আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২১ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

লেগে যা নারদ নারদ...

গৌরব মুখোপাধ্যায়


"The written word hasn’t kept up with the age... The movies have outmaneuvered it. We have the talkies, but as yet no Readies." - Bob Brown

দুনিয়ায় কিছু দ্বন্দ্ব চিরকালীন। যদিও দ্বন্দ্বের বিষয় দুটো যার যার নিজের পথেই বয়ে যায়, পরিণত হয় - পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব বজায় রেখেই। মানুষ মানুষের স্বার্থেই এই দ্বন্দ্ব তৈরি করে। চিরকাল পরম যত্নে তাকে লালন পালন করে কোনও কারণ ছাড়াই!

এমনই একটি চিরকালীন দ্বন্দ্ব - মুদ্রিত বই আর ই-বই-এর মধ্যে। মজার ব্যাপার হল ১৯৩০-এর দশক থেকেই এটা চলে আসছে, অথচ নব্বই বছর পার করেও মুদ্রিত বই আর ই-বই যার যার নিজের স্থানে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। কারোর জনপ্রিয়তায় কোনও ভাটা পড়েনি। বই পড়ার দুটো ভিন্ন মাধ্যম হওয়া সত্ত্বেও উভয়ই বর্তমানে সমান প্রাসঙ্গিক। মানুষ প্রধানতঃ ব্যবসায়িক স্বার্থে বরাবর মাধ্যম দুটোকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করে এসেছে। আমাদের দেশে সেই প্রচেষ্টাকে মদত জুগিয়েছে বৈদ্যুতিন মাধ্যম সম্বন্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অজ্ঞতা। অজ্ঞতা থেকেই ধীরে ধীরে জন্ম নেয় ভীতি। যাঁরা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে (বিশেষ করে সেলফোনে) স্বচ্ছন্দ ও সেই মাধ্যম সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল তাঁদের কাছে উভয় মাধ্যমেই অনায়াস যাতায়াত চলে। যাঁদের তা নয়, তাঁরা ছাপাই বইতেই তৃপ্ত। তাঁরা সেখানেই স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে নেন।

বিষয়টা আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধারণ মনে হলেও বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আদৌ তা নয়। দুটো ভিন্ন মাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা দুই প্রজন্মের কাছেই সমান গুরুত্বপূর্ণ - এই সারসত্যকে উনিশশো তিরিশের দশকে শিকাগো শহরে প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন জনৈক লেখক, কবি, প্রকাশক ও প্রমোদানুষ্ঠানের সংগঠক বব ব্রাউন। সেই জন্যই তাঁকে বলা হয় ই-পাঠের পথিকৃৎ (The Godfather of the e-Reader)। উনিই সর্বপ্রথম বলেছিলেন, "ছাপার অক্ষর ঠিক সময়ের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না। চলচ্চিত্র মাধ্যম এসে চোরের উপর বাটপাড়ি করেছে। চলচ্চিত্র মাধ্যম যদি সবাক (Talkies) হতে পারে, ছাপা বইয়ের মাধ্যমের সহজেই দৃশ্য-শ্রাব্য (Readies) হতে বাধা কোথায়?"

অনেকেই হয়তো জানেন এই ১৯৩০-এই পেপারব্যাক বই এসেছে। কিন্তু খুব স্বল্প সংখ্যক মানুষই জানেন যে ওই বছরই ই-বই (electronic books)-এর ধারণার প্রকাশ ঘটেছিল। বব ব্রাউন তাঁর ই-বই আবিষ্কারের ওপরে বই লিখলেন। 'টকিজ'-র নামানুসারে নিজের লেখা বইয়ের নাম দিলেন 'রিডিজ' (The Readies)। মজার কথা হল প্রথম 'সবাক চলচ্চিত্র' দেখেই এই ধারণা তাঁর মাথায় এসেছিল। বব ব্রাউন ব্যাখ্যা করলেন কেন ই-বই দরকার। বললেন, "বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পড়তে হলে, আমার একটা যন্ত্র দরকার"। ভবিষ্যতের আদর্শ ই-পাঠকে উনি বর্ণনা করলেন - "একটা খুব সাধারণ পড়ার যন্ত্র যেটা আমি খুব সহজেই যত্রতত্র বয়ে নিয়ে যেতে পারবো, আর সেটা কোনো বৈদ্যুতিক প্লাগ-এ লাগিয়ে একশো থেকে হাজার শব্দের উপন্যাস দশ মিনিটেই পড়ে ফেলতে পারবো সত্যিই যদি আমি চাই, আর আমি সেটাই চাই"। উনি আরও যোগ করলেন, "যন্ত্রটা পাঠককে অক্ষরের আকার সমন্বয় করতে ও পৃষ্ঠা ওল্টানো রোধ করতে সাহায্য করবে"। পাঠক একটি নিরবিচ্ছিন্ন পাঠের আনন্দ উপভোগ করবেন।


বব ব্রাউন

ব্রাউন সাহেবের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে চল্লিশ বছর লেগে গেল। ১৯৭১ সালে জনৈক মার্কিন লেখক মাইকেল এস. হার্ট (Michael S. Hart) চালু করলেন 'গুটেনবার্গ প্রকল্প' (Project Gutenberg)। যেখানে তিনি 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র' (U.S. Declaration of Independence) ডিজিটাইজ করার মাধ্যমে পৃথিবীর সর্বপ্রথম ই-বইটির সূচনা করলেন। ইন্টারনেটের মাধ্যমে এই প্রথম কোনো বই জনসাধারণের কাছে বিনামূল্যে প্রকাশিত হল। বলা বাহুল্য এতে পাঠকের বই পড়ার ক্ষেত্রে তো বটেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বই সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও একটি নতুন অধ্যায় শুরু হল। এই ১৯৭১ সালটি আরও একটি ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তা হল এই বছরই দুটি মেইনফ্রেম কম্পিউটারের মধ্যে সর্বপ্রথম ইমেইল বার্তা আদান-প্রদান করা হয়েছিল!

আজ থেকে বছর ১৪-১৫ আগেও পাঠক সমাজে এমনকি প্রকাশকদের মধ্যেও ই-বই নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা ছিল। তাঁদের কাছে 'ই-বুক' মানেই ছিল মুদ্রণ শিল্পের ঘাটতি, সাহিত্যের অপমৃত্যু এবং পুস্তক প্রকাশের পরিসমাপ্তি। ২০০৭ সালে পাঠক মহলে তাদের উত্থান ছিল দ্রুত এবং এটি স্পষ্ট ছিল যে এই যত্রতত্র পাঠ্য ফাইলগুলি অবিচ্ছিন্নভাবে পড়ার জগতকে সম্ভবতঃ চিরকাল বিপর্যস্ত করে রাখবে।

এই বছরই পঠনপাঠনের জগতে এক মহাবিপ্লব এসেছিল যা মানুষের পাঠ্যাভাসকে চিরকালের মতো পরিবর্তন করে দিয়েছিল - আমেরিকার 'আমাজন' কোম্পানি তাদের 'কিন্ডল' ই-বুক বাজারে নিয়ে এলো। আর এই ২০০৭ সালেই 'অ্যাপেল' কোম্পানি প্রথম আইফোন সর্বসমক্ষে নিয়ে এলো।


বব ব্রাউন-এর মস্তিস্কপ্রসূত একটি ইলেকট্রনিক রিডিং মেশিনের কল্পিত প্রদর্শন।
Source: The Architecture of Possibility.

অথচ বাস্তবে 'পুস্তক প্রকাশের পরিসমাপ্তি' ঘটল না। বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার নিজস্ব ট্যাবলেট ডিভাইসগুলি জনসমক্ষে আগমনের সাথে সাথে, ই-বইগুলি দ্রুত মোট বই-বাজারের এক চতুর্থাংশের চেয়ে কিছুটা বেশি দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হচ্ছিল এই নতুন পঠন মাধ্যমে মুদ্রণ বইয়ের বাজার পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে - তবে তা হয়নি। এটি তার নিজস্ব স্থানে শীর্ষে ছিল এবং সেখানেই গত কয়েক বছর ধরে এটি অবিচল থেকেছে।

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগবে এমন কেন ঘটল? মূলত এর নেপথ্যে আশ্চর্যজনক ভাবে দায়ী মুদ্রিত বইগুলিই! প্রত্যেকেই মুদ্রিত বই পছন্দ করে - আপনার হাতে একটি ছাপাই বই ধরে রাখা, কাগজ ও মুদ্রণের গুণমান যাচাই করা, এর পৃষ্ঠাগুলির ঘ্রাণ নেওয়া, ওজন অনুভব করা এবং শেষ পর্যন্ত আপনি যখন বইয়ের গভীরে ডুব দেন এবং নিজেকে একটি নতুন বিশ্বে আবিষ্কার করেন তখন, পাঠকমাত্রেই জানেন এর আনন্দ অনুভব করার মতো তৃপ্তি আর কিছুতে নেই।

একটি ছাপাই বই পড়া হ'ল 'ট্যাবলেট পঠন'-এর নিস্তরঙ্গ ভার্চুয়াল জগতে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা এবং এটি সেই অভিজ্ঞতা যা পাঠকদের আরও বেশি করে মুদ্রিত বইয়ের জগতে ফিরিয়ে আনতে পারে।

যদিও ই-বইগুলির তাদের নিজস্ব সুবিধা রয়েছে। যেমন অতীতে কোথাও ভ্রমণকালের শুরুতে কোনো পুস্তকপ্রেমীর লাগেজগুলিতে কয়েক কেজি বই নিয়ে তাঁকে ভ্রমণ করতে হতো। আর এখন তিনি তাঁর মুঠোয় বন্দী মোবাইল বা ট্যাবলেটে তাঁর সমস্ত পছন্দের বই বহন করতে পারেন! এখন আপনার নিজের পছন্দের প্রত্যেকটি বই আপনার তর্জনীর ডগায় রয়েছে। আপনি যদি হঠাৎ কোনও বই চান, তবে তর্জনীর মৃদু চাপেই বইটি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আপনার কাছে পৌঁছে যাবে সে আপনি বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুন না কেন।

ধরুন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে আপনার নিকটতম পুস্তক বিপণিটিতে যেতে আপনাকে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের পথ পাড়ি দিতে হবে, বা আপনি যদি একজন অভিভাবক হন এবং আপনার সন্তানদের কাছ থেকে দ্রুত সময় বের করার প্রয়োজন হয় তখন আপনার গন্তব্য হতে পারে প্রকাশকের ভার্চুয়াল ই-বুক স্টোর। সবথেকে বড় কথা। ই-বইগুলি ছাপা বইয়ের তুলনায় সস্তা!

পরবর্তীকালে ১৯৯৮ সালে চারটে বড় ঘটনা ই-বইয়ের জগতে ঘটেছিল - ১) 'রকেট ই-বুক' আর 'সফটবুক' নামে দুটি ডেডিকেটেড ই-বুক রিডার সর্বসমক্ষে এলো; ২) প্রথম ই-বইটির আই.এস.বি.এন. প্রাপ্তি ঘটলো; ৩) আমেরিকার লাইব্রেরিগুলি পাঠকদের বিনামূল্যে তাদের ওয়েবসাইট ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক সার্ভিসের মাধ্যমে ই-বই প্রদান করতে লাগলো; আর ৪) আমেরিকার 'সিলিকন ভ্যালি'তে ল্যারি পেজ ও সের্গে ব্রিন নামে দুজন তরুণ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার 'গুগল' নামে একটি সার্চ ইঞ্জিন দুনিয়ার সামনে নিয়ে এলেন। এই বৈপ্লবিক ঘটনাগুলি ই-বই-এর জগতকে দ্রুত কয়েক ধাপ এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।

সুতরাং নির্দ্বিধায় বলা যায়, মুদ্রিত বই এবং ই-বই একই বিষয় অনুভব করার জন্য কেবল ভিন্ন দুটি মাধ্যম মাত্র। ই-বই-এর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র লেখাগুলি কম্পোজ হবার পর ভ্রম সংশোধন করে লেখাটির পরিমার্জিত সংস্করণ আপনার ফোনে বা অন্য কোনো ডিভাইস-এ পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টিই বিবেচ্য নয় - গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হ'ল বইয়ের শব্দগুলি শেষপর্যন্ত পাঠকের কাছে উপলব্ধ, এতে মুদ্রণ এবং ই-বই উভয়ই সমৃদ্ধ হচ্ছে, প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্থানে স্বমহিমায় উজ্জ্বল।