আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ● ১৬-২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

সমসাময়িক

ব্যাঙ্ক বেসরকারীকরণ রুখতে হবে


সদ্য শুরু হওয়া সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে ভারতের ব্যাঙ্কিং আইনের পরিবর্তন করা হবে ব্যাঙ্ক বেসরকারীকরণের নীতিকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাজেট পেশ করার সময় অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন যে এই অর্থবর্ষে দুটি সরকারী ব্যাঙ্ককে বেসরকারীকরণ করা হবে। এই ঘোষণার সূত্র ধরেই নতুন বিল সংসদে পেশ করা হবে বলে সরকার ইতিমধ্যেই জানিয়েছে। ব্যাঙ্ক কর্মী আন্দোলন-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি ইতিমধ্যেই এই নীতির বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করার লক্ষ্যে কর্মসূচী গ্রহণ করছে।

কৃষি আইন ফেরত নেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনগুলির পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু বেসরকারীকরণ, কর্পোরেটদের তুষ্টিকরণ-সহ সমস্ত নবউদারবাদী আর্থিক নীতিগুলি যে বিজেপি সরকার আগামীদিনে তীব্র গতিতে প্রবর্তন করবে, ব্যাঙ্ক বেসরকারীকরণ বিল পেশ করার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়েই এই কথা পরিষ্কার। ২০২১ সালের বাজেটে বিলগ্নীকরণের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার ১,৭৫,০০০ কোটি টাকা বাজার থেকে আয় করবে বলে হিসেব করেছে। এর মধ্যে ব্যাঙ্ক, এলআইসি, এয়ার ইন্ডিয়া-সহ অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বিলগ্নীকরণের হিসেব ধরা আছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিলগ্নীকরণ করার দুটি মৌলিক যুক্তি সরকার ও তাদের মাইনে করা অর্থনীতিবিদদের তরফে দেওয়া হয়ে থাকে। প্রথমত, বলা হয় যে কোষাগারের ঘাটতি কমানোর জন্য টাকার প্রয়োজন। সেই টাকা সরকারী সম্পত্তি বেচে আদায় করা উচিত। কিন্তু বিলগ্নীকরণের মাধ্যমে সরকারকে টাকা তুলতে হবে কেন? হিসেব করলে দেখা যাবে যে, ভারতের কর্পোরেট ট্যাক্স ও জিডিপি-র অনুপাত লাগাতার কমছে। এই অনুপাতকে যদি না কমিয়ে দুই বছর আগের হারে রেখে দেওয়া যায়, তাহলে বিলগ্নীকরণের মধ্যে দিয়ে সরকার যত টাকা তুলবে বলে আশা করছে, তার থেকে বেশি টাকা তারা আদায় করতে পারে। কিন্তু দেশের ধনী এবং কর্পোরেট ক্ষেত্রের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে তাদের উপর করের হার বাড়িয়ে মোদী তার মিত্রদের বিড়ম্বনায় ফেলতে চান না। অতএব, তেলা মাথায় তেল মাখানোর মানসিকতা নিয়ে সেই বেসরকারী ক্ষেত্রের হাতেই সস্তায় দেশের জাতীয় সম্পদ তুলে দিতে চায় কেন্দ্রীয় সরকার।

দ্বিতীয় কারণটি হল বাজার। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন যে ব্যবসায় সরকারের নাক না গলানোই ভালো। বাজারকে তার নিজের হালে ছেড়ে দিলে তা দেশের আর্থিক অগ্রগতি ও সামাজিক কল্যাণের পথকে প্রশস্ত করে। তর্কটি অনেকগুলি কারণে ভ্রান্ত। যেই সমস্ত ক্ষেত্রে, সামাজিক লাভ ও খরচ ব্যক্তিগত লাভ ও ক্ষতির হিসেবের মধ্যে ধরা সম্ভব হয় না, সেই ক্ষেত্রে সরকারকে বাজার নিয়ন্ত্রণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেই হয়। তদুপরি, কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র রয়েছে যেমন বিমা, ব্যাঙ্ক ইত্যাদি, সেখানে শুধুমাত্র বাজার নির্ভর ব্যবস্থা থাকলে গরীব সাধারণ মানুষ সেই ব্যবস্থা থেকে বাদ চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গরীব মানুষ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, চাষিকে ঋণ কে দেবে? কোনো বেসরকারী ব্যাঙ্ক দেবে না। এখানেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের গুরুত্ব। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক শুধুমাত্র লাভ-ক্ষতির হিসেবে চলে না, দেশের প্রান্তিক মানুষকে ঋণের জোগান দেওয়ার দায়িত্বও তাদের। ব্যাঙ্ক বেসরকারীকরণ হয়ে গেলে এই শ্রেণির মানুষগুলি ব্যাঙ্কিং পরিষেবার নাগালের বাইরে চলে যাবে।

ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হচ্ছে অনাদায়ী ঋণ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে দেউলিয়া আইনের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন সংস্থাকে অন্য কোনো সংস্থার হাতে বেচে তার টাকা ব্যাঙ্কগুলোকে ফেরত দিয়ে ২০২১ সালের মার্চ মাস অবধি মোট অনাদায়ী ঋণের মাত্র ৩৯ শতাংশ টাকা উদ্ধার করা গেছে। অর্থাৎ ৬১ শতাংশ টাকা স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কারা টাকা নিয়েছিল? বেসরকারী ক্ষেত্র। কারা টাকা ফেরত দেয়নি? বেসরকারী ক্ষেত্র। কিন্তু এখন সরকারী নীতি মেনে সেই ঋণ খেলাপী বেসরকারী ক্ষেত্রের হাতেই ব্যাঙ্কগুলিকে তুলে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করছে মোদী সরকার। এর ফলে দেশে একচেটিয়া পুঁজির দাপট আরো বাড়বে, বাড়বে অর্থনৈতিক বৈষম্য।

যারা ব্যাঙ্ক বেসরকারীকরণের নামে গলা ফাটান, তারা ভুলে গেছেন যে ভারতের অধিকাংশ ব্যাঙ্ক একসময় বেসরকারী ছিল। সেই ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে দেশে ঋণের জোগান বাড়ানো যাচ্ছিল না, পুঁজিবাদী উন্নয়নেও ঋণের জোগানের সমস্যা মিটছিল না। তদুপরি, কৃষি ক্ষেত্র, ছোট ও মাঝারি ক্ষেত্র, প্রান্তিক মানুষ ছিল মহাজনদের হাতের মুঠোয়, কারণ ব্যাঙ্কের মাধ্যমে তারা ঋণ পাচ্ছিল না। এই পরিস্থিতিতে দেশের পুঁজিবাদী উন্নয়নের পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তদুপরি, ব্যাঙ্ক মালিকদের ফাটকাবাজি এবং অবিমৃশ্যকারিতা বহু ব্যাঙ্ককে দেউলিয়া করে দিয়েছিল। এহেন পরিস্থিতিতে সরকার ব্যাঙ্কগুলির রাষ্ট্রায়ত্তকরণ করে ১৯৬৯ সালে। এর প্রভাব আমাদের দেশে সুদূরপ্রসারী হয়েছে। একদিকে শিল্পে ঋণের জোগান বেড়েছে, যার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী উন্নয়ন হয়েছে। অন্যদিকে কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্প এবং প্রান্তিক শ্রেণির মানুষরা সস্তায় ঋণ লাভ করেছে। গ্রামীণ এলাকায় ব্যাঙ্কের সংখ্যা এবং ঋণের জোগান বেড়েছে। যার ফলে দেশের অর্থব্যবস্থা গতি লাভ করেছে।

এখন ব্যাঙ্ক বেচে দেওয়ার নামে ভারতের অর্থব্যবস্থাকে ১৯৫০-৬০ এর দশকে নিয়ে যেতে চাইছে দেশের সরকার। এখনও আমরা যদি বেসরকারী ব্যাঙ্কের ঋণের পরিসংখ্যান দেখি, তাহলে দেখব যে এরা কৃষি বা ক্ষুদ্র শিল্প বা গ্রামীণ এলাকায় বিশেষ ঋণ দেয় না। মুদ্রা যোজনা, যা মোদী তার সরকারের একটি প্রধান প্রকল্প হিসেবে তুলে ধরেছিলেন, তার থেকেও ঋণ প্রদান করে না বেসরকারী ব্যাঙ্ক। সামাজিক ব্যাঙ্কিং-এর সম্পূর্ণ দায়ভার গ্রহণ করতে হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে। যার ফলে তাদের শুধুমাত্র মুনাফার লক্ষ্যকে পরিত্যাগ করতে হয়েছে। কিন্তু বেসরকারী ক্ষেত্র শুধুমাত্র মুনাফার লক্ষ্যে ব্যবসা করেছে। এখন তাদের মুনাফার হারকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের তুলনায় বেশি দেখিয়ে সরকারী ব্যাঙ্ক বেচে দেওয়া আসলে দেশে সোশ্যাল ব্যাঙ্কিং-এর উপরে কুঠারাঘাত। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে বেসরকারী করে দিলে আসলে পুরোনো গ্রামীণ মহাজনদের পরিবর্তে দেশের মানুষকে ঋণ দেওয়ার গুরু দায়িত্ব তুলে দেওয়া হবে সংগঠিত বৃহৎ পুঁজির মহাজনদের হাতে। ক্ষতিগ্রস্থ হবেন সাধারণ মানুষ।

মোদী সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্কারের নীতি তারা গ্রহণ করেছে। অনেকগুলি ব্যাঙ্ককে একত্রিত করা হয়েছে (মার্জার করা হয়েছে), ঋণ সংক্রান্ত বেশ কিছু নীতি সরকার গ্রহণ করেছে। মার্জার করার ফলে ব্যাঙ্কগুলির মুনাফা বাড়বে বলে মনে করেছিল সরকার। তা হয়েছে কী? সরকার কোনো পর্যালোচনা রিপোর্ট পেশ করেনি। যেই সংস্কারগুলি ইতিমধ্যেই হয়েছে, তার ফলে দেশের মানুষের কী লাভ হল, সেই বিষয়ে আগে সরকার আলোকপাত করুক। তা না করে, পুঁজিপতিদের হাতে ভারতের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে তুলে দেওয়ার জন্য তারা তৎপর, কারণ জনস্বার্থ নয়, আসলে মোদী সরকারের প্রধান লক্ষ্য কর্পোরেট তোষণ।

ব্যাঙ্কিং আইন পরিবর্তন বিল সংসদে গায়ের জোরে সরকার পাশ করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে। তা যদি তারা করতে সফল হয়, তাহলে সামনে লম্বা লড়াইয়ের প্রস্তুতি যেন আমাদের থাকে। দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ সরকারী ব্যাঙ্কের পরিষেবার উপরে নির্ভরশীল। শুধু ব্যাঙ্ক কর্মীরা নন, সেই সাধারণ মানুষকে রাস্তায় নামাতে হবে ব্যাঙ্ক বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে। কৃষক আন্দোলনের মতন এক বৃহৎ আন্দোলন গড়ে তুলে মোদী সরকারকে আবার পর্যুদস্ত করতে হবে। প্রমাণ করতে হবে যে দেশের সম্পত্তি, ব্যাঙ্ক-বিমা ইত্যাদি পুঁজিপতিদের হাতে সস্তায় তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে তার খেসারত সরকারকে দিতে হবে। সমস্ত প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, বামপন্থী শক্তিসমূহের উচিত এখন থেকেই এই বিশাল লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু করা।