আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ● ১৬-২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮
প্রবন্ধ
ভার্চুয়াল কারেন্সিই কি অর্থনীতির ভবিষ্যৎ?
গৌতম সরকার
সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। সেই পরিবর্তন যদি মানবকল্যাণে সদর্থক ভূমিকা পালন করে তাহলে আমরা সাদরে গ্রহণ করি, অন্যথায় বর্জন করি। সমস্যা দেখা যায়, যখন কোনও একটি পরিবর্তন সমাজকল্যাণে সদর্থক না নঙর্থক কোন ভূমিকা পালন করবে সেই ব্যাপারে ধোঁয়াশা বা সংশয় সৃষ্টি হয়। সেক্ষেত্রে গ্রহণ বা বর্জন সিদ্ধান্তে আসার আগে অনেক চিন্তা-ভাবনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার হয়ে পড়ে। বিগত কয়েকবছর ধরে বিনিময় এবং বিনিয়োগের দুনিয়ায় একটি শব্দ খুব শোনা যাচ্ছে - 'ক্রিপ্টোকারেন্সি', যেটি একটি ডিজিটাল মুদ্রা। বর্তমান কাল হল প্রযুক্তির কাল, তাই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এবার কাগজী মুদ্রার অবলুপ্তি ঘটিয়ে আর্থিক দুনিয়ার সমস্ত রকম বেচাকেনা, বিনিয়োগ, বিনিময় ভার্চুয়াল বা কম্পিউটারের মাধ্যমে হওয়ার পথ দেখাচ্ছে এই ক্রিপ্টোকারেন্সি।
ইতিহাস
ক্রিপ্টোকারেন্সির ইতিহাস খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হয় বেশ কয়েক দশক আগে। ১৯৮৩ সালে ডেভিড চৌম নামের এক মার্কিন ক্রিপ্টোগ্রাফার ডিজিটাল উপায়ে টাকাপয়সা আদানপ্রদান নিয়ে প্রথম কাজ শুরু করেন। এর নাম দেন ই-ক্যাশ। ১৯৯৫ সালে ওই ব্যক্তি ডিজিক্যাশের মাধ্যমে একটি ক্রিপ্টোগ্রাফিক ইলেকট্রনিক পেমেন্ট ফরম্যাট তৈরি করতে সমর্থ হন, এবং কিছুদিনের মধ্যেই সফ্টওয়্যারের সাহায্যে নির্দিষ্ট এনক্রিপ্টেড কী ইনপুট করে ভার্চুয়াল উপায়ে 'পিয়ের-টু-পিয়ের' টাকা পাঠাতে সক্ষম হন। কিন্তু এরপর ব্যাপারটির অগ্রগতি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। ২০০৮ সালে অজানা এক গবেষক ইন্টারনেট ফোরামে একটি গবেষণাপত্র পাঠান যেখানে ক্রিপ্টোগ্রাফির সাহায্যে ডিজিটাল মুদ্রার আদানপ্রদান সংক্রান্ত তথ্য বিশদভাবে বর্ণনা করা ছিল। সেই লেখক তাঁর সমাধান পদ্ধতির নাম দেন 'ব্লকচেইন'। এই ব্লকচেইন অ্যালগোরিদম ব্যবহার করে প্রথম দিকে একটা কয়েন জেনারেট করতে কম সময় (৫ মিনিট) লাগলেও, সময়ের সাথে সাথে পদ্ধতির ডিফিকাল্টি লেভেল বাড়ে, আর ডিফিকাল্টির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে কয়েন প্রস্তুতির সময়। কখনও কখনও সেটা পনের থেকে তিরিশ দিন হয়ে যায়। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে সাতোশি নাকামোতো (আসল নাম গোপন রাখেন) নামের এক জাপানিজ 'বিটকয়েন' নামের ক্রিপ্টোকারেন্সি তৈরি করতে সক্ষম হন। এরপর ২০১১ সালে বাজারে আসে লাইটকয়েন, এটির লেনদেন বিটকয়েনের চেয়ে আরও দ্রুততর হয়। এই দ্রুততার কারণ হল এর পৃথকীভূত উইটনেস আর লাইটনিং নেটওয়ার্কের সুবিধা। ২০১৩ সালে ইথেরিয়াম চালু হয়, এর লেনদেন আরও দ্রুত হল এবং কয়েকদিনের মধ্যেই জনপ্রিয়তায় লাইটকয়েনকে ছাড়িয়ে গেল। বিটকয়েনের যেখানে একটা ব্লক তৈরি করতে ১০ মিনিট লাগে, ইথেরিয়ামের লাগে ১৫ সেকেন্ড আবার স্টেলার ব্লকচেইনে নতুন ব্লক যুক্ত হতে সময় লাগে মাত্র ৬ সেকেন্ড। এইভাবে নিত্যনতুন প্রযুক্তি আর ফর্মুলা নিয়ে হাজার হাজার কয়েন ক্রিপ্টোমার্কেটে যুক্ত হচ্ছে, যাদের মধ্যে অন্যতম হল - বিটকয়েন, ইথেরিয়াম, লাইটকয়েন, রিপল, মোনেরো, ড্যাশ, বাইটকয়েন, ডোজকয়েন ইত্যাদি।
ক্রিপ্টোকারেন্সি কী?
ল্যাটিন শব্দ 'ক্রিপ্টোস'-এর অর্থ হল লুকোনো। সুতরাং এটি হল একটি লুক্কায়িত এবং নিরাপদ মুদ্রাব্যবস্থা। এটি একটি সাংকেতিক মুদ্রা, যার কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই। শুধুমাত্র ইন্টারনেটেই এর অস্তিত্ব আছে। এই মুদ্রা দেশের সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক যোগান দেয় না। এই মুদ্রা সৃষ্টি হয় বিভিন্ন হার্ডওয়্যারের মাধ্যমে ইন্টারনেট-এ যুক্ত থেকে মাইনিং পদ্ধতির সাহায্যে। এই মাইনিং প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন জটিল অ্যালগোরিদম, ব্লক এবং ক্রিপ্টোগ্রাফির সাহায্যে একটি একটি করে কয়েন বানাতে হয়। সাধারণ মুদ্রার সঙ্গে ক্রিপ্টোকারেন্সির অনেক তফাৎ আছে। সাধারণ মুদ্রা যেমন, রুপি, ডলার, পাউন্ড, দিনার দেশভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয় এবং উৎপাদন এবং নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে থাকে। দেশের সরকার প্রয়োজনমতো নিজেদের কারেন্সি বাড়াতে কমাতে পারে। অন্যদিকে, ক্রিপ্টোকারেন্সি তৈরিতে সরকারের কোনও হাত নেই। এই সাংকেতিক মুদ্রা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জেনারেট করা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ওয়ানকয়েন সর্বোচ্চ ২.১ বিলিয়ন প্রস্তুত করা যাবে। তবে ডলার-পাউন্ডের মত ক্রিপ্টোকারেন্সির মূল্যও স্থির নয়, এর দাম বাজারের চাহিদা-যোগান শক্তির দ্বারা নির্ধারিত হয়।
বিটকয়েন উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কম্পিউটার সিস্টেমের সাহায্যে তৈরি হয়। এই প্রস্তুত প্রনালীকে বলা হয় 'মাইনিং', যার মূল চালিকা শক্তি হল GPU। মাইনিং যাঁরা করেন তাঁদের বলা হয় মাইনার। এঁরা কমিশনের ভিত্তিতে কাজ করেন। এঁদের কাজ হল যেসমস্ত বিটকয়েনের লেনদেন হয় তার ভ্যালিডিটি চেক করা। মাইনাররা যদি দেখেন ট্রানজ্যাকসন ঠিকঠাক তখন সেটা ভ্যালিডেট করে ব্লকে পাঠান। এইভাবে সমস্ত ভ্যালিড ট্রানজ্যাকসন নিয়ে তৈরি হয় ব্লকচেইন। বিটকয়েনের ব্লকচেইনে ১০ মিনিট পরপর একটা করে ব্লক তৈরি হয়। ১০ মিনিটের মধ্যে পৃথিবীর সমস্ত লেনদেন ওই ব্লকের মধ্যে এনক্রিপ্টেড হয়ে যায়। ব্লক দেখতে অনেকটা বাক্সের মতন, লেনদেন সংক্রান্ত যাবতীয় ইনফরমেশন, যেমন - লেনদেনের পরিমাণ, কোন ঠিকানায় টাকা পাঠানো হল ইত্যাদি এই বক্সে সংগৃহিত থাকে। এই ব্লকগুলো যায় মাইনারদের কাছে, যেটি তাঁরা ভেরিফাই করেন। ওই নির্দিষ্ট ১০ মিনিটের মধ্যে সারাবিশ্বের লেনদেনের কারণে যে ব্লকটি তৈরি হয় তার একটা নির্দিষ্ট অ্যাড্রেস থাকে যাকে 'হ্যাশ' বলা হয়। হ্যাশ হচ্ছে মূলত একটা আলফা নিউমেরিক সাইন বা সিগনেচার যেটি পুরো নেটওয়ার্কে একটাই মাত্র থাকে।
দুটো আলাদা আলাদা ব্লকের হ্যাশ কখনও একরকম হয় না, তাহলে ট্রানজ্যাকশন তাদের আইডেন্টিটি হারাবে। ব্লকের মধ্যে কোনও পরিবর্তন হলে আপনা-আপনি সেটা হ্যাশের মধ্যে চলে আসবে। তবে এই পরিবর্তন করা খুব ঝামেলার ব্যাপার। ব্লকগুলো স্বকীয় হলেও তারা পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকে। তাই প্রথম ব্লকের কোনও পরিবর্তন হলে সেকেন্ড ব্লকের হ্যাশও পরিবর্তিত হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় ব্লকটি ইনভ্যালিড হয়ে পড়বে। এইভাবে একটা ব্লক বা ট্রানজ্যাকশন বদলাতে চাইলে আগে-পরের সবকটা নেটওয়ার্ক সার্ভারের অ্যাপ্রুভাল নিতে হবে, যেটি কার্যত অসম্ভব। তাই কোনোভাবেই ব্লকের পরিবর্তন করা যাবে না। এই কারণেই ব্লকচেইন পারতপক্ষে কেউ হ্যাক করতে পারে না।
ক্রিপ্টোকারেন্সির সুবিধাঃ
১. এই মুদ্রার বিনিময় পিয়ের-টু-পিয়ের হওয়ার কারণে ব্যাংকের মধ্যস্থতার প্রয়োজন পড়ে না। ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে সরাসরি গ্রাহক-প্রেরকের মধ্যে বিনিময় সংগঠিত হয়। ব্লকচেইন ব্যবহৃত প্রযুক্তির কারণে কে কার কাছে ডিজিটাল মুদ্রা পাঠাচ্ছে সেটি সম্পূর্ণভাবে গোপন থাকে। অন্যদিকে এর এনক্রিপ্টেড লেজার সব ধরণের লেনদেনকে যেকোনো রকম ঝুঁকির হাত থেকে রক্ষা করে। এই মুদ্রাব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হল এর কোনোরকম কেন্দ্রীয় রূপ নেই, পুরোটাই বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে।
২. এই ব্যবস্থায় মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে মুদ্রা পাঠিয়ে দ্রব্য ও সেবা কেনা যেতে পারে। সাবেক ব্যবস্থায় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় এই বাণিজ্যে অনেক বেশি সময় লাগে। ক্রিপ্টোমুদ্রার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে মুদ্রা বিনিময় হারের কোনও ব্যাপার না থাকায় বিনিময় অনেক সহজ এবং দ্রুত হয়।
৩. এই মুদ্রার ত্বরিত গতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিটকয়েনের বিনিময়ে সর্বোচ্চ সময় লাগে ১০ মিনিট। সময়ের সাথে সাথে আরও দ্রুত গতিসম্পন্ন মুদ্রা বাজারে আসছে।
৪. এই মুদ্রা বিনিময়ের খরচ প্রায় নেই বললেই চলে। আর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল, পাঠানোর খরচ কত মূল্য পাঠানো হল তার ওপর নির্ভর করেনা। একটি লাইটকয়েন পাঠাতে যা খরচ হবে, এক লক্ষ লাইটকয়েনের ক্ষেত্রেও খরচ একই।
৫. ক্রিপ্টোমুদ্রার লেনদেন জাল করা যায়না। একবার লেনদেন হয়ে গেলে তাকে পরিবর্তন কিংবা ফেরত পাওয়া যায়না। ট্রানজ্যাকশনের সঙ্গে সঙ্গে তথ্য সারা বিশ্বের সমস্ত কম্পিউটার মেশিনে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।
৬. এই সাংকেতিক মুদ্রার সৃষ্টির কারণে মুদ্রাস্ফীতি হয় না। এই মুদ্রা একটি পূর্ব নির্ধারিত পরিমাণের বেশি তৈরি করা যায়না। যেমন বিটকয়েন সর্বোচ্চ ২.১ কোটি পর্যন্ত তৈরি করা যায়। অর্থাৎ কাগুজে মুদ্রার ক্ষেত্রে ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অতিরিক্ত টাকা ছাপালে দেশে মুদ্রাস্ফীতি অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে, যেটির সম্ভাবনা ক্রিপ্টোমুদ্রার ক্ষেত্রে নেই।
ক্রিপ্টোমুদ্রার অসুবিধাঃ
১. একটা সমস্যা হল ক্রিপ্টোমুদ্রা বিনিময় পদ্ধতিতে প্রাইভেট কী অনেক বড় হওয়ায় পাসওয়ার্ডটি খটোমটো হয়, তাই ব্যবহারকারীর পক্ষে মনে রাখা একটু সমস্যার হতে পারে। পাসওয়ার্ডটি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা খুব জরুরি।
২. ক্রিপ্টোমুদ্রা পুরোপুরি সুরক্ষিত সেই দাবি করা যাবে না। যে ফিজিক্যাল স্টোরেজে বিটকয়েন সংরক্ষিত থাকে সেটি চুরি যাবার সম্ভাবনা থেকে যায়। হ্যাকারদের ক্রিপ্টোমুদ্রা সংক্রান্ত জ্ঞান থাকলে সে স্টোরেজে সংরক্ষিত অন্যের বিটকয়েন ব্যবহার করতে পারে। ম্যালওয়্যারের সাহায্য নিয়ে বিটকয়েনের ফাইলগুলোর সন্ধান পেলে, সেই ম্যালওয়ার তথ্যগুলো নির্দিষ্ট গন্তব্যে পাঠাতে পারবে। তাই ক্রিপ্টোকারেন্সিকে বিনিময়ের একটি অন্যতম মাধ্যম করতে গেলে আরও অনেক প্রযুক্তিগত নিশ্ছিদ্রতা অবলম্বন করা জরুরি।
৩. বিটকয়েন বা যেকোনো সাংকেতিক মুদ্রার মূল্য অনেক বেশি অস্থির। একদিকে এই মুদ্রার যোগান নির্দিষ্ট, আর অন্যদিকে চাহিদার ক্রমাগত বৃদ্ধিতে দামের বৃদ্ধি খুব দ্রুতগতিতে হয়। তবে সত্যিই যদি এই মুদ্রা বিনিময়ের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে, তাহলে ভবিষ্যতে চাহিদা-যোগানের ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপারে সঠিক দিশা দেখানোর দায় অর্থনীতিবিদদের উপরে পড়বে।
ক্রিপ্টো মুদ্রাব্যবস্থার নিরাপত্তা
সাতোশি নাকামোতো লিখিত একটি প্রবন্ধ, "Bitcoin: A Peer-to-Peer Electronic Cash System"-তে বলা আছে, যতক্ষণ পর্যন্ত বিটকয়েন নেটওয়ার্কে সংযুক্ত বেশিরভাগ কম্পিউটার কোনও আক্রমণে সাহায্য করবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা সবচেয়ে লম্বা ব্লকচেইন তৈরি করবে এবং আক্রমণকারীদের থেকে অনেক এগিয়ে থাকবে। আপাতভাবে দেখতে গেলে বিটকয়েনের নিরাপত্তা খুব সংরক্ষিত। বিটকয়েন মাইনিং-এ হ্যাশ ফাংশন SHA-256 ব্যবহার করার কারণে এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই মজবুত। তবে একটা কথা ভুললে চলবে না প্রযুক্তিই প্রযুক্তিকে অতিক্রমের পথ দেখায়। তাই 'একশো শতাংশ নিরাপদ' বলে কিছু হয় না।
ক্রিপ্টোকারেন্সির সম্ভাবনা
বিশ্বের বাজারে ইতিমধ্যেই ক্রিপ্টোমুদ্রা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সরকারি তরফ থেকে একমাত্র এল সালভাদর ছাড়া কোনো দেশ এখনও পর্যন্ত এই মুদ্রাকে স্বীকৃতি না দিলেও বেসরকারি মহলে এর গুরুত্ব বাড়ছে। বিটকয়েন এবং অন্যান্য ডিজিটাল মুদ্রা দিয়ে এখন অনেক কিছুই কেনা যায়। যেমন, ওভারস্টক ডট কম থেকে বিটকয়েনের সাহায্যে যেকোনো দ্রব্য কেনা যায়। এরকম আরও অনেক অনলাইন পোর্টাল আছে যারা এই সমস্ত ভার্চুয়াল মুদ্রাকে স্বীকৃতি দেয়। অনেকের মতে ভবিষ্যতে নগদ টাকা এবং ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের পরিবর্ত হিসাবে এইসমস্ত সাংকেতিক মুদ্রা ব্যবহৃত হতে চলেছে।
সিলিকন ভ্যালি ভিত্তিক ভেঞ্চার ফার্ম Andressen Horowitz-এর সহ প্রতিষ্ঠাতা মার্ক অ্যান্ড্রেসেন নিউইয়র্ক টাইমসে একটি উত্তর সম্পাদকীয় 'Why Bitcoin Matters' প্রবন্ধতে বলেছেন, বিটকয়েনের জনপ্রিয়তার একটি বিশাল বড় লাভবান ক্ষেত্র হচ্ছে আন্তর্জাতিক রেমিটেন্স। প্রতিদিন শতশত মিলিয়ন মানুষ অন্যদেশে উপার্জন করে নিজ নিজ দেশে বসবাসকারী আত্মীয়-পরিবারকে অর্থ পাঠান। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, এইভাবে প্রতি বছরে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স বাবদ অর্থের লেনদেন হয়। ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই কাজ বাবদ দশ শতাংশ বা তার বেশি ফি বা সার্ভিস চার্জ কেটে নেয়। এখন বিটকয়েনের মাধ্যমে অর্থ পাঠালে প্রেরককে কোনও ধরণের ফি দিতে হবে না, বা প্রসেসিং ফি বাবদ ন্যূনতম অর্থ দিতে হবে। তাই অদূর ভবিষ্যতে বিটকয়েন এই সমস্ত বিনিময়ের একমাত্র মাধ্যম হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ভারতে ক্রিপ্টোকারেন্সি কতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে
ভার্চুয়াল কারেন্সি ইতিমধ্যেই ভারতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেনের উপর ২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল, ২০২০ সালে সুপ্রিম কোর্ট সেটি খারিজ করে দেয়। এরপরই ভারতীয়দের মধ্যে এই মুদ্রা কেনাবেচার ধুম লেগে যায়। শুধু বিটকয়েন নয়, ভারতীয় বাজারে ইতিমধ্যে ডোজিকয়েন, লাইটকয়েন, ইথেরেনিয়ামের মত ক্রিপ্টোমুদ্রাগুলি এসে গেছে। এই মুদ্রার কেনাবেচা শেয়ার বাজারের চেয়ে আলাদা, নিয়মনীতি অন্যরকম এবং ঝুঁকির মাত্রাও অনেক বেশি। তদুপরি প্রায় দেড় কোটি ভারতীয় ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করেছেন। তথ্য বলছে, ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে আমাদের দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ ছিল ৯২ কোটি ৩০ লক্ষ ডলার, ২০২১ সালের মে মাসে সেই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬,৬০০ কোটি ডলার। ভুললে চলবে না এই সময়কালটি ছিল করোনাক্লিষ্ট দুর্দিন, যে সময়ে বিশ্বের সমস্ত দেশ আর্থিক মন্দার চরম সংকটের মধ্যে দিয়ে গেছে। ভারতের সর্ববৃহৎ 'ক্রিপ্টো প্ল্যাটফর্ম' 'CoinSwitch Kuber' ২০২০ সালের জুন মাসে বাজারে আসে, ইতিমধ্যেই এর অ্যাক্টিভ ইউজারের সংখ্যা ৬০ লক্ষ পেরিয়ে গেছে। এই তথ্যগুলোই ভারতে ক্রিপ্টোমুদ্রার জনপ্রিয়তার পক্ষে সওয়াল করছে। বয়স ও লিঙ্গ নির্বিশেষে ভারতীয়রা দিনদিন প্রযুক্তি ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠছেন এবং তাঁরা বুঝতে পারছেন দুনিয়া যেদিকে যাচ্ছে আগামী দিনে ভার্চুয়াল কারেন্সিই বাণিজ্য ও বিনিময় ব্যবস্থার কান্ডারী হতে চলেছে। তাই ক্রিপ্টোমুদ্রা লেনদেনে ভারত রীতিমতো আমেরিকা-ব্রিটেনের মত দেশগুলির সাথে পাল্লা দিচ্ছে। একটি সূত্র বলছে, আমেরিকায় এই মুহূর্তে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারকারীর সংখ্যা হল ২ কোটি ৩০ লক্ষের কাছাকাছি, যেখানে ব্রিটেনে এই সংখ্যা ২৩ লক্ষ। অর্থাৎ ভারত ব্রিটেনকে অনেক পিছনে ফেলে আমেরিকার সাথে রীতিমতো টক্কর দিচ্ছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে ক্রিপ্টোকারেন্সির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে কেন্দ্র। যদিও এক্ষুনি এই সাংকেতিক মুদ্রাকে লেনদেনে অর্থাৎ 'মিডিয়াম অফ এক্সচেঞ্জ' হিসাবে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই, তবে এই মুদ্রা সোনা, শেয়ার বা বন্ডের মত কেনাবেচার অনুমতি মিলতে পারে। আসলে ক্রিপ্টোকারেন্সির ক্ষেত্রে লেনদেন 'পিয়ার-টু-পিয়ার' হওয়ায় এখানে কোনো তৃতীয় পক্ষের ভূমিকা থাকেনা। তাই ইচ্ছে করলেও এর চাহিদা-যোগান নিয়ন্ত্রণের কোনোরকম সুযোগ সরকারের থাকবে না। এটাই কেন্দ্রের মাথাব্যথার কারণ। কেন্দ্রের আশঙ্কা এই কারেন্সির মাধ্যমে অবাধে বেআইনি লেনদেন চলবে যেখানে প্রশাসন কিছু করতে পারবে না। এই ব্যাপারে আলোচনার জন্য কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক সচিবের নেতৃত্বে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি তৈরি করা হয়েছে। যে কমিটি সরকারকে প্রাথমিক রিপোর্টও পেশ করেছে। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, কেন্দ্র স্বনিয়ন্ত্রিত ভার্চুয়াল মুদ্রা চালু করতে পারে, কিন্তু বেসরকারি ক্রিপ্টোকারেন্সি 'নৈব নৈব চ'। এদিকে কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর একটি বিবৃতিতে জানিয়েছেন, "যেকোনো নতুন ভাবনাকে আমাদের খোলা মনে ভালভাবে যাচাই এবং উৎসাহ প্রদান করা উচিত। ব্লকচেইন একটি উদীয়মান প্রযুক্তি। ক্রিপ্টোকারেন্সি হল ডিজিটাল মুদ্রা। আগামী দিনে ভারতীয় অর্থনীতিতে এই মুদ্রা কি ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে সেটি গভীরভাবে বিশ্লেষণ প্রয়োজন। "তবে বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, ক্রিপ্টোমুদ্রার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভারত সরকার খুব শীঘ্রই একটি বিল আনতে চলেছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই সেই বিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় পেশ করা হতে পারে। জানা গিয়েছে, সরকারি অনুমতি পেলে এইসব ক্রিপ্টোমুদ্রার লেনদেনের উপর নজরদারির জন্য 'সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (SEBI)’-কে দায়িত্ব দেওয়া হবে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কিছু নেওয়া হয়নি, এব্যাপারে সরকার ধীরে চলো নীতি অবলম্বন করছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের সমস্ত দেশকে 'ক্রিপ্টোকারেন্সি' নিয়ে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এমাসেই 'দ্য সিডনি ডায়ালগ'-এ ভারতের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও বিবর্তন সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেছেন, "এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে সমস্ত গণতান্ত্রিক দেশ যাতে ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে একযোগে কাজ করে এবং এই কারেন্সি ভুল হাতে পড়ে যুব সম্প্রদায়কে যাতে বিপথে চালিত না করে, তা নিশ্চিত করা।" এরপর তিনি আরও বলেন, "আমরা এখন এমন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যখন প্রযুক্তি এবং তথ্য নতুন হাতিয়ার হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে সতর্ক থাকা খুব জরুরি।" রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর শক্তিকান্ত দাস সম্প্রতি একটি আলোচনায় বলেছেন, "ক্রিপ্টোমুদ্রা এই মুহূর্তে আর্থিক স্থিতিশীলতার দিক থেকে আমাদের কাছে উদ্বেগের বিষয়। কীভাবে এই সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে সেই সংক্রান্ত বিশদ পরামর্শ আমরা ইতিমধ্যেই সরকারকে দিয়েছি। সরকার এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।"
ডিজিটাল দুনিয়ায় দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে সবকিছু। এর প্রভাব থেকে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থাও রক্ষা পাচ্ছে না। ডিজিটাল এই যুগ দেশের সার্বভৌমত্ব, প্রশাসন প্রণালী, নীতি নির্ধারণ, অধিকার ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রতিমুহূর্তে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি সেরকম একটি উদাহরণ। তবে তথ্য বলছে, ডিজিটাল কারেন্সিই ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক দুনিয়া শাসন করবে, ভারত তার ব্যতিক্রম হবে না। আধুনিক ভারত সোনায় টাকা খাটানোর রক্ষণশীল মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে ক্রিপ্টোকারেন্সির দিকে ঝুঁকছে। প্রথাগত সুরক্ষিত বিনিয়োগ নয়, ঝুঁকিবহুল বিনিয়োগের নতুন দুনিয়ায় পা রাখতে ভয় পাচ্ছেন না ভারতীয় নব্য বিনিয়োগকারীরা। এই কমবয়সী ভারতীয়দের কাছে এখন আর 'Old is Gold' নয়, বরং এই জমানার বিশ্বাস 'Gold is old'. তবে পরিবর্তনকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি সচেতন ও সাবধান থাকাটাও খুব জরুরি। কারণ ভুললে চলবে না, একটি গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শক্তি হল তার স্বচ্ছতা এবং খোলামেলা পরিবেশ। একইসাথে প্রশাসনকে এটাও নিশ্চিত করতে হবে যাতে করে কেউ কোনোভাবেই সেই স্বচ্ছতার অপব্যবহার করতে না পারে।