আরেক রকম ● নবম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ১৬-৩০ মাঘ, ১৪২৭

সমসাময়িক

বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদ


লকডাউনের চিত্রগুলি মনে করার চেষ্টা করুন, প্রিয় পাঠক। আপনি ঘরবন্দী, চাকরি থাকবে কি না নিশ্চয়তা নেই, অনেকের চাকরি চলে গেছে, পরিযায়ী শ্রমিকদের বিপুল সংখ্যায় হেঁটে চলা মানুষের চোখে জল এনে দিয়েছে। আপনি হয়ত ভাবছিলেন এহেন সংকট ভারতের ইতিহাসে এর আগে কখনও আসেনি। আপনি ঠিকই ভাবছিলেন। তবে আপনার এই ভাবনায় যদি ভারতীয় হিসেবে দেশের বিখ্যাত ধনী ব্যক্তিদের নামও এসে থাকে, তবে, প্রিয় পাঠক আপনি ভুল ভাবছিলেন। মানুষ ধ্বংস করে দিয়েও ধনীদের সম্পত্তি দুধে-ভাতে-ডলারে বিপুল পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে এই সময়।

কতই বা আর বেড়েছে ধনীদের সম্পদ? শুধুমাত্র ভারতের ধনীতম ১০০ জন ডলার বিলিয়নেয়ার (অর্থাৎ যাদের সম্পদ ১০০ কোটি ডলারের বেশি)-এর সম্পদ মার্চ ২০২০ সালের তুলনায় বেড়েছে ১৩ লক্ষ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্ক ইউবিএস-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী এপ্রিল থেকে জুলাই মাসের মধ্যে ভারতের ডলার বিলিয়নেয়ারদের সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ শতাংশ। অক্সফ্যামের রিপোর্ট জানাচ্ছে ভারত যখন প্রবল অতিমারির কবলে, দেশের ২৪ শতাংশ মানুষ প্রতি মাসে ৩০০০ টাকার কম উপার্জন করছিলেন তখন মুকেশ আম্বানির সম্পদ বৃদ্ধি হচ্ছিল ঘন্টায় ৯০ কোটি টাকা। একজন অসংগঠিত শ্রমিকের ১০০০০ বছর সময় লাগবে মুকেশ আম্বানি ১ ঘন্টায় যত সম্পদ বানিয়েছেন তা আয় করতে। এই হচ্ছে আমাদের দেশের আর্থিক বৈষম্যের পরিস্থিতি।

সমস্যা শুধুমাত্র আর্থিক বৈষম্য নয়। প্রশ্ন হচ্ছে এই আর্থিক বৈষম্য বাড়ছে কোন পদ্ধতিতে। একদিকে দেশের সরকার প্রায় বিনামূল্যে সম্পদ তুলে দিচ্ছে পুঁজিপতিদের হাতে। অতিমারির মধ্যেই দেশের ৬টি বিমানবন্দর আদানি গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। মুকেশ আম্বানির কোম্পানিকে বহু বছর আগেই গোদাবরী অঞ্চলের বিপুল প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডারের বরাত দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই গ্যাসের দাম নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে আম্বানি চুক্তিভঙ্গ করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশের কয়লা খনি তুলে দেওয়া হবে পুঁজিপতিদের হাতে। দেশের অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ হওয়ার আগেই জানিয়েছেন যে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রি করে দেওয়া হবে। অথচ সাধারণ শ্রমজীবি মানুষের আয় বাড়ছে না। গ্রামীণ এলাকায় প্রকৃত মজুরি কমছে, কৃষকরা ফসলের দাম পাচ্ছেন না, শ্রমিকদের মজুরি বাড়ছে না। অধিকাংশ কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে অসংগঠিত ক্ষেত্রে যেখানে না আছে আয় এবং সামাজিক নিরাপত্তা। শিক্ষা ক্ষেত্রকে সরাসরি বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে এবং নতুন শিক্ষা নীতির ফলে সেই প্রক্রিয়া আরো তরাণ্বিত হবে। সাধারণ শ্রমজীবি মানুষের হাতে শিক্ষাই একমাত্র অস্ত্র ছিল যার মাধ্যমে তারা সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর হতে পারতেন। বর্তমান সরকার সেই শিক্ষাকেও গরীব মানুষের হাতের বাইরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও পাকা করে ফেলেছে। একদিকে আয়ুষ্মান ভারতের গল্প শোনানো হচ্ছে অন্যদিকে লাগাতার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেসরকারীকরণ হয়ে চলেছে। সমস্ত দিক দিয়ে তাই গরীব মানুষের উন্নততর জীবনে রূপান্তরের পথ অবরুদ্ধ হয়ে চলেছে।

বাড়তে থাকা এই বৈষম্য আমাদের রাজনীতিতেও এক গভীর ছাপ ফেলেছে। দেশের ৫৪২ জন সাংসদের মধ্যে ৪৭৫ জনের সম্পদ কোটি টাকার বেশি। যেখানে দেশের অধিকাংশ মানুষ জীবনে কোনোদিনই এক কোটি টাকা আয় করতে পারবে না, সেখানে দেশের জনপ্রতিনিধিদের এই বিপুল আয়ের পরিমাণ বুঝিয়ে দেয় যে তারা জনগণের নয় আসলে নিজেদের শ্রেণি অর্থাৎ ধনীদের প্রতিনিধি। অন্যদিকে, নির্বাচন লড়ার খরচ প্রবলভাবে বেড়েছে। কোনো নতুন বা ছোট দলের পক্ষে নির্বাচনের ময়দানে অংশগ্রহণ করে প্রাতিষ্ঠানিক দলগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করা প্রায় অসম্ভব। ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিজেপি-র ঝুলিতে চলে যাচ্ছে, বাকি দলগুলির আয় নগন্য। ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে বিজেপি মোট ২৪১০ কোটি টাকা বাজার থেকে তোলে যার মধ্যে ১৪৫০ কোটি টাকা আসে ইলেক্টোরাল বন্ড থেকে যা মোট ইলেক্টোরাল বন্ডের অর্থের ৬০ শতাংশ। এই বিপুল পরিমাণ টাকা বিজেপি কাদের থেকে পাচ্ছে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অতএব যারা বিজেপিকে এই হাজার হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে বিজেপি সরকার যে তাদের পক্ষেই নীতি গ্রহণ করবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে আর্থিক বৈষম্য বাড়ছে। এই ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষম্য একদিকে যেমন অকুপাই ওয়াল স্ট্রিটের মতন আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল তেমন আন্দোলন সংগঠিত রূপ নিয়ে অবস্থার পরিবর্তন করতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং প্রতিক্রিয়াশীল অংশ একদিকে এই বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পক্ষে নীতি গ্রহণ করছে অন্যদিকে জনগণের মধ্যে বিভেদমূলক রাজনীতির নির্মাণ করে জনগণের আশু বিষয়গুলি থেকে মানুষের মনোযোগ সরিয়ে দিচ্ছে। আমাদের দেশে মোদী মনে করেন যে দেশের সম্পদের জন্মদাতা দেশের ধনী শ্রেণি তাই তাদের পক্ষে নীতিগ্রহণ করা স্বাভাবিক। অথচ যারা প্রকৃত শ্রমের মাধ্যমে দেশের সম্পদ নির্মাণ করেন সেই শ্রমিক এবং কৃষকদের বিরুদ্ধে একের পর এক আইন প্রণয়ন করে চলেছেন। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন হলে পুলিশ লেলিয়ে সেই আন্দোলন ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

বর্তমান পৃথিবীতে রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত সম্পদ নির্ভর ক্ষমতার যে মেলবন্ধন ঘটছে তাকেই ফ্যাসিবাদের জনক মুসোলিনি ফ্যাসিবাদ আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন ফ্যাসিবাদ হল এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা যেখানে কর্পোরেট এবং রাষ্ট্রের মধ্যে বিভাজন রেখা অস্পষ্ট হয়ে গিয়ে একে অপরের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। আজ ভারতের জনগণকে বোঝানো হচ্ছে যে পুঁজিপতিদের ভাল হলেই দেশের ভাল, প্রধানমন্ত্রী ধনীদের গুণগান করে চলেছেন, রাষ্ট্রের জনপ্রতিনিধিরা ধনী শ্রেণি থেকে আসছেন, তারাই সরকার চালাচ্ছেন, নীতি গ্রহণ করছেন এবং সাধারণ মানুষ নিজেদের দাবি নিয়ে লড়াই আন্দোলন করলে তাকে দেশবিরোধী আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। মুসোলিনি বর্নিত ফ্যাসিবাদের থেকে আমাদের দূরত্ব লাগাতার কমছে।