ১৪২৭

সমসাময়িক

গেরুয়া সাংবাদিকতা


সংবাদপত্র আমাদিগের ব্যবসায় নহে। ঠাকুর জমিদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো কাঙাল হরিনাথ মজুমদার লিখেছিলেন। এখনকার সরকারি দাক্ষিণ্য কাঙালরা লিখছেন, অপ্রকাশ্যেঃ সংবাদ রচনা আমাদের ব্যবসা। ইহাতেই আমাদের প্রসাদ, পয়সা ও প্রচার লাভ।

আগে বলা হতো, হলুদ সাংবাদিকতা। তাকে সহস্র লক্ষ গুণে ছাপাইয়া উঠেছে - গেরুয়া তথা ভেড়ুয়া সাংবাদিকতা। এখানে সং আছে, সংবাদ বাদ। যেভাবে ভারতের ৯৯% প্রচার মাধ্যম মোদী ও আরএসএস বন্দনায় মুখর, তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। আগে দেখা যেতো আলোকচিত্রীরা ঠেলাঠেলি করেন ছবি ভালো পাবেন বলে। আর সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যম লড়ালড়ি করছে, তোষামোদ ও তৈলমর্দনে আগে প্রাণদানের প্রতিক্রিয়ায়। হয়কে নয় করছে, নয়কে হয় । তিলকে তাল বানাচ্ছে। তালকে তিল। নিজেরা সেরা প্রমাণ করতে টিআরপি সংস্থার প্রধানকে ঘুষ দিচ্ছে। বিদেশ ভ্রমণের টিকিট দিচ্ছে।

টিআরপি গণনা করে বার্ক। সেই বার্কের প্রধান পার্থ দাশগুপ্তকে ঘুষ দিয়েছেন রিপাবলিক টিভির প্রধান অর্ণব গোস্বামী। চ্যানেলটির মালিক এক বিজেপি সাংসদ। রিপাবলিক তো নয় আসলে রেপ-পাবলিক। রাতদিন চিৎকার করে ধর্ষণ চলছে। গণতন্ত্র ধর্ষণ। বাকস্বাধীনতা ধর্ষণ। চিন্তার স্বাধীনতা ধর্ষণ। রাজনৈতিক মতবাদ ধর্ষণ। ধর্মীয় স্বাধীনতা ধর্ষণ। মিছিল মিটিং সভা সমিতি করার অধিকার ধর্ষণ। নারী ধর্ষণে তো ভারত এখন বিশ্বসেরার দাবিদার। আর তার মধ্যে সেরা উত্তরপ্রদেশ। যেখানে ছয় মাসে ছয় জন সাংবাদিক খুন। তাঁরা মুসলিম নন, সকলেই ব্রাহ্মণ/উচ্চবর্গের মানুষ।

পুলওয়ামা কাণ্ড সাজানো অনেকেই বলেছিলেন। এতো দিনে প্রমাণ মিললো।‌ অর্ণব গোস্বামী ও পার্থ দাশগুপ্তের হোয়াটসঅ্যাপ ফাঁসে। পুলওয়ামা বিস্ফোরণের কোনো লোকদেখানো তদন্তও হয় নি। এনআইএ শুধু মুসলিম, বিরোধী রাজনীতিবিদ আর কৃষক নেতাদের বিরুদ্ধে কাজ করে। পুলওয়ামা বিস্ফোরণের ঘটনার তদন্ত নিয়ে তেমন হেলদোল নেই। অন্য বিস্ফোরণে অভিযুক্ত সন্ত্রাসী প্রজ্ঞাকে ছাড়াতে চেষ্টা করে এনআইএ। অর্ণব গোস্বামীর ক্যামেরাম্যান আধঘন্টা আগে থেকেই অপেক্ষা করে বিস্ফোরণ স্থলের অদূরে। কী করে জানলেন, বিস্ফোরণ হবে? অর্ণবকে তো গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত।

বালাকোটে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মতো গোপন খবর তিনদিন আগেই জানেন অর্ণব? কে বা কারা জানাল। উঁচু পর্যায়ের নেতা। অর্ণব ছাড়াও তাঁদের তো এখনই বরখাস্ত করে গ্রেপ্তার করে বিচার শুরু করা উচিত। কিন্তু এ-সব কথা বলার লোক নেই। সব ভয়ে কুঁকড়ে হয়ে আছে। যাঁরা সামান্য সাহস দেখাচ্ছেন সেই বিনোদ দুয়া রাজদীপ সরদেশাইদের বিরুদ্ধে মামলা। এতো দেশদ্রোহের মামলা ব্রিটিশরাজও করেনি।

ভারতে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সংবাদপত্র চালু করেন জেমস অগাস্টাস হিকি। তিনি তাঁর লেখায় সংবাদে ধুইয়ে দিতেন তৎকালীন শাসক ওয়ারেন হেস্টিংস ও তাঁর বেআইনি কাজকে আইনি করার সাগরেদ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে। এখন প্রধান বিচারপতি ও প্রধান শাসকের ন্যায় দেখলে পাড়ার মোড়লও লজ্জা পাবেন। এতোটা অন্যায্য অন্যায় কাজ করা যায়? না দেখলে বিশ্বাস হয় না। কোনো প্রতিকার নেই। প্রতিবাদ নেই।

তাঁর মাঝে আশা জাগানিয়া কিছু ছোটো সংবাদপত্র, অনলাইন সংবাদ। দি টেলিগ্রাফ, দি হিন্দু লড়ছে বিজ্ঞাপন না পেয়েও। আমাদেরও লড়তে হবে। পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা আদানির বিরুদ্ধে লিখেছিলেন। ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলিতে। তাই গুজরাটের এক আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। গুজরাটের আরেক আদালত আদানির বিরুদ্ধে কিছুই লেখা যাবে না বলে জানিয়েছে। এক যুবককে সতর্ক করা হয়েছে। এর মধ্যে আশার আলো ভারতের নবজাগ্রত কৃষক আন্দোলন। গত ৬৪ দিন ধরে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করছেন। ১৮২ জন শহিদ। সরকারের হেলদোল নেই। আদানি আম্বানিদের স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত সঙ্ঘী পরিবারের দুই কাগুজে বাঘ পুতুল মোদি শাহ কৃষকদের বিরুদ্ধে এনআইএ লেলিয়ে দিয়েছে। দেশদ্রোহের মামলা এনেছে। কৃষক আন্দোলনের খবর করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন সাংবাদিক মনদীপ পুনিয়া।

অথচ অর্ণব গোস্বামী ও তাঁর গোপন মালিকদের বিরুদ্ধে সবার আগে দেশদ্রোহের মামলা শুরু করা উচিত। ওরা দেশ বেচছে। সংবিধান ও গণতন্ত্র ধ্বংস করছে। সংসদে হট্টগোলের মধ্যে জোরজবরদস্তি করে ব্যালটে ভোট না করে বেআইনিভাবে কৃষি আইন পাশ করেছে।

ওদের এজন্য জেল হাজতে পোরা দরকার। বেআইনি দলবদল ঠেকানো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাজ। তা নয় জেট প্লেন পাঠিয়ে দলবদলুদের নিয়ে যাচ্ছে দিল্লি।

প্রধানমন্ত্রী আইন রক্ষাকারী হবেন তা নয় দেশের উপরাষ্ট্রপতিকে চাপ দিচ্ছেন গোলমালের মধ্যে বিল পাশ করাতে। সে-কথা লিখেছেন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি। তাঁর বইয়ে। তা নিয়ে টিভিতে ঘন্টাখানেক নেই। আলোচনা নেই।

এদের বয়কট করা দরকার। করতেই হবে। মিথ্যার সমুদ্রে ডুবিয়ে দিচ্ছে দেশ। এদের দেখলে গোয়েবলসও লজ্জা পেতো। এদের দেখেই কেউ বলতেন, জননীর জঠরের লজ্জা। হলুদ সাংবাদিকতাকে ছাপিয়ে গেছে গেরুয়া সাংবাদিকতা।

ধিক্কার এদের।

নোটবন্দী করে, জিএসটি চাপিয়ে, ব্যাংক দেউলিয়া করে, আম্বানি আদানিদের সম্পত্তি বহুগুণ বাড়িয়ে, লকডাউন করে শ্রমিকদের হত্যা করে, শ্রমিক বিরোধী নতুন শ্রম আইন তৈরি করে কর্পোরেট স্বার্থে শিক্ষা বিল এনেছে গরিবের শিক্ষার সুযোগ কেড়ে নিতে।

সিএএ বিল পাশ করেছে সংবিধানের বিরুদ্ধে।

জিডিপি নিয়ে গেছে - মাইনাস ২৪ শতাংশে। রেল, বিমান, বীমা, টেলিকম সব বেচে দিচ্ছে, কৃষকদেরকে কোম্পানিরাজের হাতে তুলে দিচ্ছে। নোট প্রত্যাশী গেরুয়া/ঘেরুয়া/ভেড়ুয়া সংবাদমাধ্যম আসল দেশ-বিরোধীদের আড়াল করতে লড়াকুদের দেশদ্রোহী বলে দেগে দিচ্ছে।

এদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়াই সময়ের দাবি।

শিরোনামে গেরুয়া ঘেরুয়া কেন? ওরা ঘিরছে মানুষের মন।

বিদ্বেষে, পাশবিকতায়, হিংস্র উল্লাসে। তাই ঘেরুয়া।

গেরুয়া/ভেড়ুয়া কেন?

টীকা নিষ্প্রয়োজন।