আরেক রকম ● নবম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ১৬-৩০ মাঘ, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

কোন খেলা যে খেলবে কখন


শাসক আতঙ্কগ্রস্ত। এবং আতঙ্কে দিশাহারা। কৃষি সংস্কারের নামে কৃষক সংহারের যে তিনটি আইন সংখ্যাধিক্যের অহমিকায় তৈরি হয়েছে তার প্রতিক্রিয়ার তীব্রতায় শাসকের এখন নাজেহাল অবস্থা। শাসকের খেয়াল ছিল না যে এই নতুন আইন কৃষকের জীবন এবং জীবিকার সঙ্গে জড়িত।

গত জুন মাসে দেশ যখন সংক্রমণের দাপটে অবরুদ্ধ সেই সময় জারি হয় অধ্যাদেশ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অধ্যাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু হয়। সংবাদমাধ্যম কোনো খবর করেনি। সেপ্টেম্বরে সংসদের সংক্ষিপ্ত অধিবেশনে কোনোরকম আলোচনা না করে, সমস্তরকমের সংসদীয় রীতিনীতি উপেক্ষা করে অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করা হল। তারপর ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। কোনোরকমে উৎসবের মরসুম পেরিয়ে ফসল কাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে শুরু হয় কৃষকের সঙ্ঘবদ্ধ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন।

শাসকের দরজায় প্রতিবাদ পৌঁছে দেওয়ার জন্য রাজধানীর দিকে রওনা দিলেন লক্ষ লক্ষ কৃষক। জাতীয় সড়ক খুঁড়ে রাজধানীর সীমান্তে সঙ্ঘবদ্ধ কৃষকের যাত্রাপথ রুদ্ধ করে দেওয়া হল। জাতীয় সড়কের ক্ষতিসাধন আইনত দণ্ডনীয় জানা সত্ত্বেও প্রশাসনের উদ্যোগে এমন অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লাখে লাখে কৃষক দিল্লির সীমান্তে রাজপথে অবস্থান শুরু করে দিলেন। শান্তিপূর্ণ অবস্থান আন্দোলন নিয়ে শাসক প্রথম দিকে নির্বিকার আচরণ করেছে। কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। অবস্থান আন্দোলন ক্রমশঃ শক্তিশালী হতে থাকে। প্রতিদিনই সমাবেশে নতুন নতুন কৃষক উপস্থিত হচ্ছেন। তাঁদের সমবেত কন্ঠের একটাই দাবি,- তিনটি আইন প্রত্যাহার করতে হবে।

অতঃপর প্রশাসন কিছুটা নড়েচড়ে বসে। বৈঠকের পর বৈঠক করে চলতে থাকে কালক্ষেপণ। শাসকের ধারণা ছিল না যে প্রবল শৈত্য, কুয়াশা, বৃষ্টির মধ্যেও কৃষক দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অবস্থানের মানসিক প্রত্যয় নিয়েই পথে নেমেছেন।

সরকারি প্রচার ব্যবস্থা ধারাবাহিকভাবে নতুন আইনের গুণকীর্তন শুরু করে দেয়। প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভক্তবৃন্দ। আন্দোলনকারীদের গায়ে নানারকমের দেশদ্রোহী তকমা এঁটে চলতে থাকে একতরফা প্রচার। কিন্তু পথে নামা কৃষক নিজেদের মৃত্যু পরোয়ানা প্রত্যাহারের দাবিতে অবিচল।

প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিস্থিতির মধ্যেও অবস্থানরত আন্দোলনকারীর সংখ্যাবৃদ্ধিতে সন্ত্রস্ত হয়ে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয় শাসক। সরকারের মুখ রক্ষার জন্য আপাতত আইন স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয় আদালত। এবং কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য একটি কমিটি গড়ে দেয়। আদালতের রায়কে সম্মান জানিয়ে কৃষকের তরফে জানিয়ে দেওয়া হল যে নতুন আইন প্রত্যাহারের পর অন্য কথাবার্তা হবে। একই সঙ্গে ঘোষণা করা হয় যে প্রজাতন্ত্র দিবসে রাজধানীতে ট্র্যাক্টর প্যারেড হবে।

শাসকের ঔদ্ধত্যের আস্ফালনের প্রতিস্পর্ধা প্রদর্শন অর্থাৎ চোখে চোখ রেখে কথা বলার হিম্মত দেখে শুরু হয় ষড়যন্ত্র। একদিকে ট্র্যাক্টর প্যারেডের যাত্রাপথ নির্ধারণ করার জন্য কৃষকের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে প্রশাসন আর তলে তলে চলতে থাকে ষড়যন্ত্র। প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে ট্র্যাক্টর প্যারেডের যাত্রাপথ নির্ধারণের পর শুরু হয় প্রস্তুতি।

২৬ জানুয়ারি দিল্লিতে এই কৃষক প্যারেড সফল করতে আগের দিন রাত থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়। সিঙ্ঘু, টিকরি সীমান্তে ট্র্যাক্টরের লাইন সাজানো শুরু হয়ে যায়। ট্র্যাক্টর ও অন্যান্য যানবাহনে লাগানো হয় জাতীয় পতাকা ও কৃষক সংগঠনের পতাকা। ২৬ জানুয়ারি নির্ধারিত সময়ে চিল্লা, ধানসা, শাহজাহানপুর, বাসানি ব্যারেজ, সুনেদা সীমান্ত, পালওয়াল প্রভৃতি জায়গা থেকে প্যারেড শুরু হয়। ট্যাবলোয় বর্ণময় পোস্টার, ফেস্টুন, পতাকা নিয়ে, কেউ কেউ ঘোড়ায় চড়ে প্যারেডে অংশ নেন। পথে তাঁদের অভ্যর্থনা জানিয়ে ফুল ছোঁড়া হয়। বহু জায়গায় পথের দু’ধারে মানুষজন দাঁড়িয়ে শ্রমিক-কৃষক ঐক্য জিন্দাবাদ ধ্বনি তোলেন। দিনভর স্থানীয় মানুষ প্যারেডে অংশগ্রহণকারীদের জল ও খাবার দিয়েছেন। এদিন উৎসবের মেজাজেই শুরু হয় কৃষকদের প্রজাতন্ত্র দিবস পালন।

দেশের টিভি চ্যানেলগুলি এইসব ঘটনাবলী সম্প্রচারের কথা বোধ হয় ইচ্ছাকৃতভাবেই উপেক্ষা করেছিল। তারা তখন রাজপথের সামরিক কুচকাওয়াজ প্রদর্শনে ব্যস্ত। অথবা সরকারের কাছে নিজেদের সমর্পিত করে শাসকের সুনজরে থেকে বাণিজ্য প্রসারের কাজ সামলাচ্ছিল।

প্রজাতন্ত্র দিবসের সকাল থেকেই শুরু হয় ট্র্যাক্টর যাত্রা। সিঙ্ঘু থেকে কৃষক নেতারা গাড়ি ও ট্র্যাক্ট‍‌রে করে রাজধানীতে ঢোকার পর শুরু হয় পরপর ট্র্যাক্টর মিছিল। টিকরি সীমান্তে মিছিল শুরু হলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে বাধা দেওয়া হয়। নির্ধারিত পথ ধরে মিছিল চলতে শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই একদল জনতা মিছিল থেকে বেরিয়ে রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে যাবার চেষ্টা করেন। কৃষক নেতারা তাদের নিরস্ত করার চেষ্টা করেন। এরইমধ্যে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়তে শুরু করলে পরিস্থিতির অবনতি হয়। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যায় একের পর এক ট্র্যাক্টর। পরে কৃষক নেতৃবৃন্দ ওই জনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনলেও পু‍লিশি বাধা চলতেই থাকে।

গাজিপুর থেকে ট্র্যাক্টর মিছিলের একটা অংশ হঠাৎ করেই নির্ধারিত পথে চলতে চলতে পূর্বনির্ধারিত পথ এড়িয়ে আইটিও’র দিকে চলে যায়। পুলিশি বাধা ভেঙে আইটিও পৌঁছালে পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে। এখানে কিছু সময়ের জন্য খণ্ডযুদ্ধ বেধে যায়। আইটিও-তে বিক্ষোভের সময়ে ট্র্যাক্টর উলটে গিয়ে একজন কৃষকের মৃত্যু হয়। পুলিশ শেষ পর্যন্ত জনতাকে পিছিয়ে দিলেও বেশ কয়েকটি ট্র্যাক্টর লালকেল্লা অভিমুখে চলতে শুরু করে। পায়ে হেঁটেও অনেকে লালকেল্লার দিকে চলে যায়। প্রথম ধাক্কাতেই পুলিশকে সরিয়ে তারা লালকেল্লার সামনের প্রাঙ্গণ দখল নিয়ে নেয়। কিছু লোক উঠে যায় র‌ামপার্টে। একটি স্তম্ভে শিখ সম্প্রদায়ের নিজস্ব পতাকা ‘নিশান সাহিব’ টাঙিয়ে দেয়। তবে, লালকেল্লার জাতীয় পতাকা কেউ স্পর্শ করেনি। এখানেও অনেকের হাতে ছিল জাতীয় পতাকা। পুলিশ প্রথমে বাধা না দিলেও পরে লাঠিচার্জ করে জনতাকে কেল্লা থেকে সরিয়ে দেয়। এই ঘটনা কৃষক আন্দোলনের কর্মসূচির অঙ্গ ছিল না। আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ এই ঘটনার নিন্দাও করেছেন। কিন্তু এই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিয়েই সারাদিন ধরে চলতে থাকে সংবাদমাধ্যমে প্রচার। এমনকি তিনদিন পর সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণেও জাতীয় পতাকার অসম্মান করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। অথচ পা‍‌লওয়াল থেকে নির্ধারিত পথে প্যারেড আসতে থাক‍‌লেও ফরিদাবাদে ঢোকার মুখে পুলিশ বাধা দেয়। সিকরিতে প্যারেডে পুলিশ লাঠি চালায়। ট্র্যাক্টরের চাকার হাওয়া খুলে দেয়। সেখানেই বসে পড়েন হাজার হাজার কৃষক। শাহজাহানপুরেও নির্ধারিত সময়ে শান্তিপূর্ণ ভাবেই প্যারেড শুরু হয়। সেসব নিয়ে প্রচারমাধ্যম নীরব।

লাল কেল্লার অবাঞ্ছিত বিচ্ছিন্ন ঘটনা কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করে। প্রথমতঃ আইটিও-তে অবস্থিত দিল্লি পুলিশের সাবেক সদর দপ্তরের সামনে কয়েকশো যুবক পুলিশের সঙ্গে ধ্বস্তাধস্তি করে বাহাদুর শাহ্ জাফর মার্গ ধরে দু' কিলোমিটার দূরের লাল কেল্লা অভিমুখে যখন রওনা দেয় তখন কেন পুলিশ নিস্ক্রিয় ছিল? আইটিও মোড় আর লাল কেল্লার মধ্যিখানে অবস্থিত দিল্লি গেটের সামনে সারা বছরই তো কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা বহাল থাকে। এমনকি দরিয়াগঞ্জ থানাও এখানেই অবস্থিত। অথচ পুলিশ নিষ্ক্রিয়। সন্দেহের অবকাশ আছে। সর্বোপরি লাল কেল্লা সারা বছরই কঠোর নিরাপত্তার বর্মে আঁটোসাঁটো হওয়া সত্ত্বেও প্রজাতন্ত্র দিবসের সকালে সেখানে কেন যথেষ্টসংখ্যক নিরাপত্তা বাহিনীর জওয়ান অনুপস্থিত ছিল? সংখ্যায় তাঁরা এতই কম যে উত্তেজিত কয়েকশো যুবক তাঁদের লাঠিসোঁটা দিয়ে পিটিয়ে দিতে সক্ষম হল। এবং তাদের পাকড়াও করা তো দূরের কথা পুলিশ পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাধ্য হল। কাজেই ষড়যন্ত্রের সন্দেহ অস্বীকার করা যায় না। প্রশাসনের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মদক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন করা যেতে পারে। অবস্থানরত কৃষকদের মধ্যে দুষ্কৃতীরা মিশে থাকার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশাসন কোনো গোয়েন্দা রিপোর্ট সংগ্ৰহ করেছিল কি? যদি করা হয়ে থাকে তবে তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। এত বিশাল আকারের একটি পূর্বঘোষিত প্যারেডের প্রস্তুতিপর্বে প্রশাসনের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর পূর্বনির্ধারিত পথে আগুয়ান মানুষ ও ট্র্যাক্টরের মিছিলে কেন বিভিন্ন জায়গায় বাধা সৃষ্টি করা হয় এই প্রশ্নের জবাব কোথায়। হাঙ্গামাকারীদের নেতার গেরুয়া পরিচয় প্রকাশিত হওয়ার পর ষড়যন্ত্রের দুর্বলতা আরও প্রকট হয়ে দেখা যায়। লাল কেল্লার দুর্বৃত্তদের গ্রেফতার করা তো দূরের কথা তাদের বিরুদ্ধে কোনো এফআইআর পর্যন্ত করা হয়নি। অথচ আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে। পাঁচ রাজ্যে ৩৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছেন ৮৪ জন। বাদ যাননি সাংবাদিকরাও। তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে। সিঙ্ঘু সীমান্তে খবর করতে যাওয়া দুই সাংবাদিককে দিল্লি পুলিশ ৩০শে জানুয়ারি আটক করেছে। সবমিলিয়ে একেবারেই কাঁচা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে প্রশাসনিক ব্যর্থতা মিলেমিশে একাকার হয়ে এমন এক কান্ড হল যা বেশিক্ষণ সম্প্রচার করা যায়নি।

আপাতদৃষ্টিতে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা কৃষকের উদ্দীপনা কিছুটা হলেও স্তিমিত হয়ে যায়। ২৭শে জানুয়ারি থেকে শুরু হয় নতুন ধরনের আক্রমণ। সংবাদমাধ্যমে সারাদিন ধরে স্থানীয় মানুষ বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া কিছু মানুষের সাক্ষাৎকারের সম্প্রচার চলতে থাকে। দিল্লির শহুরে মানুষের মনজয়ের চেষ্টা। স্বল্পস্থায়ী কথাবার্তায় সেইসব তথাকথিত স্থানীয় লোকজন বুঝিয়ে দেন যে তাঁরা আদতে ভক্ত।

পরের দিন অর্থাৎ ২৮শে জানুয়ারি প্রশাসন হঠাৎ করেই যেন সক্রিয় হয়ে ওঠে। রাজপথ ফাঁকা করার জন্য হাজির হয় বিশাল পুলিশ বাহিনী। জল সরবরাহ বন্ধ। বিদ্যুৎ নেই। অস্থায়ী শৌচালয় সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে গাজিপুর, সিঙ্ঘু, টিকরি, পালওয়াল সীমান্তে কৃষক আন্দোলনের উত্তেজনা থাকে। বাড়তি উৎপাত হিসেবে কৃষকদের আন্দোলনস্থল থেকে তুলে দেওয়ার দাবিতে সিঙ্ঘু সীমানায় ঢুকে পুলিশি পাহারায় তাণ্ডব চালায় শ'দুয়েক গেরুয়া ভক্ত। প্রাথমিকভাবে পোস্টার, ব্যানার নিয়ে হাজির হলেও পরে পাথর ছোড়া হয় ও একাধিক তাঁবু ভেঙে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। শুধু সিঙ্ঘু সীমানা নয়, টিকরি সীমানাতেও কৃষক আন্দোলন বিরোধীদের জটলা দেখা যায়। খবরে বলা হয় যে তাঁরা স্থানীয় মানুষ। ‘জাতীয় পতাকার অপমান করা হয়েছে’, এই পোস্টার হাতে তাঁরা আন্দোলনস্থলে আসেন।

চারদিকে পুলিশের কড়া পাহারা, গাড়ি যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা, এমনকি জলের গাড়ি দাঁড় করাতেও হাজারো ঝামেলা। তার মধ্যে এত লোক কী করে আন্দোলনস্থলে ঢুকে পড়ল, তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, সাদা পোশাকে পুলিশকর্মীরাই আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করতে ঢুকে ভাঙচুর চালিয়েছেন। পুলিশ অবশ্য অভিযোগ করেছে, এই সময়ে দু’দিক থেকেই পাথর ছোড়া শুরু হয়েছিল। সেই কারণেই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। শান্তি বজায় রাখতে পুলিশকে লাঠি চালাতে হয়, ফাটাতে হয় কাঁদানে গ্যাসের শেল।

মাত্র ৭২ ঘণ্টা। সাধারণতন্ত্র দিবসের রাতে লালকেল্লার সাজানো ঘটনার পরে যে কৃষক আন্দোলনকে ‘দুর্বল’ হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করা হয়েছিল, তা বহুগুণ শক্তিশালী হয়ে গেছে। এমনকি দু’মাস দিল্লির সীমান্তের অবস্থানে যত মানুষ ছিলেন, তারও বহুগুণ বেশি কৃষক এসে ঢেউ তুলে দিয়েছেন। ৩০শে জানুয়ারি সিঙ্ঘু, টিকরি এবং এখন আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে ওঠা গাজিপুরে জনসমুদ্র তৈরি হয়ে গেছে। এও অংশ মাত্র। লাগাতার স্রোতের মত কৃষক আসছেন ট্রাক্টর, ট্রলি, ট্রাকে করে। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তরাখণ্ড থেকে মিনিটে মিনিটে মানুষ আসছেন। জাতীয় সড়কগুলি কৃষকের দখলে। মারদাঙ্গা করে, পুলিশ পাঠিয়ে কৃষক জমায়েত ভাঙার সরকারি কৌশল সম্পূর্ণ বিপরীত প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। বরং, যা সীমাবদ্ধ ছিল রাজধানীর সীমান্তে তা এখন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানায়। সর্বত্র কৃষকের ডাকে পঞ্চায়েত হচ্ছে, সেখান থেকে দিল্লির সীমান্তে আসার ডাক দেওয়া হচ্ছে। হরিয়ানায় পঞ্চায়েতের সভা করে শাসকদলের স্থানীয় কর্মী-নেতাদের সামাজিক বয়কট করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। উত্তর প্রদেশের ৩৬টা বেরাদরির লক্ষ কৃষক মহাপঞ্চায়েতে সমবেত হয়ে "লোটা নমক" শপথ নিয়ে গেরুয়া শিবিরের সদস্যদের সামাজিক বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। চিরাচরিত পদ্ধতি অনুযায়ী এক লোটা (ঘটি) গঙ্গাজলে কিছুটা নুন দিয়ে এই শপথ নেওয়ার অর্থ ব্যক্তির মত গোটা সম্প্রদায়ের মতে পরিণত হওয়া - ব্যক্তি আর সমষ্টির এই যৌথ মত আর কোনোভাবেই আলাদা হবে না। বাংলায় যা "ধোপা-নাপিত" বলে পরিচিত।

৩০শে জানুয়ারি গান্ধীজীর হত্যাকাণ্ডের দিন দেশব্যাপী কৃষকদের গণ-অনশনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। দিল্লির তিন সীমান্তেই কৃষক নেতারা অনশন করেন। অনশন পালিত হয়েছে দেশের নানা রাজ্যেই। আবার, অনেক রাজ্যে এদিন মানববন্ধন, মিছিল, বিক্ষোভ হয়েছে। দিল্লিতে জেএনইউ’র মধ্যে ছাত্ররা অনশন করেন। কৃষক আন্দোলনকে বিপর্যস্ত করতে সরকারের তৎপরতা এখনও চলছে। সিঙ্ঘু, টিকরি, গাজিপুর সহ লাগোয়া অঞ্চলে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হরিয়ানার ১৭টি জেলায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ। মোবাইল ফোনও কাজ করছে না। শুধু কৃষকরা নন, সব অংশের সাধারণ মানুষই জরুরি পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। টিকরি থেকে অস্থায়ী শৌচালয় তুলে নেওয়া হয়েছে, জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। দিল্লি পুলিশ সীমান্তে ট্র্যাক্টর মিছিল আটকাতে নতুন করে হঠাৎই ব্যারিকেড লাগানো হয়েছে। গাজিপুরে কৃষকের স্রোতে এখন আর শুধু তিন আইন তোলার কথাই নেই, আছে ‘স্বাভিমান’-এর কথা। সরকার কৃষকের সম্মানে আঘাত করেছে, এই ক্রোধ কাজ করছে। গ্রামের মানুষ খাবারদাবার জল নিয়ে আসছেন। ২৮শে জানুয়ারি রাতে যখন গাজিপুর পুলিশ ঘিরে ফেলেছে, জল বন্ধ করে দিয়েছে তখন কোনো এক কৃষক নেতা বলেছিলেন, গ্রাম থেকে জল না এলে তিনি জলই খাবেন না। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ থেকে মাথায় জলের কলসি নিয়ে শত শত মানুষ চলে এসেছেন। শিশুরাও এসেছে টিফিনের কৌটোয় পরোটা-ভাজা নিয়ে। সমবেত কৃষকদের মধ্যে তা বিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নতুন পোস্টারে ভরে গেছে সমাবেশস্থলঃ ‘গর্ব সে কহো কিষাণ কা পুত্তর হ্যায়’। শাসক বুঝতে পারছে যে কৃষকদের ওপরে শক্তিপ্রয়োগ করলে পরিণতি ভয়ঙ্কর হবে। কৃষকের পাগড়িতে কেউ হাত দিলে, ষড়যন্ত্রকারীরা আক্রমণ করলে তা বরদাস্ত করা হবে না। প্রকৃতপক্ষে কৃষকদের আক্রমণ করতে চেয়েছিল উদ্ধত শাসক। পরিবর্তে তা কৃষকের হৃদয়ে আঘাত দিয়েছে। কৃষক নেতার চোখের জল সমস্ত কৃষককে কাঁদিয়েছে। আন্দোলন আরও জোরালো হয়েছে। ২রা ফেব্রুয়ারি দিল্লির সীমান্তে বিশাল সমাবেশের জন্য সমস্ত রাজ্য থেকে অসংখ্য কৃষক দিল্লির দিকে রওনা দিয়েছেন। আন্দোলনের নেতৃত্ব দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল এবং আছে। সরকার কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনার ছবি তুলে ধরে মানুষের মনে ভয় ধরাতে চাইছে। মিথ্যা প্রচার করে আন্দোলনের বদনাম করতে চাইছে। প্রতিবাদস্থলে প্ররোচনা তৈরি করতে চাইছে। কিন্তু কৃষক এখন সতর্ক। কোনো রকম হিংসা বরদাস্ত করা হবে না বলে আন্দোলনের নেতৃত্ব জানিয়েছেন।

শাসক বিপর্যস্ত। ভক্তবৃন্দের বৃন্দগান বন্ধ। সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে ঠেকেছে। কৃষকের শান্তিপূর্ণ দীর্ঘ আন্দোলন এখন আন্তর্জাতিক স্তরেও বহুল আলোচিত বিষয়। কিন্তু সরকার নির্বিকার। তার মানে এই নয় যে নতুন কোনো মতলব ভাঁজা হচ্ছে না। নতুন আক্রমণ কোন দিক থেকে কীভাবে হানা হবে তা অনুমান করা সম্ভব নয়। তবে সর্বজনীন সতর্কতা আবশ্যক। ইদানিং আবার রবীন্দ্রনাথ চর্চা শুরু হয়েছে। সেই সুবাদে নিরাপত্তার মোড়কে নিভৃতে অবস্থানরত উদ্ধত আধিপত্যবাদের হয়তো পছন্দ হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান। মনে মনে হয়তো মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হচ্ছে, "কোন্‌ খেলা যে খেলব কখন্‌ ভাবি বসে সেই কথাটাই..."