আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

দেশ হারানো নির্মম স্বপ্নের কথোয়াল

গৌতম গুহ রায়




‘আগুনপাখি’তে বাংলার এক শেকড় হারানোর কষ্ট নিয়ে দেশ হারানো মহিলার বয়ানে তিনি লিখেছিলেন, “আমাকে কেউ বোঝাতেই পারলে না ক্যানে আলাদা দ্যাশ হয়েছে গোজামিল দিয়ে? ...আমাকে কেউ বোঝাতেই পারলে না যে সেই দ্যাশটা আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটা আমার লয়।” এই যন্ত্রণা, ভিটা থেকে শেকড় ছিড়ে চলে যাওয়ার যন্ত্রণা নিজেও আজীবন বহন করেছেন যে মানুষটি তিনি হাসান আজিজুল হক, এই যন্ত্রণাই ছিল তাঁর যাবতীয় সৃজনকর্মের চালিকা শক্তি। ‘রিভিউ প্রিভিউ’ পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকারে হাসান আজিজুল হক বলেছিলেন, "দেশভাগের মতো মহাবিপর্যয় গত হাজার বছরে বাঙালির ইতিহাসে ঘটেনি। তাই তার ফলে যা যা ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে তার ব্যত্যয় ঘটাবে কে? তবে দেশভাগ না ঘটলে দুই বাংলার মিলিত শক্তি কিন্তু অন্য এক ইতিহাস রচনা করত এতে কোনো সন্দেহ নেই।" এই কথাগুলোর মধ্যদিয়ে অনুভব করা যায় যে বেদনার ভিত্তিভূমি থেকে তিনি সাহিত্যসৃজনে মগ্ন হয়েছিলেন। তাঁর ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’-এর উল্লেখ আলোচনার সূচনাতেই করা যায়, এটি তাঁর একটি প্রধান ও অসাধারণ গল্প। দেশবিভাজনের অভিশপ্ত গ্লানির ব্যথা যে কী তা এই লেখাটিতে হাসান সাহেবের কষ্টজারিত সংলাপে ও নির্মাণে অনুভব করা যায়। শেকড় হারানো মানুষের মর্মান্তিক যন্ত্রণার স্পর্শ পাওয়া যায় এই লেখাটিতে। আমাদের, যাদের একপুরুষ আগের মানুষেরা তাঁদের ভূমিচ্যুতির যন্ত্রণা নিয়ে চলে এসেছিলেন বা চলে গিয়েছিলেন তাঁদের সেই যন্ত্রণা আমাদের প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত হলেই হাসান আজিজুল হকের অন্তরাত্মার ব্যথাকে স্পর্শ করা যাবে। তাঁর গল্পের সুচনা হয়েছে এক মর্মস্পর্শী বয়ানে, ‘এখন নির্দয় শীতকাল, ঠান্ডা নামছে হিম, চাঁদ ফুটে আছে নারকেল গাছের মাথায়। অল্প বাতাসে একটা কলার পাতা একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়। ওদিকে বড় গঞ্জের রাস্তার মোড়ে রাহাত খানের বাড়ির টিনের চাল হিমঝকঝক করে’। জীবনযুদ্ধের হতাশাগ্রস্ত বাস্তবতা তিনি অন্তরের কান্না মিশিয়ে পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছেন, যেখানে ইনাম বসে বসে উদবাস্তু বৃদ্ধের গল্প শুনছে আর তার দুই বন্ধু সেই বুড়োর হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে তার মেয়েকে শয্যাগত করছে। গল্পটির মধ্যে আমরা এক উদবাস্তুর সবহারানো দীর্ঘশ্বাস খুঁজে পাই, ছিটকে পড়া মানুষটার তিমিরাচ্ছন্ন গ্লানিময় অন্ধকার। দেশ হারানো বাঙালির এক বিমূঢ় বয়ান, “তখন হু হু করে কেঁদে উঠল, চুড়ির শব্দ এলো, এলোমেলো শাড়ির শব্দ আর ইনামের অনুভবে ফুটে উঠল নিটোল সোনারঙের দেহ - সুহাস হাসছে হি হি হি ‘ - আমি একটা করবী লাগাই বুঝলে?’ বলে থামলো বুড়ো, কান্না শুনল, হাসি শুনল, ফুলের জন্যে নয়, বুড়ো বলল ‘বিচির জন্যে, বুঝেছ করবী ফুলের বিচির জন্য। চমৎকার বিষ হয় করবী ফুলের বিচিতে’। আবার হু হু ফোঁপানি এলো আর এই কথা বলে গল্প শেষ না করতেই পানিতে ডুবে যেতে, ভেসে যেতে থাকল বুড়োর মুখ...”। গল্পটি প্রবল রকমের রাজনৈতিক আখ্যান। তবে এর মধ্যে একধরনের আত্মপ্রবঞ্চনার আড়ালও আছে যা একে কিছুটা কমিকাল আবরণ দিয়েছে যা গল্পের ভেতর থাকা নির্দয় এক নগ্ন বাস্তবতাকে কিছুটা প্রতিক্ষেপক দূরত্ব দিয়েছে। হাসান আজিজুল হক এই গল্পটিতে এক বহুমাত্রিক নিজস্বতা দিয়েছেন। আমরা এখানে দেখবো ন্যারেটিভ ফর্ম ও থিমেটিক কমপ্লেক্সিসিটির আন্তর্সম্পর্ক। অসহায় ও ‘পরাজিত’ কিছু মানুষ, যাদের এক করলে একটা সময় ও তার সমাজের চালচিত্র ফুটে ওঠে, সেই ব্যর্থ মানুষগুলোর কথা এমন আশ্চর্য নৈর্ব্যক্তিকতায় বিবৃত হয় যে মনে হয় লেখক এখানে বড়জোর একজন নিস্পৃহ দর্শক মাত্র। অথচ পাঠক গল্পটি পাঠান্তে তাঁর মননে এক তীব্র চাবুকের আঘাত অনুভব করেবেন, কথক নিস্পৃহ হলে এই আঘাতটি হানার প্রয়োজন থাকতো না। গল্পের একটি কেন্দ্রীয় বিন্দুতে টাকা না থাকায় ফুর্তি থেকে বঞ্চিত ইমানের আর্তস্বর ‘এ্যহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যহান তুমি কাঁদতিছ?’ এখানে এসে পাঠক অনুভব করেন যে তীব্র অভাব ও ক্ষুধার মুখে সকল সামাজিক বা ধর্মীয় অনুশাসন ফুঁৎকারে উড়ে যায়, কিন্তু চেতনার গভীরে যে দ্বন্দ্ব কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তা কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে।

আটটি গল্প নিয়ে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিলো ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’। অন্য গল্পের মধ্যে রয়েছে, সারা দুপুর, অন্তর্গত নিষাদ, মারী, উটপাখি, সুখের সন্ধানে, আমৃত্যু আজীবন। এই গল্পগুলোতে হাসান আজিজুল হক কোনো নীতি কথা শোনাতে চাননি, ইতিহাসের পাঠও দিতে চাননি। এখানে তিনি মানবিক ট্রাজেডিগুলোর নিস্পৃহ দর্শক মাত্র। কথাকারের এখানে কোনো পক্ষপাত নেই, নৈতিক অবস্থান নিয়ে পূর্ব-নির্ধারিত কোনো সিদ্ধান্তও নেই। গল্পগুলোতে তিনি বাস্তব ও দৈনন্দিন সংকটের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটান। হাসান আজিজুল হক বরাবরই তাঁর আখ্যানে নিরাসক্ত কঠিন-কঠোর বাস্তবতার নির্মাণের জন্য পরিচিত। নিজের বয়ানে তিনি বলেছেন, “সাহিত্যে একমাত্র তখনই সাদামাটা বাস্তবের পাশাপাশি দেখা দেয় আন্তর বাস্তবতা, যখন লেখক বহিরঙ্গ - সাদৃশ্য ভেদ করে চলে যান বাস্তবের তীব্রতর তীক্ষ্ণতর চেহারা ফুটিয়ে তুলতে, বাস্তবের সচরাচর দৃশ্যগোচর রূপ ভেঙ্গে দিয়ে তাকে দুমড়ে-মুচড়ে তছনছ করেন। আর এইভাবে শতপথ সূচিতীক্ষ্ণ আলো এসে পড়ে, লেখকের মন মেধা প্রজ্ঞা মিশে যায় তার সঙ্গে।

"বাস্তব যখন এত নিকট ও প্রবল তখন শুধু কল্পনার সাহায্য নিয়ে সে বাস্তবের পু্ননির্মাণ সম্ভব নয়। লেখককে জীবনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়, অথবা কোন না কোন ভাবে সে জীবনের অংশীদার হতে হয়।” নিজের লেখালেখি নিয়ে তাঁর অকপট উক্তি, “আমি মূলত অভিজ্ঞতার দিক থেকে লেখক। ধরো আমি কল্পনা করে কিছু লিখি না, বানিয়ে কিছু লিখি না যা যা কিছু লিখতে পারিনা, তা তা লিখছি তখন যদি কেউ প্রশ্ন করে এর ভিত্তি কি? আমি বলবো এই দেখো আমার অভিজ্ঞতা।... ‘এভরি হিউম্যান ইজ ইন্ডিভিজ্যুয়ালি ইউনিক’ এই কথাটা আমার সাহিত্যেও মূল কথা"। (চিহ্ন ৩৩ / আগস্ট, ২০১৭)

হাসান আজিজুল হক ছিলেন দর্শনের অধ্যাপক। তাঁর কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিলো সাহিত্যের সঙ্গে দর্শনের সম্পর্ক নিয়ে। আলাপচারিতায় তিনি বলেছিলেন, "...ল্যাঙ্গুয়েজ ইজ পার্সনালিটি। ল্যাঙ্গুয়েজ-ই হচ্ছে প্রকাশ। এটা কিন্তু ভাববার কথা - যেখানে ল্যাঙ্গুয়েজ পৌঁছায়নি সেখানে কি আছে - ‘সাইলেন্স’। যেখানে ল্যাঙ্গুয়েজ দাঁড়ানো রিক্স সেখানে সাইলেন্স আর সাইলেন্স মানে অনস্তিত্ব ...”

মার্ক্সবাদে তাঁর বিশ্বাস নিয়ে তিনি কোনো আড়াল রাখেননি। তবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা সোমনাথ হোড়, নবারুণ ভট্টাচার্যদের মতো মার্ক্সবাদের উচ্চকিত উচ্চারণ তিনি করেননি। এই প্রসঙ্গে তাঁর মতামত পরিষ্কার, "লোকে যে নির্ধারণ করে যে মার্কসিস্ট লেখক, এই ধরনের আরকি! আসলে অনেকেই বিপ্লব বিপ্লব বলে চিল্লায় আমি আসলে সেই রকম নই, আমি একটু আলাদা অন্যরকম। ...মানুষ সমাজে বাস করে তো, তাই তাকে বড়লোক হয়ে বাঁচতে হয়, গরীব হয়ে বাঁচতে হয়, নানাভাবে বাঁচতে হয়। ইউ আর কনসার্ন টু দ্য হিউম্যান বিংস। আমি সেটা মনে করি। এবং সেজন্য আমার মনে হয় যে হিউম্যান লাইফ ইজ বিউটিফুল"।

জন্মেছিলেন বাংলার পশ্চিমপ্রান্তের জনপদ বর্ধমানে, এরপর দেশভাগ, তিনি চলে গেলেন দিদির কাছে, খুলনায়। পড়াশোনার জন্য দৌলতপুর। স্কুল শিক্ষক, কলেজের অধ্যাপনা থেকে মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপনার নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে অবশেষে, জীবনের অধিকাংশটা নিয়ে তিনি অবিভক্ত উত্তরবাংলার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক। প্রয়াত হলেন সেই রাজশাহীতেই। জন্ম ও মৃত্যুর দুই ভূমিই বাংলার, কিন্তু মাঝে এক যন্ত্রণার সীমান্তরেখা।

হাসান আজিজুল হক, আমাদের মাতৃভাষার অন্যতম প্রধান কথোয়াল, বাংলাভাষার ছোটগল্প ধারায় এক স্বতন্ত্র নাম। তিনি চিরনিদ্রায় চলে গেলেন। ১৪ই নভেম্বর রাতে যখন তাঁর প্রয়াণের দুঃসংবাদ এলো তখন কিছুক্ষণের জন্য চারপাশটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলো। তাঁকে নিয়ে আমার অনেক অনেক স্মৃতির ঝলক হঠাৎ বিন্দু বিন্দু হয়ে জ্বলে উঠলো। সেইসব কথা লিখতে ইচ্ছে করছিলো, আবার তাঁর সদাহাস্যোজ্জ্বল মুখটার দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকতেও ইচ্ছে করছিলো। আবার মাঝে মাঝে তাঁর শ্রেষ্ঠ গল্প থেকে প্রিয় গল্পগুলো উল্টেপাল্টে দেখছিলাম।

বেশ কয়েকবার তাঁর নৈকট্য আমার স্মৃতিতে আটকে আছে। সেই সত্তরের শেষের দিকে একদিন পড়ে ফেলেছিলাম একটি ছোট গল্প 'শকুন'। এর প্রায় কুড়ি বছর আগে, ১৯৬০ নাগাদ গল্পটি লিখেছিলেন হাসান আজিজুল হক, গল্পটি জন্মের ষাট বছর পরেও, আজকেও সেটি আমাকে স্তব্ধ করে দেয়, যে স্তব্ধতা হাসান সাহেব আমাকে দিয়েছিলেন তাঁর প্রথম পাঠেই।

এই গল্পে একদল অশান্ত ও চঞ্চল স্বভাবের ছেলেছোকরার হাতে আক্রান্ত হয় একটি শকুন। অসাধারণ সূচনা গল্পটির, “...কয়েকটি ছেলে বসে ছিল সন্ধ্যার পর। তেঁতুল গাছটার দিকে পিছন ফিরে। খালি গায়ে ময়লা হাফশার্টকে আসন করে। ...একটা আর্তনাদের মত শব্দে সবাই ফিরে তাকাল। তেঁতুলগাছের শুকনো ডাল নাড়িয়ে, পাতা ঝরিয়ে সোঁ সোঁ শব্দে কিছু একটা উড়ে এলো ওদের মাথার উপর। ফিকে অন্ধকারের মধ্যে গভীর নিকষ একতাল অন্ধকারের মত প্রায় ওদের মাথা ছুঁয়ে সামনের পড়ো ভিটেটায় নামল সেটা।” সেই ‘কিছু একটা’ শকুনটা কিন্তু মানবের অকারণ নিষ্ঠুরতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারেনি, হেরে যায় সে। ছোকরার দল তার শরীর থেকে পালকগুলোও ছিঁড়ে নেয়। এই পালকমুক্ত শকুনিটি একটি বড়সড় মোরগের মত দেখতে লাগে তখন। এই চেহারায় অত্যাচারিত মনুষ্যেতর জীবটি মারা যায়। হাসান আজিজুল হক লিখেছেন, “ন্যাড়া বেলতলা থেকে একটু দূরে প্রায় সকলের চোখের সামনেই গতরাতের শকুনিটা মরে পড়ে আছে। মরার আগে সে কিছু গলা মাংস বমি করেছে। কত বড় লাগছে তাকে! ঠোঁটের পাশ দিয়ে খড়ের টুকরো বেরিয়ে আছে। ডানা ঝামড়ে, চিৎ হয়ে, পা দুটো ওপরের দিকে গুটিয়ে সে পড়ে আছে। দলে দলে আরও শকুন নামছে তার পাশেই। কিন্তু শকুন শকুনের মাংস খায় না। মরা শকুনটার পাশে পড়ে রয়েছে অর্ধস্ফুট একটি মানুষের শিশু। তারই লোভে আসছে শকুনের দল। চিৎকার করতে করতে। উন্মত্তের মত।

আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে মানুষ ডেকে আনছে মৃত শিশুটি।

ই কাজটো ক্যা করলো গো? মেয়ে-পুরুষের ভিড় জমে গেল আস্তে আস্তে। শুধু কাদু শেখের বিধবা বোনকে দেখা যায় না। সে অসুস্থ, দিনের চড়া আলোয় তাকে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে"।

মুলত বাস্তববাদী নিরীক্ষাপ্রবণ গল্পকার হাসান আজিজুল হকের লেখালেখির প্রকাশ ১৯৬০ নাগাদ। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বপ্ন; শীতের অরণ্য’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে, সে আমার জন্মবছর। এর তিন বছর পরে ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ প্রকাশিত হয়। হাসান সাহেবের ‘উত্তর বসন্তে’ গল্পটি আমার কাছে তাঁর অন্যতম সেরা গল্প। ‘পরবাসী’ গল্পটাকেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এই গল্পটি খন্ডিত বাংলার দুই মুখ্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের অন্তর্দাহী যন্ত্রণা থেকে উঠে এসেছে।

“বাড়িটা পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। বাড়িটা শান্ত। বাড়িটা স্থির। বাড়িটা মূক। ওরা চলে গেছে। বল্লম দিয়ে মাটির সঙ্গে গাঁথা বশিরের সাত বছরের ছেলেটা। বাড়ির মতই শান্ত এবং মূক এবং ছাব্বিশ বছরের একটি নারীদেহ - কালো এক খন্ড পোড়া কাঠের মত পড়ে আছে ভাঙ্গা দগ্ধ ঘরে। কাঁচা মাংস পোড়ার উৎকট গন্ধে বাতাস অভিশপ্ত।” হত্যা ও জিঘাংসার ভয়ানক রূপ এই গল্পে দেখা যায়, নিষ্ঠুরতার বীভৎসতা থেকে উঠে আসা আর্তি আমাদের এক গভীর মানবিক আবেদনের কাছে নিয়ে যায়। গল্পের এক বাঁকে এক অবিস্মরণীয় বয়ানের সামনে থমকে দাঁড়াতে হয়, "তোর বাপ কটো? এয়া - কটো বাপ? একটো তো? দ্যাশও তেমনি একটো। বুইলি?” এই বাক্যের সামনে দেশের মাটিও কথা বলে। এই অকপট উক্তির সারল্য অসাম্প্রদায়িক জনতার বিদ্বেষহীন অন্তর্লোকের কাছে নিয়ে যায়। সাম্প্রদায়িকতার আগুনে যে বশিরের মন হত্যাপ্রিয় হয়েছিলো সেই বশিরের মন বীভৎস হত্যালীলার স্বরূপের সামনে ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। সে চিৎকার করে বলে, “আল্লা তু যে থাকিস মানুষের দ্যাহোটার মধ্যে - কোতা, কোতা থাকিস তু, কুনখানে থাকিস বল"।

এই নির্মম স্বপ্নের কথোয়ালকে আমি প্রথম দেখি আমার জন্মশহর জলপাইগুড়ি সন্নিহিত হলদিবাড়িতে। ‘কবিকুঞ্জ’র অনুষ্ঠানে, সম্ভবত ১৯৯৪-এর জানুয়ারি। কথার সময় মুখে মেখে রাখা অনবদ্য হাসি ও অতুলনীয় রসবোধ প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ করেছিলো। সেই গড়ে ওঠা সম্পর্ক ক্রমশ আরো নৈকট্য দিয়েছিলো। এর কয়েক বছর পরে তিনি জলপাইগুড়ি এলেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে, তিনি ও নবারুণ ভট্টাচার্য। আমার দায়িত্ব ছিলো তাঁদের দেখভালের। সস্ত্রীক হাসান আজিজুল হক সেবার আমাদের শহরে। সার্কিট হাউসে রাখা হয়েছিলো। প্রথম রাতে আমার বাসায় আমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছিলেন। পরদিন খুব ভোরে আমাকে যেতে বললেন। আমার বাইক নিয়ে ভোর ৫/৩০ নাগাদ সার্কিট হাউসে পৌঁছই। সেই ভোরে তিনি তিস্তা দেখতে চাইলেন। আমি আমার ধুসর রঙয়ের বাইকে এই আগুনপাখিকে তুলে নিয়ে তিস্তার বাঁধে যাই। সেই বিস্তৃত তিস্তার পূর্ব থেকে সুর্য ওঠা দেখা, কী শিশুর মতো উচ্ছ্বাস তাঁর! সঙ্গে আমার পুরোনো ক্যামেরা, রিল ভরে শাটার টেপা আদ্দিকালের ক্যামেরা। তাতেই কিছু ছবি তোলা হলো। ফিরে আসার পর শিলিগুড়ি থেকে শুভময় এলো, সাক্ষাৎকারের কাজ শুরু হল। এই সময়ই বিপত্তি এলো। সেই যাত্রায় ঢাকা থেকে সেই অনুষ্ঠানেই এক যুব নেতা এসেছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন শাসক অনুগামী। তাঁর সঙ্গে আরো চার জন চ্যালা। অনেক রাজনৈতিক কথা উঠে আসছিলো, প্রগতিশীল রাজনৈতিক শূন্যতার হতাশা হক সাহেব প্রকাশ করছিলেন। প্রাক্তন শাসক জিয়া শাসনের বিরুদ্ধেও খোলামেলা অভিমত ছিলো সেখানে, এরশাদ জামানা নিয়েও। সেই ‘যুব’ নেতা সরাসরি সেই সময় হাসান স্যারের কথার বিরোধিতা করে আমাদের কথাবার্তায় ব্যাঘাত করতে শুরু করে। বিরক্ত হাসান আজিজুল হক বাধ্য হলেন কথা থামিয়ে দিতে। এরপর আলাদাভাবে যদিও অনেক কথা হয়েছে পরে, তাঁর সঙ্গে। আমার বাসায় আড্ডাছলে বলা তাঁর একটি কথা পরবর্তীতে আমার কাছে খুব দামি হয়ে উঠেছিল। আমার সক্রিয় বাম সাংস্কৃতিক কর্মী থাকার বিষয়টি নিয়ে তিনি দ্বিমত রেখেছিলেন। বলেছিলেন, তিনি একসময় বাংলাদেশের প্রগতি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন, সঙ্গী ছিলেন আখতারুজ্জ্বমান ইলিয়াস। পরে তিনি সঙ্ঘ থেকে বেরিয়ে আসেন। বলেছিলেন, “বেঁটে বেঁটে পিগমির মত মানুষেরা, যারা সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে ততটা ভাবে না, যতটা না শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে সেখানে ছড়ি ঘোরাতে থাকেন। তাঁরাই যেদিন তোমার চেতনাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবে, না পারলে সংঘাতে আসবে সেদিন তুমিও ভাববে যে কি অমূল্য সময়ের অপচয় করেছো তুমি।.. লেখকের প্রধান কাজ লেখা, সততার সঙ্গে সেই কাজটাই করে যাওয়া"। এরপর অনেক দিন পরে তাঁর এই কথাগুলো কতটা সত্যি তা হাড়েহাড়ে টের পেয়েছি আমি।

বর্ধমান তাঁর জন্ম ও শৈশবের স্মৃতি গন্ধ মাখা মাটি। নিজের সেই শৈশব যাপনের ধ্বনি প্রতিধ্বনি তাঁর নানা লেখায় খুঁজে পাওয়া যায়। বিশেষ করে ‘ফিরে যাই ফিরে আসি’ বা ‘উঁকি দিয়ে দিগন্ত’তে। হাসান আজিজুল হক তাঁর নিজের ‘গল্পের জায়গা জমি মানুষ’ সম্পর্কে লিখেছেনঃ "আমাদের দেশ ছিলো রুক্ষ কর্কশ। গাছপালা প্রায় নেই। খুব বড়ো মাঠ। তেপান্তর যাকে বলে। গরমের দিনে ঘাস জ্বলে যায়। মাটির রঙ হয় পোড়া তামাটে। শরতে সেই মাটিকে দেখি হাড়ের মতো সাদা। ...এই হল রাঢ়। কি নির্দয় শুকনো কঠিন রাঢ়। ...এই দেশ যেন দুর্ভিক্ষ আর খিদের জন্যই তৈরি হয়ে আছে। ...আমার কাছে রাঢ় তাই শীতরাতের হিম কালো আকাশ - বিশাল প্রান্তরের উপর যেন বিশালতর ঢাকনা, তার ঝকঝকে তারা, তারাদের অস্পষ্ট চাপা আলো, ...রাঢ় হচ্ছে ধান কেটে নিয়ে যাবার পর জমির নারা, চৈত্র মাসের শুকনো এলোমেলো বাতাস, সাদা ধুলো। এইভাবে আমি এখন রাঢ় গড়ে তুলি - কামারশালে গনগনে আগুন জ্বলে, মাঠের ভূমি নিয়ে মারামারিতে মানুষের মাথা ফাটে, জ্বরের ঘোরে কোঁকাতে কোঁকাতে মানুষ ইয়ার্কি করে, জমিতে কাজ করতে গিয়ে মোষের আর মানুষের জিভ বেরিয়ে আসে, মানুষ রক্তমুখী হয়ে ওঠে, ভয়ানক স্বার্থ নীল বিষ ওগরায়, হিন্দু মুসলমানের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষে, মুসলমান হিন্দুকে পছন্দ করে না - সাময়িকভাবে মানুষ হারিয়ে যায় - আবার গলায় গলায় মানুষ ফিরে আসে। ...তবে শেষ পর্যন্ত মানুষ মানুষকে পাইয়ে দেয়। সমগ্র তৈরি হয় এভাবেই।” মানুষ ও তাঁর ভিত্তিভূমির এই ‘সমগ্র’ নিয়েই হাসান আজিজুল হকের সামগ্রিক সাহিত্য নির্মান। তাঁর লেখায় আমরা সেই বাংলাকে পাই যে বাংলা জসিমুদ্দিন বা বিভূতিভূষণের, যে বাংলা সতীনাথ বা মানিকের, শামসুল হক বা সুলতানের। তাঁর এই স্বপ্নের দেশের ছবিটা ক্রমশ তাঁর কাছে পালটে যাচ্ছে, তিনি দেখছেন - "সমতল চ্যাপটা দেশ তখন সবুজের চিহ্ন বিলুপ্ত হয়েছে - খালগুলোতে মিশমিশে কালো রং-এর কাদা ছাড়া আর কিছু নেই। কাদাখোঁচার লম্বা ঠোঁট খচ খচ করে ক্ষত বিক্ষত করছে কাঁচা কাদাকে, এক ঠ্যাং এর উপর ভর দিয়ে কালোয় সাদায় মেশানো বিরাট সারস লম্বা সারি দিয়ে বসতে শুরু করেছে। উত্তুরে বাতাস দিন দিন সঙ্কুচিত করতে শুরু করলো দেশটাকে, গাছগুলো সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে গেল এবং ঘাস-পাতার রং মিলিয়ে গাঢ় সবুজ বর্ণের ফড়িং মেটে হয়ে গেল। আর ধুসর চ্যাপ্টা দেশ গরুর গাড়ির নেমি চিহ্নিত সমান্তরাল চওড়া রাস্তায় আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে গেল"।

আমার উল্লিখিত ক্যামেরাটিতে ছবি তুলছিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, "এই ছবি আমি কি করে পাবো? আমি সেই ক্যামেরাটি তাঁকে দিয়ে বললাম বর্ধমানেও কিছু ছবি স্মৃতিতে রাখার জন্য তুলতে হবে। আপনি এটি নিয়ে যান। পরে কোলকাতায় জয়দেব এটি নিয়ে নেবে"।

এমন অনেক স্মৃতি আজ অতীত ফুঁড়ে উঠে আসছে। স্মৃতি তো তাঁরও অন্যতম আয়ুধ ছিলো। এই স্মৃতি নিয়ে নিজেকেই তিনি জিজ্ঞাসা করেন আবার জবাব তৈরি করেন, "স্মৃতিকে কতটা পিছনে নেওয়া যায়? - নিশ্চই চেতনার পিছনে নয়। আমার ধারণা শুধুমাত্র চেতনাতেও স্মৃতি নেই, যদি থাকেই স্মৃতির শুরু। জন্মের পর থেকে চেতনা আছে, গূঢ় রহস্যময় চেতনা - কিন্তু স্মৃতি নেই। চেতনা-আত্মা-চেতনার মাঝখানের সান্ধ্য জায়গায় অনেকবার ফিরে যেতে চেয়েছি। সে যেন শুধু চাঁদের আলোই নয়, স্বপ্নের চাঁদের আলো। কোনো কিছুই ঠিকমত ঠাহর হয় না। কিন্তু বস্তুর চেহারা ত্যাগ করে, ভয় মূর্ত চেহারার সামনে এসে দাঁড়ায়, কল্পনাও বস্তু হয়ে ওঠে। স্মৃতির এই ভরবেলা নিয়ে কিছু কথা।...” এই ‘স্বপ্নের চাঁদের আলো'র সামনে দাঁড়িয়ে হাসান আজিজুল হক সাহিত্যকে দেখেন, লেখেন। “তবে রহস্যের ছিটেফোঁটা মাত্র না-রেখে একটা কথা বোধহয় বলা চলে যে, সমাজে সাধারণ-অসাধারণ অন্যসব মানুষের মতোই লেখকও তাঁর রচনায় একটি পরিপ্রেক্ষিতের প্রতিনিধিত্ব করেন।... সামনে থেকে, পেছন থেকে, পাশ থেকে, কোনাকুনি বা সোজাসুজি লেখককে তাকাতেই হয় - তাঁকে মত দিতে হয়, মতের জন্যে খুঁটি গেড়ে বসতে হয়, কিছু কিছু মূল্যের জন্যে লড়তে হয়, কিছু কিছু বিশ্বাসের জন্য মায়া রাখতে হয়।” লেখকের নিজস্বতা, অনন্যতা এখানেই, তাঁর স্মৃতি ও পরিপ্রেক্ষিত দর্শনের ভিত্তিতে রচিত হয়। হাসান সাহেবের মতে যা, "লেখকের অভিজ্ঞতার জগৎ অবশ্যই বহুস্তরা। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ এখানে দুর্জ্ঞেয়ভাবে মিশে যায়, কৈশোর-স্বপ্ন থাকে, অভিমান থাকে, জীবনের শ্রম থাকে, ভালোবাসা, ঘৃণা সবই থাকে, চেনা-অনুভূতি অজানা-বোধের প্রান্তদেশ ছুঁয়ে যায়। তাঁর এই অভিজ্ঞতার জগৎ যদি সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়, তাহলে একজন লেখকের অনন্যতার ব্যাখ্যা খানিকটা পাওয়া যায়"।

তাঁর স্ত্রীর প্রয়াণের পর আমি রাজশাহী যাই ‘চিহ্নে’র অনুষ্ঠানে। কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায় আমাকে বলেছিলেন হাসান আজিজুল হক’কে তাঁর শোকবার্তা জানাতে। হাসান সাহেবের বাসা থেকে আমি ফোনে ধরে দিয়েছিলাম তাঁকে। বাংলা সাহিত্যের দুই চিরকালের শ্রেষ্ঠ স্রষ্টার সেই আবেগমাখানো কথোপকথন, এক অমলিন স্মৃতি হয়ে থাকলো আমার কাছে। দুজনেই আজ চিরশান্তিতে চলে গেছেন। বাংলা ভাষা রিক্ত হয়ে আরো শূণ্যতার দিকে চলে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও দেশ বর্ণনায় এই দুই সাহিত্যিকের কলম কাছাকাছি এসে যায়। ‘পরবাসী’ গল্পে হাসান সাহেব লিখেছেন, "পাতলা একটা কুয়াশা পড়েছে। কালচে রং-এর মাটি অল্প ভিজে এবং পাথরের মত কঠিন। গরুর গোয়াল থেকে ধোঁয়া এসে কুয়াশায় মিশেছে। ভারি একটা পর্দা ভেদ করে ওরা মাঠে এসে পড়লো। ভিজে ভারি ধানের লুটিয়ে পড়া শীষ চাবুকের মত আঘাত করে পায়ের গোছায়। শির শির করে বাতাস দেয়, ধানে ধানে ঝাপ্টা লেগে শন শন শব্দ হতে থাকে এবং এই অল্প একটু শব্দ ছাড়া বিরাট খোলা মাঠের কোথাও কোন শব্দ নেই। অন্ধকারে ছায়ার মত মানুষগুলোকে হুস হুস করে হাঁটতে দেখা যায়। তারপর কুয়াশার পাতলা চাদর ছিঁড়ে হঠাৎ সূর্যের অজস্র আলো লাল হয়ে মাঠে পড়তেই দেখা যায় বিরাট মাঠে জনারণ্য। তখন একটা শব্দ ওঠে, একটা বিশাল গম্ভীর গুঞ্জন মাঠের আকাশ এবং বাতাস বেষ্টন করে বাজতে থাকে। এর অন্য কোনো নাম নেই। একে জীবনের গুঞ্জন বলা চলে"। ভাষার সপ্তরঙে এভাবেই তিনি নিসর্গের ভেতর থাকা মানুষকে আঁকেন, লেখেন মানুষের কথা।