আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২১ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

দেশের কথা

অমিতাভ রায়


মাঠ-ময়দান-মঞ্চ থেকে শুরু করে সংসদ-বিধানসভা সর্বত্রই সুজন চক্রবর্তী সক্রিয়। বাম ঘরানার রাজনৈতিক বার্তা প্রচার ও প্রসারের কাজে তিনি সর্বদাই ব্যস্ত। মানুষের নিত্যদিনের চাওয়া-পাওয়া অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তথ্যের ভিত্তিতে যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণ সহজ সরল ভাষায় উদ্যত স্বরে উচ্চারণ করতে সুজন চক্রবর্তী সক্ষম। এবং প্রয়োজনে তিনি কলমও ধরতে পারেন।

সাংগঠনিক প্রয়োজনে সুজন চক্রবর্তী গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। তার থেকে বাছাই করা তেরোটি প্রবন্ধ নিয়ে নির্মিত হয়েছে একটি স্বল্পকায় বই 'দেশপ্রেম বাংলা ভাগ ও তারপর'। প্রবন্ধগুলি গত তিন দশকে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত। তবে প্রতিটি প্রবন্ধই একটি নির্দিষ্ট প্রত্যয় উচ্চারিতঃ বামপন্থাই সুস্থভাবে বেঁচে থাকার ও জনজীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক এবং একমাত্র পথ।

প্রবন্ধগুলিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় হিন্দু ও মুসলিম মৌলবাদীদের ভূমিকা যথাযথ ভাবে আলোচিত হয়েছে। একই সঙ্গে বিবৃত হয়েছে আজাদীর লড়াইয়ে বামপন্থীদের সংগ্রামের কাহিনী। সেই সময়ে জাতীয়তাবাদী রাজনীতি কোন পথে পা মিলিয়েছিল তার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। দেশভাগের পটভূমিতে জাতীয়তাবাদীদের অবস্থান ও বামপন্থীদের বিরোধিতার তথ্যও বিভিন্ন প্রবন্ধে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সর্বোপরি দেশভাগের যন্ত্রণা ও বাস্তুহারাদের বঞ্চনার কথা নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে দেশভাগের পর বাংলার পূর্বাঞ্চল থেকে আগত বাস্তুহারাদের কোনওদিনই সরকারি বয়ানে উদ্বাস্তু বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সর্বস্ব হারিয়ে আসা এক কোটিরও বেশি ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ সরকারের নথিতে আজও ইস্ট পাকিস্তান ডিসপ্লেসড পার্সনস্ (ইপিডিপি) হিসেবে পরিচিত। রাষ্ট্রপুঞ্জের নীতি অনুসারে উদ্বাস্তুদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান এবং শিক্ষা-স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান যথাযথ জীবনযাপনের বন্দোবস্ত করা আশ্রয়দাতা দেশের কর্তব্য। একই সময়ে পাঞ্জাব বিভাজনের পরে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত মানুষেরা উদ্বাস্তু বলে নথিভুক্ত হওয়ায় রাষ্ট্রপুঞ্জের নিয়ম-নীতি অনুযায়ী যাবতীয় সুযোগ সুবিধা পেয়েছিলেন। এহেন বৈষম্যমূলক সরকারি আচরণের প্রসঙ্গেও লেখক লিখেছেন। তবে বিষয়টি নিয়ে আরও ব্যাখ্যা করার অবকাশ ছিল।

দেশভাগের পরবর্তী সময়ে মানুষের বিভিন্ন দাবিদাওয়া আদায়ের লড়াই সংগঠিত করার ক্ষেত্রে বামপন্থীদের ভূমিকা ও দায়িত্ব পালনের বিবরণ প্রবন্ধগুলিতে বলা হয়েছে। দুই মলাটের মধ্যে সংগৃহিত প্রবন্ধগুলি অতীতের ঘটনাবলী নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়ায় বইটিকে প্রামাণ্য নথি হিসেবে গণ্য করা যায়।

বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধঃ বিষনজরে বাংলা। রুখতে পারে বামপন্থীরাই। ১৯৫৬-র পয়লা মে ভারতের দ্বিতীয় শিল্প নীতি ঘোষণার মাধ্যমে পশ্চিম বাংলায় যে বঞ্চনার ইতিবৃত্ত রচিত হওয়া শুরু হয় তার পূর্ণাঙ্গ পরিণতি ছিল মাশুল সমীকরণ নীতি। দেশের দ্বিতীয় শিল্প নীতিকে ভিত্তি করে ১৯৫৬-র ১০ই জুন ভারত সরকার জারি করে মাশুল সমীকরণ নীতি। অর্থাৎ ভারী শিল্পের মূল উপাদান কয়লা এবং লৌহ আকরিকের দাম দেশের সর্বত্র সমান করে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। খনি মুখে কয়লা ও লৌহ আকরিক যে দামে পাওয়া যেত সেই দামেই দেশের দূরবর্তী অঞ্চলেও পাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেওয়া হল। অথচ কৃষিজাত পণ্য যেমন তুলা কিন্তু মাশুল সমীকরণ নীতির আওতায় এল না।

মাশুল সমীকরণ নীতির বিরোধিতায় বামপন্থীরা বরাবরই সোচ্চার। বামপন্থী সাংসদরা সংসদের অন্দরে নিয়মিত এই নীতির বিরোধিতা করেছেন। মাঠে-ময়দানে প্রচার করেছেন। পশ্চিম বাংলার শিল্প অবনয়নের প্রধান কারণটিকে ভুলিয়ে দেওয়ার তাগিদে পাশাপাশি চলতে থাকে অন্য প্রচারঃ 'বামপন্থী আন্দোলনের জন্য রাজ্যের শিল্পের করুণ পরিণতি'। রাজ্য স্তরে তো বটেই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিসরেও এই বার্তা দ্রুত গতিতে ধারাবাহিক ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হতে থাকে। জনমানসে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। এবং সেই প্রচার আজও অব্যাহত। অনেকদিন পর সুজন চক্রবর্তী বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করায় নবীন প্রজন্মের বিতর্ক সমৃদ্ধ হবে।

দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়ে বামপন্থীরা যে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তারই ধারাবাহিকতায় দেশভাগের বিরুদ্ধে ১৯৪৭-এ তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি যে অবস্থান নেয় সেই দলিলও পরিশিষ্ট পর্যায়ে যুক্ত হওয়ায় বইটির মান নিঃসন্দেহে অনেক উন্নত হয়েছে।

গণ আন্দোলনের প্ৰয়োজনীয়তা আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে লেখক উপস্থাপন করেছেন আন্দোলনের সাফল্য। সেই সাফল্যের অন্যতম মাইলফলক দীর্ঘদিনের বামপন্থী সরকার। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় একটি অঙ্গ রাজ্যে জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য কতরকমের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে তার উল্লেখ করে লেখক তথ্য পরিবেশন করে নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছেন বাম শাসনে কী কী হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে দুর্বলতাগুলিকে নির্দিষ্ট করে দিলে প্রবন্ধগুলি সম্পৃক্ত হতে পারত।

সাংসদ থাকাকালীন সুজন চক্রবর্তী বেশ কয়েকটি কেন্দ্রীয় প্রকল্প পশ্চিম বাংলায় স্থাপনের জন্য ভারত সরকারের নীতিগত অনুমোদন আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যেমন, নাইপার (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ্ ফার্মাসিউটিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ), সিএসআইআর (কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ) ট্র্যান্সলেশনাল রিসার্চ শাখা, ন্যাশনাল সেন্টার অফ্ ন্যানো টেকনোলজি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ্ ম্যানগ্রোভ রিসার্চ অ্যান্ড কোস্টাল বায়োস্ফিয়ার, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ্ ওশান টেকনোলজি (পূর্বাঞ্চলীয় শাখা), সায়েন্স পার্ক, টেরি, পূর্বাঞ্চলীয় শাখা (দ্য এনার্জি রিসার্চ ইনস্টিটিউট), স্পাইস্ রিসার্চ সেন্টার, ডিআরডিও, পূর্বাঞ্চলীয় শাখা (ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন) ইত্যাদি। এইসব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য তাঁর উদ্যোগে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জেলা সদরের আশপাশে কমবেশি ৫০০ একর জমি আহরণ করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে। তবে পশ্চিম বাংলায় একটিও হয়নি। এই বিষয়ে একটি প্রবন্ধ প্রণয়ন প্রয়োজন ছিল। এবং তা এই বইয়ে সংযুক্ত হলে বইটি নিশ্চিতরূপে সমৃদ্ধ হতে পারত।


দেশপ্রেম বাংলা ভাগ ও তারপর
ড. সুজন চক্রবর্তী
আবুল বাসার বুক সেন্টার
বারুইপুর, কলকাতা-৭০০১৪৪
সেপ্টেম্বর, ২০২১
দামঃ ১০০ টাকা