আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ● ১৬-২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮
প্রবন্ধ
এক ছুতোরের ঘড়ি আর দ্রাঘিমার গল্প
কৌশিক সাহা
মুখবন্ধ
“দেখবে সেথায় ডাইনে বাঁয়ে পথ গিয়েছে কত,
তারি ভিতর ঘুরবে খানিক গোলকধাঁধার মতো।
তার পরেতে হঠাৎ বেঁকে ডাইনে মোচড় মেরে,
ফিরবে আবার বাঁয়ের দিকে তিনটে গলি ছেড়ে।
তবেই আবার পড়বে এসে আমড়াতলার মোড়ে,
তার পর যাও যেথায় খুশি, জ্বালিয়ো নাকো মোরে!”
এমন প্রাঞ্জল করে দিক্দর্শক চিহ্ন বাতলে দেওয়া সত্ত্বেও, লোকাকীর্ণ বসতি এলাকায় আদ্যনাথের মেসোর ঠিকানা খুঁজে বার করার সে কী বিষম ঝক্কি! শহরের মসৃণ পায়ে হাঁটা পথেই যদি এই হাল, তবে গভীর অথৈ সাগর পেরিয়ে, কোটি কোটি টাকার পণ্য আর যাত্রীদের নির্দিষ্ট গন্তব্য বন্দরে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কতখানি জটিল এক সমস্যা হতে পারে! কোনো স্পষ্ট দৃশ্যমান মানবিন্দু নেই, আছে শুধু গভীর জলরাশি। নাবিকের কাছে ডাইনে বাঁয়ের কোনো নিশানা নেই, চক্রবাল অবধি নীল জল ছাড়া সে আর কিছু দেখতে পায় না। দিনের আকাশে দেখে সূর্যের চলন, রাত্রে দেখে গ্রহ তারার। পাখি কিংবা মাছ দেখতে পেলে সে বোঝে কাছাকাছি কোথাও ডাঙ্গা আছে। কিন্তু সে ডাঙ্গা ভারতের না আমেরিকার, কে বলে দেবে! আজকের সময়ে যে সমুদ্রাভিযান এতো সহজ, কেমন ছিল তার গোড়ার দিনগুলি? কীভাবে শুরু হলো আদিগন্ত সাগরের বুকে দিক খুঁজে বের করার সেই প্রয়াস? কী সেই মাপ জোকের ইতিহাস?
ভূপৃষ্ঠে স্থানাঙ্ক জ্যামিতি
একটি সরলরেখা, আয়তক্ষেত্র বা ঘনকের মধ্যে অবস্থিত যে কোনো বিন্দুকে তার স্থানাঙ্ক দিয়ে চিহ্নিত করা যায়। আয়তক্ষেত্রের একটি কোণাকে, যেমন, নিচের বাঁ দিকের কোণাটিকে, মূল বিন্দু (০,০) ধরে নিয়ে, ওপরে এবং ডানদিকে মূলবিন্দু থেকে চিহ্নিত বিন্দুর দূরত্বকে তার স্থানাঙ্ক হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়। স্থানাঙ্ক দেওয়া থাকলে মূলবিন্দু থেকে যেকোনো বিন্দুতে পৌঁছনো সহজ। যেমন, স্থানাঙ্ক (৬,৮) মানে মূল বিন্দু থেকে ডানদিকে ৬ একক দূরত্বে গিয়ে বাঁ দিকে ঘুরে ৮ একক উপর দিকে গেলে নির্দিষ্ট বিন্দুতে পৌঁছনো যাবে। কিন্তু এই পথটা একটু ঘুরপাকের। সাধারণ ত্রিকোণমিতি ব্যবহার করে আরো সহজে মূলবিন্দু থেকে ৫৩ ডিগ্রি কোণে গেলে সোজাসুজি চিহ্নিত বিন্দুতে পৌঁছাতে পারা যায়। একইভাবে আমরা দুটি চিহ্নিত বিন্দুর স্থানাঙ্ক ব্যবহার করে তাদের মধ্যে যাতায়াতও করতে পারি। ভারতে চন্ডীগড় বা গান্ধীনগরের মতো পরিকল্পিত শহরে অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহানগরগুলিতে এই পদ্ধতিতেই ঠিকানা নির্দিষ্ট করা হয়। যেমন, গান্ধীনগরের বড় বাস স্ট্যান্ড ঘ-৬ উত্তর-দক্ষিণে ঘ এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৬ রাজপথের সংযোগস্থলে অবস্থিত। অতএব ক-১ থেকে ঘ-৬ যেতে হলে শুধু রাজপথ সূচক সংখ্যা ও অক্ষরগুলি দেখে চললে সহজেই গন্তব্যে পৌঁছনো যায়, গোলকধাঁধার মতো ঘোরার দরকার হয় না।
স্কুল-কলেজে অঙ্ক ক্লাসে স্থানাঙ্ক চিহ্ন নির্দেশ করার জন্য খোপ কাটা graph paper ব্যবহার করা হয়। René Descartes ১৬০০ শতাব্দীতে স্থানাঙ্ক জ্যামিতি (coordinate geometry) উদ্ভাবন করেন। তবে ভূপৃষ্ঠের মানচিত্রে খোপ কেটে কোনো জায়গার স্থানাঙ্ক নির্দিষ্ট করার ভাবনাটি কিন্তু আরো প্রাচীন। ভূপৃষ্ঠের ক্ষেত্রে graph paper-এর ঝাঁঝরিতে (grid) ডান-বাঁ দিকগামী রেখাগুলি পূর্ব থেকে পশ্চিমে আঁকা হবে এবং উপর-নীচগামী রেখাগুলি উত্তর থেকে দক্ষিণে। মানচিত্রে অঙ্কিত ঝাঁঝরিতে পূর্ব থেকে পশ্চিমে এবং উত্তর থেকে দক্ষিণে আঁকা রেখাকে যথাক্রমে অক্ষরেখা (latitude) ও দ্রাঘিমা রেখা (longitude) বলা হয়। অক্ষরেখাসমষ্টির জন্য ভূগোলকের বিষুবরেখাকে ০ ডিগ্রি মূল রেখা ধরে উত্তর মেরুকে ৯০ ডিগ্রি উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুকে ৯০ ডিগ্রি দক্ষিণ চিহ্নিত করা হয়। আকাশে সূর্য এবং নক্ষত্রের গতিপথ দেখে উত্তর ও দক্ষিণ মেরু এবং বিষুবরেখার অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব। তাই অক্ষরেখা নিরূপণ এবং মানচিত্রে আঁকা অপেক্ষাকৃত সহজ।
দ্রাঘিমা রেখা নিরূপণের জটিলতা অনেক বেশি। ভূগোলক পশ্চিম থেকে পূর্বে সবসময় ঘুরছে বলে পূর্ব-পশ্চিম গতিপথে মেরু বা বিষুবরেখার মতো কোনো প্রাকৃতিক মূল বিন্দু বা রেখা নেই। অতএব নানা যুগে মানচিত্রকর ও ভূগোলশাস্ত্রীরা তাদের রাজনৈতিক প্রভুদের আদেশ অনুসারে ০ ডিগ্রি দ্রাঘিমা নির্দেশ করে এঁকে এসেছেন। ১৬৬৭ ও ১৭২১ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স ও গ্রেট ব্রিটেন যথাক্রমে Paris ও Greenwich-এ ০ ডিগ্রি দ্রাঘিমা রেখা (মূল দ্রাঘিমা বা Prime Meridian) নির্দিষ্ট করে। প্রায় দু' শতক ধরে দুটি দ্রাঘিমা নিরূপণ পদ্ধতি এক সাথে বজায় ছিল এবং বেশ কিছু বিভ্রাটের কারণও হয়েছিল। Tintin-এর 'লাল বোম্বেটের গুপ্তধন'-এ (Red Rackham’s Treasure) এমন বিভ্রাটের বিবরণ আছে। Dan Brown-এর উপন্যাস 'Da Vinci Code'-এ Paris মানমন্দিরে স্থিত Paris মূল দ্রাঘিমারেখা Rose Line-এর উল্লেখ পাওয়া যাবে। শেষ পর্যন্ত ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে Washington DC-তে International Meridian Conference-এ Greenwich মূল দ্রাঘিমাকে ০ ডিগ্রি বা আন্তর্জাতিক মূল দ্রাঘিমা (International Prime Meridian) মেনে নেওয়া হয়।
নৌ-অভিযান আর দ্রাঘিমার কথা
জ্যামিতি শাস্ত্রী ও সমুদ্রগামী নাবিকের সমস্যা একটু অন্যরকম। দ্রাঘিমা রেখাসমষ্টির পরিসীমা মূল দ্রাঘিমা থেকে পূর্বে ১৮০ ডিগ্রি এবং পশ্চিমে ১৮০ ডিগ্রি। ভূগোলক বরাবর যে কোনো বিন্দু থেকে সোজা পূর্বে (বা পশ্চিমে) যাত্রা করে ৩৬০ ডিগ্রি অতিক্রম করলে প্রারম্ভিক বিন্দুতে ফিরে আসা যায়। অতএব Christopher Columbus স্পেন থেকে পশ্চিমে যাত্রা করে আমেরিকায় ধাক্কা না খেলে হয়তো ভারতবর্ষে পৌঁছতে পারতেন এবং দেশেও ফিরতে পারতেন। ভূগোলক তার আহ্নিক ঘূর্ণন গতির কারণে ২৪ ঘন্টায় এই ৩৬০ ডিগ্রী বা ১ ঘন্টায় ১৫ ডিগ্রি অতিক্রম করে। ঘূর্ণনের একটি আবর্তনে ভূগোলকের পূর্ব থেকে পশ্চিমে নানা স্থান একের পর এক সূর্যের ঠিক নীচ দিয়ে এগিয়ে যায় এবং সেই সময়ে সেই জায়গায় স্থানীয় মধ্যাহ্ণ বা দুপুর ১২টা বাজে। সুতরাং ১৫ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশের দূরত্বে অবস্থিত দুটি স্থানে ১ ঘন্টার ব্যবধানে স্থানীয় সময়ে দুপুর ১২টা বাজবে। যে জায়গাটি বেশি পূর্বে অবস্থিত তার স্থানীয় মধ্যাহ্ন ১ ঘন্টা আগে ঘটবে (চিত্র ১)।
চিত্র ১. স্থানীয় সময় ও দ্রাঘিমার সম্পর্ক
৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ফিনিশিয় এবং ৪০০ খ্রিস্টাব্দে পলিনেশিয় নাবিকেরা অক্ষাংশ গণনা করতে আকাশে নক্ষত্রের অবস্থান ব্যবহার করতো। স্কুলের জ্যামিতি যন্ত্রের বাক্সে কোণ মাপার জন্য যে ধরণের চাঁদা থাকে, তারা অনেকটা সে ধরণের Sextant এবং আরব দেশীয় Kamal যন্ত্র দিয়ে সূর্য ও তারার কৌণিক উচ্চতা পরিমাপ করে তাদের অবস্থানের অক্ষাংশ নির্ধারণ করত। ১৬০০ শতাব্দীতে ইউরোপের সব দেশের পক্ষেই নাবিক, যাত্রী আর পণ্য পরিবহনের জন্য দ্রাঘিমাংশ জানা জরুরি হয়ে পড়ে। তার সাথে ছিল জাহাজের নিরাপত্তার প্রশ্ন আর সমুদ্রপথে বাণিজ্য বিস্তারের ঔপনিবেশিক লক্ষ্য। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে ওলন্দাজ গণিতজ্ঞ Gemma Frisius জাহাজে রাখা ঘড়ি দিয়ে দ্রাঘিমাংশ গণনা করার একটি পদ্ধতির প্রস্তাব দেন। এতে বন্দর থেকে জাহাজ ছাড়ার সময় মূল দ্রাঘিমার স্থানীয় সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে এবং যাত্রাকালে সর্বক্ষণ ঘড়িটি মূল দ্রাঘিমার স্থানীয় সময়টিই দেখাবে। নাবিক এই ঘড়িতে দেখানো সময়ের সাথে স্থানীয় সময়ের ব্যবধান থেকে মাঝসমুদ্রেও দ্রাঘিমাংশ নির্ধারণ করতে পারবে। কিন্তু এমন নিঁখুত, নির্ভুল ঘড়ি নির্মাণ করার প্রযুক্তি সে যুগে পৃথিবীর কোনো দেশেই ছিল না।
এদিকে সমুদ্রপথে বাণিজ্যের পরিমাণ এবং বাণিজ্যিক অধিকার কায়েম করার জন্য দূরদেশে নৌযাত্রা ও সমুদ্রে নৌযুদ্ধ করার প্রয়োজন ক্রমাগত বেড়ে চলেছিল। ইতিহাস সাক্ষী, ভুল দ্রাঘিমাংশ নিরূপণের জন্যে বহু জাহাজডুবি হয়েছে এবং বহু প্রাণ ও পণ্যের ক্ষতি হয়েছে। দ্রাঘিমাংশের হিসাবে ভুলের জন্যে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে গ্রেট ব্রিটেনে Cornwall-এর উপকূলে Scilly দ্বীপপুঞ্জে ঝোড়ো আবহাওয়ার মধ্যে পাঁচটি জাহাজের সংঘর্ষে যাত্রী, নাবিক ও অফিসার সমেত প্রায় ২,০০০ জনের সলিল সমাধি ঘটে। ১৭৪১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ভুল দ্রাঘিমাংশ নিরূপনের ফলস্বরূপ একটি বিখ্যাত দুর্ঘটনায় HMS Centurion জাহাজ দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের দক্ষিণতম প্রান্ত Horn অন্তরীপের কাছে রসদ সরবরাহকারী বন্দরের পথ থেকে সরে গিয়ে দূর সমুদ্রে পড়ে। প্রায় সমস্ত নাবিক এবং অফিসার অনাহারে বা scurvy রোগে মারা যায়। ধীরে ধীরে অবস্থা এমনি গুরুতর হয়ে ওঠে যে ১৭১৪ খৃষ্টাব্দে গ্রেট ব্রিটেনের সংসদ সমুদ্রে দ্রাঘিমাংশ নিরূপণ পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্যে ২০,০০০ পাউন্ড (আজকের মূল্যে প্রায় দেড় কোটি পাউণ্ড) পুরস্কার ঘোষণা করে এবং পুরস্কারের ব্যবস্থাপনার জন্য দ্রাঘিমা বোর্ড (Board of Longitude) তৈরি করা হয়।
ঘড়ি ও সঠিক দ্রাঘিমাংশ গণনা
চাঁদ পৃথিবীকে পরিক্রমণ করে। পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিক গতির নিয়মে, ভূপৃষ্ঠ থেকে মাপলে, বছরের দিন-ক্ষণ অনুযায়ী নানা গ্রহ এবং নক্ষত্র থেকে চাঁদের কৌণিক দূরত্বের হ্রাস-বৃদ্ধি দেখতে পাওয়া যায়। জ্যোতির্বিদরা মনে করলেন যে, কোনো বিশেষ স্থান (যেমন Greenwich মূল দ্রাঘিমা) থেকে সূর্য ও নানা গ্রহের সাপেক্ষে চাঁদের কৌণিক দূরত্বের বাৎসরিক পঞ্জিকা তৈরি করতে পারলে, তা দিয়ে মূল দ্রাঘিমার স্থানীয় সময়ের হিসাব পাওয়া যেতে পারে। যেমন, কালিকট-মুখী জাহাজের এক নাবিক ভারত মহাসাগরের বুকে থেকেই Greenwich-এর স্থানীয় সময় জানতে পারবে। সমুদ্রে নাবিক কোণ পরিমাপ যন্ত্র দিয়ে এই কোণগুলি মেপে এবং এই পঞ্জিকা দেখে নিজের অবস্থান থেকে মূল দ্রাঘিমার দূরত্ব গণনা করতে পারে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে জার্মান জ্যোতির্বিদ Tobias Mayer পৃথিবী, সূর্য এবং ৫টি গ্রহ থেকে চাঁদের কৌণিক দূরত্বের এই রকম বাৎসরিক পঞ্জিকা প্রকাশ করেন। এই পঞ্জিকা ব্যবহার করে মোটামুটি সঠিকভাবে (+/- ১/২ ডিগ্রি তারতম্যের মধ্যে) দ্রাঘিমাংশ নিরূপণ করা যেত (চিত্র ২, ছবিতে নাবিককে মঘা নক্ষত্র (Regulus) থেকে চাঁদের কৌণিক দূরত্ব মাপতে দেখা যাচ্ছে)।
চিত্র ২. Tobias Mayer-এর কৌণিক চান্দ্র-দূরত্ব পরিমাপ পদ্ধতি ও কোণ মাপক যন্ত্র Sextant
কিন্তু এই পদ্ধতির ব্যবহারের জন্য যে নিখুঁত কোণ মাপক যন্ত্র দরকার, তা সে সময়ে নির্মাণ করা সম্ভব ছিল না। এই সময় ইংরেজ Rev. Neville Maskelyne ইংলন্ডে এই পদ্ধতির মুখ্য প্রবক্তা হয়ে ওঠেন এবং ইংলন্ডের রাজকীয় মানমন্দিরকে সমুদ্রযাত্রার সুবিধার্থে বাৎসরিক চান্দ্রপঞ্জিকা প্রকাশ করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু এই চান্দ্র-দূরত্ব ভিত্তিক পদ্ধতি কৃষ্ণপক্ষে ব্যবহার করা যেত না। এ ছাড়াও এই পদ্ধতির গাণিতিক সূত্রগুলি ছিল দুরূহ। তার ওপর সমস্ত খুঁটিনাটি ধাপ পেরিয়ে দ্রাঘিমাংশ গণনা করতে প্রত্যেকবার অন্তত ৪ ঘন্টা সময় লেগে যেত।
বিজ্ঞানী এবং নাবিকদের কাছে এ কথা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে, একটি নিখুঁত ঘড়ি তৈরি করতে না পারলে দ্রাঘিমাংশ নিরূপণ সমস্যার কার্যকর সমাধান সম্ভব নয়। কিন্তু এ কাজের উপযুক্ত প্রযুক্তি তখনো ছিল না। সপ্তদশ শতাব্দীতে Galileo Galilei ছাদ থেকে দড়ি বা কাঠি দিয়ে ঝোলানো দোলকের (Pendullum) ধর্ম আবিষ্কার করেন। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গাণিতিক বিশ্লেষণ করে দেখান যে এ রকম দোলকের দোলনকাল (period of oscillation) কেবল ঝুলন্ত অংশের দৈর্ঘ্য এবং মাধ্যাকর্ষণ বল দিয়েই নির্ধারিত হয়। উপরন্তু তা স্থান কাল নির্বিশেষে প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। তবে তো এমন দোলকের ভিত্তিতে ঘড়ি নির্মাণ সম্ভব! এর পর প্রায় দুই শতক ধরে বহু দোলক ঘড়ি নির্মিত হতে থাকে এবং আজও হয়। Grandfather Clock বা Cuckoo Clock জাতীয় দোলক ঘড়ি আমাদের সকলেরই পরিচিত। কিন্তু এমন দোলক ঘড়ি সমুদ্রযাত্রায় সময় নির্ধারণ করার জন্যে যথেষ্ট নয় কারণ ঢেউয়ের তালে জাহাজের দুলুনি এবং ঝাঁকুনির কারণে দোলকের দোলনকালের হেরফের হতে পারে। এছাড়া ভূপৃষ্ঠে নানা জায়গায় তাপমাত্রার পরিবর্তনের সাথে তাপীয় সম্প্রসারণ বা সংকোচনের কারণে দোলকের লম্বমান কাঠির দৈর্ঘ্যও বদলে যাবে এবং দোলনকালে তারতম্য সৃষ্টি হবে। সমুদ্রে সঠিক দ্রাঘিমাংশ মাপার জন্য এমন ঘড়ির দরকার যা ৯০ দিনের সমুদ্রযাত্রায় যথাসম্ভব সঠিকভাবে (দিনে +/- ২.৮ সেকেন্ড তারতম্যের মধ্যে) Greenwich মূল দ্রাঘিমার সময় দেখাতে পারে। কঠিন কাজ। স্বয়ং Isaac Newton-ও এমন ঘড়ি নির্মাণের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন।
John Harrison, ক্রোনোমিটার ও দ্রাঘিমাংশ নিরূপণ
John Harrison ১৬৯৩ সালে ইংলন্ডের Yorkshire County-র Foulby গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সৎ বাবা পেশায় ছুতোর মিস্ত্রী ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তাই Harrison যন্ত্রবিদ্যায় কুশলী হয়ে ওঠেন এবং নানারকম উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচয় দেন। একবার তাঁর মা একটা বড়ো মাংসের টুকরো শিকে গেঁথে উনুনে রোস্ট করতে দিয়ে কাজে বেরিয়ে যান। বেরোবার সময় তিনি ছোট John-কে বলে যান শিকটিকে বারবার ঘোরাতে, যাতে রোস্ট একদিক থেকে বেশি পুড়ে না ওঠে। John তার বাবার কর্মশালা থেকে কিছু দাঁতওয়ালা চাকা (gear wheels) আর একটি পাখা দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে একটি কল তৈরি করে ফেলেন। উনুনের উর্দ্ধগামী গরম বাতাসের শক্তি রোস্ট করার শিকটিকে স্বয়ংচালিত করে দেয়। তাঁর মা ফিরে এসে দেখেন শিক ও মাংসখন্ড আপনা-আপনি ঘুরে যাচ্ছে এবং John নিজের মনে খেলায় মত্ত। ২০ বছর বয়েসে Harrison ইংলন্ডের সেরা লম্বা দোলক ঘড়ি (longcase clock) বানানোর কাজ আরম্ভ করেন। ঘড়ির দাঁতওয়ালা চাকা (gears) এবং অন্যান্য যন্ত্রাংশে কাঠের বদলে তিনি পিতল ও অন্য ধাতু ব্যবহার করেন। এই ঘড়িটির বিশেষত্ব এই যে, এতে দোলকের সাথে যুক্ত সেকেন্ড গোনার ও সেকেন্ডের কাঁটাকে এগিয়ে দেবার যন্ত্রাংশ (escapment) তৈরি করতে শক্ত কাঠ ও পরবর্তীকালে মণি (jewel) ব্যবহার করা হয়েছিল। ফলে ঘড়িতে বারবার তেল দেবার প্রয়োজন হতো না। দোলকের লম্বমান কাঠিতে কাঠ, পিতল বা লোহার বদলে তিনি পিতল এবং দস্তার পাত ব্যবহার করেন। এই পাতগুলি sandwich-এর মতো জোড়া করে একটি দ্বিধাতব দোলক (bimetallic gridiron pendulum) তৈরি হয়, যার দৈর্ঘ্য তাপমাত্রা হ্রাস-বৃদ্ধি সত্ত্বেও অপরিবর্তিত থাকতে পারে। এই অভিনব কৌশলের ফলে তাপমাত্রার সাথে দোলকের দোলনকালের তারতম্যের সমস্যা আর থাকল না।
১৭৩০ সালে Harrison দ্রাঘিমা নিরূপণ পুরস্কারের জন্য সমুদ্রযাত্রার উপযোগী ঘড়ি নির্মাণ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা মনস্থ করেন এবং London গিয়ে অগ্রগণ্য জ্যোতির্বিদ Edmond Halley-কে নিজের ঘড়ির নকশা দেখান। Halley তাঁকে ইংলন্ডের সেরা ঘড়ি নির্মাতা George Graham-এর কাছে পাঠান। Harrison-এর নকশা Graham-এর পছন্দ হয় এবং তিনি Harrison-কে নকশা অনুযায়ী ঘড়ি নির্মাণ করার জন্যে ৫০০ পাউন্ড ঋণ দেন। পাঁচ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ১৭৩৬ সালে Harrison-এর প্রথম সমুদ্রগামী ঘড়ি H1 ক্রোনোমিটার সমুদ্রযাত্রার জন্য প্রস্তুত হয় (চিত্র ৩)।
চিত্র ৩. John Harrison ও তাঁর প্রথম সমুদ্রগামী ঘড়ি H1 ক্রোনোমিটার
H1 ক্রোনোমিটারে Harrison লম্বমান দোলকের বদলে আনুভূমিক তলে দোদুল্যমান চাকা (balance wheel) ব্যবহার করেছিলেন। চাকাটির দোলন মাধ্যাকর্ষণ বলের বদলে একটি চুলের মতো সরু স্প্রিং (hairspring) দ্বারা সঞ্চালিত হতো। এর ফলে ঘড়ির দোলকের দোলনকালে জাহাজের উপর-নীচ দুলুনি-জনিত (pitching) হেরফের দূর করা সম্ভব হলো। ক্রোনোমিটারটি পরীক্ষা করা হলো Portsmouth থেকে Lisbon-গামী HMS Centurion নামের যুদ্ধজাহাজে। এই সমুদ্রযাত্রায় H1 ঘড়িটির আশাতীত ভালো ফল Harrison-কে কাজের স্বীকৃতি এনে দিলো।
H1-এর সাফল্যের পর দ্রাঘিমা বোর্ড Harrison-কে তাঁর ঘড়ি আরো উন্নত করার জন্যে পরপর দুবার ৫০০ পাউন্ড অনুদান দেয়, যা দিয়ে তিনি আরো উন্নত H2 ও H3 ক্রোনোমিটার প্রস্তুত করেন। এই দুটি ঘড়িতে তিনি দোলায়মান চাকায় (balance wheel) উল্লম্ব দোলকের দ্বিধাতু নির্মাণ পদ্ধতি কাজে লাগান। এ ছাড়াও তিনি ঘড়ির দাঁতওয়ালা চাকার অক্ষদণ্ডে (axle) ঘর্ষণ কমানোর জন্যে নতুন ধরণের roller bearing ব্যবহার করেন। ১৭৫১-৫২ নাগাদ Harrison তাঁর বৈপ্লবিক H4 ঘড়ি নির্মাণ করেন (চিত্র ৪)।
চিত্র ৪. John Harrison-এর H4 ক্রোনোমিটারের সম্মুখভাগ ও অভ্যন্তর
এই ঘড়িটির নকশায় বহু অংশে তাঁর উদ্ভাবন ক্ষমতার ছটা দেখা যায়। ঘড়ির মুখ্য চালিকা স্প্রিংয়ে তিনি একটি শঙ্কু আকারের fusee যোগ করেন, যার ফলে স্প্রিংয়ে দেওয়া দম ফুরিয়ে আসার মুখেও ঘড়ির চলন মন্থর হয়ে যেত না। দোলায়মান চাকার (balance wheel ) সঙ্গে যুক্ত সেকেন্ড গোনার নিয়ন্ত্রক যন্ত্রাংশে (escapement) তিনি হীরে ব্যবহার করেন যার ফলে ঘড়ির জীবনকালে বহুবার ধাতুর উপর আঘাত করা সত্ত্বেও সেটি ক্ষয়ে যেত না। ১৭৬১ থেকে ১৭৬৪ সালের মধ্যে HMS Tartar যুদ্ধজাহাজ বেশ কয়েকবার অতলান্তিক মহাসাগর পাড়ি দেয় এবং সেই যাত্রাপথে H4 ক্রোনোমিটার পরীক্ষা করা হয়। একই জাহাজে ছিলেন Rev. Neville Maskelyne, যিনি তাঁর চান্দ্র-কৌণিক পরিমাপ পদ্ধতি পরীক্ষা করছিলেন। যদিও দুজনের পদ্ধতি নির্ভুল প্রমাণিত হয়, তবু Maskelyene-এর পদ্ধতির অসুবিধাগুলি পরিষ্কার চোখে পড়ে।
দেশে ফিরে Maskelyne ইংলন্ডের রাজকীয় জ্যোতির্বিদ (Astronomer Royal) নিযুক্ত হন এবং দ্রাঘিমা বোর্ডের উচ্চপদে আসীন হন। তিনি Harrison-এর পদ্ধতি ও ঘড়ির নকশা বারবার বাতিল করে দেন এবং প্রতিবার Harrison পুরস্কারের অর্থ থেকে বঞ্চিত হতে থাকেন। প্রতারিত Harrison সহ্যের সীমায় পৌঁছে রাজা তৃতীয় George-এর কাছে দরবার করেন। রাজা দ্রাঘিমা বোর্ডের ব্যবহারে চরম বিরক্তি প্রকাশ করেন এবং Harrison-এর H5 ক্রোনোমিটার রাজপ্রাসাদে রেখে তিন মাস ধরে নিজে পরীক্ষা করেন। ঘড়ির ফলপ্রসূতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর রাজা Harrison-কে গ্রেট ব্রিটেনের সংসদে নিজের দাবির পিটিশন করতে বলেন এবং স্বয়ং সংসদকে Harrison-এর পিটিশন মঞ্জুর করার নির্দেশ দেন। রাজকীয় চাপে পড়ে সংসদ Harrison-কে ৮,০০০ পাউন্ড পুরস্কার দিতে স্বীকৃত হয়। এর তিন বছর পরে ১৭৭৬ সালে ৮৩ বৎসর বয়েসে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। তিনি তাঁর কাজের জন্য নানা সূত্রে জীবনে প্রায় ২৩,০০০ পাউন্ড অনুদান ও পুরস্কার পেয়েছিলেন, কিন্তু দ্রাঘিমা বোর্ড দ্বারা ঘোষিত ২০,০০০ পাউন্ডের পুরস্কার তাঁর কাছে অধরাই থেকে যায়।
সমুদ্রবিজয় গ্রেট ব্রিটেনের সাম্রাজ্য গঠন এবং বিস্তারের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। তার পেছনে ছিল প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ব্যাপক ভূমিকা। দ্রাঘিমাংশ নিরূপণকে বলা যেতে পারে সেই বৈপ্লবিক যাত্রাপথের প্রথম পদক্ষেপ, এক সামান্য ছুতোরের সন্তানের চরম উদ্ভাবনীশক্তিতে যা হয়ে উঠেছিল সহজবোধ্য, সহজপ্রযোজ্য আর দৈনন্দিন সমুদ্রযাত্রার সহায়। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে ভবিষ্যতের ব্রিটিশ জাতির বিভিন্ন রকমের বাণিজ্যপোত ও যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ প্রকৌশল এবং নৌযুদ্ধকৌশলের সুদীর্ঘ ঔপনিবেশিক ইতিহাস। সে আরো আরো চমকপ্রদ প্রযুক্তিগত আবিষ্কার কাহিনির অধ্যায়।
তথ্যসূত্রঃ
১) Longitude - The True History of a Lone Genius who Solved the Greatest Scientific Problem of his Time, Dava Sobel, Bloomsbury Publishers, USA, 2007, ISBN-10 0007790163.
২) John Harrison: the man who found longitude, Humphrey Quill, The Journal of Navigation, Volume 20, Issue 3, July 1967, John Baker Publishers, London.
৩) Encyclopedia Britannica.
৪) Wikipedia.
৫) 'Longitude' ছায়াছবি, নির্দেশনা Charles Sturridge, অভিনয়ে Jeremy Irons, Anna Chancellor, Emma Kay.