আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২১ ● ২-১৭ মাঘ, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

আত্মপ্রত্যয়ী জীবন-জীবিকার আন্দোলন


এক আত্মমুগ্ধ-উদ্ধত নিরঙ্কুশ শাসকের সঙ্গে চলতে থাকা কৃষকের লড়াইয়ের পঞ্চাশ দিন পেরিয়ে গেল। ষাট জনের বেশি আন্দোলনকারী ঠান্ডার দাপটে প্রাণ হারালেন। আত্মঘাতীও হয়েছেন কয়েকজন। কৃষি সংক্রান্ত তিনটি নতুন আইন প্রত্যাহারের দাবিতে চলতে থাকা শান্তিপূর্ণ অবস্থান আন্দোলনের মধ্যেই সরকারের সঙ্গে নয় নয় করে ন’বার আলোচনা হয়েছে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী নতুন আইনের প্রচারে এই পঞ্চাশ দিনে অন্তত পঁচিশবার অংশ নিয়েছেন। দেশের দূরদুরান্তের বাছাই করা ভক্ত কৃষকের সঙ্গে ভার্চুয়াল আলোচনা করেছেন। কিন্তু ঘরের কাছে আন্দোলনরত কৃষকদের সম্মুখীন হননি।

দেশে-বিদেশে তাঁর এই আচরণ নিয়ে সমালোচনা চলছে। কিন্তু তিনি নির্বিকার। তিনি তাঁর মন কী বাত বলতে পছন্দ করেন। কিন্তু জনগণের মনের কথা শুনতে আগ্রহী নন। ফলাফল - শূন্য।

সত্যিই তো একটা হ্যাঁ আর একটা না কী করে সহমত হবে? সরকার নতুন আইন বহাল রাখতে বদ্ধপরিকর। কৃষকের একটাই কথা, আইন বাতিল না করা পর্যন্ত দিল্লির সীমান্তে শান্তিপূর্ণ অবস্থান আন্দোলন চলবে।

সূর্যের বাৎসরিক দক্ষিণায়ন শেষ হওয়ার পর উত্তরায়নের সূচনা লগ্নে নতুন ফসল তোলার আনন্দে সমস্ত গ্রীষ্মপ্রধান দেশে পালিত হয় লোকায়ত উৎসব। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে শুরু করে কম্বোডিয়া পর্যন্ত এটাই প্রচলিত রীতি। বহুত্বের মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে তার বিভিন্ন নাম। কোথাও পোঙ্গল কোথাও আবার মকর সংক্রান্তি । ওড়িশার মকর চাউলা আর বাংলার পৌষ সংক্রান্তি কিংবা অসমের মাঘ বিহু-র মধ্যে পার্থক্য কোথায়? সবই তো নতুন ফসলের উদযাপন। পাঞ্জাব হরিয়ানা পূর্ব রাজস্থান এবং পশ্চিম উত্তর প্রদেশে সেই একই অনুষ্ঠান ধুমধাম করে উদযাপন করা হয় পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন। নাম লোহরি । কৃষকরা নিজের নিজের এলাকায় সম্মিলিত ভাবে লোহরির সন্ধ্যায় কাঠের আগুন জ্বেলে তাতে ঘি ঢেলে, বাদাম, ভুট্টা ছুড়ে উদযাপন করেন লোহরি। চলে গান-বাজনা। এবারও তাঁরা সম্মিলিত ভাবেই লোহরি উদযাপন করলেন। তবে নিজের মহল্লায় নয়, দিল্লির সীমানায়। তাঁরা সকলেই যেখানে গত পঞ্চাশ দিন ধরে নির্দিষ্ট দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এবারের লোহরি উদযাপন উপলক্ষে দিল্লির সীমানায় সমবেত আন্দোলনকারীরা তিন কৃষি আইনের কপি পুড়িয়ে লোহরি পালন করলেন। একই সঙ্গে তাঁরা শপথ নিলেন, কৃষি আইন প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন প্রত্যাহার করবেন না।

সরকার একদিকে বৈঠকের পর বৈঠক ডেকে সময় খরচ করে কৃষকের দম বুঝতে চাইছে। ভাবখানা এমন যে এমন প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশে কতদিন আর অবস্থান চলবে। কৃষকরা সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে প্রয়োজনে এই সরকারের মেয়াদ ২০২৪-এ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান আন্দোলন চলবে।

বৈঠকের পর বৈঠকে শুধুই স্থির হচ্ছে পরের বৈঠক কবে হবে। সম্পূর্ণভাবে কোণঠাসা হয়ে এই অবসরে কিছু পেটোয়া লোক মারফত সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়ে আবেদন জানানো হয়েছিল যে রাজপথে কৃষকদের অবস্থানের জন্য জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে; সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে; এমনকি বার্ড ফ্লু ছড়িয়ে পড়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এক ধাপ এগিয়ে সরকারের তরফে অ্যাটর্নি জেনারেল সুপ্রিম কোর্টকে জানালেন, কৃষকদের আন্দোলনে সন্ত্রাসবাদীরা ঢুকে পড়েছে। প্রমাণ দাখিল করা হয়নি। এই প্রসঙ্গে প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানালেন যে এমন মন্তব্য করা উচিত নয়। তিনি জানেন যে আন্দোলনে অবস্থানরত প্রায় প্রতিটি কৃষক পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য ফৌজে কর্মরত অথবা অবসরপ্রাপ্ত ফৌজি। প্রাক্তন ফৌজিদের অনেকেই আবার দিল্লির সীমানায় উপস্থিত। একই সঙ্গে দিল্লি পুলিশ সুপ্রিম কোর্টে ২৬ জানুয়ারি কৃষকদের ট্র্যাক্টর মিছিলে নিষেধাজ্ঞা জারি করার আর্জি জানিয়েছে। আন্দোলনরত কৃষক সংগঠনগুলি শুনানিতে অংশ নেয়নি। তা সত্ত্বেও আদালত এ বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য জানতে চেয়ে নোটিস জারি করেছিল। কৃষক নেতাদের বক্তব্য, সরকার এ বিষয়ে ভুল ধারণা তৈরির চেষ্টা করছে। ২৬শে জানুয়ারি কৃষকেরা অবশ্যই দিল্লিতে ট্র্যাক্টর মিছিল করবেন কিন্তু ইন্ডিয়া গেট বা লালকেল্লার সামনে সেই মিছিল হবে না। প্রজাতন্ত্র দিবসের বাৎসরিক কুচকাওয়াজ বিঘ্নিত করার কোনো ইচ্ছাই তাঁদের নেই।

শেষ পর্যন্ত তিন কৃষি আইনের রূপায়ণে স্থগিতাদেশ জারি করে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকার ও কৃষক সংগঠনগুলির কথা শোনার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে দিয়ে দায় সেরে দিল। অথবা সরকারের মুখ রক্ষার সুযোগ করে দিল।

কৃষকরা কমিটির বিষয়ে নিস্পৃহ থাকলেও প্রশ্ন ওঠে কাদের নিয়ে কমিটি? কমিটির চার সদস্যের প্রত্যেকেই সরকারের কৃষি আইনের পক্ষে বলে ধারাবাহিক ভাবে প্রচার অভিযান করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরেও কৃষকরা আন্দোলন থেকে সরেননি। তাঁরা আদালতের কমিটির সামনে যাবেন না বলেও অনড় রয়েছেন। পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতি দেখে একজন সদস্য ইতিমধ্যে দায়িত্ব পালনে অনিচ্ছুক বলে জানিয়ে দিয়েছেন।

মন্ত্রীরা বারবার বলছেন সরকার আলোচনার জন্য তৈরি। এ বার কৃষক সংগঠনগুলি ঠিক করুক, তাঁরা কী চান; সুপ্রিম কোর্ট যখন কমিটির সামনে সকলকে হাজির হতে বলেছেন, তখন সেই রায়কে সকলের সম্মান করা উচিত। কিন্তু কৃষক নেতাদের যুক্তি, এখানে সুপ্রিম কোর্টকে অসম্মান করার কোনও প্রশ্নই নেই। কারণ, তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে কোনও আর্জিই জানাননি। আর সুপ্রিম কোর্ট আইন খারিজ করেনি। আপাতত স্থগিত রেখেছে।

এই পটভূমিতে ১৫ই জানুয়ারি নবম দফা বৈঠক শুরুর আগেই সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রী। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে সরকারের উপর মহামান্য আদালতের পূর্ণ আস্থা আছে। বৈঠকে যাওয়ার আগে এই প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (আইএমএফ) যে মতামত জানিয়েছে তা জানা থাকলে মন্ত্রী মহোদয় হয়তো আরও উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়তেন। আইএমএফ-এর মতে, কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারসাধনের সবরকম সম্ভাবনাই নতুন আইন তিনটির রয়েছে। কিন্তু এই নতুন আইন কার্যকর হওয়ার পথে যে বা যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তাঁদের নিরাপত্তা দেওয়াও সরকারের কর্তব্য বলে জানিয়েছে আইএমএফ।

বস্তুত বর্তমান সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে গেছে। সরকারি তরফে বারবার বলা হয়েছে যে আইন প্রণয়নের আগে নাকি সমস্ত স্টেকহোল্ডার অর্থাৎ নতুন আইন প্রয়োগের ফলে যে সমস্ত মানুষের ওপর প্রভাব পড়বে তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে অনেকবার আলোচনা হয়েছে। সরকারের উচ্চ পদে আসীন ব্যাক্তিদের অসত্য ভাষণ কাম্য নয়। বিধি অনুযায়ী কৃষি রাজ্যের বিষয়। অথচ কোনো রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি। কৃষকদের সংগঠনের সঙ্গে কথা বলারও কোনো দৃষ্টান্ত নেই।

সরকারের সঙ্গে যেন পাল্লা দিয়ে মিথ্যাচার করে চলেছে কর্পোরেট সংস্থাগুলি। তাদের স্বার্থে এই নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে বলেই কৃষক আজ বাড়িঘর ক্ষেত জমি ছেড়ে রাস্তায় বসে দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলনে সমবেত। কৃষি আইনে চাষিদের উপকারের প্রচারে সরকার অনড়। নতুন আইনের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সরকারের তরফে বলা হয়েছিল যে কর্নাটকের রায়চূড়ে রিলায়্যান্স রিটেলের তরফে এক হাজার কুইন্টাল চাল কেনার চুক্তি করা হয়েছে। ‘স্বাস্থ্য ফার্মার্স প্রোডিউসিং কোম্পানি’ নামে সংস্থার থেকে সোনা মাসুড়ি চাল কেনার চুক্তি হয়েছে। এই সংস্থায় নাকি ১,১০০ কৃষক নাম লিখিয়েছিলেন। তাঁরা নাকি এমএসপি-র থেকে প্রতি কুইন্টালে ৮২ টাকা বেশি দর পেয়েছেন। অথচ নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহেই রিলায়্যান্স গোষ্ঠী পঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্টে হলফনামা দিয়ে জানিয়েছিল, তারা চুক্তি চাষে জড়িত নয়। রিলায়্যান্স চাষিদের দিয়ে চুক্তি-চাষ করায় না। আসলে পুরোটাই প্রহসন। এমএসপি সাধারণ মানের চালের জন্য ঘোষিত হয়। সোনা মাসুড়ি চাল উন্নত মানের। তার দাম তো বেশি হবেই। গোবিন্দভোগ বা বাসমতী চালের মতো সোনা মাসুড়ির মতো উন্নত মানের চালের দাম সবসময়ই বেশি। এবং তার জন্য কোনো এমএসপি ধার্য করা হয় না। হাইকোর্টে হলফনামা দিয়ে অস্বীকার করার পরেও রিলায়্যান্স কীভাবে ধান কেনার চুক্তি করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। হলফনামায় স্পষ্ট বলা রয়েছে, রিলায়্যান্স রিটেল সরাসরি কৃষকের থেকে চাল-ডাল কেনে না। সংস্থার সরবরাহকারীদের থেকে কেনে। রায়চূড়ে রিলায়্যান্সের সরবরাহকারী সংস্থাই কৃষকদের থেকে চাল কিনছে। যে কোনো বড়ো আকারের শিল্পে অনুসারী শিল্পের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এখন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো মিথ্যার মোড়কে সত্যকে বিপণন করা হচ্ছে।

অসততার উদাহরণ এখানেই শেষ নয়। কৃষকদের জন্য ঢাকঢোল পিটিয়ে দু’বছর আগে প্রধানমন্ত্রী ‘কিসান সম্মান নিধি’ (পিএম-কিসান) প্রকল্প শুরু করার সময় বলা হয়েছিল, ছোটো কৃষকের পাশে থাকতেই এমন আর্থিক সুরাহার বন্দোবস্ত। অথচ তথ্যের অধিকার আইনে করা এক প্রশ্নের উত্তরে খোদ সরকার জানাল, প্রকল্পটির প্রায় ১৩৬৪ কোটি টাকা চলে গিয়েছে ভুল লোকের কাছে। কৃষি মন্ত্রকের তথ্য বলছে, যারা এই সুবিধা পেতে পারে না এমন ২০ লক্ষ ৪৮ হাজার কৃষিজীবী টাকা পেয়েছেন। যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই (৫৫.৫৮%) আয়কর দেন। আর বাকিরা প্রকল্পের অন্যান্য শর্ত পূরণ করেন না।

চার মাসে ২০০০ টাকা করে (বছরে ৬০০০ টাকা) সরাসরি সেই কৃষকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়ার কথা যাঁর জমির পরিমাণ ২ হেক্টরের থেকে কম। মাসে ১০,০০০ টাকার বেশি পেনশন পেলে বা আয়কর দিলে এই অনুদান পাওয়ার কথা নয়। অর্থাৎ শুধুমাত্র মিথ্যাচার নয় দুর্নীতিও চলছে।

বি-রাষ্ট্রীয়করণ থেকে শুরু করে দেশের যাবতীয় খনিজ-বনজ সম্পদ কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার পর বাকি ছিল কৃষিজ উৎপাদন। তার জন্য আনা হল নতুন তিনটি কৃষি আইন। কিন্তু সেই আইন প্রয়োগ যে এত কঠিন আবর্তে ফেলে দেবে সে বিষয়ে বোধ হয় কোনো আন্দাজ ছিল না। খেয়াল ছিল না যে কৃষকের জীবন ও জীবিকা নিয়ে যা খুশি করার কোনো অধিকার কারো নেই। কাজেই এখন সরকার আতঙ্কগ্রস্ত। স্বয়ংশাসিত বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপর প্রভাব বিস্তার করে অনেক জনবিরোধী কাজ সম্পন্ন করার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়ে হয়তো ধারণা হয়েছিল যে কৃষি আইনও সেই ধারাবাহিকতায় নিশ্চিন্তে প্রয়োগ করা যাবে। কিন্তু কৃষকের জেদ সেই আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে দিয়েছে। কৃষক কোনো মতেই মাথা নীচু করতে রাজি নন। তাঁদের এই দৃঢ় প্রত্যয় আগামীদিনের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য হবে। নয় নয় করে, নয় দফায় বৈঠক করার পর শুধু একটাই সিদ্ধান্ত হয়েছে যে পরের বৈঠক ১৯শে জানুয়ারি বেলা ১২টায় অনুষ্ঠিত হবে।

চূড়ান্ত প্রতিকূল পরিবেশে দিল্লির সীমান্তে রাজপথে অবস্থানরত শান্তিপূর্ণ কৃষক আন্দোলনের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে সমাজের অন্য অংশের মানুষ নিজেদের দাবিদাওয়া আদায়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে লড়াইয়ের ময়দানে সমবেত হলে প্রতিহত করা যাবে আধিপত্যবাদী আগ্রাসন।