আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৮

সমসাময়িক

দূষণে বিধ্বস্ত রাজধানীর জনজীবন


দূষণে ধুঁকছে দিল্লি। প্রতিদিন হিসাব কষা হচ্ছে আবহাওয়া দূষণের মাত্রা। এবং প্রতিনিয়ত তা বেড়েই চলেছে। শীর্ষ আদালতের প্রশ্ন কেন দূষণের মাত্রা বেড়ে গেছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয় দূষণের কারণ অনুসন্ধানের জন্য। কেন্দ্র ও রাজ্য প্রশাসন প্রতিদিন বৈঠক করে জানিয়ে দেয় দূষণ থেকে দূরে থাকার জন্য কী কী করতে হবে। দূষণ নিয়ন্ত্রণের বদলে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দূষণ আক্রান্তর সংখ্যা কমানোর চেষ্টা হয়। কিন্তু দূষণ দূরীকরণের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

গত কয়েক বছর ধরে দেশের রাজধানীর জন্য নভেম্বর ডিসেম্বর মাস বিভীষিকাময়। এতদিনেও দূষণের মূল কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। অন্যান্য বছর বলা হত হরিয়ানা-পাঞ্জাবের কৃষিজমিতে ফসল কাটার পর পড়ে থাকা গাছের গোড়া (চলতি ভাষায়, নারা) জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য এমনটা ঘটে। কিন্তু এবার শীর্ষ আদালতের প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ওকালতনামা মারফত জানিয়েছে যে, এই ভয়াবহ দূষণের মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ নারা-পোড়ার ফলে তৈরি হয়। বাদবাকি?

উত্তর খোঁজার কাজ চলছে। উত্তর প্রদেশের জনৈক মন্ত্রী অবশ্যি দিল্লির প্রবল দূষণের এক মোক্ষম কারণ খুঁজে পেয়েছেন। প্রকাশ্য জনসভায় তিনি জানিয়েছেন যে, পাকিস্তান থেকে আসা দূষিত বাতাসের জন্য এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। পাকিস্তান থেকে আগত এহেন দূষিত বাতাসের বিরুদ্ধে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক গোছের কোনো আক্রমণ হানা উচিত কিনা তা নিয়ে অবশ্য তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

উত্তরের তীব্র শীতল হওয়ার দাপটে দূষণের মাত্রা সামান্য কমে গেলেই প্রশাসনের মাথাব্যথা কমে যাবে। শীর্ষ আদালতও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মামলায় নজর দেওয়ার সময় পাবে। দূষণ দূর করার জন্য কী করা হবে? আগামী বছর আবার দেখা যাবে।

সেপ্টেম্বরের শেষ থেকেই দিল্লি ও সংলগ্ন এলাকায় রোদের প্রখর তাপ ক্রমশঃ ঝিমিয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু গাড়ি চলাচল কমে না। বরং উৎসবের মরশুম বলে রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। তেলের দাম বাড়তে থাকলেও রাস্তায় গাড়ির অভাব নেই। তা-ও এখন দিল্লির বাস ডিজেলের বদলে সিএনজি জ্বালানী ব্যবহার করে। অটো রিক্সাও সিএনজিতে চলে। দিল্লি হয়ে অন্য রাজ্যে যাওয়া ভারী ট্রাক এখন শহরের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না। রাজধানীর বাইরে তৈরি হওয়া ইস্টার্ন এক্সপ্রেসওয়ে এবং ওয়েস্টার্ন এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে চলে যায়। প্রকৃতপক্ষে ২০১১ নাগাদ দিল্লির দূষণ কমানোর জন্য এবং শহরের রাস্তায় ভারী ট্রাক চলাচল বন্ধ করার জন্য এই দুটি রাজপথ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এমনকি যেসব সাধারণ গাড়ির গন্তব্য দিল্লি নয়, সেগুলিও এই দুই সড়কের কোনও একটি দিয়ে দিল্লিকে পরিহার করে চলাচল করে। তবুও দিল্লির দূষণ কেন কমে না?

প্রতি নিয়ত গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কার্বন নিঃসরণ বাড়তেই থাকে। কার্বন নিঃসৃত দূষণ সাধারণ উচ্চতায় বাতাসে ভেসে বেড়ায়। রোদের ঝাঁজ কমে যায়। কমে যায় হাওয়ার গতি। বাতাস স্থির হয়ে থাকে না। ধীর লয়ে হলেও চলাচল করে। কাজেই যেখানে সুযোগ পাওয়া যায় সেখানেই হাওয়া বহে চলে। এবং এ বাতাস দূষিত। ফলে লোকালয়, জনপদ থেকে শুরু করে জনপথ, বাজার সমস্তই দূষণে আক্রান্ত।

এর সঙ্গে রয়েছে নির্মাণ শিল্পের অবিরাম কাজ। শহরের সর্বত্রই হয়ে চলেছে পুরোনো বাড়ি ভাঙা এবং নতুন বাড়ি তৈরির কাজ। সেই সুবাদে বাতাসে প্রতি মুহূর্তে সংযোজিত হয়ে চলে দূষণের উপকরণ।

শীর্ষ আদালতের নির্দেশে সাময়িকভাবে সমস্ত নির্মাণ বন্ধ করা হলেও সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পের কাজ কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়নি। সংসদ ভবনের আশপাশের বিশাল এলাকা জুড়ে চলছে ২০ হাজার কোটি টাকার ধ্বংস ও নির্মাণের কাজ। সেখান থেকে যে পরিমাণ ধূলিকণা প্রতি মুহূর্তে বাতাসে মিশে যাচ্ছে তাতেই বাড়ছে দূষণের মাত্রা।

বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, এ বছর দেওয়ালির সময় অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি বাজি পোড়ানো হয়েছে। করোনা সংক্রমণ জনিত কারণে যখন মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্ত তখন এত বিপুল পরিমাণ বাজি কেনার টাকা কোত্থেকে আসে?

নভেম্বর মাসের সূচনা লগ্নে অনুষ্ঠিত দেওয়ালির সময় বাজি পোড়ানোর জন্য যে পরিমাণ দূষণ-উপাদান বাতাসে মিশেছে তা নিশ্চিতরূপে দিল্লির দূষণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বাজি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের তরফে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বলে শোনা যায়নি। বাজি বিক্রি করার জন্য কোনো বিক্রেতা সাজা পেয়েছেন বলেও জানা যায়নি। আর লাখে লাখে মানুষ যখন উৎসব উদযাপনের উদ্দীপনায় সাঁঝরাত থেকে ভোররাত পর্যন্ত বাজি পোড়ায় তখন কি কোনো দোষীকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব?

দূষণ সৃষ্টির কারণ অনুসন্ধান চলতে থাকুক। দূষণের দায় কোন সরকারের, কেন্দ্র না রাজ্য, তা নিয়ে বিবাদ-বিতর্ক চলতে থাকুক। দূষণ নিয়ন্ত্রণে নানাবিধ পন্থা খুঁজে বের করার অভিযান অব্যাহত থাকুক। গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণে গাড়ির নম্বর প্লেটের বিজোড় সংখ্যার জন্য সোম-বুধ-শুক্রবার এবং মঙ্গল-বৃহস্পতি-শনিবারের জন্য জোড় সংখ্যার গাড়ির রাস্তায় নামানোর নির্দেশ রাজ্য সরকার দিলে দিল্লীবাসী মেনে নিতে আপত্তি করেন না। কিন্তু কেন্দ্রীয় কর্তারা তা নিয়ে হাসাহাসি করেন। এবং বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে লম্বাচওড়া প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু দিল্লির দূষণ দূরীকরণে, নিদেনপক্ষে নিয়ন্ত্রণে কী করণীয়? সকলে নীরব।

চূড়ান্ত বিচারে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের এই কূটকাচালিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দিল্লির সাধারণ মানুষ। সরকারের হুকুমনামা মেনে সকলের পক্ষে দুয়ারে তালা লাগিয়ে বাড়িতে বসে থাকা সম্ভব নয়। কাজে-কর্মে তো বটেই দোকান-বাজারেও যেতে হয়। আর মুখে মাস্ক লাগিয়ে বাইরে বেরোলেই শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। খানিকক্ষণ পর মাস্ক খুললেই দেখা যাচ্ছে মাস্কের ভেতর দিক অর্থাৎ যে দিকটি নাক ও মুখ ছুঁয়ে থাকে তার রং কুচকুচে কালো হয়ে গেছে। ঘরের ভেতরের অবস্থাও খুব একটা অন্যরকম নয়। যাঁদের সামর্থ আছে তাঁরা বাড়িতে বা দপ্তরে বাতাস শোধনকারী যন্ত্র বা এয়ার পিউরিফায়ার লাগিয়েছেন। সেই যন্ত্রর কাঁটা সারাদিন সর্বোচ্চ দূষণের জায়গায় আটকে রয়েছে। অর্থাৎ ঘরের ভেতরের দূষণ মাত্রা যন্ত্রের মাপার ক্ষমতার থেকেও বেশি। ফলে দিল্লিতে শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে। হাসপাতালে ফুসফুসের রোগীদের ভিড় বাড়ছে। একে করোনার সংক্রমণ তার উপরে দূষণ। চিকিৎসকরা চিন্তিত। কোন রোগী করোনা আক্রান্ত আর কে দূষণের শিকার? এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো মন্তব্য নেই। নেই কোনো কার্যকরী কর্মসূচি। দিনের শেষে দিল্লির বাসিন্দাদের এক ভয়ঙ্কর আবহাওয়ায় কোনোরকমে বেঁচে থাকা ছাড়া অন্য কোনো পন্থা আপাততঃ নজরে আসছে না।