আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২১ ● ২-১৭ মাঘ, ১৪২৭

সমসাময়িক

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্যু-র প্রচেষ্টা


ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম থেকেই বলে এসেছেন নির্বাচনের ফল তিনি মানেন না, এবং এই গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়াটাই তাঁর কাছে বেশ অপ্রয়োজনীয় লাগে। কাজেই তাঁর প্রত্যক্ষ মদতে সমর্থকেরা মার্কিন কংগ্রেসের ভবন ক্যাপিটল হিল দখল করে নেবেন, বৈধ নির্বাচনী রায়ে জো বাইডেনকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করতে বাধা দেবেন, এতে আশ্চর্যের কিছু ছিল না। গুলি, কাঁদানে গ্যাস, বোমার শব্দে মার্কিন গণতন্ত্রের পীঠস্থান যে কেঁপে উঠবে, পুলিশের গুলিতে মারা যাবেন বিক্ষোভকারী, তাতেও গেল গেল ভাবার কিছু নেই, কারণ এই প্রক্রিয়া অনেক আগেই শুরু হয়েছে। এই ঘটনার দিন দুই আগেই ট্রাম্প জনসভা করে হুমকি দিয়েছিলেন - আমরা পিছু হটব না, চুরি করে ছিনিয়ে নেওয়া আসন ফিরিয়ে নেব। তার পরই ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ে হামলার ঘটনা ঘটে। গত বছর করোনা ও লকডাউন সম্বলিত নির্দেশাবলীকে অগ্রাহ্য করে মিশিগানে ট্রাম্প সমর্থকেরা যখন পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছিলেন স্বাভাবিক জীবনযাত্রার দাবীতে, তার ভেতরেই আজকের দিনটির অশনিসংকেত লুকিয়ে ছিল - লুকিয়ে ছিল এই সম্ভাবনা যে গণতন্ত্রই আসলে নিজস্ব প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে জন্ম দেয় স্বৈরাচারী একনায়কের, যার কাছে প্রশাসন, আইন, সংবিধান, স্বাস্থ্য অথবা সুরক্ষাবিধি, এই সমস্তকিছুই আসলে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করবার উপাদান, কাজ শেষ হয়ে গেলে যাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়।

আমেরিকাতে যা হয়েছে তা মোটেই ভাল কিছু নয়, এবং গণতন্ত্রের পক্ষে যথেষ্ট আশংকারও বটে। দেশে দেশে যেভাবে দক্ষিণপন্থী পপুলিস্ট রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তারই সম্প্রসারণ আপাতত আমেরিকাতেও পৌঁছে গিয়েছে। এবং সাংবিধানিক গণতন্ত্রের ব্যর্থতা এখানেই যে এই দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদী রাজনীতিকে সমূলে উৎখাত করার বদলে তাকে তুষ্ট করবার নীতি নিয়ে চলেছে বরাবর। রিপাবলিকান সেনেটররা ট্রাম্পকে ইমপিচমেন্টের মুখে পড়তে দেন নি, তাঁর সুরে সুর মিলিয়ে জো বাইডেনকে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হবার বিরোধীতা করে গেছেন, এমনকি পুলিশ ও প্রশাসন পর্যন্ত ক্যাপিটল হিল হামলায় অদ্ভুতভাবে নিষ্ক্রিয় থেকেছে, যদিও তাদের কাছে আগে থেকেই খবর ছিল যে এমন হামলা ঘটতে পারে। যেখানে খোদ রাষ্ট্রপতি জনসভা করে হামলার উস্কানি দিচ্ছেন সেখানে পুলিশ-প্রশাসন এতটা নিষ্ক্রিয় থাকে যখন - মনে রাখতে হবে তুলনায় বহুগুণে নির্বিষ ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনে কিন্তু পুলিশ ও মিলিটারির সক্রিয়তা ও দমনমূলক চেহারা ছিল চোখে পড়বার মত - তখন এরকম ঘটনার একটাই ব্যাখ্যা হয়। একটি দেশের বড়ো অংশের জনগণ প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিরোধের জায়গাতে তো নেইই, বরং ফ্যাসিবাদকে বৈধতা দেবার স্থানে চলে গেছে। সবথেকে বড় ব্যাপার, ট্রাম্পের মত ফ্যাসিস্ত এই যে একটা বড় অংশের জনাদেশকে সঙ্গে করে নিয়ে সাংবিধানিক গণতন্ত্রে আঘাত হানছেন, এই ব্যাপারটাও কিন্তু ঘটিয়েছে সেই সাংবিধানিক গণতন্ত্রই। ট্রাম্পের উত্থান কোনও ক্যু ডেটার মাধ্যমে ঘটেনি, ঘটেছে নির্বাচনের মাধ্যমে। ঠিক যেমন ঘটেছে নরেন্দ্র মোদীর উত্থান। আর এই পুরোটাই সম্ভব হয়েছে কারণ সাংবিধানিক গণতন্ত্র প্রশ্রয় এবং তোষণের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদকে পোষ মানাবার চেষ্টা করে গিয়েছিল।

কাজেই আজ এই ধরনে সান্ত্বনাবাক্য খুবই ফাঁকা শোনায় যখন বলা হয় যে জনগণ ফ্যাসিবাদের সঙ্গে নেই। বাস্তব এটাই যে একটা বিশাল অংশের মানুষ ফ্যাসিবাদকেই সমর্থন করেছেন, ভারত হোক অথবা আমেরিকা। ট্রাম্প পরাজিত হয়েছেন অল্পের জন্য, সামান্য কয়েকটি প্রদেশে ফলাফল একচুল এদিক ওদিক হলেই ঘুঁটি উলটে যেত। যারা ক্যাপিটল ভবনে হামলা চালিয়েছেন সকলেই সাধারণ মানুষ, সন্ত্রাসবাদী বা গুণ্ডা-মাস্তান নন। আর কোটি কোটি এরকম মানুষের সমর্থন পেয়েই ট্রাম্প সাহস রাখেন নির্বাচনী জনাদেশকে উলটে দেবার। ঠিক যেমন বিজেপি ভারতবর্ষে ক্ষমতায় এসেছে অভ্রান্ত জনাদেশকে সঙ্গে নিয়েই, এবং ৩৭০ ধারা বিলোপ থেকে রাম মন্দির, সমস্তই করেছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অস্ত্র করেই। গণতন্ত্র কোথায় গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছে, সেটা কি বোঝা যাচ্ছে? নিরাময়ের ওষুধও কি কিছু ভাবা হচ্ছে? শুধুই নির্বাচন তো ওষুধ হতে পারে না, কারণ ট্রাম্প হারলেও ট্রাম্পবাদ যে দাপটের সঙ্গে নিজের খেলা চালিয়ে যাবে সেটা ক্যাপিটল বিল্ডিঙ-এর ঘটনাই দেখিয়ে দিল।

কিন্তু সেই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন, কিছুটা অপ্রিয়ও হয়ত, উঁকি মারছে। আজ দুনিয়াজুড়ে ‘গেল’ ‘গেল’ আওয়াজ ঘটেছে কারণ প্রথম বিশ্বের জ্যেষ্ঠভ্রাতা আক্রান্ত হয়েছেন, আক্রান্ত হয়েছে তথাকথিত গণতন্ত্রের পীঠস্থান। কিন্তু এমন ঘটনা কি প্রথম ঘটল এই পৃথিবীতে? দেশে দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মার্কিন মদতে যখন অভ্যুত্থান ঘটেছে, ফেলে দেওয়া হয়েছে নির্বাচিত সরকারকে, সিআইএ মদতে মিলিটারি হানায় তছনছ হয়েছে দেশ ও সংবিধান, চিলি থেকে শুরু করে কঙ্গো হয়ে ইরাক অথবা লিবিয়া, তখন দেশি বিদেশী আন্তর্জাতিক মিডিয়ার চোখের জল কোথায় লুকিয়ে থাকত? আমেরিকা তো গোটা সত্তর বছর ধরে এই কাজ করে গিয়েছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে। এবার যেটা ঘটল, প্রতিবেশীর ঘরে আগুন জ্বালাবর নেশায় উন্মত্ত থাকায় খেয়াল ছিল না আগুনের শিখা কখন নিজের ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। আর তাই এত বুক চাপড়ানো। গণতন্ত্র বিপন্ন তো বতেই, কিন্তু সেই বিপন্নতা আজকের নয়। বছরের পর বছর ধরেই আমেরিকার মত নয়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে গণতন্ত্র বিপন্ন ও লাঞ্ছিত হয়েছে। ট্রাম্প সম্ভবত আমেরিকার পক্ষেও খুব তীব্র ফ্যাসিবাদী ছিলেন। কিন্তু এর বহুগুণ হিংস্র মুখ তাঁর পূর্বসূরীরাই অন্যান্য নানা দেশে দেখিয়ে এসেছেন। বাইডেন এসে আমেরিকাকে খুব উদার ও পরমতসহিষ্ণু বানিয়ে দেবেন এমনটাও ভাবার বিশেষ কারণ নেই। কিন্তু এবার হয়ত উচিত, নিজেদের অবস্থান খতিয়ে দেখা। একই জিনিস অন্যের বেলা হলে সেটা সুশাসন আর নিজের বেলায় হলে স্বৈরাচার, এমন দ্বিচারিতা মোটেও ভাল জিনিস নয়!