আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২১ ● ২-১৭ মাঘ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

অনেক প্রশ্ন রেখেই টিকা

স্বপন ভট্টাচার্য


ভারতে রাষ্ট্রীয় স্তরে কোনো শুভকাজ যাগযজ্ঞ ছাড়াই হয়ে যাবে এটা সচরাচর হয় না। ধরুন রাফায়েল বিমানের গায়ে রাজনাথ সিংহ একখানা নারকেল ফাটিয়ে শুভ সূচনা করবেন সেটার আকাশ পরিক্রমণের অথবা তের হাজার কোটি টাকার নতুন একখানা পার্লামেন্ট ভবনের শিলান্যাস হবে প্রধানমন্ত্রীর ফুল বেলপাতায়-এমনটাই রীতি। এই একুশের প্রথম রবিবারে আমাদের কিছুটা অবাক করেই ড্রাগস কন্ট্রোলার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া শ্রীযুক্ত ভি জি সোমানি অবশ্য যাগযজ্ঞি ছাড়াই যে কাজটা করেছেন তাতে তিনি নিজেই কিছুটা অবাক না হলে আশ্চর্য হব। সেদিন সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে তিনি কোভিডের দুটি টিকাকে ভারতে ব্যবহারের জন্য ‘অ্যাপ্রুভাল’ দেবার কথা ঘোষণা করে দেন। এর একটি হল অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার দ্বারা তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল পার করা টিকা ‘কোভিশিল্ড’ এবং দ্বিতীয়টি হল হায়াদ্রাবাদের ভারত বায়টেক সংস্থা দ্বারা পরিকল্পিত টিকা ‘কোভ্যাক্সিন’ যা এখনো তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালেই রয়ে গেছে। অবাক হবার কথা বলছি এই কারণে যে মাত্র দু দিন আগেই এটিকে অননুমোদনযোগ্য বলে বাতিল করেছিলেন তিনিই। হয়তো বা মোদীই এই অনুমোদনের কথা ঘোষণা করলে এত হইচই হত না যতটা হচ্ছে দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থার সর্বোচ্চ ব্যক্তি তা করে বসায়, কেন না অনুমোদনের প্রশ্নে যত বজ্র আঁটুনি তিনি নিজে এঁটেছেন এই এক ঘোষণায় তা আলগা করার সব দায় বেচারি তাঁকেই নিতে হল।

ভারতে টিকা তো বটেই, যে কোনো ওষুধ, বায়োমেডিক্যাল যন্ত্রাদি মায় ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ পর্যন্ত সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (CDSCO)-অনুমোদন ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি। টিকা এবং ওষুধের অনুমোদন দেওয়া হয় নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা সম্পর্কে নিঃসংশয় হবার পর। এটা সাধারণভাবে একটা রীতিমত সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া যার প্রতিটি ধাপে আছে স্বতন্ত্রভাবে অনুমোদিত হবার দায়। টিকা গবেষণার ইতিহাস বলে সবচেয়ে কম সময়ে অনুমোদন পাওয়া টিকা হল মাম্পস ভ্যাকসিন যা ১৯৬০-এর দশকে সাড়ে চার বছর সময় নিয়েছিল অনুমোদন পেয়ে বাজারে আসতে। কোভ্যাক্সিন তো নয়ই, কোভিশিল্ডও এসব ধাপ সন্তোষজনকভাবে পার হয়ে এসেছে এ’কথা তারা নিজেরাও দাবি করবে না, তবু কী ভাবে এই ‘অ্যাপ্রুভাল’ এসে গেল? এখানেই একটা ‘ইতি গজ’ টাইপের রাইডার আছে যেটা না বুঝলে দেশভক্তির তলায় বিজ্ঞান চাপা পড়তে পারে। সেটাকে বলা হয় ‘ইমারজেন্সি ইউজ অথরাইজেশন’(EUA) বা জরুরী ভিত্তিতে ব্যবহারে স্বীকৃতি যা নাকি সঠিক অর্থে ‘অ্যাপ্রুভাল’ বা অনুমোদনের চেয়ে কয়েক যোজন দূর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশমতেই কোনো জরুরী ব্যবস্থা নেবার তাগিদে (যেমন, এই কোভিড অতিমারির প্রকোপে) পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই ওষুধ-বিসুধের পূর্ণ অনুমোদনের আগে অন্তর্বর্তীকালীন অনুমোদনের সংস্থান আছে যদি তা যথেষ্ট নিরাপদ এবং কার্যকরী বলে বিবেচিত হতে পারে। ভারত সহ যে সব দেশে টিকা অনুমোদিত হয়েছে বলে বলা হচ্ছে তার কোনোটিই পূর্ণ অনুমোদন নয়। যা হচ্ছে বা হয়েছে তা হল ওই অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা, যেখান থেকে এই টিকাগুলোর যে কোনটিরই ভবিষ্যতে বাতিল হবার সম্ভাবনা আক্ষরিক অর্থেই ষোল আনা।

এই অন্তর্বর্তীকালের টিকা দু’টোয় ঢোকবার আগে আমরা একবার দেখে নিতে পারি একটা টিকা অনুমোদিত হবার আগে ঠিক কোন কোন ধাপ তাকে পেরোতে হয়। কয়েকটি পর্যায়ে বিভক্ত টিকা গবেষণা ও অনুমোদনের এই প্রক্রিয়া।

১। অনুসন্ধান পর্যায় (Exploratory Stage): এই পর্যায়ে জীবাণুর ধরনটি বুঝে নিয়ে তার বিরুদ্ধে শরীরকে প্রতিরোধক্ষমতা দান করার বিজ্ঞানটি সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়া। এজন্য গবেষক সঠিক ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেটটি খুঁজে চলেন যার কার্যকারিতা সম্পর্কে তিনি অন্তত সন্দেহ পোষণ করবেন না।

২। প্রাক- ক্লিনিক্যাল পর্যায় (Pre-clinical Stage): সঠিক ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট পাওয়া গেলে সেটিকে মানুষে ডাক্তারি পরীক্ষায় ব্যবহারের আগে অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীতে প্রতিক্রিয়া দেখে নেওয়া। ইঁদুর থেকে বাঁদর, শিম্পাঞ্জির উপর এই পর্যায়ে টিকার প্রভাব দেখা হয়।

৩। ক্লিনিক্যাল পর্যায় (Clinical Stage): তিন স্তরে বিভক্ত এই পর্যায় -
প্রথম ধাপ (Phase-1): অল্পসংখ্যক স্বেচ্ছাগ্রাহীর উপর টিকার প্রভাব দেখা হয়।
দ্বিতীয় ধাপ (Phase-2): জাতি, ধর্ম, বয়স, বর্ণ ইত্যাদি বৈচিত্র রেখে অপেক্ষাকৃত বেশি সংখ্যায় স্বেচ্ছাগ্রাহীর উপর পরীক্ষা।
তৃতীয় ধাপ (Phase-3): হাজার হাজার মানুষের উপর বিভিন্ন ভৌগলিক অঞ্চলে পরীক্ষা চালিয়ে সর্বজনীনতা, কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়া। অনেক টিকা অনুমোদিত হবার পরেও এই পর্যায় বা চতুর্থ আর একটি পর্যায়ের পরীক্ষার ভিতর দিয়ে যায়।

৪। ফলাফল বিশ্লেষণ এবং অনুমোদন (Regulatory Review and Approval): স্যাম্পেল সাইজ যত বড় হবে তত বেশি সময় লাগবে এই পর্যায়ের নির্ণায়ক ফলাফল পেতে। পোলিও টিকার সময় তৃতীয় পর্যায়ে আঠেরো লক্ষ বাচ্চার উপর ফলাফল বিশ্লেষণ করতে পুরো এক বছর লেগে গিয়েছিল।

৫। বাণিজ্যিক উৎপাদন (Manufacturing): গবেষণাগার থেকে প্রযুক্তি হস্তান্তরিত হবে বাণিজ্যিক সংস্থায় এবং সেটাকে বিক্রয়যোগ্য করে বানানো এবং বাজারে আনার কাজ করে সেই সংস্থা।

৬। গুণমাণ পরীক্ষা (Quality Control): এটা চলমান প্রক্রিয়া। প্রতি ব্যাচের উৎপাদনকে সুনিশ্চিতভাবে গুণমান বজায় রাখতে হয়।

এ তো গেল স্বাভাবিকভাবে যে টিকা বাজারে আসে তার কথা। অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিক দ্রুততায় টিকা বাজারে আনার জন্য কিছু গাইডলাইন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তৈরি করে ২০১৪-১৬ সময়কার ইবোলা মহামারির সময়। তারা বলছে ‘পাবলিক হেলথ ইমারজেন্সি অফ ইন্টারন্যাশানাল কনসার্ন’ দাবি করে ওষুধ বা টিকা বা বায়োমেডিক্যাল উপাদানসমূহের অন্তর্বতীকালীন অনুমোদনের। তারা এটাকে ঝুঁকিভিত্তিক বা Risk Based Procedure বলেই চিহ্নিত করছে। ইবোলা প্রতিরোধে দুটি এরকম আবেদন এসেছিল বটে কিন্তু কোনোটাকেই হু অনুমোদন দেয়নি। তাদের নীতিতে একটা টিকা বিশ্বব্যাপী অতিমারির সময় আপৎকালীন অনুমোদনের (EUL) আবেদন করতে পারে যদিঃ
ক) রোগটি জীবননাশী হয় এবং তার জন্য কোনো ইতিপূর্বে আবিষ্কৃত লাইসেন্সপ্রাপ্ত টিকা না থেকে থাকে।
খ) যদি এমন হয় যে বাজারে পাওয়া যায় এমন কোনো উপাদানেই (অর্থাৎ ওষুধে) রোগটিকে কাবু করা যাচ্ছে না।
গ) টিকা তৈরি হয়েছে ‘গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস’ গাইডলাইন মেনে। এবং
ঘ) উৎপাদক সংস্থা লাইসেন্স পাবার পরেও নিজেদের দায়িত্বে সব কয়টি পর্যায়ের ট্রায়াল সম্পন্ন করবে এবং EUL আবেদনের সময় সেটির উৎপাদন প্রক্রিয়া যেন শুরু হয়ে গিয়ে থাকে।

এই মোটা হরফের বাক্যটিতেই আছে এই প্রশ্নের উত্তর যে, কীভাবে অনুমোদন পাবার আগেই লক্ষ লক্ষ ডোজ টিকা রেডি বলে ছাতি ফোলানো হচ্ছে ? সে অক্সফোর্ড টিকা হোক বা ভারত বায়োটেকের অর্ধপক্ক টিকা- প্রচুর ডোজ তৈরি না থাকলে আপৎকালীন অনুমোদন পাওয়াই যাবে না, অন্তত হু গাইডলাইন তাই বলে। হু-এর গাইডলাইন আছে বলে অন্য দেশকে সেটাই মানতে হবে তার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের FDA সুনির্দিষ্টভাবে তৈরি নিজস্ব গাইডলাইন মানে EUL-এর জন্য। তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল সম্পূর্ণ করার পর অন্ততপক্ষে ৫০% কার্যকারিতা দেখাতে পারলে তবেই সে দেশে আবেদন করা যায় আপৎকালীন অনুমোদনের। ভারতে কিন্তু এই করোনাকালের আগে এমন কোনো গাইডলাইন ছিলই না, এখনো নেই। তা সত্বেও, অতিমারি নিয়ন্ত্রণে জুন মাসে রেমডিসিভির ও ফাভিপিরাভির নামক দুটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ আপৎকালীন অনুমোদন পেয়েছে। আর এই জানুয়ারিতে এসে পেল দু’খানা টিকা যাদের সম্পর্কে চিকিৎসক মহলেই অনেক প্রশ্ন। টিকাদান প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি আমাদের দেশে কিন্তু আশা করা যায় অচিরেই তা হবে এবং তার আগে সব প্রশ্নের জবাব মিলে যাবে, তা দূরাশাই বটে, তা হলেও প্রশ্নের কথায় আসার আগে একবার তুলনা করে নিতে পারি একটা টিকা স্বাভাবিকভাবে তৈরি হওয়া আর আপৎকালীনভাবে তৈরি হওয়ার মধ্যে সময় ও প্রক্রিয়াগত তফাৎগুলো কী? (ক)স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতিটা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্যায় আলাদা আলাদা আর জরুরী অবস্থায় তারাই ওভারল্যাপিং । (খ) স্বাভাবিক ক্ষেত্রে অনুমোদনের পরেই প্রোডাকশন আর জরুরী অবস্থায় অনুমোদনের আগেই কোম্পানি ঝুঁকি নিয়ে প্রোডাকশনে যাবে, যেতেই হবে কেননা সেটাই EUL এর পূর্বশর্ত। (গ) স্বাভাবিক টিকা আসতে যেখানে সময় লাগে পনের বছর সেখানে জরুরী অবস্থায় লাগে ১২ থেকে ১৮ মাস মাত্র।

এবার আসি যে টিকা দুটিকে অনুমোদন দেওয়া হল তাদের কথায়। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা, যা ভারতে কোভিশিল্ড নামে বাজারে আনছে সেরাম ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়া, সেটি তৃতীয় পর্যায় পার করে আসা টিকা। এই টিকার ফলাফল পিয়ার রিভিউড সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসা সংক্রান্ত জার্নাল ল্যান্সেটে প্রকাশিত। যে কোনো টিকারই দু’টো জিনিস বিশেষ করে দেখবার- নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা। দেখা হবে, টিকা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার নিরিখে নিরাপদ কিনা এবং টিকার যা উদ্দেশ্য, অর্থাৎ টিকা নিয়ে গ্রাহকের দেহে রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে মোটামুটিভাবে স্থায়ী প্রতিরোধক্ষমতা সৃষ্টি হল কি না? অক্সফোর্ড টিকায় খুব বড়সড় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার নজির নেই। সামান্য জ্বর-জারি, এক-আধজনের অ্যালার্জি ইত্যাদি যা হয়েছে তা তারা রিপোর্ট করেছে এবং বাড়িতেই সেসব সামাল দেওয়া গেছে, হাসপাতাল লাগেনি। কার্যকারিতার নিরিখে সব মিলিয়ে অক্সফোর্ডের তৃতীয় ট্রায়ালের ফলাফলে কমবেশি ৭০ শতাংশ কার্যকারিতার দাবি করা হয়েছে। এখানে একটা মজাও আছে। দুই ডোজের এই টিকায় যারা দুটো পুরো মাত্রার ডোজ পেয়েছে তাদের মধ্যে ৬২ শতাংশের দেহে কোভিডের অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। একটা গ্রুপকে ভুল করে প্রথমবারে আর্ধেক ডোজ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বুস্টারে এদের পুরো ডোজই দেওয়া হয়েছে এবং অবাক কান্ড, এদের মধ্যে ৯০ শতাংশের দেহেই প্রতিরোধক্ষমতা এসেছে। এই উপদলে গ্রাহকের সংখ্যা অবশ্য খুব বেশি নয়। কেনই বা একটা ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট অনেক বেশি প্রতিরোধক্ষমতা দিতে সমর্থ হল তারও সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি গবেষকরা, তাই ডোজ ঠিক কী হওয়া উচিত তা নিয়ে নিশ্চিত হবার আগে আরো অনেক ফলাফলসংক্রান্ত তথ্য প্রয়োজন। অক্সফোর্ড টিকার সম্পর্কে আর একটা সংশয় হল ৫৫ থেকে সত্তরোর্ধ বয়ঃক্রমকে নিয়ে। মাত্র ১২ শতাংশ গ্রাহীর বয়স ছিল ৫৫ এর উপরে আর ৭০ উপরে তো নগণ্য। সুতরাং তাদের ক্ষেত্রে কার্যকারিতা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন ঊঠতেই পারে। বস্তুত টিকাদানের জন্য উপযুক্ত বয়স আর ডোজ নির্ধারণের ব্যাপারটা অ্যাস্ট্রাজেনেকা কোম্পানির আধিকারিকরা অনুমোদন দিচ্ছে যারা তাদের উপরই ছেড়ে দিচ্ছে। সুতরাং বল CDSCO-এর কোর্টে, তারাই ঠিক করবে ভারতে কোন ডোজের টিকা দেওয়া হবে। যতদুর জানি, হাফ ডোজের টিকা কোথাও অনুমোদন পায়নি। ভারতে অক্সফোর্ড টিকা বানানোর স্বত্ব আদর পুনাওয়ালার কোম্পানি সেরাম ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়ার হাতে। অনুমোদনের জন্য আবেদন করার আগে ভারতের মানুষের উপর একটা তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল তাদেরই দ্বারা পরিচালিত হবার কথা, হয়েওছে তাই। তাদের স্যাম্পেল সাইজ অবশ্য ছোট- মাত্র ১৬০০। সে পরীক্ষার কোনো পিয়ার রিভিউড প্রকাশনা এখনো দেখিনি। আমেরিকায় এই একই টিকা অনুমোদনের আগে তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে ৩৩০০০ নাম নথিভুক্ত করতে বাধ্য হয়েছে তারা এবং ফেব্রুয়ারির আগে সেখানে ফলাফল বিশ্লেষিত হবার কথা নয়। তবে এই টিকার ভালো দিক অনেকগুলো। প্রথমত দাম; মাত্র দুই থেকে তিন ডলার দামে এই টিকা সরকারি কোষাগারে কম চাপ ফেলবে আর কিনে নিতে চাইলেও তা মোটামুটি দু-তিনশো টাকায় পেয়ে যাবার কথা। দ্বিতীয়ত সংরক্ষণ; অতিহিমায়ন দরকার নেই এ টিকা স্টোর করে রাখতে, রেফ্রিজারেটরের তাপমাত্রাতেই তা হবার কথা। আমেরিকায় অনুমোদিত মডার্না কোম্পানির টিকা দামে এর দশগুণ এবং স্টোর করতে মাইনাস সত্তর ডিগ্রির হিমায়ন দরকার। মডার্নায় কার্যকারিতা অবশ্য নব্বই শতাংশের বেশি তবুও গরীবের টিকা ওই অক্সফোর্ডের টিকা কোভিশিল্ডই হওয়া উচিৎ। অন্তত টিকা নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ার বা কোভিডে আক্রান্ত হবার মত পরিস্থিতি আসবে না বলেই মনে হয়।

কোভিডের টিকা নিয়ে কোভিডে আক্রান্ত হতে হবে না একথা অধিকন্তু বলে মনে হতে পারে, কিন্তু সত্য এই যে অনেক সময় টিকা নিয়ে রোগ ডেকে আনার ঘটনাও ঘটেছে। একে বলে রোগের ভ্যাকসিন ইনডিউসড ইনডাকশন অফ ডিজিজ। পোলিও ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে এটা একটা মাথাব্যাথা ছিল বিজ্ঞানীদের। এমনটা যে হবে না সেটা টিকার গবেষণা পর্যায়েই দু’শো শতাংশ নিশ্চিত করা উচিৎ। এর জন্য যথেষ্ট বড় স্যাম্পল সাইজ হওয়া দরকার। এখানেই আসে আমাদের দেশে অনুমোদন পাওয়া দ্বিতীয় টিকা কোভ্যাক্সিনের কথা। কোভ্যাক্সিন প্রযুক্তিগত দিক থেকে অক্সফোর্ড টিকার মতই। এটির গবেষণা আইসিএমআর এবং ন্যাশানাল ইন্সটিটিউট অফ ভাইরোলজির। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের দায় নিয়েছে হায়দ্রাবাদের ভারত-বায়োটেক সংস্থা। অনির্ভরযোগ্য বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান উদাহরণ বলে বিবেচিত হবার কথা এই কোভ্যাক্সিনের। এ তো তৃতীয় পর্যায়ে প্রবেশই করেনি। দ্বিতীয় পর্যায়ে মাত্র ১২৪ জন স্বেচ্ছাগ্রাহীর উপর পরীক্ষা চালিয়ে এরা যে কী ফলাফল পেয়েছে তাও জানা নেই পরিষ্কারভাবে, কেন না কোনো পিয়ার রিভিউড জার্নালে এই টিকা সংক্রান্ত কোনো গবেষণাপত্র এখনো প্রকাশিত হয়নি। অতিমারিকালে দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষার পরেই টিকা অনুমোদনের নজীর তৈরি করেছে রাশিয়া । তাদের স্পুটনিক-ভি টিকা মাত্র ৩৪টি ফলাফল প্রকাশ করেই অনুমোদন পেয়েছিল সে দেশে। তৃতীয় পর্যায়ের পর তাদের তো ৯৪ শতাংশ কার্যকারিতার দাবি রয়েছে কিন্তু ফলাফল প্রকাশে তাদের অনীহা আছে। রেড্ডিজ ল্যাবরেটারি এদেশে স্পুটনিক-ভি বানাচ্ছে , কিন্তু জরুরী অনুমোদন তারা চায়নি, এমন কি মডার্নাও এদেশে এখনো আপৎকালীন অনুমোদন চায়নি। ভারত বায়োটেক অনুমোদন চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল জানুয়ারির পয়লা তারিখে। স্বাভাবিক, কেননা কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিই নেই অনুমোদন দেবার। হঠাৎ সেই একই টিকা কিভাবে যে জানুয়ারির তিন তারিখে অনুমোদন পেয়ে গেল তার কোনো ব্যাখ্যা নেই কেবল ভারতীয় অস্মিতায় ধুনো দেওয়া ছাড়া। এখন শোনা যাচ্ছে, এ টিকা অনুমোদিত হয়েছে ব্যাক আপ হিসেবে কোভিশিল্ডের পাশাপাশি। কোভিডের নতুন প্রকরণ (ইউ.কে. স্ট্রেইন) যদি ছড়িয়ে পড়ে এবং তার প্রতিরোধে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন যদি ব্যর্থ হয় (কে না জানে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়টি ইউ.কে.’তেই অবস্থিত!) তাহলে কোভ্যাক্সিন হবে উপযুক্ত আয়ুধ। এর চেয়ে কুযুক্তি আর হয় না। আমার মতে, এ টিকা একটা বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের সঙ্গেই বাজারে আসা উচিৎ। এ টিকা কাজ করতে পারবে না এমন বলছি না কিন্তু করতে পারবে এমন দাবি করার মত বিশ্বাসযোগ্য তথ্য কোথায়? প্রতিরোধক্ষমতা এলেও তার আয়ু কতদিন, ডোজ কি, বুস্টার কতদিনে - এসব প্রকাশ করেনি, বা করতে পারার মত যথেষ্ট ডেটা নেই তাদের হাতে। তবু তারা আপৎকালীন অনুমোদন পেলো। এতে আপনি আমি সংশয়ী হতে পারি কিন্তু তাতে ছাতি ফোলাতে আটকাচ্ছে কোথায়?


তথ্যঋণঃ
১) https://www.who.int/diagnostics_laboratory/eual/200110_new_eul_procedure_final.pdf?ua=1
২) https://www.thehindu.com/news/national/coronavirus-amid-vaccine-volunteers-allegations-serum-institute-of-india-stresses-safety-of-covishield/article33220065.ece
৩) https://indianexpress.com/article/explained/covid-19-vaccine-emergency-use-authorisation-explained-7074852/