আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ● ১৬-২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলন ও কিছু ভাবনা

শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার


সিপিআই(এম)-এর সম্মেলন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সম্মেলনের প্রধান কাজ, নিজের মুখোমুখি দাঁড়ানো। ব্যক্তি হিসেবে এবং সাংগঠনিকভাবেও। কিন্তু সেটাই সবচেয়ে কঠিনতম কাজ। বিরোধী রাজনৈতিক দলের সহিংস বিরোধিতার মুখোমুখি হতে বা রাষ্ট্রের আক্রমণের মুখে দাঁড়াতে সাহসের প্রয়োজন ঠিকই। কিন্তু সবচেয়ে বেশি সাহসের প্রয়োজন নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে। এটাই যদিও হওয়ারই কথা কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনগুলিতে। কিন্তু এই কাজটি সত্যিই সম্মেলনে হয়ে থাকে এ কথা যিনি বলবেন তিনি আর যাই হন সত্যভাষী নন।

এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এরিয়া স্তরের সম্মেলনগুলি চলছে। এই স্তরের সম্মেলনের সফল হওয়ার ওপর নির্ভর করছে সার্বিকভাবে পার্টির সম্মেলন প্রক্রিয়া কোনো নতুন দিশা দেখাতে পারবে কিনা। এটা বলার কারণ এটাই, এই এরিয়া স্তর যা আগেকার লোকাল ও জোনালের একটি মধ্যবর্তী পর্যায়, সেখানেই যাবতীয় ভালো এবং মন্দের সারাৎসার নিহিত রয়েছে। এই এরিয়া স্তরটি আগেকার লোকাল ও জোনালের সব বৈশিষ্ট্যই ধারণ করছে। এই স্তরে যেখানে যেখানে গণ্ডগোল সেখানে নিচেও সমস্যা ওপরেও সমস্যা। এগারো সালের ধাক্কার পর সাংগঠনিক ভাবে সিদ্ধান্ত হল, লোকাল ও জোনাল স্তর তুলে দিয়ে জেলা ও শাখাস্তরের সংযোগকে আরো সজীব করার জন্যে এরিয়া নামে একটিমাত্র মধ্যবর্তী স্তর রাখা হবে শুধু। এগারোর ধাক্কার পর নেতৃত্বের অনুভবে এটা এসেছিল যে, লোকাল ও জোনালের দু'টি প্রাচীর ভেদ করে নিচের তলার বাতাস ওপরে এসে পৌঁছচ্ছে না। ফলেই মাঠপর্যায়ে কী ঘটছে তার কোনো খবরই পৌঁছচ্ছে না ওপরে। দশ বছর পর এই সম্মেলন পর্বে এটাও পর্যালোচনার প্রয়োজন, এই সাংগঠনিক অঙ্গ পুনর্বিন্যাস কি সত্যিই কাঙ্ক্ষিত পথে হাঁটতে পেরেছে? একটা বদল হয়ত হয়েছে, আগে লোকাল ও জোনাল মিলে মধ্যবর্তী স্তরে নেতার সংখ্যা ছিল অনেক বেশি, এখন কমেছে। মাঝের স্তরে নেতার সংখ্যা বেশি হওয়ায় নিচে নেমে কাজ করা মানুষের চেয়ে নেতার সংখ্যা তুলনায় বেড়ে গিয়েছিল। ফলে মানুষের সাথে সরাসরি সংযোগের চেয়ে কর্মীদের ওপর মাতব্বরী করাটাই রাজনৈতিক সাংগঠনিক কাজের প্রধানতম অংশ হয়ে উঠেছিল একটা বড় অংশের। এই মাতব্বরী থেকেই যাবতীয় রোগের উদ্ভব। এই রোগ থেকে নিরাময়ের লক্ষ্যেই সাংগঠনিক স্তরের পুনর্বিন্যাস। যাতে সরাসরি মানুষের কাছে যাওয়াটা প্রধান কাজ হয়ে ওঠে।

দশ বছর হয়ে গেলেও এই পরিবর্তন খুব একটা সাফল্য পায়নি। লোকাল/জোনাল তুলে দিয়ে একটি মাত্র মধ্যবর্তী স্তর হিসেবে এরিয়া কমিটির ধারণা সাংগঠনিক স্বাস্থ্যের খুব একটা বদল আনেনি। মাঠপর্যায়ে মানুষের সাথে দৈনন্দিন রাজনৈতিক যোগাযোগ যা কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, তা এখনও পুরোপুরি ফিরে আসেনি। এখনও বেশিরভাগ জায়গায় এলাকাভিত্তিক কর্মসূচির চেয়ে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির দিকেই বেশি ঝোঁক। এলাকায় যদি কর্মসূচি নেওয়া হয়ও সেখানে কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া কর্মীদের একটা উল্লেখযোগ্য উপস্থিত হয় না। নতুন আরেকটি সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। আগেকার লোকাল ও জোনাল স্তরের সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে যে স্থাপনাগুলি কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হত, সেগুলির দেখভাল করাই বিদ্যমান রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক বাস্তবতায় বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঠপর্যায়ের সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা কাঙ্ক্ষিত গতি পায়নি বলেই দখল থেকে উদ্ধার হওয়া কার্যালয়গুলিও সচল হয়ে ওঠেনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে। সবটাই যে পুনর্দখল বা শাসকপক্ষের রাজনৈতিক ভয়ভীতির জন্যে ঘটছে তা বললে সত্যের অপলাপ হবে।

এগারোর ধাক্কার পর তিন তিনটি সম্মেলন পর্ব গেছে। নানা আলোচনা পর্যালোচনা তর্ক বিতর্ক সংঘাত দলিল পালটা দলিল এসেছে, কখনো সংঘাত সম্মেলনস্থল পেরিয়ে বাইরের রাস্তার হাতাহাতিতেও নেমে এসেছে। কিন্তু এতকিছুর পরও সাংগঠনিক স্বাস্থ্যের কোনো অর্থবহ উন্নতি ঘটেনি। বরং রক্তাল্পতা বেড়েই চলেছে। দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বামপন্থার গুরুত্ব যত বাড়ছে রাজনৈতিক পরিসরগুলিতে বামপন্থীরা ততই দৃশ্যমানতা হারাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর এই সম্মেলন পর্বের কাছে বামপন্থী মনোভাবাপন্ন মানুষেরা প্রত্যাশা করেন। অবশ্যই প্রত্যাশা করেন সিপিআই(এম) দলের সর্বস্তরের কর্মী ও সমর্থকরাও। এটাও সত্যি, শুধু বামপন্থী বা সুনির্দিষ্টভাবে সিপিআই(এম) কর্মী সমর্থকেরাই নয়, বাম রাজনীতির বৃত্তের বাইরের উদার গণতান্ত্রিক মানুষের সমাজও চাইছে বামপন্থীরা দলীয় শক্তির বৃদ্ধি ঘটিয়ে আরো দৃশ্যমান হয়ে উঠুক। ভারতের বর্তমান শাসকদের রাজনীতির বিরোধী যে মানুষেরা তাদের সমস্ত অংশই চায় এটা। কারণ এটা তাদের ধারণা এবং এই ধারণার যথেষ্ট বাস্তব কারণও রয়েছে, দেশে বামপন্থীরা উল্লেখযোগ্য শক্তির অধিকারী না হলে ভারতের বর্তমান শাসকদের ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা সম্ভব নয়। কারণ শুধু দল হিসেবে নয়, ভাবাদর্শের দিক থেকেও বামপন্থাকে চাইছে এই সময়। বর্তমান শাসকপক্ষ ভাবাদর্শগত দিক থেকে দেশ ও রাষ্ট্রকে যেভাবে পরিবর্তিত করতে চাইছে, তাকে রুখতে পারে একটি উদার গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ যা নির্মিত হতে পারে আজকের সময়ের বামপন্থার এক নতুন বয়ান নির্মাণের মধ্য দিয়েই। এই মুহূর্তে চলতে থাকা কৃষক আন্দোলনের মধ্যে এই ভাবাদর্শগত বিকল্পই প্রতীয়মান হচ্ছে। মুশকিল হচ্ছে, কৃষক আন্দোলনের সাংগঠনিক স্তরে বামপন্থীদের যে হস্তক্ষেপের পরিসর রয়েছে, দেশের নির্বাচনী রাজনীতির ক্ষেত্রে তার ছিটেফোঁটাও নেই। প্রকৃতপক্ষে কৃষক আন্দোলন ছাড়া বামপন্থীদের অংশগ্রহণ থাকা আর কোনো আন্দোলন সারা দেশের কোনো জায়গাতেই তেমন দানা বাঁধতে পারছে না। দেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সম্বৎসরের দেশব্যাপী ধর্মঘট আহ্বানের বৃত্তের মধ্যেই ঘোরাফেরা করতে বাধ্য হচ্ছে। নয়া উদারবাদের আঘাতের বিরুদ্ধে তেমন কার্যকর কোনো প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারেনি দেশের ট্রেড ইউনিয়নগুলি যা দেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে একটা বড় প্রভাব ফেলতে পারে। এই না-পারাটা কি শুধুই একটি সাংগঠনিক ব্যর্থতা? নাকি এর সাথে জড়িয়ে আছে আজকের পরিবর্তিত সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা যেখানে দেশের শ্রমশক্তির মোট সংখ্যার মধ্যে সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণি ক্রমেই অনুল্লেখ্য হয়ে উঠছে?

ইন্টারনেটে ‘ভারতে বামপন্থার শক্তিক্ষয়’ কথাটি ইংরেজি, বাংলা বা যে কোনো ভারতীয় ভাষায় লিখে অনুসন্ধান করলে ফলাফলে শুধু ‘সিপিআই(এম)-এর নির্বাচনী বিপর্যয়’ সংক্রান্ত লেখালেখি বা তথ্যউপাত্তই ফিরে ফিরে আসে। তার মানে সিপিআই(এম)-এর শক্তিহ্রাস এবং ভারতে বামপন্থার দুর্বলতা দু’টিকে সমার্থকই মনে করা হয় সাধারণভাবে। সিপিআই(এম)-বহির্ভূত বামপন্থীরা অবশ্য এই বিপর্যয়কে শুধুমাত্র সিপিআই(এম)-এর সমস্যা বা প্রত্যাখান বলেই মনে করেন এবং এক ধরনের নিশ্চিন্ত আত্মতৃপ্তিতে থাকেন। কখনোই এই আত্মসমীক্ষা করেন না, কেন সিপিআই(এম)-এর শক্তিক্ষয় নতুন কোনো বামপন্থী শক্তির উদয়কে সুনিশ্চিত করছে না। কেন সিপিআই(এম)-এর বাইরে থাকা বামপন্থীরা এতগুলি বছর ধরে সিপিআই(এম)-বৃত্তের থেকে দূরে থেকে বামপন্থী রাজনীতি করেও বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারলেন না ভারতের রাজনীতিতে। পশ্চিমবঙ্গে বিগত সাত দশক ধরেই নানা ধারার বামপন্থীরা সক্রিয়। কিন্তু যখন বামফ্রন্টকে অপসারণের প্রশ্ন এলো, তখন তারা কেউই বিকল্প কোনো বামপন্থা দিয়ে এই কাজটি সমাধা করতে পারলেন না। বামফ্রন্ট সরকারের অপসারণ করতে গিয়ে তাদের প্রায় সমস্ত অংশকেই চরম অগণতান্ত্রিক দক্ষিণপন্থী তৃণমূলের অনুবর্তীই হতে হল। এসইউসিআই-এর মত কট্টর ‘বিশুদ্ধ’ দল একটি এমপি ও এমএলএ উপঢৌকন হিসেবে পেয়েও সাংগঠনিক শক্তির বিন্দুমাত্র অগ্রগতি ঘটাতে পারল না। কিষাণজীর কথা আর নাই বলা হল।

অন্য রাজ্যে, লিবারেশন দল এক সময়ে আসামে কার্বি আংলং জেলায় জেলা পরিষদের ক্ষমতা দখল করেছিল। আজ তারা সেখানে বিন্দুমাত্র দৃশ্যমানতায়ও নেই। আসামের কার্বি আংলং জেলার লিবারেশন নেতা রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ এখন বিজেপির নেতা। বিধানসভার এক সময়ের মুখর লিবারেশন সদস্য এখন একটি স্বতন্ত্র দক্ষিণপন্থী দল গঠন করেছেন। আসামের বিজেপি সরকারের বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী এক সময়ে অন্য একটি নকশালপন্থী দলের মুখ হিসেবে সেখানে জনজাতিদের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সিপিআই(এম) হোক আর অন্য বামপন্থী দল, ভারতের কোনো একটি রাজ্যে বিচ্ছিন্নভাবে একটি দু’টি বিধানসভার আসনে জয়ী হওয়া বা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ দখল করা, এগুলি জাতীয় বা রাজ্যস্তরে বামপন্থার কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির সূচক নয়।

ফলে বামপন্থার সংকট নিয়ে আলোচনাটি শুধু নির্দিষ্ট কোনো রাজ্য বা দলের বিষয় নয়। যখন পশ্চিমবঙ্গ বা ত্রিপুরায় বামপন্থীরা নির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়, তখন পরাজয়টা সামগ্রিকভাবে বামপন্থারই হয়, সিপিআই(এম)-এর একার নয়। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বামফ্রন্টের পরাজয়ের জন্যে সিপিআই(এম) সহ বামফ্রন্ট অন্তর্ভুক্ত বামপন্থীরাই প্রধানত দায়ী। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সেই পরাজয় ছিল বামপন্থার। এসইউসিআই ও নকশালপন্থীদের নানা ধারার রাজনীতির মানুষদের কাছে ২০১১ সালের বামফ্রন্টের পরাজয় একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক অগ্রগতি হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিল ঠিকই, আজ প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও তারা বোঝেন পরাজয়টা সেদিন আসলে তাদেরও হয়েছিল। তফাৎ এটাই সেই পরাজয়ে তাদের নিজেদেরই একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।

যে সময়টায় সিপিআই(এম)-এর সম্মেলন পর্ব চলছে তার কাছাকাছি সময়ে অন্য বামপন্থী দলগুলিরও সম্মেলন হবে। এসইউসিআই ব্যতিক্রম। তারা সম্মেলন ব্যাপারটা কমই করেন। ১৯৪৮ সালে দলের প্রতিষ্ঠার পর তাদের প্রথম কংগ্রেস হয় ৪০ বছর পর ১৯৮৮ সালে। দ্বিতীয় কংগ্রেস হয়েছিল আরো ২১ বছর পর ২০০৯ সালে। ৩য় কংগ্রেস হয় ২০১৮ সালে। তবে এটা ধারণা করাই যায়, কোনো বামপন্থী দলের সম্মেলন পর্বেই ভারতে বামপন্থীদের বর্তমান বিপর্যয়কর অবস্থাকে বামপন্থার সমস্যা হিসেবে কেউই দেখবে না। তাদের কাছে ব্যাপারটা সিপিআই(এম)-এর বিপর্যয়। এক অর্থে হয়ত সত্যও, কারণ অতীত দিনেই অন্য বামপন্থীরা কখনোই একটি কার্যকরী শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি যে এখনকার অবস্থাকে তাদের বিপর্যয় মনে হবে। প্রধানত সিপিআই(এম) এবং কিছুটা সিপিআই (১৯৭০-৭১ থেকে ১৯৭৫) জাতীয় ও রাজ্য রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা দীর্ঘ সময়জুড়ে উল্লেখযোগ্য শক্তি হিসেবে থাকার পর এই মুহূর্তে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে চরম দুর্বল অবস্থার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তারপরও গভীরে অনুধাবন করলে দেখা যাবে, সমস্যাটা সিপিআই(এম)-এর একার নয়, সার্বিকভাবে বামপন্থার।

মুশকিল হচ্ছে, সিপিআই(এম)-এরও সিংহভাগ সদস্য সমর্থকও মনে করেন, এই মূহূর্তের সংকটটি মূলত সিপিআই(এম)-এরই সমস্যা, সামগ্রিকভাবে বামপন্থার নয়। বিষয়টা আরো গুরুতর এই জন্যে যে সিপিআই(এম) বৃত্তের এই মানুষেরা মনে করেন এই বিপর্যয় এসেছে প্রধানত দলের রণকৌশলগত ভুল এবং কিছুটা সাংগঠনিক শিথিলতার জন্যে। পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম)-এর সদস্য সমর্থকদের মধ্যে কোনো জরিপ চালালে দেখা যাবে, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মনে করে ভারত মার্কিন সামরিক চুক্তির প্রশ্নে ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের জন্যেই ২০১১ সালের নির্বাচনী বিপর্যয় হয়েছে। ওই সমর্থন প্রত্যাহারের ঘটনা না ঘটলে কংগ্রেস এবং তৃণমূলের নির্বাচনী আঁতাত হত না এবং বামফ্রন্টও পরাস্ত হত না। ফলে এদের তরফ থেকে আসা সংকটের নিরাময়ের প্ন্থা সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলিও রণকৌশলগত প্রশ্নেই প্রধানত ঘোরাঘুরি করে। এই রণকৌশলও নির্বাচনকেন্দ্রিক। ২০১৬, ২০১৯ ও ২০২১ এর নির্বাচনী পরাজয় সংক্রান্ত তর্কবিতর্কগুলিও জোট, আঁতাত এই প্রশ্নগুলিকেই আবর্তিত হয়। নির্বাচনী আঁতাত বা রণকৌশল হয়ত অনিবার্য সংকটকে ত্বরাণ্বিত করেছে, কিন্তু এই সংকটের কারণ অবশ্যই নির্বাচন নয়।

এই মুহূর্তে সিপিআই(এম) দলের সামনে যে সমস্যা, সেই সমস্যা সাধারণ ভাবে সারা পৃথিবী জুড়ে বামপন্থীদের সামনে উপস্থিত হওয়া সাধারণ প্রত্যাখ্যানের থেকে স্বতন্ত্র নয়। সাধারণীকরণের মাধ্যমে গোটা বিষয়কে হয়ত দু’টি প্রশ্নে নামিয়ে আনা যায়। প্রথম প্রশ্ন, হারানো গণভিত্তি ও জনসমর্থন সাংগঠনিক ও রাজনৈতিকভাবে পুনরুদ্ধার করা। এটা শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের নয়, পৃথিবীর যে দেশেই বামপন্থীরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পর অপসারিত হয়েছে তাদের সকলের এটা অভিন্ন সমস্যা। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের নির্বাচনী পরাজয় হয়েছিল ২০১১ সালে, কিন্তু জনসমর্থন হারানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় বিগত শতকের নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকেই। নির্বাচনী ফলাফলের সাফল্যের চোখ ধাঁধানো আলোয় এই ক্ষয়ের প্রক্রিয়া ঢাকা পড়েছিল। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯১-এর মধ্যে যখন পূর্ব ইউরোপ ও সোভিয়েত ভেঙে পড়ল, তখন পর্যালোচনা করতে গিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পর জনগণ থেকে দূরত্ব রচিত হওয়া, সরকার ও দল একাকার হয়ে যাওয়া এবং সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে জনসাধারণের কন্ঠস্বরের চাপা পড়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির ইতিহাসের সরকারি বয়ানের বাইরে গিয়ে নতুন করে আবার কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসকে নির্মোহ ভাবে চর্চা করতে হবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই চর্চাগুলি হয়নি। সোভিয়েত বা পূর্ব ইউরোপের যে ত্রুটিগুলির কথা বলা হয়েছে, তা পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট রাজনীতিতেও বিদ্যমান কিনা তখন তারও অনুসন্ধান করা হয়নি। উপর্যুপরি নির্বাচনী বিজয়ের উল্লাসে ঘরের ভেতরের ছিদ্রগুলি যা ক্রমেই গহ্বরের আকার নিচ্ছিল তাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য ত্রিপুরার ক্ষেত্রেও।

২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে পরাজয়ের পর কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরে যে আত্মসমালোচনাগুলি হয়েছিল তার কার্যকারিতা ত্রিপুরাতেও রয়েছে কিনা তার অনুসন্ধান করা হয়নি সেখানে। বিরোধীদের ভোটের হার ধারাবহিকভাবে হ্রাস পেতে থাকার উল্লাসে জনগণের সাথে রচিত হতে থাকা দূরত্ব নজর থেকে চলে গিয়েছিল। ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সময়টা কম নয়, নজর দিলে হয়ত বিপর্যয় ঠেকানো যেতো।সব সমস্যাকে শুধু পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা ভেবে আত্মসন্তুষ্ট থাকার মাশুল দিতে হয়েছে পরে ২০১৮ সালের নির্বাচনে। জনবিচ্ছিন্নতা টের পাওয়া এবং তাকে কাটিয়ে উঠে আবার জনসংযোগ স্থাপন করার সমস্যা আসলে শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা ত্রিপুরার নয়। রাশিয়া থেকে পূর্ব ইউরোপ, পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত সাধারণতন্ত্রগুলি থেকে যুগোশ্লাভিয়া আলবেনিয়া - সমস্যা সর্বত্র অভিন্ন। এটা নজরে রাখার কোনো পদ্ধতির কথাও কখনো তাত্ত্বিক স্তরে ভাবা হয়নি।এই মুহূর্তে কেরলের নির্বাচনী বিপুল বিজয় দেখে যদি আত্মসন্তুষ্ট হয়ে থাকা হয়, তবে বিপদকেই ডেকে আনা হবে। সমস্যা এখনও প্রকট না হলেও সমস্যার কারণ কেরলেও একইভাবেই রয়েছে। নির্বাচনী সফলতা দিয়ে সব ঠিকবেঠিক বিচার করা উচিত হবে না।

দ্বিতীয় প্রশ্ন, জাতি ও ধর্ম নিয়ে অন্ধতা ও বিদ্বেষের রাজনীতির মোকাবিলা। এটাও শুধু ভারতের সমস্যা নয়। একটা সময়ে ভাবা হয়েছিল মানুষের খাওয়া পরার সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে মানুষ ধর্ম বা জাতি নিয়ে উগ্রতার খপ্পরে পড়বে না। সোভিয়েত ইউনিয়নে জাতি সমস্যার সমাধান যে পথে হয়েছিল তাকে আদর্শ মেনে ধরে নেওয়া হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি এই অন্ধত্ব থেকে মুক্ত হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়তেই দেখা গেল সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির মানুষ এক ভয়ঙ্কর জাতি ও ধর্মীয় হিংস্রতায় মত্ত হয়ে উঠেছে। অনেকেই বলেন, সমাজতন্ত্রের পতনের জন্যেই এমনটা হয়েছে। কিন্তু সত্য তো এটাও, এই হিংস্র বিদ্বেষের মানসিকতা রাতারাতি জন্ম নেয় না। বরং এই জাতি ও ধর্মীয় উচ্চমন্যতা ও ঘৃণা মুছে যায়নি বলেই সামান্য স্ফুলিঙ্গ পেতেই দাবানলের জন্ম হয়েছিল।

পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি পরাস্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা গভীরভাবে মানুষের মনে গেড়ে বসেছে। ত্রিপুরাতেও অভূতপূর্ব সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বিস্তার ঘটেছে। উপজাতিদের মধ্যে নতুন করে পৃথকত্বের এক উগ্র মানসিকতাও দ্রুত ছড়াচ্ছে, বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে। শুধু রুটি রুজির প্রশ্নকে জোরালো করে এই ঘৃণার রাজনীতিকে মুছে দেওয়া সম্ভব নয়। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের একটি অংশের মধ্যে আবার এই ধারণা জন্মাচ্ছে যে বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতি ঠেকাতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতির চর্চা প্রয়োজন। এটা যে কতটা আত্মঘাতী তা আসামকে দেখলেই বোঝা যাবে। ওখানেও অনেকে ভেবেছিলেন ভাষা ও জাতির রাজনীতি দিয়ে বিজেপির হিন্দুত্ব ঠেকাবেন। ফল হয়েছে উলটো, বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতি ভাষা ও জাতির রাজনীতিকে আত্মস্যাৎ করে যুগপৎ ধর্ম ও ভাষার বিদ্বেষের রাজনীতি করছে এখন। মনে রাখা উচিত, পরিচিতিসত্তা কোনো একরৈখিক বিষয় নয়। তার ব্যাপ্তি বহুমাত্রিক। এই নিয়ে লোফালুফি খেলতে গেলে হিতে বিপরীত হবে।

জনবিচ্ছিন্নতা কাটানো ও বিদ্বেষের রাজনীতির মোকাবিলা করা, এই দুই প্রত্যাহ্বানকে কীভাবে মোকাবিলা করা হবে তার রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও তাত্ত্বিক চর্চা, তর্ক-বিতর্ক, আলাপ আলোচনা উঠে আসবে সিপিআই(এম)-এর সম্মেলন প্রক্রিয়া থেকে এটা তো কাম্যই। কিন্তু প্রশ্নটা হল কীভাবে হবে? এখানেই সবচেয়ে অস্বস্তির জায়গা। প্রশ্নটি হল, সাংগঠনিক গণতন্ত্রের বিদ্যমান নীতি ও তার প্রাসঙ্গিকতা। কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত হয় গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতির ভিত্তিতে।১৯০২ সালে যখন এই নীতি প্রথম গৃহীত হয় তখন থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির অন্দরে এই নিয়ে তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই। একটি অংশের বক্তব্য, সারা পৃথিবী জুড়ে কমিউনিস্ট পার্টিগুলি টিকে আছে এই সাংগঠনিক নীতিমালার ভিত্তিতেই। আবার বিরুদ্ধ অংশের বক্তব্য, সোভিয়েত থেকে পূর্ব ইউরোপ, আলবেনিয়া, যুগোশ্লাভিয়া হয়ে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা সর্বত্র কমিউনিস্ট পার্টির যে বিপর্যয় তার প্রধান কারণ কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক পরিসরের স্বল্পতা আর তার জন্যে দায়ী গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি। পার্টির জন্যে যে নীতির কথা বলেছিলেন লেনিন তাকে পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশে শাসনব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত করা হয়। ফলে এই দেশগুলিতে সাধারণের সাথে যোগসূত্রছিন্নতার জন্যে প্রধানত দায়ী গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতিই। এই নীতিমালা আদর্শ হিসেবে গণতন্ত্রকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার কথা বললেও কার্যত তা ভয়ঙ্কর ধরনের কেন্দ্রিকতারই জন্ম দিয়েছে। সোভিয়েতের ভাঙনের পর যখন আবার গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার প্রশ্নটি আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে, তখন কেউ কেউ বলেছেন এই নীতি আর চলবে না। কিন্তু বিকল্পে কোনো নীতিমালার কথা কেউ সামনে আনেনি।

সিপিআই(এম) সমাজতান্ত্রিক শিবিরের ভাঙন নিয়ে আলোচনার সময় এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে রাষ্ট্র, সরকার ও দলে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নামে আমলাতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার জন্ম হয়েছিল। এ জন্যেই সমস্ত সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। নীতি হিসেবে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতিমালা ভ্রান্ত নয়। ভ্রান্ত এর বাস্তবায়ন। আবার বিভিন্ন সময়ে পার্টি সম্মেলন ও প্লেনামে বারবার নিজেদের ক্ষেত্রেও এই কথাটি উঠেছে যে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নামে পার্টিতে কেন্দ্রিকতাই বড় হযে উঠছে। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার সার্থক রূপায়ন কোন দেশে বা পার্টিতে হয়েছে তার দৃষ্টান্ত পাওয়াও দুষ্কর। সোভিয়েতে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার জায়গায় আমলাতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার প্রাদুর্ভাবও কি শুধুই পরবর্তী পর্যায়ের বাস্তবতা? নাকি লেনিনের মৃত্যুর পরপরই সোভিয়েত পার্টিতে কার্যত কেন্দ্রিকতাই গ্রাস করে নেয়। ১৯১৭ সালের বিপ্লবকালীন পলিটব্যুরোর লেনিন বাদে সমস্ত সদস্যকেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে হল। এই সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে দেওয়া সব যুক্তি কি আজও গ্রহণযোগ্য? যেভাবে মেক্সিকো অবধি তাড়া করে ট্রটস্কির হত্যা করা হল তা কোন্ ধরনের সমাজতান্ত্রিক নৈতিকতার মানদণ্ডে গ্রাহ্য হবে? যদিও বলা হয়েছিল কমিউনিস্ট আন্দোলনের গোটা পর্বের ইতিহাসকে আবার অধ্যয়ন করে পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। কার্যক্ষেত্রে এখনও সোভিয়েত বা অন্য দেশের সরকারি বয়ানকেই মান্যতা দিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রোজা লুক্সেমবুর্গ, ট্রটস্কি, বুখারিন সম্পর্কে এখনও ব্রাত্য। এখনও ফ্যাসীবাদ সম্পর্কে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ষষ্ঠ কংগ্রেসে জিনোভিয়েভের বক্তব্য মান্যতা পাচ্ছে, যদিও একটু আধটু গ্রামশি চর্চাও শুরু হয়েছে। বিপ্লব-পরবর্তী শাসনতন্ত্রের ধরন হিসেবে এখন আর কেউ গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার কথা বলে না। বিকেন্দ্রীকৃত শাসনতন্ত্রের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার তত্ত্বই আলোচিত হচ্ছে সারা বিশ্বের বামমহলে। লাতিন আমেরিকায় যে বামপন্থার নতুন ঢেউ পরিলক্ষিত হচ্ছে তার মূল বৈশিষ্টই হচ্ছে বিকেন্দ্রীকৃত গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের আদর্শ। পাহাড় জঙ্গলে বন্দুক হাতে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ গ্রহণ করা এক সময়ের কট্টর বামপন্থীরাও এখন গণআন্দোলনের পথে বহুত্বের আদর্শকে ভিত্তি করে নতুন ধরনের বামপন্থার কথা বলছেন। সিপিআই(এম)-ও পার্টি কর্মসূচিতে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার কথা বলেনি। রাজ্যের হাতে প্রকৃত স্বায়ত্তশাসনের পাশাপাশি নিচের তলার বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসন ও সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর প্রকৃত স্বশাসনের কথা বলেছে। পার্টি কর্মসূচির সাম্প্রতিকতম সংস্করণ বিপ্লব পরবর্তী সময়ে বহুদলীয় গণতন্ত্রের কথাও বলেছে। রাষ্ট্র ও সমাজের পরিচালনার ক্ষেত্রে যখন অধিকতর উদার ও প্রতিযোগিতামূলক গণতন্ত্র ও বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসনের কথা বলা হচ্ছে, তখন দলীয় স্তরের ধ্যাণধারণাগুলি সাধারণভাবে অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, আর দল কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থার দ্বারা সমান্তরালে পরিচালিত হলে দলের কেন্দ্রীকরণের প্রভাবই প্রশাসনে প্রতিফলিত হয় বেশি।

১৯৭৮ সালে পশ্চিবঙ্গে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টানোর মধ্য দিয়ে গ্রামাঞ্চলে অংশগ্রহণমূলক শাসনতন্ত্রের যে বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল তা এক দেড় দশকের পর থেকেই আনুষ্ঠানিক চেহারা নিতে শুরু করে গ্রামীণ সমাজের সর্ববিষয়ে কেন্দ্রীভূত পার্টি সংস্কৃতির দাপটে। সোভিয়েত ও পূর্ব ইউরোপের বিপর্যয়ও মূলত এই কারণেই। লাতিন আমেরিকার নবোত্থিত বামেরা এখন দলীয় পদাধিকারী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও পার্টির বাইরে থাকা সাধারণ মানুষের মতাভিমতকে গুরুত্ব দেওয়ার নানা ব্যবস্থাপনার কথাও ভাবছেন। মার্তা হার্নেকারের বইয়ে তার কিছুটা রূপরেখা আমরা দেখেছি। সমাজ ও রাষ্ট্রে স্বায়ত্বশাসন ও বিকেন্দ্রীকরণের পথ, অন্যদিকে এই কর্মযজ্ঞের মুখ্য পরিচালক রাজনৈতিক দলে কেন্দ্রীভূত পরিচালন পদ্ধতি, এই দুইয়ের মধ্যে যে বিরোধাভাস রয়েছে, তা থেকে উত্তরণ নিয়ে এ দেশে এখনও যথেষ্ট তাত্ত্বিক ভাবনাচিন্তা বা বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রায় হয়নি বললেই চলে।

আসলে সারা পৃথিবী জুড়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সামনে সবচেয়ে বড়ো প্রত্যাহ্বান গণতন্ত্রের প্রসঙ্গ। দলীয় স্তরের গণতন্ত্রের নীতিমালা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় স্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার রূপরেখা নিয়ে বিকল্প নীতির প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এই কঠিন তাত্ত্বিক চর্চার শুরুই করতে হয় নিজের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামার মধ্য দিয়ে। এই কাজটিই সবচেয়ে কঠিন। নিজের বা নিজেদের ভাবনাচিন্তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিজেই সেখানে বিচারকের ভূমিকায় উপনীত হওয়ার চেয়ে কঠিন কাজ আর কীই বা হতে পারে। বলা হয়েছিল, সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অভিমত গ্রহণ করবে সিপিআই(এম) দল। পার্টি সমর্থক দরদীদের অভিমতকেও মূল্য দেওয়া হবে। নীতিগতভাবে এর চেয়ে সঠিক আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু পার্টির সাংগঠনিক বৃত্তের বাইরের মানুষদের মতাভিমত নেওয়ার কোনো প্রণালীবদ্ধ পদ্ধতির কথা কি ভাবা হয়েছে? সম্ভবত না। ফলে সব ভালো প্রস্তাব আলোচনার পর্যায়েই আটকে থেকে গেছে এখন অবধি। নিবন্ধ শুরু করেছিলাম সাহসের কথা দিয়ে। আসলে তত্ত্ব, রাজনীতি, রণনীতি, রণকৌশল সবকিছুকে ছাড়িয়ে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, সাহস। নিজের মুখোমুখি হওয়ার সাহস। যারা সমর্থক বা নিচের তলার কর্মী বা সভ্যদের প্রশ্নমুখরতা বা তার্কিকতাকে অপছন্দ করেন, তাদের পক্ষে দর্পণে নিজের চেহারার মুখোমুখি হওয়াটা প্রায় শাস্তির মতই। সব কি আর রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর রাজার মত শেষ দৃশ্যে নন্দিনীর সাথে ঝাণ্ডা হাতে ছুটে যেতে পারে নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে?

তবু এই অনিবার্য যুদ্ধ ছাড়া গত্যন্তর নেই! বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ আছে কি নেই, তার চেয়েও বড় কথা বামপন্থীদের বাদ দিয়ে এদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা সম্ভব নয়। এ কথা শুধু অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়কের কথা নয়, এটাই সত্য। আরেকটি কথা, সিপিআই(এম)-কে বাদ দিয়ে এদেশের বামপন্থারও পুনরুজ্জীবন সম্ভব নয়। ফলে বৃত্তভাঙার লড়াইয়েও সিপিআই(এম)-কেই প্রধান ভূমিকা নিতে হবে। ভবিষ্যৎকালের জন্যেই এ অপরিহার্য। এই মূহূর্তে চলতে থাকা সম্মেলন প্রক্রিয়ায় এই কথাগুলি উঠে আসুক, এটাই চাইছেন দলে ভেতরের ও বাইরের অগণিত শুভানুধ্যায়ীরা।