আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৮

সমসাময়িক

বিরোধী জোট ও অন্তর্লীণ সমস্যা


বহুদলীয় গণতন্ত্রের সদর্থক সমস্ত দিকগুলোর পরেও একটা বড় সমস্যা হল, দলগুলির নিজস্ব উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনেক সময়েই সম্মিলিত সিদ্ধান্তগ্রহণকে মসৃণ করে না। ভারতের ক্ষেত্রেও যা দেখা যাচ্ছে, বিজেপি বিরোধী জোট শুরু হবার আগেই নানা রকম প্রশ্নের মুখে, কারণ আঞ্চলিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠবার উচ্চাশা। আম আদমি পার্টি, তৃণমূল কংগ্রেস, আশাদউদ্দিন ওয়াইসির দল, সকলেই চায় নিজেরা রাজা হতে, অথবা কিংমেকার। ইগো সমস্যা যদি বাদও দেওয়া হয়, অথবা বিজেপির সঙ্গে তলায় তলায় বোঝাপড়ার অভিযোগ, তাহলেও বোঝাপড়ার অভাব ও স্বার্থপর আচরণগুলোকে কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি আবার যদি জয়ী হয় তাহলে তার দায় এই দলগুলোর ওপরেও বর্তায় বই কি!

মুম্বাইতে শরদ পাওয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে ইউপিএ জোটকে অস্বীকার করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং একইসঙ্গে সমান্তরাল বিরোধী জোটের ডাক দিলেন। সে তিনি দিতেই পারেন কারণ তাঁর স্বাধীনতা আছে। কিন্তু তিনি তারপর বললেন যে, বিজেপির বিকল্প একমাত্র তৃণমূলই হতে পারে। সেই তৃণমূল, বাজপেয়ীর জমানায় দীর্ঘদিন এনডিএ জোটে থাকার ইতিহাস যাদের আছে, যারা আরএসএস-কে 'ন্যাচারাল অ্যালাই' হিসেবে মনে করে। নীতিগত প্রশ্ন বাদ দিলেও, তৃণমূল কংগ্রেসের উপস্থিতি বাংলার বাইরে কোথায়? ত্রিপুরাতে এত লম্ফঝম্প করেও মাত্র একটা আসন জুটেছে। অন্য কোনও রাজ্যে বিধায়ক বা সাংসদ নেই। শুধুমাত্র বাংলার ভরসায় থেকে এবং অন্যান্যদের অস্বীকার করে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে যাবার মুর্খামি দেখে মনে অন্য সন্দেহ জাগে - এগুলো কি বিজেপিকে সুবিধা পাইয়ে দেবার জন্য করা হচ্ছে? নাগাল্যান্ড নিয়ে প্রশ্নেও সমস্ত বিরোধী দল যখন সংসদ বয়কট করেছিল, তৃণমূল করেনি। বিজেপি বিরোধী সর্বভারতীয় ধর্মঘট বাঁচাল করতে বাংলায় সরকারের সক্রিয়তার ব্যাপারেও আমরা অবহিত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘ ইতিহাস আছে বিজেপির সঙ্গে ঘর করার। তাই তিনি যখন কংগ্রেসকে অস্বীকার করেন, অথবা বিরোধী জোট, যার একটা বড় উপাদান কংগ্রেস, তার বিরুদ্ধে সমান্তরাল জোট গড়তে চান, তখন প্রশ্ন জাগে, তিনি কার সুবিধে করে দিচ্ছেন। তবে শিবসেনা ও ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং বেগতিক দেখে গোয়াতে সুর নরম করেছেন মমতা। তবুও রাজ্যে রাজ্যে ওয়াইসির দল মীম যেভাবে বিজেপির হয়ে কাজ করে এবং বিরোধী জোটে ভাঙন ধরায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও যদি সেরকম এজেন্ট হিসেবে প্রতিপন্ন হন, তাহলে সেটা দুর্ভাগ্যের হবে। আম আদমি পার্টিও একইভাবে পাঞ্জাব বা অন্যত্র বিরোধী জোটে যোগ দেয় না, বিরোধী ভোটে ভাঙন ধরায়, এমনকি যোগ দেয় না রাস্তার আন্দোলনেও। সংসদের বাইরে যে সংগ্রামগুলো চলে, সেটা কৃষক আন্দোলন হোক বা কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের বিরুদ্ধে আন্দোলন, সেসব কিছুতেই কেজরিওয়ালের নীরবতা ও সময়ে সময়ে বিজেপিকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন চোখে পড়বার মত ছিল। কেজরিওয়াল বা মমতা, সবারই উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে প্রধানমন্ত্রী হবার। যদি বিজেপির সঙ্গে বোঝাপড়ার অভিযোগ মিথ্যেও হয়, এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে তো অস্বীকার করা যাবে না ! আর এটারই বলি হবে বিরোধী জোট।

একটা কথা বুঝতে হবে যে, বিজেপির বিরুদ্ধে সম্ভব হলে একের বিরুদ্ধে এক, এই সমীকরণে ভোটের লড়াই না লড়লে সুবিধে পাওয়া নাও যেতে পারে। তেমনই, সংসদের বাইরেও যে কোনও আন্দোলনে সার্বিক বিরোধী জোট ছাড়া জয়লাভ কঠিন। কিন্তু এটার জন্য এমন একটা শক্তি দরকার যার নিজস্ব উচ্চাশা নেই কিন্তু যে অন্য দলগুলিকে একটা প্ল্যাটফর্মে আনতে পারবে। জরুরি অবস্থার সময়ে এই দায়িত্ব পালন করেছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ। নব্বই দশকে বামপন্থীরা বিশেষত জ্যোতি বসু ও হরকিষেণ সিং সুরজিতের এরকম উচ্চ্চতা ছিল। বামেদের সততা, নির্লোভ রাজনীতি ও সমস্ত দলকে একসঙ্গে নিয়ে চলার ক্ষমতা ইউপিএ গঠনের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে কাজ করেছিল। আজ বামেরা দুর্বল, এবং মমতা বা কেজরীওয়াল সেই স্থান নিতে চান। কিন্তু তা করতে গেলে সবার আগে ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছাড়তে হবে। রাজনীতি অ্যাম্বিশাস হতেই পারে, কিন্তু রাজনীতিককে অ্যাম্বিশাস হতে নেই, বিশেষত ঘাড়ের কাছে বিজেপির মত দল নিঃশ্বাস ফেললে তো আরওই হতে নেই। দায়টা কংগ্রেসেরও আছে তা ঠিক। তাদের দিশাহীন নেতৃত্ব, অপদার্থ রাজনীতি ও গোষ্ঠীকোন্দল রাজ্যে রাজ্যে বিজেপির সুবিধে করে দিচ্ছে এবং অন্যান্য আঞ্চলিক দলকে বেশি করে জায়গা দিচ্ছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়েও কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিজেপি বিরোধী জোট সম্ভব নয়। যদি জোটের রাজনীতিতেই যেতে হয় তাহলে তার সমস্ত নিয়ম মেনে খেলা উচিত, আর নয়ত একা লড়লেই হয়। কিন্তু জোট ভাঙিয়ে নিজের জোট তৈরি করতে গেলে পতন অনিবার্য, আর বিজেপিও এমন সুযোগের জন্যই অপেক্ষা করে আছে।