আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ● ১৬-২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮
প্রবন্ধ
গ্লাসগো সম্মেলনঃ কী পেলাম?
শুভাশিস মুখোপাধ্যায়
জাতিসঙ্ঘের আনুকুল্যে প্রায় বছর বছর বিশ্বের ধনী দরিদ্র দেশ নির্বিশেষে রাষ্ট্র নায়ক, রাজনৈতিক কর্মী,পরিবেশ নিয়ে চিন্তিত সচেতন নাগরিক সহ বিশ্বের ঝানু ব্যবসাদার বণিক-শ্রেষ্ঠীবৃন্দ, অনেক বিদেশী সাংবাদিকদের বর্ণনায় 'ডিসেন্ডস ইন্টু', বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মিলিত হয়। উদ্দেশ্য স্পষ্টতই মহৎ, বিশ্বের নাগরিকদের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ, আনন্দময় জীবনযাপন নিশ্চিত করা, অবশ্য তা কিঞ্চিৎ ব্যবসার বিনিময়ে এবং সম্মেলনের উদ্দেশ্যের সঙ্গে বিরাট মাপের সমঝোতা করে। অন্যদিকে, বিশ্বের সচেতন নাগরিকরা এই একই জমায়েতকে ব্যবহার করতে চান মানুষের, জীবজগতের এবং পরিবেশ-প্রতিবেশের মধ্যে নষ্ট হয়ে যাওয়া ভারসাম্য পুনঃসংস্থাপন করার কাজে। সেই মহাসম্মেলন এবার অনুষ্ঠিত হলো ইংল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে, চলতি বছরের নভেম্বর ১ থেকে ১২।
গত কয়েকটি এই জাতীয় সম্মেলনের শহরগুলিতে আমরা দেখেছি, এই জাতীয় সম্মেলনের প্রাক্কালে সেই দেশে এবং সেই শহরে প্রবল শ্রমিক ও জনবিক্ষোভ। বিক্ষোভকারীরা শ্লোগান তুলেছেন যে 'নয়া উদারনীতিবাদ' এবং 'কাঠামোগত পুনর্গঠন' যেমন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুঁজির বিশ্বায়নের মাধ্যমে শ্রমের বিরুদ্ধে পুঁজির লাগামহীন শোষণ বৈশ্বিক স্তরে ছড়িয়ে দিয়েছে, ঠিক তেমনি পুঁজির কবলে বিশ্বের পরিবেশ-প্রতিবেশের অপূরণীয় ও অ-প্রত্যাহারযোগ্য ক্ষতি নিয়ে বিশ্বের জনগণের প্রতিবাদীকণ্ঠকে পুঁজির তরফে স্তব্ধ করে দেওয়ার বৈশ্বিক প্রচেষ্টা হলো এই জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে 'সদিচ্ছা' জ্ঞাপনের প্রক্রিয়া। তাই এই বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে শ্রমের সংহত প্রতিবাদ জরুরি। এই একই ঘটনা আমরা দেখেছি কানকুন, বন, দোহা-তে, এখন দেখলাম গ্লাসগোতে। গ্লাসগোতে একযোগে ধর্মঘটে সামিল হন সাফাই কর্মী সহ পরিবহন কর্মীদের একাংশ। দোসর পুঁজি এবং এবং ভাই-বেরাদরদের কাছে সম্মানহানীর আশঙ্কায় অতি দ্রুত সরকার এবং মালিকপক্ষ খানিকটা হলেও শ্রমিকদের অনুকুলে ফয়সালা করতে বাধ্য হয়। অন্তত পুঁজির একচেটিয়া আক্রমণের বিরুদ্ধে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন যে এখনও অন্যতম এক বিকল্প, তা বিশ্বের জনগণ পুঁজির এই সর্বব্যাপী জয়যাত্রার যুগেও প্রত্যক্ষ করলেন।
১৯৯২-তে 'বসুন্ধরা বৈঠক' নামে এক আন্তর্জাতিক স্তরের সম্মেলনে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ ব্রাজিলে বৈশ্বিক স্তরে পরিবেশ-প্রতিবেশের বেহাল অবস্থা নিয়ে সক্রিয় ভাবে কিছু করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে মিলিত হয়। সম্মেলনের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়, “to reconcile worldwide economic development with protection of the environment.” বা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে, তার সঙ্গে কোনও বিরোধ না বাধিয়ে কীভাবে বৈশ্বিক স্তরে পরিবেশ-প্রতিবেশ সংরক্ষণ করা যায়। সেই সম্মেলনের একটি রিপোর্টের একটি পাদটীকায় প্রথমবারের জন্য 'জলবায়ু পরিবর্তনের মতো' এক বৈশ্বিক বিষয়ে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জন্য প্রয়াসী হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। সেই হলো এই সব মহা সম্মেলনের মূল বিষয় হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে বিচারের মধ্যে আনার শুরু।বিশ্ব উষ্ণায়নকে জলবায়ু পরিবর্তনের মুখ্য কারণ হিসেবে বলে, বৈশ্বিক স্তরে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে চিহ্নিত করে এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ কমিয়ে এনে বা সেই বৃদ্ধির হারকে শূন্যে পরিণত করার পদ্ধতির অনুসন্ধান করা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। জীবাশ্ম-জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যবহার বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড-এর পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়ছে, যাকে বিশ্ব উষ্ণায়ন বলা হলো। যে সব গ্যাস এই উষ্ণায়নের জন্য দায়ী, সেই উষ্ণতা-বর্ধক গ্যাসের মধ্যে কার্বন ডাইঅক্সাইড বাড়ার মুখ্য কারণ অতি-শিল্পায়না। অতি-শিল্পায়নকে বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন কয়লা, খনিজ তেল ইত্যাদি কার্বন-ভিত্তিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রের লাগাম-ছাড়া বৃদ্ধি এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড-এর বায়ুমণ্ডলে নির্গমন। বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন মানেই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং এর কারণ বিশ্ব উষ্ণায়ন - এই দুই চিহ্নিতকরণ কয়েকটি অতি সরলীকৃত স্বীকারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। বিশ্বের সব বিজ্ঞানী এমন সরল কার্য-কারণ সম্পর্কে বিশ্বাসী নন। কিন্তু জাতিসংঘের এই উদ্যোগে সেই সব বিজ্ঞানীরাই সামিল, যাঁরা এই সরল কার্য-কারণ সম্পর্কে বিশ্বাসী। জাতিসংঘ বলেই দিয়েছে যে তারা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে 'গণতন্ত্র'-এ বিশ্বাসী, অর্থাৎ বিজ্ঞানীদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতই 'বিজ্ঞান-সম্মত'। অথচ বিজ্ঞানের ইতিহাস দেখাচ্ছে যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সংখ্যালঘিষ্ঠ মতামতটাই আসলে সত্যি, রাষ্ট্রচালনার গণতন্ত্রের ধারণা প্রকৃতি বা পরিবেশ বিজ্ঞানে অচল। পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন মানেই উষ্ণায়ন, আর এই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী কার্বন ডাইঅক্সাইড। এই সরলীকৃত ধারণা থেকে নিদান এসেছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা কমানো; আমাদের বিভিন্ন কাজকর্মের ফলে উদ্ভূত কার্বন ডাইঅক্সাইড বায়ুমণ্ডলে নির্গমনের পরিমাণ কমানোর। বায়ু দূষণ কমানোর এটা যে শ্রেষ্ঠ পন্থা, এই নিয়ে কোনও বিরোধ নেই।
এই বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত অধিবেশন প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় যার প্রথম অধিবেশনটি বসে জার্মানির বার্লিনে, ১৯৯৫-এ। ১৯৯৭-তে জাপানের কিয়োতো শহরের অধিবেশনে পৃথিবীর কর্তাব্যক্তিরা বিশ্বের দেশগুলিকে 'শিল্প-সমৃদ্ধ' এবং 'উন্নতিকামী দেশ', যারা এখন 'উন্নতি'-র পথে হাঁটছে, এমন সরলভাবে বিভক্ত করেন। প্রথম দলের সিদ্ধান্তঃ যে তারা ১৯৯৭ সাল থেকেই এমন সব পদ্ধতি নেবে যার ফলে আগামী দশ বছরে তারা ১৯৯০ সালে বিশ্বের বায়ুমণ্ডলে যে পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমন করছিলো, অতঃপর তারা আগামী দশ বছরে তার চেয়ে ৫ শতাংশ কম পরিমাণ এই গ্যাস বাতাসে ছাড়বে। অন্য দলটি এই কাজ করতে খানিকটা সময় পাবে।
পাঁচ বছরের এক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে বৈশ্বিক স্তরে এই কিয়োতো বিধি চালু হয়। স্থির হয় যে ২০০৮ থেকে ২০১২, এই সময়কালে বিশ্ব উষ্ণায়নের হার কমিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যার মোকাবেলা কতটা করা গেলো, তার পর্যালোচনা করা হবে ২০১৩ সালের অধিবেশনে। নানা কথার মারপ্যাঁচ, বিক্ষোভ, খসড়া প্রস্তাবের পর খসড়া প্রস্তাব, নতুন মুসাবিদা করা হলেও ওয়ারশ শহরে অনুষ্ঠিত এই অধিবেশনের সিদ্ধান্ত - কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সারা পৃথিবীর বহুজাতিক কর্পোরেশন ও অন্যান্য আর্থিক লেনদেনকারী সংস্থাগুলির কথা ছিল পরিবেশ-প্রতিবেশকে অগ্রাধিকার দিয়ে আপাতত ব্যবসায়িক স্বার্থকে একটা সীমার মধ্যে রেখে পরিবেশ-বান্ধব বৈশ্বিক পদক্ষেপ করা। কিন্তু আমরা জানি, ১৮৪৮ সালে একজন দার্শনিক ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে, পুঁজি মানবজাতির যাবতীয় ক্রিয়াকলাপকে মুনাফার ক্ষেত্রে পর্যবসিত করবে। সেই ভবিষ্যৎবাণীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই এই সব সম্মেলনে ব্যবসায়ী এবং অর্থ লগ্নিকারী সংস্থাগুলির প্রতিনিধিবৃন্দ কিয়োতো বিধিকে ব্যবহার করে 'কার্বন ট্রেডিং' নামে এক অতিমুনাফার ব্যবসায়ে লিপ্ত হয়েছে, যার ফলে বৈশ্বিক স্তরে নিট কার্বন নির্গমন বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এই 'কার্বন ট্রডিং'-এর অন্যতম ক্ষেত্র ছিল স্পঞ্জ আয়রন কারখানাগুলি, আর কার্বন নির্গমন কমানোর নামে দেশের ক্ষেত্রে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের আড়ালে অনভিপ্রেত ভূমি-উচ্ছেদ, বনাঞ্চল ধ্বংস।
২০১৫-তে প্যারিস শহরে অনুষ্ঠিত এমনই একটি অধিবেশনের সিদ্ধান্ত - যদিও কিয়োতো বিধি তার অভিপ্রেত ফল দেয়নি, কিন্তু সেই বিধি মতে আবারও এক 'শেষ চেষ্টা' করা হোক যাতে ২০২০ সালের মধ্যে উষ্ণতা-বর্ধক গ্যাস বাতাসে কমানোর ক্ষেত্রে যদি কিছু অর্জন করা যায়। কথা ছিল, কিয়োতো বিধি মতে 'উন্নত' দেশগুলি ২০০৫ সালের মধ্যে বায়ুমণ্ডলে তাদের তাদের কার্বন নির্গমনের হার ১৯৯০ সালের নির্গমনের মাত্র ৫ শতাংশ কমাবে, কিন্তু তারা সেই সামান্য পরিমাণও কমায়নি। নানা কায়দায় তারা উচ্চ হারে কার্বন নির্গমন করে গেছে এবং এই সমস্যাটিকে একটি আর্থিক লগ্নির ক্ষেত্র করে তুলে বিপুল পরিমাণে আর্থিক মুনাফা করেছে। এই একই কারণে আরও নতুন লগ্নির ক্ষেত্রের খোঁজে তারা প্যারিসে হাজির হয়। এবারে দৃশ্যমান কেলেঙ্কারি চাপা দেওয়ার জন্য প্যারিসে তারা আরও অনেক বেশি কিছু করার জন্য আরও নতুন লগ্নি, লগ্নির আরও কিছু ক্ষেত্রের জন্য চাপ দিয়ে সেগুলি আদায় করে। প্যারিস সমঝোতাতে পৃথিবীর সব দেশকে বরাবর করে দিয়ে কর্পোরেশনগুলোর লগ্নির ক্ষেত্র আরও অনেকটা প্রসারিত করার ব্যবস্থা হয়। প্যরিসের ঘোষণার লক্ষ্য হয়ে গেলো আরও বিস্তৃত - যা করলে শিল্প-বিপ্লবের যুগের তাপমাত্রার চেয়ে বর্তমান তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে বেঁধে ফেলা যায়; এমন দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে ক্রমে ক্রমে সেই বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম হয়। ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতিটি দেশ যে পরিমাণে কার্বন ডাইঅক্সাইড বায়ুমণ্ডলে ছড়াবে, তা এখন নির্ধারণ করবে সেই দেশগুলি, এই বিষয়ে কোনও আন্তর্জাতিক চাপ থাকবে না!
কতটা কী হলো, তার বিচার হলো ২০২১ সালে, গ্লাসগো-তে, যে সম্মেলনের পর এই সম্মেলন থেকে কী পাওয়া গেলো, বিশ্বের পরিবেশ-পীড়িত জনগণ কী পেলেন আর ব্যবসায়ীদের নতুন কী কী অর্জন হলো, তা নিয়ে বাদানুবাদ চলছে, যা পরবর্তী মিশর সম্মেলন পর্যন্ত জারি থাকবে আশা করা যায়।
বলাই বাহুল্য, পৃথিবীর বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই মনে করেন যে আচমকা এতোটা তাপমাত্রা কমানো দুটি মূল কারণে এতো দ্রুত হওয়া বাস্তবত অসম্ভব। বিজ্ঞান-সম্মত উপায়ে এই দুই লক্ষ্যমাত্রা প্রস্তাবিত সময়ে করার মতো বিজ্ঞান ও কারিগরি দক্ষতা এখনও আমদের হাতে নেই। আর বিশ্বের ব্যবসায়ী লবি তাদের এই সংকটাপন্ন অবস্থায় স্বার্থহীনভাবে মুনাফার হার কমিয়ে দেবে, তা পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়মমতেই সম্ভব নয়। অন্য আর একটি মত - পৃথিবীর সব দেশ যদি তাদের প্যারিস সমঝোতা অনুসারে দায়বদ্ধতা পালন করেও, তবুও এই শতাব্দীর শেষে বৈশ্বিক স্তরে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়বে প্রায় ২.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস; জাতিসংঘের জলবায়ু পরিববর্তন অধিবেশনের অনুমান - বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
যথাযথ কারিগরির অনুপস্থিতিতে অপ্রমাণিত নানান ফিকিরে আর্থিক লগ্নির পেছনেই পৃথিবীর প্রায় সব দেশই ছুটে কোথাও লগ্নি করেছে 'তাপমাত্রা কমানোর জন্য সামাজিক উদ্যোগ', কোথাও তা এসেছে 'পরিচ্ছন্ন ও সবুজ প্রযুক্তির রূপায়ণ'-এর নামে। আর্থিক লগ্নির পরিমাণ, স্বভাবতই বিপুল, এই সব কাজ করার জন্য পৃথিবীতে একাধিক বড় মাপের নতুন স্টক এক্সচেঞ্জ চালু হয়েছে, আমাদের দেশের স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া এই জাতের এমন একাধিক এক্সচেঞ্জের অংশীদার।
এই প্রেক্ষিতেই অনুষ্ঠিত হলো নভেম্বর ২০২১-এ গ্লাসগোতে জাতিসংঘের জলবায়ুর পরিবর্তন সংক্রান্ত ২৬তম অধিবেশন। এই অধিবেশন বিচার করা হলো, প্যারিস সমঝোতা অনুসারে বৈশ্বিক স্তরে দেশগুলির যে যে কাজ ২০২০ সালের মধ্যেই সম্পন্ন করার কথা ছিল, তার কে কতটা করেছে! এই সম্মেলনের ভিত্তি জাতিসংঘের যে রিপোর্টটি, সেই রিপোর্ট তৈরির সময় পৃথিবীর মুখ্য ১৫টি দেশ, যেমন মার্কিন দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রাজিল, চীন, ভারত, ইংল্যান্ড ইত্যাদি দেশগুলিকে হিসেবে আনা হয়েছে। এই রিপোর্টের মতে, সারা পৃথিবীর প্রবণতা হলো তারা জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন ও ব্যবহার, এই দুই বিষয় মিলিয়ে ২০১৫ সালের সাপেক্ষে ২০৩০ সালের মধ্যে ১১০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্য ধার্য করেছে। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে শক্তি চাহিদায় যে ঘাটতি দেখা দেবে বা এখনই দিয়েছে, তা পূরণ করার করার কোনও বাস্তব পদক্ষেপ তারা এখনও করেনি; যদি তারা এখনই তা করে তবে সেই চাহিদার ঘাটতি পূরণ হতে পারে ২০৪৫ সাল নাগাদ। অর্থাৎ, বাস্তবত আমরা সেই প্যারিস সমঝোতার সময়কালেই আটিকে আছি, গ্লাসগো-তে এই একই কাজ করার পাশাপাশি আরও অনেক বেশি কাজ করার জন্য বরাদ্দ সময় বাড়ানো হয়েছে মাত্র। নিট কার্বন নির্গমন কমানোর যে লক্ষ্য নিয়ে সারা পৃথিবীর অনেক ছোটো দেশ, যারা প্রতিবেশের ক্ষতিতে এখনই ব্যতিব্যস্ত এবং বিশ্বের আন্দোলনরত কর্মীদের এক বড়ো অংশ মুখর, গ্লাসগো সম্মেলন তাদের হতাশ করেছে। কার্বন ভিত্তিক শক্তি উৎপাদন বন্ধ করার যে প্রস্তাব ছিলো, সম্মেলনের শেষ দিনে ভারত এবং চীনের প্রস্তাব, যা গৃহীত হয়েছে, তা সেই আশায় ছাই দিয়েছে। এই সম্মেলনও সদর্থক ও সক্রিয় পথ গ্রহণের পরিবর্তে অনুরোধ, উপরোধ ও 'সদিচ্ছা'-কেই অর্জন বলে দাবি করেছে।
পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং বিশ্বের যে নাগরিকরা প্রতিবেশ বিপর্যয় নিয়ে চিন্তিত, তাদের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে, শিল্প ও বাণিজ্যের কথা মাথায় রেখে পৃথিবীর সব দেশই আগামী দশ বছরে ২০১৫ সালের সাপেক্ষে ২৪০ শতাংশ বেশি কয়লা, ৫৭ শতাংশ বেশি খনিজ তেল, ৭১ শতাংশ বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করবে বলে সিদ্ধান্ত করেছে। বাণিজ্যিক রপ্তানি ও শিল্প বজায় রাখার তাগিদে প্রাকৃতিক গ্যাস সমৃদ্ধ দেশগুলির প্যারিস সমঝোতায় সই দিয়েও তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত ছিলো - প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন ক্ষমতা তারা ক্রমাগত বাড়াবে, সেই মর্মে লগ্নি করা, এই ক্ষেত্রের উৎপাদন ২০৩০ থেকে ২০৪০ সময়কালে বহুগুণ বাড়ানো। ফল - বৈশ্বিক স্তরে কার্বন নির্গমন কমার পরিবর্তে বাড়বে। তাই গ্লাসগো সম্মেলনকে 'পর্বতের মূষিক প্রসব' বলা যায়, এর বাইরে আম জনতার প্রাপ্তি প্রায় নেই, আর কিছু প্রত্যাশা না থাকাই শ্রেয়।