আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২১ ● ২-১৭ মাঘ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

নির্বাচনের নির্বন্ধ

সৌরীন ভট্টাচার্য


এ রাজ্যে নির্বাচনের সময় এসেছে। ২০২১-এ বেশ কয়েকটি রাজ্যে নির্বাচন হবে। পশ্চিমবঙ্গ তার মধ্যে অন্যতম। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন নিয়ে এবার একটু বাড়তি আগ্রহের কারণ আছে। এ রাজ্যের নির্বাচনী মঞ্চে একটি নতুন শক্তি নাকি এবার উঠে এসেছে। এখনো পর্যন্ত যা চেহারা তাতে মনে হয় এবারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে তৃণমূল কংগ্রেস আর ভারতীয় জনতা পার্টির মধ্যে। অন্য দুটি রাজনৈতিক শক্তি, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস আর এ রাজ্যের সম্মিলিত বাম দলগুলি, এবার স্পষ্টত হীনবল।

এই দুটি শক্তির বর্তমান যে নিষ্প্রভ চেহারা সাধারণ মানুষের চোখে পড়ে তা রাজনৈতিক বার্তা হিসেবে খুব দুর্ভাগ্যজনক। ভারতীয় রাজনৈতিক পরিসরে জাতীয় কংগ্রেসের ভূমিকা এখনো নিঃশেষিত হয়নি। কিন্তু কংগ্রেসের নিজেরই মাথাতে সে কথা আদৌ আছে কিনা বলা শক্ত। নানারকম দোলাচলের বৃত্তান্ত কংগ্রেস রাজনীতিতে বহুবার নানাভাবে দেখা গেছে। দুর্নীতি এবং আনুষঙ্গিক অপকর্মেরও নজির কিছু কম নেই। তা সত্ত্বেও রাজনীতির একটা স্বাস্থ্যকর মধ্য পরিসর খুব জরুরি। অথচ সাংগঠনিক দিক থেকে কংগ্রেসের এমন দিশাহারা চেহারা প্রকট হয়ে পড়ছে যে সে বিষয়ে কিছু বলাই মনে হয় নিরর্থক। দলের তরুণ সভাপতি গত লোকসভার নির্বাচনের পরাজয়ের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সঙ্গে এ ধরনের কাজ সংগতিপূর্ণ। দল অন্য কোনো সভাপতির দিকে গেল না। সোনিয়া গান্ধীকেই অস্থায়ী দায়িত্ব দিয়ে সভাপতির পদে রাখা হল। সবাই জানেন তাঁর শরীর ভালো না। তবুও অস্থায়ী দায়িত্বভার তাঁর উপরেই বর্তাল। কংগ্রেসের ২৩ জন প্রবীণ নেতা সাংগঠনিক দুর্বলতার কথা তুলে নেতৃত্বের কাছে জোরালো প্রশ্ন তুললেন। তাঁদের সততায় সন্দেহ করা হল। প্রকাশ্যেই। সাংগঠনিক প্রশ্ন তোলা ব্যাপারটাকেই নেতৃত্বের প্রতি অবিশ্বাস ও বিদ্রোহ হিসেবে দেখা হল। পরিবর্তনের একটা সুযোগ স্বচ্ছন্দে হাতছাড়া করা হল। জোড়াতালি হিসেবে আবার সোনিয়া গান্ধীকেই আরো কিছুদিন কাজ চালিয়ে যেতে বলা হল। তরুণ সভাপতি এইরকম ডামাডোলের মধ্যে এরকম আভাস দিলেন যে তিনি দরকারে সভাপতির ভার নিতে পারেন, তবে এখন না, বছর দুয়েক বাদে। এর পরে একটাই কথা বলা চলে, এসব হচ্ছেটা কী? ভারতীয় জনতা পার্টির উত্থান কি এঁরা দেখতে পাচ্ছেন না, না তাকে স্বীকার করছেন না? সেই উত্থানকে প্রতিরোধ করার এই হল কৌশল? এত কথা বলার পরেও বলতে হবে যে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের ভূমিকা ভারতীয় রাজনীতিতে এখনো ফুরিয়ে যায়নি।

পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বাম দলগুলির রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে কথা বলতেই হবে। এখানে তাঁরা যে একদিন প্রধান শক্তি ছিলেন তা আজকের চেহারা দেখলে কারো বিশ্বাস হবে না। একটা নির্বাচনে হেরে গেলেই যদি পার্টি উঠে যাবার উপক্রম হয়, তাহলে তো অনেক কথাই ভাবতে হয়। ১৯৭২-এর নির্বাচনেও তো বামেরা হেরে গিয়েছিলেন বা হারিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যাই হোক। তখন অনেক পার্টি সদস্য নিজেদের এলাকা থেকে বাইরে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও বাম রাজনীতি তখন হয়তো হতবল হয়েছিল, কিন্তু তার এমন মুমূর্ষু চেহারা তখন বেরিয়ে পড়েনি। কী এমন হল এর মধ্যে যে এত বড় ফারাক তৈরি হয়ে গেল দু’বারের পরাজয়ের প্রসঙ্গে। দুটো কথা স্পষ্টতই মনে আসে। এক, বাহাত্তরে তখনো সোভিয়েত রাষ্ট্র অটুট। দুই, বামেরা এর মধ্যে চৌত্রিশ বছরের জন্য রাজ্যে ক্ষমতাসীন ছিলেন। এর মধ্যে কোন ঘটনার প্রভাব কত বেশি তা অত চট করে বলা যাবে না। সোভিয়েত রাষ্ট্রের পতনের অন্য কোনো প্রভাব যদি নাও থেকে থাকে, তাহলেও জনমানসে বাম রাজনীতি বিষয়ে হতাশ্বাস একটা বড়ো ব্যাপার বলে মানতেই হয়। আর শুধু রাজনৈতিক বিষয়ের কথাই বা বলছি কেন। বাম দৃষ্টিভঙ্গি বলে তো একটা জিনিস আছে, অন্তত সেদিন পর্যন্তও ছিল। সোভিয়েতের পতনে সাধারণের মনে সেখানে বড়ো ধাক্কা লেগেছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু যাকে প্রত্যক্ষ রাজনীতির কথা বলে, সেখানে ছাড়াও অন্য নানা স্তরে কাজ করে। আমাদের মূর্ত জীবনযাপনে সেরকম দৃষ্টিভঙ্গির খুব বড়ো ভূমিকা থাকে। সব সময়ে ব্যাপারটা হয়তো পরিষ্কার টের পাওয়া যায় না। কিন্তু অলক্ষে হলেও জীবনদৃষ্টি আমাদের আচারে আচরণে ফুটে বেরোয় তো বটেই এবং তা অবশ্যই আমাদের জীবনের ধরনধারণকে কিছুটা পরিমাণে হলেও নিয়ন্ত্রণ করে। তা ছাড়া সোভিয়েতের পতনের সঙ্গে বিশ্বায়নের যোগাযোগের কথাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া শক্ত। বিশ্বপুঁজির জোর সোভিয়েতের সময়কালেও কিছু কম ছিল না। তবে সোভিয়েতের পতনমুহূর্তে তার উল্লাস ও জয়ধ্বনি চোখে না পড়ার কোনো কারণ ছিল না। এই সব মিলিয়ে আমাদের জীবনের ঘেরটা বদলে গেল। রাষ্ট্রীয় মন ও সমাজমন একযোগে সেই বদলে শামিল হল।

এ রাজ্যের বাম শক্তির যে চেহারা দীর্ঘদিনের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠেছিল তা যে কয়েক পর্যায়ের ক্ষমতার অলিন্দে অধিষ্ঠান করার সূত্রে এভাবে ধসে গেল সে কথা মনে রেখেও দু-একটা কথা এখন ভেবে দেখার দরকার আছে। রাষ্ট্র ক্ষমতা এক দারুণ কুহক, এই কথাটা মনে রেখে এখনকার কথা সাজাতে হবে। এই সঙ্গে দুটো কথা একযোগে খেয়াল করতে হবে। আমাদের রাজনীতির এখনো পর্যন্ত মূল লক্ষ্য রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা। চিন্তাটা এই যে, রাষ্ট্রই যেহেতু আধুনিক কালের প্রধান সমাজ সংগঠন, তাই সেই ক্ষমতা দখল করতে পারলে সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রেও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। কিন্তু যেটা খেয়াল করা দরকার সেটা এই যে, ইতিমধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রই প্রায় পুরোপুরি বৃহৎ পুঁজির দখলে এসে গেছে। এ ঘটনা একদিনে ঘটেনি। এমনও নয় যে শুধুই বিশ্বায়নের পরেই এ জিনিসের দেখা পাওয়া গেল। প্রক্রিয়া আগে থেকেই যথেষ্ট প্রকট হচ্ছিল। বিশ্বায়নের পরে সেই প্রক্রিয়া আরো ত্বরান্বিত হয়েছে। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণায় বড় রকমের আঘাত এসেছে। আজকের অধিকাংশ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যে সমস্ত বড় বড় আইন পাশ করতে হয় তার চিত্রনাট্য কোনো এক অলক্ষ্য উৎস থেকে যেন উৎসারিত। আমাদের এই মুহূর্তের কৃষি আইন এর বড় উদাহরণ। এর আগে শ্রম আইন, বিমা আইন, এমনকি বিদ্যুৎ আইন, ট্রাই প্রমুখ নিয়ন্ত্রক সংস্থা, এ সবই সেই নতুন ধরনের চিত্রনাট্যের বিষয়। জিএসটি-র মতো বিষয়ও একই গল্পের অন্তর্গত। দেশে দেশে কি কোনো তফাত থাকছে না তাহলে? না, একেবারে সপাটে সব এক হয়ে গেছে তা নিশ্চয়ই ঠিক নয়। তবে দেয়াল লিখনটা যেন মনে হয় সেইরকম। ‘দিস ফ্ল্যাট আর্থ’ বলে যে কথাটা প্রায় চালু হয়ে গেছে তার তাৎপর্য এখানে।

পুঁজিগ্রস্ত এই রাষ্ট্রের দখল নিয়ে আমার রাজনীতি সত্যিই কতটা এগোবে তা আজ ভাবতে হবেই। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান অভিমুখ যদি হয় রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র, তাহলে সমাজের বোধে আর রাষ্ট্রের ভাষায় মিল হওয়া শক্ত। এবং আমাদের সমাজ রাজনীতির ক্ষেত্র থেকে মূলত নির্বাসিতই থেকে যাবে। রাষ্ট্রীয় রাজনীতিকে আজ সমাজের ভাষা শোনবার জন্য নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা করতে হবে। ‘কোমল গান্ধার’ ছবির যে বঞ্চিত বালকটি সুপ্রিয়া চৌধুরীর আঁচল টেনে ধরেছিল পিছন থেকে, সেই দৃশ্য মনে পড়ে। শকুন্তলার আশ্রম কাহিনী আর বাংলার অন্নকষ্টের গল্প সেই দৃশ্যে মিলে গিয়েছিল। একটানা একঘেয়ে সুরে সেই বালক বলে চলেছে দে, দে, দে না আমাকে। আমাদের রাষ্ট্রীয় রাজনীতির তরফে সমাজের এই ভাষা শুনতে শিখতে হবে।

এই ফ্ল্যাট আর্থের দর্শনে বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে, সব কিছুতে, সব স্তরে। নানা স্তরে এই কথাটা ভাববার যথেষ্ট অবকাশ আছে যে বৈচিত্র্য প্রাণশক্তির অনুকূল। ধানের বীজে, গমের বীজে একদিন প্রচুর বৈচিত্র্য ছিল। আধুনিক কৃষি পদ্ধতির বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বৈচিত্র্য কমেছে। ফসলের রোগ বালাই বেড়েছে। কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। এইসব আনুষঙ্গিক একসঙ্গে নিয়েই আমাদের চলতে হয়, চলতে হবে। এ যেমন ঠিক, তেমনি এ কথা মনে রাখাও জরুরি যে এরকম ঘটে, ঘটছে। ঠিক অনুরূপ একটা ব্যাপার আমাদের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও ঘটছে। সবই কেন্দ্রীয় টানে একরকম করার মধ্যে কাজ চালাবার একটা সুবিধার দিক নিশ্চয়ই আছে। পাঁচ রকমের ব্যাপার থাকলে পাঁচ রকমের ঝামেলাও থাকে। সে সব ঝামেলা এড়াবার একটা উপায় পাঁচ রকম না রাখা। তাই সব এক রকম করে দেবার চিন্তা। এক দেশ, এক কর ব্যবস্থা; এক দেশ, এক শাসন; এক দেশ, এক শিক্ষা; এক দেশ, এক নির্বাচন, অন্তত এক সময়ে নির্বাচন। মনে রাখতে হবে যে একদিন স্বাভাবিকভাবে তা-ই ছিল এখানে। ১৯৬৭-র পরে সে ব্যবস্থা আস্তে আস্তে ভেঙেছে। কারণ ওই বৈচিত্র্য। নানা রাজ্যের রাজনীতির গতি প্রকৃতি ভিন্ন রকমের হয়েছে একটা সময়ের পরে। তাই আলাদা আলাদা সময়ে নির্বাচন দরকার হয়েছে। আবার যদি তা এক সময়ে নিয়ে আসার চেষ্টা হয়, তাহলে সুবিধা হয়তো হবে, কিন্তু রাজ্য রাজনীতির অবস্থাগত ভিন্নতার কী হবে। মনে মনে হয়তো এ চিন্তা কোথাও কাজ করে যে, এক রকমের শাসন সারা দেশ জুড়ে চলবে, তাহলে সবই এক রকম হওয়ার পথে যেসব বাধা তা সহজে দূর হবে। কিন্তু তা বোধহয় হবার নয়, ধনঞ্জয়ের কথার প্রতিধ্বনি করে বলা চলে যে, হবার যেটা সেটাই হবে, তুমি যা চাও তা সব সময়ে হবে না। কিভাবে হবে তা অমন করে আগে থেকে বলা চলে না। এই সমস্ত ভাবনাই রাজনীতির ভাবনা। রাজনীতি বললেই যে মনে হয় দলাদলি আর দলবদল, সে রাজনীতি শব্দের এক অপভ্রংশ ব্যবহার। এ কথা ঠিক যে আমাদের চারপাশের আয়োজনে অপভ্রংশ ব্যবহার আজ স্বাভাবিক অর্থকে প্রায় ছেয়ে ফেলেছে। রাজনীতি যেমন শুধু তোলা তোলা নয়, শুধু গোরু পাচার, কয়লা পাচার নয়, এমনকি রাজনীতি শুধু নির্বাচনও নয়। রাজনীতি সমাজের আর পাঁচটা ক্রিয়াকর্মের মতো একটা সুস্থ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। অন্য পাঁচটা কাজে যেমন নৈতিকতার প্রশ্ন বাদ দিয়ে কোথাও পৌঁছোনো যায় না, রাজনীতির কাজেও তাই। কথাগুলো এতই সাধারণ লাগে শুনতে যে মনে হয় এতে বলার কী আছে। ঠিক তাই। তাও যে বলতে হচ্ছে তাতেই বোঝা যাচ্ছে ব্যাপার কতদূর গড়িয়েছে।

এই যে রাজনীতির কথা উঠলে সবাই হতাশ হয়ে বলেন, সব দলের এই যে চেহারা তাতে কিছুতেই কিছু হবার নয়। এটা দুর্লক্ষণ। তা ছাড়াও রাজনীতির কুশীলবেরা সবাই প্রায় সর্বক্ষণ সবার নামে অকথা কুকথা বলে চলেছেন। এ অসুখ শুধু আমাদের রাজনীতির অসুখ নয়। তাই বলতেই হয় যে সব দিক দিয়ে রাজনীতির এমন একটা কদর্য চেহারা বেরিয়ে পড়ছে যে তাতে করে সামাজিক শুভ জীবনযাপনের মাপকাঠিতে রাজনীতি ব্যাপারটাই পরিহার্য বলে মনে হচ্ছে ক্রমশ। এটা আরো বড়ো দুর্লক্ষণ। সাধারণ নাগরিকদের তরফে তাই দায়িত্ব এক অর্থে আজ আরো বেশি। একটা কথা কিন্তু ভাবনার চৌহদ্দিতে ইতিমধ্যেই আছে। রাজনীতির সত্যিই এত কি প্রয়োজন? আমরা চাই সুশাসন। গুড গাভার্নান্স। তার জন্য লাগে ভালো ব্যবস্থাপনার কর্মীবৃন্দ, অর্থাৎ উপযুক্ত ম্যানেজমেন্ট দক্ষতা। আজকের ম্যানেজমেন্ট বিদ্যার প্রসারের ফলে সেরকম কর্মীবাহিনী তৈরি করা সংগঠিত বৃহৎ পুঁজির পক্ষে জলভাত। এমনিতেই রাষ্ট্র পুঁজিগ্রস্ত। তার সঙ্গে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ বলতে আমরা যা বুঝি তাও যদি পুঁজির হাতে চলে যায় তাহলে সোনায় সোহাগা। তাই রাজনীতিকে খেলো হতে দিলে সমূহ সর্বনাশ। এ কথা আজ আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে। সামাজিক প্রক্রিয়া হিসেবে রাজনীতির বিকল্প হতে পারে না ম্যানেজমেন্ট কুশলতা। রাজনীতি শুধু দক্ষ প্রশাসনের ব্যাপার নয়। তার মধ্যে আছে সমাজদৃষ্টির কথা। সমাজের বিবিধ বিন্যাসের কথা।

এই সমাজদৃষ্টির মধ্যে রাষ্ট্রের কথাও অবশ্যই আছে। আমাদের রাষ্ট্রকে আমরা কতটা সামরিকতায় আচ্ছন্ন হতে দিতে চাই বা চাই না, এসব প্রশ্নে আমাদের নির্দিষ্ট দৃষ্টি যে জরুরি এই বোধ হারিয়ে যেতে দিলে আমাদের লোকসানটা কোথায় তা আমাদের বুঝে নিতে হবে। সামরিকতার মন আমাদের রাষ্ট্রকে যে দ্রুত গ্রাস করছে, এ বোধ আমাদের জনমনের বিচারে পরিষ্কার থাকা চাই। প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে বা রাষ্ট্রদের যে আমরা দুশমন সাজাই তার রাজনীতি আলোচনার বাইরে চলে যেতে চায় ক্রমশ। এ আলোচনা আমাদের হাত থেকে হারিয়ে গেলে আমাদের কী দশা হবে সে কথা রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন ‘মুক্তধারা’ নাটকে। কারো কান-ঢাকা টুপি দেখলেই আমরা বুঝে যাব সে কত বড়ো দুশমন। এতে আর সন্দেহ কি, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অসাড় জড়বৎ নাগরিক নিয়ে যে সমাজ গড়ে উঠবে তা শাসকের আকাঙ্ক্ষার কাছে চিত্তাকর্ষক। কিন্তু আমাদের কাছে তা বিপজ্জনক।

নির্বাচন আসছে। একে রাজনীতির দিক থেকেই দেখতে হবে। আমরা অনেক সময়ে মুখে বলে থাকি রাজনৈতিক মোকাবিলার কথা। কিন্তু মূলত নেমে যাই খেউড়ের খেলায়। আর মারামারি, চোরাগোপ্তা খুন দু-চারটে, তাও থাকে। শুধু বিপক্ষ দলের কেচ্ছা শুনে যতদিন আমাদের মন ভরবে ততদিন এ খেলা থেকে আমাদের মুক্তি নেই। আমাদের প্রশ্ন তুলতে শিখতে হবে। আলংকারিক ভাষায় অন্যের নিন্দাবাদ, রাজনীতির কথা নয়, এ কথা মুখের উপরে বলতে পারা দরকার। তাতে ঝড়ঝঞ্ঝা ধেয়ে আসতে পারে। কিন্তু আমাদের রাজনীতি খোয়া যাবার বিপদ তার চেয়ে অনেক বড় লোকসান। কোনো নির্বাচনী উপঢৌকনেই এর ক্ষতিপূরণ হবার নয়। আর তা ছাড়া সরকারি জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা, সে তো আমার হকের ধন। তার টোপ আমরা গিলব কেন। সে কেন্দ্র থেকেই আসুক আর রাজ্য থেকেই আসুক।