আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২১ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

লেখক সন্ধানী সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথ

শুভাশিস মণ্ডল


তেত্রিশ বৎসর ছয় মাস বয়সে প্রকাশ্যত 'সাধনা' (নভেম্বর, ১৮৯৪) পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ। যদিও প্রেসিডেন্সির স্নাতক ভ্রাতুষ্পুত্র সুধীন্দ্রনাথকে তার তিন বৎসর পূর্বে সাধনা (নভেম্বর, ১৮৯১) সম্পাদকের পদে বসিয়ে ব-কলমে সাধনা-সম্পাদনা করতেন তিরিশ বৎসর ছয় মাস বয়সের সুধীন্দ্র-পিতৃব্য রবীন্দ্রনাথ। অর্থাৎ প্রকাশ্যত না হলেও অপ্রকাশ্যে ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দ থেকেই সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ। সাধনার প্রকাশ-অবসান ঘটে কার্তিক, ১৩০২ (নভেম্বর, ১৮৯৫)-এ। তারপর দুই বৎসর পাঁচ মাস পর, দায়িত্ব গ্রহণ করেন 'ভারতী' (বৈশাখ, ১৩০৫/এপ্রিল, ১৮৯৮)র। এক বছর 'ভারতী' সম্পাদনার পর তার দায়িত্ব ত্যাগ করেন চৈত্র, ১৩০৫ (এপ্রিল, ১৮৯৯)-এ। তারপরের দুই বৎসর তিনি আর কোনও সাময়িকপত্রের সম্পাদনা-ভার গ্রহণ করেননি। বৈশাখ, ১৩০৮ (এপ্রিল, ১৯০১)-এ পুনরায় 'বঙ্গদর্শন নবপর্যায়'-এর সম্পাদকতা শুরু করেন। টানা পাঁচ বছর 'বঙ্গদর্শন নবপর্যায়' সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথ। বৈশাখ, ১৩০৮ (এপ্রিল, ১৯০১) থেকে চৈত্র, ১৩১২ (এপ্রিল, ১৯০৬) পর্যন্ত। রবীন্দ্রনাথ-সম্পাদিত 'বঙ্গদর্শন নবপর্যায়'-এর শেষ বছর অর্থাৎ বৈশাখ, ১৩১২ (এপ্রিল, ১৯০৫) থেকে চৈত্র, ১৩১৩ (মার্চ, ১৯০৬)-এই কালপর্বে পুরোপুরি এক বছর তিনি একই সঙ্গে 'বঙ্গদর্শন নবপর্যায়' এবং 'ভাণ্ডার' পত্রিকার সম্পাদন-কর্ম চালনা করেন। এক বছর একইসঙ্গে দুটি পত্রিকা সম্পাদনার পর, চৈত্র, ১৩১২ (এপ্রিল, ১৯০৬)-তে 'বঙ্গদর্শন নবপর্যায়'-এর সম্পাদন-দায়িত্বভার ত্যাগ করেন, কিন্তু 'ভাণ্ডার' সম্পাদনা চালিয়ে যান। দুই বৎসর এক মাস 'ভাণ্ডার' সম্পাদনার পর বৈশাখ, ১৩১৪ (এপ্রিল, ১৯০৭)-তে ভাণ্ডার সম্পাদন-ভার ত্যাগ করেন। অর্থাৎ বৈশাখ, ১৩০৮ (এপ্রিল, ১৯০১) থেকে বৈশাখ, ১৩১৪, (এপ্রিল, ১৯০৭) পর্যন্ত, একটানা ছয় বৎসর এক মাস 'বঙ্গদর্শন নবপর্যায়' এবং 'ভাণ্ডার' পত্রিকার সম্পাদনা-কর্ম পরিচালনা করেন সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথ। 'ভাণ্ডার'-এর দায়িত্বভার ত্যাগ করার পরের চার বছর (মে, ১৯০৭ থেকে মার্চ, ১৯১১) তিনি আর কোনও সাময়িকপত্রের সম্পাদন-ভার গ্রহণ করেননি। বৈশাখ, ১৩১৮ (এপ্রিল, ১৯১১) থেকে আদি ব্রাহ্মসমাজের তৎকালীন সম্পাদক রবীন্দ্রনাথকে একই সঙ্গে সমাজের মুখপত্র 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা'র সম্পাদকের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সেই দায়িত্ব তিনি পালন করেন চার বছর। অর্থাৎ চৈএ, ১৩২১ (এপ্রিল, ১৯১৫) পর্যন্ত 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা' সম্পাদনার পর বাংলা সময়িকপত্র-সম্পাদক রবীন্দ্রনাথের সম্পাদক-জীবনের সমাপ্তি ঘটে। যদিও আরও আট বছর পর, ১৯২৩-এর এপ্রিল-এ রবীন্দ্রনাথকে আমরা 'এডিটরি' করতে দেখি 'Visva-Bharati Quarterly' নামক একটি ইংরেজি সাময়িকপত্রের প্রথম সংখ্যাটির।

ত্রিশ বৎসর ছয় মাস বয়সে অপ্রকাশ্যে 'সাধনা' সম্পাদনার যে দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছিলেন, ভারতী, বঙ্গদর্শন-নবপর্যায়, ভাণ্ডার পার করে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার দায়িত্ব যখন ত্যাগ করেন, তখন তাঁর তিপ্পান্ন বৎসর এগারো মাস বয়েস। অর্থাৎ নভেম্বর, ১৮৯১ থেকে এপ্রিল, ১৯১৫ - এই তেইশ বৎসর পাঁচ মাস কালপর্বে, বিচ্ছিন্ন ব্যবধানে সর্বমোট বারো বৎসর এক মাস প্রত্যক্ষত যুক্ত ছিলেন পাঁচ-পাঁচটি সাময়িকপত্র-সম্পাদনায়। এই সময়কালে সম্পাদিত সাময়িকপত্রের যাবতীয় লেখক-লেখিকাদের সঙ্গে সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ ঘটে সেই সেই পত্রিকার প্রয়োজন অনিবার্যতায়।

রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় পাঁচটি সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়েছিল সর্বমোট বারো বছর এক মাস কালসীমায়। কিন্তু বৈশাখ-চৈত্র, ১৩১২ (এপ্রিল, ১৯০৫ - মার্চ, ১৯০৬)-তে 'বঙ্গদর্শন নবপর্যায়' এবং 'ভাণ্ডার' একই সঙ্গে প্রকাশিত হওয়ায় মোট ১৩ বছর ১ মাস অর্থাৎ সর্বমোট ১৫৭ মাস সম্পাদন-দায়িত্বভার পালন করেন রবীন্দ্রনাথ। ১৫৭ মাসে পাঁচটি সাময়িকপত্রের মোট ১৪৭টি সংখ্যা সম্পাদনা করেন তিনি। সাধনা বারো মাসে প্রকাশিত হয় দশটি সংখ্যা। 'সাধনা'র শেষ তিন মাসে তিনটি সংখ্যার বদলে ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক, ১৩০২ একত্র একটি সংখ্যায় প্রকাশিত হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ-সম্পাদিত সাধনার এক বৎসরে প্রকাশিত সংখ্যা - দশ। 'ভারতী'র বর্ষব্যাপী রবীন্দ্র-সম্পাদনায় প্রকাশিত-সংখ্যা - দশ। পৌষ ও মাঘ, ১৩০৫ এবং ফাল্গুন ও চৈত্র, ১৩০৫ - এই চার মাসে দুটি যুগ্ম-সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ-সম্পাদিত ভারতীর বারো মাসে দশটি সংখ্যা পাওয়া যায়। 'বঙ্গদর্শন নবপর্যায়'-এ কোনও যুগ্ম-সংখ্যা প্রকাশিত হয়নি, ফলত পাঁচ বছরে ষাটটি সংখ্যা প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায়। 'ভাণ্ডার' সম্পাদনা করেন দুই বৎসর এক মাস, অর্থাৎ পঁচিশ মাস। পঁচিশ মাসে 'ভাণ্ডার'-এর তিনটি যুগ্ম-সংখ্যা-(ভাদ্র-আশ্বিন, ১৩১২, শ্রাবণ-ভাদ্র, ১৩১৩, অগ্রহায়ণ-পৌষ, ১৩১৩) প্রকাশিত হওয়ায় মোট ২২টি সংখ্যা সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথ। 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা' সম্পাদনা করেন চার বৎসর অর্থাৎ আটচল্লিশ মাস। এই আটচল্লিশ মাসে তিনটি যুগ্ম-সংখ্যা (আশ্বিন-কার্তিক, ১৩১৮, অগ্রহায়ণ-পৌষ, ১৩২০, আশ্বিন-কার্তিক, ১৩২১) প্রকাশিত হওয়ায় প্রকৃতপক্ষে পঁয়তাল্লিশটি সংখ্যা সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথ-সম্পাদিত পাঁচটি সাময়িকপত্রের ১৪৭টি সংখ্যায় 'বিজ্ঞাপন', 'ভ্রম সংশোধন', 'আয়-ব্যয়' ইত্যাদির হিসাব এবং 'প্রশ্ন' প্রভৃতি প্রকাশিত হয় ৫৬টি। সর্বমোট ১০০টি রচনায় রচনাকারের নাম প্রকাশিত হয়নি। রচনাকারের নাম পাওয়া যায় ১৭০১টি রচনায়। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় পাঁচটি সাময়িকপত্রে মোট ১৮০১টি রচনা প্রকাশিত হয়। স্বয়ং সম্পাদক লিখেছিলেন ৫৭৩টি রচনা। সম্পাদক ব্যতীত অন্যান্য লেখকেরা (যাঁদের রচনায় লেখক-নাম প্রকাশিত হয়েছিল) লেখেন ১১২৮টি রচনা। সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য সদস্যদের লেখা - ২৫৩টি। সম্পাদক এবং ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য সদস্যদের মোটরচনা ৫৭৩+২৫৩=৮২৬টি। সম্পাদক ও ঠাকুর-পরিবারভুক্ত অন্যান্য সদস্য ভিন্ন, আর যে অন্যান্য লেখকেরা লিখেছিলেন, তাঁদের রচনা সংখ্যা - ৮৭৫। সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় আমরা মোট ২৩৬ জন প্রকাশিত-নামা লেখকের রচনা প্রকাশিত হতে দেখি পাঁচটি সাময়িকপত্রে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, একশোটি রচনায় রচনাকারের নাম প্রকাশিত না হওয়ায় তাঁদের পরিচয় অজ্ঞাত। যদিও নামহীন-অস্বাক্ষরিত রচনাগুলি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় বলেই আমাদের মনে হয়েছে।

আমাদের অনুসন্ধান সম্পাদক-ব্যতীত অন্যান্য ২৩৬ জন লেখক-লেখিকাদের নিয়ে। তাঁরা কারা? কী তাঁদের পরিচয়? সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কোন্ কোন্ সূত্রে তাঁদের যোগাযোগ? সম্পাদন-কালে এতজন লেখকের রচনা কীভাবে তিনি সংগ্রহ করলেন? লেখককুলের উৎস-সন্ধান করতে গিয়ে আমরা তাঁদের কয়েকটি বর্গে ভাগ করে নিয়ে সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করেছি -

ক. ঠাকুরবাড়ি এবং এই পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়-সম্বন্ধযুক্ত লেখকেরা

সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথের পরিবার তৎকালীন বাংলাদেশে শিক্ষা-সংস্কৃতিক্ষেত্রে ও নানান সামাজিক-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়ে মতামত প্রকাশে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়েরা সম্পাদকের আহবানে সাড়া দিয়ে লেখনী ধারণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় যে পাঁচটি সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়েছিল সেই পত্রিকাগুলিতে ঠাকুরবাড়ির সদস্য-আত্মীয় কুড়ি জন লেখকের সন্ধান পাই আমরা। এই কুড়ি জন সদস্যের ২৫৩টি রচনা সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ করেছিলেন। ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের মধ্যে যেমন ছিলেন অগ্রজ-সহোদর দ্বিজেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ। সহোদরা স্বর্ণকুমারীদেবী। ভ্রাতুষ্পুত্র অবনীন্দ্রনাথ, ক্ষিতীন্দ্রনাথ, দিনেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ। ভাগিনেয়ী সরলাদেবী, হিরন্ময়ীদেবী। সম্পাদকের দুই-কন্যা অতসীলতা, মাধুরীলতা, জামাতা নগেন্দ্রনাথ ও সত্যেন্দ্রনাথ। ভ্রাতুষ্পুত্রবধূ হেমলতাদেবী (বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথের দ্বিতীয়-স্ত্রী)। ঠাকুরবাড়ির আত্মীয়-সম্বন্ধযুক্ত আরও তিন জামাতার সন্ধান পাই আমরা, যাঁরা আদতে সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের জামাতা হলেও হৃদ্যতায় তাঁরা বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। এঁরা হলেন আশুতোষ চৌধুরী (সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথের জামাতা, প্রতিভাদেবীর স্বামী)। প্রমথ চৌধুরী (মেজোদাদা সত্যেন্দ্রনাথের জামাতা, ইন্দিরাদেবীর স্বামী) এবং মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায় (বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের জামাতা, সরোজার স্বামী)।

রবীন্দ্রনাথ-সম্পাদিত সাময়িকপত্রে ঠাকুরবাড়ির সদস্য ও আত্মীয়, যাঁদের রচনা প্রকাশিত হয়েছিল, তাঁরা হলেন - দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বর্ণকুমারী দেবী, সরলা দেবী, হিরন্ময়ী দেবী, হেমলতা দেবী, অতসীলতা দেবী, মাধুরীলতা দেবী, আশুতোষ চৌধুরী, নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রমথ চৌধুরী, মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।

খ. অনাত্মীয়, অন্তরঙ্গ সুহৃদ এবং সাহিত্য-আগ্রহী বন্ধু-মহল

সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথ শুধু ঠাকুরপরিবারের সদস্যদের লেখা নিয়েই বকলমে 'সাধনা'র প্রথম সংখ্যা (অগ্রহায়ণ, ১২৯৮) সম্পাদনা শুরু করেছিলেন। সময়ের অমোঘ নিয়মে ঠাকুরপরিবার ব্যতিরেকে অনাত্মীয়, অন্তরঙ্গ সাহিত্যানুরাগী-সুহৃদদের লেখা সংগ্রহ শুরু করেন। আর, সেখান থেকেই সূচিত হয় রবীন্দ্র-লেখকগোষ্ঠীর নির্মাণ। তেইশ বছর পাঁচ মাস সময়ের বিস্তৃত সম্পাদন-কালপর্বে বহু মানুষের সংস্পর্শে আসেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁদের মধ্যেই কেউ কেউ হয়ে ওঠেন 'কাছের মানুষ'। যাঁদের সঙ্গে হয়তো তাঁর রক্তের সম্পর্ক নেই, কিন্তু 'সাহিত্য'কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে আত্মীয়তা। সেরকম বেশ কিছু মানুষের সন্ধান পাই আমরা, যাঁদের কাছ থেকে সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথ সংগ্রহ করেছিলেন ৮২টি রচনা। সম্পাদকের অনাত্মীয়, কিন্তু অন্তরঙ্গ সুহৃদ এবং সাহিত্যপ্রেমী বন্ধুরা হলেন - কৃষ্ণবিহারী সেন, কেদারনাথ দাশগুপ্ত, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন দাশ, জগদানন্দ রায়, জগদিন্দ্রনাথ রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, প্রিয়নাথ সেন, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, মহিমচন্দ্র দেববর্মা, মোহিতচন্দ্র সেন, রাজনারায়ণ বসু, শরৎকুমারী দেবী, শ্রীশচন্দ্র মজুমদার।

গ. সমকালীন বিখ্যাত লেখক-কবি-সমালোচক

সাময়িকপত্র সম্পাদনা করতে গেলে সমকালীন খ্যাতনামা লেখক-কবি-সমালোচকদের রচনা সংগ্রহ এবং প্রকাশ অবশ্য কর্তব্য। অনেক ক্ষেত্রে রচনার বিষয়বস্তু নয়, প্রখ্যাত লেখকদের ‘নাম’ এবং ‘সুনাম’ পত্রিকার পাঠক-সংখ্যা বৃদ্ধি করে, পত্রিকার সুখ্যাতি প্রচারে সহায়ক হয়। দুই-যুগ কাল-পর্বের একযুগ-এক মাস সময় পত্রিকা-সম্পাদনে অতিবাহিত করেন সম্পাদক-স্রষ্টা। স্বভাবতই সমকালীন বিখ্যাত লেখকদের রচনা সংগ্রহ করে প্রকাশ করেন নিজ-সম্পাদনায়। সমকালীন প্রখ্যাত লেখকেরা, কেউ সম্পাদকের সমকালীন, কেউ অগ্রজ, কেউ অনুজ, এঁরা সকলেই সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় লেখা প্রকাশ করে বহুসংখ্যক পাঠকের কাছে তাঁদের বার্তা পৌঁছে দিত সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁরা যে শুধু রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় লিখেছিলেন, এমন নয়। পূর্বেই তাঁদের রচনার সঙ্গে পাঠকেরা পরিচিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের অনেককেই রবীন্দ্রগোষ্ঠীভুক্ত করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। সমকালীন খ্যাতনামা লেখকেরা হলেন - অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, অতুলচন্দ্র ঘোষ (ওরফে বীরেশ্বর গোস্বামী), উপেন্দ্রকিশোর রায় (চৌধুরী), ক্ষিতিমোহন সেন, চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়, দীনেন্দ্রকুমার রায়, দীনেশচন্দ্র সেন, নবীনচন্দ্র সেন, নিখিলনাথ রায়, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (কথা সাহিত্যিক), বিজয়চন্দ্র মজুমদার, বিধুশেখর শাস্ত্রী (শর্ম্মা/ভট্টাচার্য), বিপিনচন্দ্র পাল, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, যোগেশচন্দ্র রায়, রমেশচন্দ্র দত্ত, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, শরৎকুমার রায়, শিবনাথ শাস্ত্রী, সুকুমার রায় (চৌধুরী), হীরেন্দ্রনাথ দত্ত।

ঘ. সমকালীন অন্যান্য পত্রিকার প্রকাশক, পরিচালক, সহকারী-সম্পাদক, সম্পাদক - সম্পাদক-স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য রচনার সূত্রে সমকালীন বেশ কিছু পত্র-পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মূলত লেখক হিসেবে। রবীন্দ্র-রচনার সিংহভাগ পুস্তকাকারে প্রকাশের পূর্বে সাময়িকপত্রের পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর জীবদ্দশায় পঞ্চাশাধিক পত্র-পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন। ফলত নিজ পত্রিকাগুলি সম্পাদন-কালে অন্যান্য পত্রিকার সঙ্গে যু্ক্ত, এমন গুণী মানুষদের রচনা তো তিনি সংগ্রহ করবেনই - এটাই স্বাভাবিক। একটানা না হলেও, দীর্ঘ আড়াই-দশক জুড়ে পত্রিকা-সম্পাদনা-কর্মে যুক্ত থাকার সুবাদে সমকালীন অন্যান্য পত্রিকাগোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেইসূত্রে বেশ কিছু লেখকের সন্ধান পাই আমরা, যাঁদের রচনা রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় তাঁর পত্রিকাগুলিতে স্থান পায়। রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় লিখেছেন, সমকালীন অন্যান্য যে সমস্ত লেখকেরা আরও অন্যান্য পত্র-পত্রিকাগুলির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সেগুলি হল - গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা, ঐতিহাসিক চিত্র, সাধারণী, নববিভাকর-সাধারণী, প্রাচীন কাব্যসংগ্রহ, নবজীবন, ভারত-মিহির, ধরণী, সর্ব্বার্থ সংগ্রহ, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, সংবাদ জ্ঞানোদয়, প্রবাসী, নারায়ণ, মানসী ও মর্ম্মবাণী, বীণাবাদিনী, বঙ্গবাণী, ভারতী, প্রদীপ, ট্রিবিউন, ল-রিভিউ, ইন্ডিয়ান নেশন, ইন্ডিয়ান মিরর, সুলভ সমাচার, সবুজপত্র, পরিদর্শক, কৌমুদী, সন্ধ্যা-করালী, আসাম মিহির, কল্প, সুরভি, সুচিন্তা, মদ না গরল, তত্ত্বকৌমুদী, সমালোচক, সখা, মুকুল, সমদর্শী, সত্য জ্ঞানসঞ্চারিনী, হিতবাদী প্রভৃতি।

সমকালীন অন্যান্য পত্রপত্রিকাগুলির সঙ্গে গোষ্ঠীকোন্দল, কাদা-ছোঁড়াছুঁড়ি, পারস্পরিক-সমালোচনা ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রে থাকলেও, সম্পাদক-স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁদের সুসম্পর্কই ছিল বলা যায়। তার প্রমাণ নিম্নোক্ত ৩৬ জন লেখক-লেখিকা, যাঁরা কোনও না কোনও সময় অন্যান্য পত্র-পত্রিকার সঙ্গে প্রত্যক্ষত যুক্ত থাকলেও রবীন্দ্রনাথের আহবানে তাঁর সম্পাদিত পত্রগুলির জন্য লেখা পাঠাতে কুন্ঠিত হননি। সোৎসাহে যাঁরা রবীন্দ্র-সম্পাদিত সাময়িকপত্রগুলিকে সমৃদ্ধ করতে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা হলেন [১] -
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় [গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা - যুগ্ম পরিচালক (১২৮৯ বঙ্গাব্দ), ‘ঐতিহাসিক চিত্র’ - সম্পাদক (১৮৯৯ খ্রীঃ)],
অক্ষয়চন্দ্র সরকার [সাধারণী - সম্পাদক (১২৮০ বঙ্গাব্দ), নববিভাকর-সাধারণী - সম্পাদক (১২৯৩ বঙ্গাব্দ), প্রাচীন কাব্যসংগ্রহ - সম্পাদক (১২৮১ বঙ্গাব্দ), নবজীবন - সম্পাদক (১২৯১ বঙ্গাব্দ)],
অনাথবন্ধু গুহ [ভারতমিহির - সম্পাদক (১৮৭৫ খ্রীঃ)],
ইন্দ্রনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় [ধরণী-সম্পাদক (১৩০১ বঙ্গাব্দ)],
কালীবর বেদান্তবাগীশ [সর্ব্বার্থ সংগ্রহ - যুগ্ম-সম্পাদক (১২৭৯ বঙ্গাব্দ)],
ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর [তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা (১৮৪৩ খ্রীঃ) - সহ-সম্পাদক ও সম্পাদক (১৯১৪-২১, ২১-২৫, ২৫-২৬, ২৬-৩০, ৩০-৩১ - মোট ৫টি পর্যায়ে, ১৭ বছর সম্পাদনা করেছেন।],
চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় [সংবাদ জ্ঞানোদয় - সম্পাদক (১২৫৮ বঙ্গাব্দ), মাসিক সমালোচক - সম্পাদক ১৮৭৯ খ্রীঃ)],
চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় [প্রবাসী - সহ-সম্পাদক],
চিত্তরঞ্জন দাশ [নারায়ণ - সম্পাদক (১৩২১ বঙ্গাব্দ)],
চিন্তামণি চট্টোপাধ্যায় [তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা (১৮৪৩ খ্রীঃ) - যুগ্ম-সম্পাদক (১৯০৬-১০ খ্রীঃ)],
জগদিন্দ্রনাথ রায় [মানসী ও মর্ম্মবাণী - যুগ্ম-সম্পাদক (১৯১৬ খ্রীঃ)],
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর [বীণাবাদিনী (১৩০৪ বঙ্গাব্দ) - সম্পাদক (১৩০৪-০৬ বঙ্গাব্দ)],
দীনেশচন্দ্র সেন [বঙ্গবাণী যুগ্ম-সম্পাদক (১৩১৮ বঙ্গাব্দ)],
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর [ভারতী (১২৮৪ বঙ্গাব্দ) - সম্পাদক (১২৮৪-১২৯০ বঙ্গাব্দ), তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা (১৮৪৩ খ্রীঃ) - সম্পাদক (১৮৮৪-১৯০৮)],
নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত [প্রদীপ (১৩০৪-১৩০৬ বঙ্গাব্দ) - সম্পাদক, প্রভাত - সম্পাদক (১৩০৭ বঙ্গাব্দ), ট্রিবিউন - সম্পাদক (১৯১০ খ্রীঃ)],
নগেন্দ্রনাথ ঘোষ [ল-রিভিউ - সম্পাদক, ইন্ডিয়ান নেশন - আমরণ সম্পাদক],
নরেন্দ্র সেন [ইন্ডিয়ান মিরর - সম্পাদক (১৮৬১ খ্রীঃ), সুলভ সমাচার - সম্পাদক (১৯১১ খ্রীঃ)],
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় [মানসী ও মর্ম্মবাণী - যুগ্ম-সম্পাদক (১৯১৬ খ্রীঃ)],
প্রমথনাথ চৌধুরী [সবুজপত্র - সম্পাদক (১৯১৪ খ্রীঃ)],
বিজয়চন্দ্র মজুমদার [বঙ্গবাণী - যুগ্ম-সম্পাদক (১৩১ বঙ্গাব্দ)],
বিপিনচন্দ্র পাল [পরিদর্শক - সম্পাদক (১৮৮০ খ্রীঃ), পরিচালক-সম্পাদক (১৮৮৪ খ্রীঃ) কৌমুদী - সম্পাদক (১৮৯৪ খ্রীঃ)],
ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় [সন্ধ্যা - সম্পাদক (১৩১১ বঙ্গাব্দ), করালী - সম্পাদক (১৯০৪ খ্রীঃ)],
যদুনাথ চক্রবর্তী [আসাম মিহির - সম্পাদক (১৮৭২ খ্রীঃ)],
রাখালচন্দ্র সেন [কল্প - সম্পাদক (১৮৯৩ খ্রীঃ)],
রাজনারায়ণ বসু [সুরভি - তত্ত্বাবধায়ক (১৮৮২ খ্রীঃ)],
শিবধন বিদ্যার্ণব [সুচিন্তা - সহ-সম্পাদক (১৮৯২ খ্রীঃ)],
শিবনাথ শাস্ত্রী [মদ না গরল (১২৭৮ বঙ্গাব্দ) - সম্পাদনায়-সাহায্যকারী, সোমপ্রকাশ - পরিচালক (১৮৭৪ খ্রীঃ), তত্ত্বকৌমুদী - সম্পাদক (১৮০০ বঙ্গাব্দ), সমালোচক - সম্পাদক (১২৮৪ বঙ্গাব্দ), সখা (১৮৮৩ খ্রীঃ) - সম্পাদক (১৮৮৫-৮৬ খ্রীঃ), সমদর্শী - সম্পাদক (১২৮১ বঙ্গাব্দ), মুকুল - সম্পাদক (১৩০২ বঙ্গাব্দ)],
শ্রীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় [সত্য জ্ঞানসঞ্চারিণী - পত্রিকা-পরিচালক (১৮৫৬ খ্রীঃ)],
শ্রীশচন্দ্র মজুমদার [বঙ্গদর্শন - নবপর্যায় (১২৭৯ বঙ্গাব্দ) - অপ্রকাশ্য - সম্পাদক (১২৯০ বঙ্গাব্দ)],
শৈলেশচন্দ্র মজুমদার [বঙ্গদর্শন-নবপর্যায় - সম্পাদক (১৩১৩-১৩২০ বঙ্গাব্দ)],
সখারাম গণেশ দেউস্কর [হিতবাদী - পরিচালক (১৯০৭ খ্রীঃ)],
সরলা দেবী [ভারতী - যুগ্ম-সম্পাদিকা (১৩০২-০৪ বঙ্গাব্দ) - সম্পাদিকা (১৩০৬-১৪ বঙ্গাব্দ), (১৩৩১-৩৩ বঙ্গাব্দ)],
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর [তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা (১৮৪৩ খ্রীঃ) - সম্পাদক (১৮৫৯-৬২ খ্রীঃ), (১৯০৯-১০ খ্রীঃ) যুগ্ম-সম্পাদক (১৯১৫-২৩ খ্রীঃ)],
স্বর্ণকুমারী দেবী [ভারতী (১২৮৪ বঙ্গাব্দ) - সম্পাদিকা (১৩১৫-২১ বঙ্গাব্দ)],
সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর [সাধনা - সম্পাদক (১২৯৮-১৩০১ বঙ্গাব্দ)],
হিরন্ময়ী দেবী [ভারতী - যুগ্ম-সম্পাদিকা (১৩০২-০৪ বঙ্গাব্দ)]

ঙ. কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগের জন্ম-লগ্ন (১ জুন, ১৯১৯) থেকেই যোগাযোগ। এই যোগাযোগ নোবেল-প্রাপ্তির পরে আরও ঘনিষ্ঠ হয়। বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে 'ডি লিট' উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯১৯-এ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'ভারতীয় ভাষা বিভাগ' স্থাপনার পর প্রধান ভাষা 'বাংলা'র ছাত্রদের বাংলাভাষা ও সাহিত্যের কয়েকটি বিশেষ বিষয়ে বক্তৃতা-দানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রবীন্দ্রনাথকে আহবান জানায়। প্রস্তাব গ্রহণ ক'রে, বাংলা ছন্দ সম্পর্কে বক্তৃতা দেন। ১৯২২-এ বাংলা এম এ পরীক্ষায় অন্যতম পরীক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৩-এ 'সাহিত্য বিষয়ে' ‘Special University Readership’ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ১৯৩০-এ 'মানুষের ধর্ম' বিষয়ে বাংলা ভাষায় 'কমলা বক্তৃতা' দান করেন। ১৯৩২-এর ১ আগষ্ট থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের 'বিশেষ অধ্যাপক' পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৪ পর্যন্ত সেই দায়িত্ব পালন করতে তাঁকে সেই সময়ের পঞ্চম ও ষষ্ঠ বার্ষিক শ্রেণীর (বর্তমানে এম এ ক্লাসের) বাংলা-পড়ুয়া ছাত্রদের কয়েকটি ক্লাস নিতে হয়েছিল। সেই ক্লাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু অধ্যাপক, অন্যান্য বিভাগের ছাত্ররা, সাহিত্য-রসিক ব্যক্তিরাও ভিড় করতেন। ক্লাস উপচে ভিড় পৌঁছতো ক্লাসের বাইরে। কবিতা-বিশেষের ব্যাখ্যা, আবৃত্তি, সাহিত্য-সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে হ'ত রবীন্দ্রনাথকে। এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ 'বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ' (ডিসেম্বর, ১৯৩২) এবং 'শিক্ষায় বিকিরণ' (ফেব্রুয়ারী, ১৯৩৩) সম্পর্কে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তা ১৯৩৩-এ বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৩৭-এর ১৭ ফেব্রুয়ারী রবীন্দ্রনাথ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম ভাষণ-দান করেন। এই বৎসরেই রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষায় রচিত গবেষণা-অভিসন্দর্ভের (পি এইচ ডি থিসিস) অন্যতম পরীক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন। [২]

স্মর্তব্য, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগের বহু পূর্বেই সেই বিভাগের ভাবী-অধ্যাপকদের সঙ্গে তাঁর আলাপ-পরিচয় ছিল। আমরা সাতজন হবু-অধ্যাপকের সন্ধান পাই, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা-কর্মে যুক্ত হওয়ার পূর্বেই রবীন্দ্রনাথ-সম্পাদিত ভারতী, বঙ্গদর্শন-নবপর্যায় এবং ভাণ্ডার-এ লিখেছিলেন মোট ৬৩টি রচনা। এই ঘটনা থেকে প্রমাণ হয়, রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় বিদগ্ধজনেরা বিশিষ্ট হয়ে ওঠার পর্বেই লেখনী ধারণ করেছিলেন এবং সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথকে সার্থক করে তুলতে তাঁদের পাণ্ডিত্যের ফসল ফলিয়েছিলেন পূর্বোক্ত সাময়িকপত্রগুলিতে। এঁদের মধ্যে দীনেশচন্দ্র সেন এবং খগেন্দ্রনাথ মিত্র বিভাগীয়-প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। প্রথম রামতনু লাহিড়ী অধ্যাপক নিযুক্ত হন খগেন্দ্রনাথ মিত্র। সাতজন বিশিষ্ট-অধ্যাপক, যাঁরা রবীন্দ্রনাথ-সম্পাদিত তিনটি সাময়িকপত্রে লিখেছিলেন, তাঁরা হলেন [৩] - খগেন্দ্রনাথ মিত্র (বাংলা বিভাগে যু্ক্ত ছিলেন - ১৯৩২-১৯৪৬), চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (বাংলা বিভাগে যুক্ত ছিলেন - ১৯১৯-১৯২৪), দীনেশচন্দ্র সেন (বাংলা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন - ১৯১৯-১৯২৫, ১৯২৬-১৯৩২), বিজয়চন্দ্র মজুমদার (বাংলা বিভাগে যোগ দেন - ১৯১৯-এ), রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (বাংলা বিভাগে যোগ দেন - ১৯১৯-এ), শশাঙ্কমোহন সেন (বাংলা বিভাগে যুক্ত ছিলেন - ১৯২০-১৯২৭), সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ (বাংলা ও ভাষাতত্ত্ব বিভাগে যোগ দেন - ১৯১৯-এ)।

চ. ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত অগ্রজ-সমবয়স্ক-অনুজ সুহৃদেরা

কাদম্বরীদেবীর আকস্মিক অকাল-প্রয়াণের (৮ বৈশাখ, ১২৯১/১৮৮৪) চার মাস পর, মাত্র তেইশ বৎসর চার মাস বয়সে গভীর-শোকাহত 'রবি'কে পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক-পদে নিযুক্ত করেন ১ আশ্বিন, ১২৯১ (সেপ্টেম্বর, ১৮৮৪)। তখন থেকে কখনও এককভাবে, কখনও যুগ্মভাবে আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘ সাতাশ বৎসর আট মাস সময়। দীর্ঘদিনের জন্য বিদেশযাত্রা উপলক্ষে জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৯ (এপ্রিল, ১৯১২)-এ দায়িত্বভার ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন প্রত্যক্ষত আদি ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে অনেক জ্ঞানী-গুণী মানুষের সান্নিধ্যলাভ ঘটে। সেই-সুবাদে শুধু 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা' সম্পাদনকালেই নয়, তার পূর্বেই সাধনা-ভারতী-বঙ্গদর্শন নবপর্যায়-ভাণ্ডার পত্রিকার জন্য লেখা-সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি দ্বারস্থ হয়েছিলেন ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত অগ্রজ-সমবয়স্ক-অনুজ সুহৃদদের কাছে। [৪] যাঁরা লেখা দিয়ে সহায়তা করেছিলেন, তাঁরা হলেন - অজিতকুমার চক্রবর্তী, আশুতোষ চৌধুরী, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, উপেন্দ্রচন্দ্র ভট্টাচার্য, কালিদাস বসু, কালীবর বেদান্তবাগীশ, কৃষ্ণবিহারী সেন, ক্ষিতিমোহন সেন, গুরুচরণ মহালনবিশ, চিন্তামণি চট্টোপাধ্যায়, জিতেন্দ্রচন্দ্র ভট্টাচার্য, জ্ঞানেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, নেপালচন্দ্র রায়, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, ব্রজেন্দ্রচন্দ্র ভট্টাচার্য, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, মনোরঞ্জন চৌধুরী, রাজনারায়ণ বসু, শরৎকুমার রায়, শিবধন বিদ্যার্ণব, শিবনাথ শাস্ত্রী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায় (চৌধুরী), সুজিতকুমার চক্রবর্তী।

ছ. শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের আচার্য-তত্ত্বাবধায়ক-শিক্ষক

বীরভূম জেলার পল্লীগ্রাম বোলপুরের শান্তিনিকেতনে যেখানে 'বিশ্বভারতী'র প্রতিষ্ঠা হয়, তার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন মাত্র দুই বৎসর, ১ মার্চ, ১৮৬৩ (১৮ ফাল্গুন, ১২৬৯ বঙ্গাব্দ) সুরুলের রায়পুরের জমিদার সিংহদের কাছ থেকে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ 'শান্তিনিকেতন' এলাকার মধ্যে মাত্র কুড়ি-বিঘা জমি বার্ষিক পাঁচ টাকা খাজনায় মৌরসী পাট্টায় গ্রহণ করেন। 'শান্তিনিকেতন' নামকরণ রায়পুরের সিংহদের, নামটি দেবেন্দ্রনাথ বা রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নয়। ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকে পরিব্রাজক জীবনে দেবেন্দ্রনাথ মাঝেমধ্যে কিছু সময় এখানে অতিবাহিত করতেন। ৪ কার্তিক, ১২৯৫ (১৯ অক্টোবর, ১৮৮৯) কোজাগরী-পূর্ণিমার দিন শান্তিনিকেতনের মন্দির নির্মিত হয়। মরুভূমির মত তৃণশূন্য প্রান্তরের ছাতিমতলায় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কেবলমাত্র তাঁর ধ্যানের আসন পাতেননি, সেই সঙ্গে একটি মহৎভাবী উদ্যোগের বীজ বপন করেছিলেন। মহর্ষির সঙ্গে বারো বৎসরের বালক রবীন্দ্রনাথ হিমালয় যাত্রাকালে যখন প্রথম শান্তিনিকেতন দর্শন করেন (৪ ফাগুন, ১২৭৯/১৪ ফ্রেব্রুয়ারী, ১৮৭৩), তখন তাঁর মনে যে বিচিত্র ভাবের উদয় হয়েছিল তার সুন্দর বর্ণনা আছে, 'জীবনস্মৃতি'-তে। মহর্ষির শেষ-বয়সের আশ্রয় ছিল এই আশ্রম। এই উন্মুক্ত প্রান্তরে তিনি 'প্রাণের আরাম; মনের আনন্দ, আত্মার শান্তির' জন্য নিবিষ্ট হয়েছিলেন। তিনি অনুভব করেছিলেন যে ভারতবর্ষের ভূতকালের আবির্ভাব এইখানেই হবে।

পারিবারিক স্থান-পরিবর্তনের ক্ষেত্র হিসাবেও জায়গাটি ব্যবহৃত হতো। রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য-ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর (চতু্র্থদাদা বীরেন্দ্রনাথের পুত্র)-ই প্রথম শান্তিনিকেতনে একটি 'ব্রহ্মবিদ্যালয়' স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। এই কাজে মহর্ষির অনুমোদনও ছিল। শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট ডীডেও (৩ মার্চ, ১৮৮৮) এইরূপ একটি বিদ্যালয় স্থাপনার সংস্থান ছিল। ব্রহ্মবিদ্যালয়ের জন্য বলেন্দ্রনাথ নিয়মাবলীর একটি প্রাথমিক খসড়াও প্রস্তুত করেছিলেন, কিন্তু ১৯ আগষ্ট, ১৮৯৯ (৩ ভাদ্র, ১৩০৫) তারিখে অকাল-প্রয়াণে, তা বাস্তবায়িত করে যেতে পারেননি।

শান্তিনিকেতনের আশ্রমে ব্রহ্মবিদ্যালয়ের গৃহনির্মাণ ও তৎসংক্রান্ত খরচের জন্য মহর্ষির দান ৫,০০০ টাকায় একটি একতলা গৃহের নির্মাণ-কাজ শুরু হয়। ৭ পৌষ, ১৩০৫ (২১ ডিসেম্বর, ১৮৯৯) সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রহ্মবিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। কিন্তু তার আগেই যক্ষ্মা রোগে বলেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। ব্রহ্মবিদ্যালয়ের উদ্বোধন হলেও বিদ্যালয়ের কাজ শুরু হয়নি। বলেন্দ্রনাথের অকাল মৃত্যুর তিন বৎসর পর রবীন্দ্রনাথ তাঁর অসম্পূ্র্ণ কাজ সম্পূ্র্ণ করতে ৭ পৌষ, ১৩০৮ (২২ ডিসেম্বর, ১৯০১) রবিবার, প্রস্তাবিত ব্রহ্মবিদ্যালয় গৃহটির আশ্রয়ে 'ব্রহ্মচর্যাশ্রম' প্রতিষ্ঠা করেন। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গৌরগোবিন্দ গুপ্ত, অশোককুমার গুপ্ত, সুধীন্দ্র চন্দ্র নান - এই পাঁচ জন আশ্রমিক ছাত্র এবং তিন জন শিক্ষক - রেবাচাঁদ, জগদানন্দ রায় ও শিবধন বিদ্যার্ণব-কে নিয়ে সূচিত হয়েছিল ব্রহ্মচর্যাশ্রমের। মহর্ষির 'আশ্রম' আর বলেন্দ্রনাথের 'ব্রহ্মবিদ্যালয়' উভয় পরিকল্পনার মিলনে রবীন্দ্রনাথ গড়েছিলেন 'ব্রহ্মচর্যাশ্রম'। এটি ভাবের দিক থেকে হল আশ্রম, আর রূপের দিক থেকে হল বিদ্যালয়।

এই বিদ্যালয়-আশ্রমে অর্থাৎ 'ব্রহ্মচর্যাশ্রমে' একে একে যোগ দেন অনেক শিক্ষক-তত্ত্বাবধায়ক-আচার্য। রবীন্দ্রনাথ নানা সূত্রে তাঁদের 'সংগ্রহ' করে আনেন। শুধু শিক্ষকতার গণ্ডিতেই তাঁদের আবদ্ধ না রেখে নানান বিষয়ে তাঁদের কাছ থেকে লেখা আদায় করে নিজ-সম্পাদিত পত্রিকাগুলিতে প্রকাশ করেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ-সম্পাদিত সাময়িকপত্রগুলিতে লিখেছেন এমন কুড়ি জন শিক্ষকের ২৩০টি রচনার সন্ধান পাই আমরা। ব্রহ্মচর্যাশ্রমের সেই শিক্ষকেরা হলেন [৫] - অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়, অজিতকুমার চক্রবর্তী, কালিদাস বসু, কালীমোহন ঘোষ, ক্ষিতিমোহন সেন, জগদানন্দ রায়, জ্ঞানেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, নেপালচন্দ্র রায়, বিধুশেখর শাস্ত্রী (শর্ম্মা/ভট্টাচার্য), ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, মোহিতচন্দ্র সেন, যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, শরৎকুমার রায়, শিবধন বিদ্যার্ণব, সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, সতীশচন্দ্র রায়, সন্তোষচন্দ্র মজুমদার, সুবোধচন্দ্র মজুমদার।

জ. শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের ছাত্র, পরবর্তীকালে সেখানকার শিক্ষক

শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রথম যুগের ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই আশ্রমের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, শিক্ষালাভ করে আশ্রমিকের শান্তি-নিকেতন ছেড়ে চলে যাননি। সেখানেই শিক্ষান্তে শিক্ষাদানকে জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। আর সেই কাজে যিনি সম্পূর্ণ সহায়তা করেছিলেন, তিনি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের চার জন ছাত্রের সন্ধান পাই আমরা যাঁরা পরবর্তীকালে আশ্রম-বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখনী ধারণ করেছিলেন সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথের 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা'র জন্য। এঁরা হলেন - গৌরগোপাল ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, নারায়ণ কাশীনাথ দেবল, সন্তোষচন্দ্র মজুমদার।

ঝ. শান্তিনিকেতন ব্রহ্মবিদ্যালয়ের ছাত্র-লেখক

'ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ' - ছাত্রদের কাছে অধ্যয়নই তপস্যা স্বরূপ। শুধু পুঁথি পড়া নয়, মৌলিক লেখাও তাদের কাছ থেকে কাম্য। মৌলিক লেখা লিখতে উৎসাহিত করা, তা ছাপার হরফে প্রকাশ করা হলে ছাত্রদের উৎসাহ বহুগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। মুখ্যত সেই উদ্দেশ্যেই ব্রহ্মবিদ্যালয়ের ছাত্রদের উৎসাহিত করা হত নানান বিষয়ে মৌলিক রচনা সৃজনে। রবীন্দ্রনাথ সহ তৎকালীন ব্রহ্মবিদ্যালয়ের আচার্যেরা উৎসাহিত করতেন তৎকালীন ছাত্রদের, যাতে তারা কিছু না কিছু বিষয়ে নিজেদের ভাবনা প্রকাশ ও বিনিময় করতে সক্ষম হয়। ব্রহ্মবিদ্যালয়ের ছাত্রদের দ্বারা প্রকাশিত, হাতে লেখা ও ছাপা আঠেরোটি ক্ষণস্থায়ী পত্রিকার সন্ধান পাওয়া যায়, সেগুলি হ'ল - শান্তি, প্রভাত, বাগান, আশ্রম, কুটির, বীথিকা, শিশু, আবর্জ্জনা, শয়ান, মধ্যাহ্ন, নিশীথ, গোগৃহ, গবেষণা, উষা, Culture, সন্ধ্যা, আশ্রম সংবাদ ও অরুণ। এই পত্রিকাগুলির পাতা ছাত্রদের রচনায় পূ্র্ণ হত। ব্রহ্মচর্যাশ্রমের ছাত্রদের প্রকৃতি পর্যবেক্ষণে উৎসাহ দেওয়া হত। পৌষ, ১৩১৮ সংখ্যা বাগান-এ 'বিজ্ঞাপন' দেওয়া হয় - “বাগান-এ 'Nature study' (প্রাকৃতিক প্রবন্ধ)-এর জন্য শ্রদ্ধেয় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ মহাশয় দুইটি পুরস্কার দিতে স্বীকৃত হইয়াছেন।” - মাঘ সংখ্যায় জানা যায়, 'পিপীলিকার কথা' ও 'টিকটিকি' প্রবন্ধের জন্য যথাক্রমে প্রদ্যোৎকুমার সেনগুপ্ত ও বিভূতিভূষণ গুপ্ত (বড়ো) প্রথম ও দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। [৬] ছাত্রদের মৌলিক রচনা সৃজনে উৎসাহিত করতে প্রশান্তচন্দ্র যেমন পুরস্কার চালু করেন, তেমনি রবীন্দ্রনাথও 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা'র মত ধর্মীয় মুখপত্রের সঙ্গে ব্রহ্মচর্যাশ্রমের মেলবন্ধন ঘটান। গুরুগম্ভীর প্রবন্ধের পাশাপাশি ছাত্রদের অকিঞ্চিৎকর রচনাও স্থান পেতে থাকে 'তত্ত্ববোধিনী'র পাতায়।

'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা'র সম্পাদক হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ আদি ব্রাহ্মসমাজের সদস্যদের কাছে 'ব্রহ্মবিদ্যালয়'-এর সংবাদ 'আশ্রমকথা' পৌঁছে দিতে যেমন চেয়েছিলেন, তেমনি ভবিষ্যতের লেখক তৈরী করতে, ছাত্রদের উৎসাহ বৃদ্ধি করতে, তাদের লেখা 'তত্ত্ববোধিনী'র পৃষ্ঠায় স্থান দিয়ে তাদেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার করে তুলতে চেয়েছিলেন। 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা'য় পৌষ, ১৮৩৩ শক সংখ্যায় গুরুদেব-'সম্পাদক' ঘোষণা করেন - “এই মাস হইতে শান্তিনিকেতন ব্রহ্মবিদ্যালয়ের সংবাদ ও সেখানকার ছাত্রগণের রচনা-প্রকাশের জন্য আমরা 'ব্রহ্মবিদ্যালয়' নাম দিয়া তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার একটি স্বতন্ত্র বিভাগ রক্ষা করিব।” [৭]

এই বিভাগে রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনা পর্বের চার-বছরে ১৯-জন ছাত্র-লেখকের ৫০টি রচনা প্রকাশিত হয়। ছাত্ররা মূলত 'প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ', 'আশ্রমকথা', 'আশ্রম সংবাদ'-বিভাগের সংক্ষিপ্ত রচনাগুলির লেখক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উক্ত চার বছরের 'তত্ত্ববোধিনী'তে বিশ্বসংবাদ, নানাকথা, বৈজ্ঞানিকবার্তা, আলোচনা, সাময়িকপ্রসঙ্গ, সংক্ষিপ্ত রচনা এবং ছাত্রদের লেখা তিনটি বিভাগ মিলিয়ে মোট ৩৭ জন লেখকের ১২৩টি সংক্ষিপ্ত-রচনা প্রকাশিত হয়, যার সিংহভাগ ব্রহ্মচর্যাশ্রম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা রচিত।

রবীন্দ্রনাথ 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা'র সম্পাদনা-ভার ত্যাগ করলে ১৮৩৭ শক (১৩২২ বঙ্গাব্দ) থেকে 'ব্রহ্মবিদ্যালয়' বিভাগ তুলে দেওয়া হয়। 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা'য় আশ্রমকথা ও আশ্রম সংবাদ বিভাগে ছাত্রদের-দ্বারা রচিত ব্রহ্মচর্যাশ্রমের সূচনা পর্বের ইতিহাস বিধৃত রয়েছে। স্বনামে যে সমস্ত ছাত্রেরা লিখেছিলেন, তাঁরা হলেন - উপেন্দ্রচন্দ্র ভট্টাচার্য, কামিনীকুমার চন্দ, গৌরগোপাল ঘোষ, চণ্ডীচরণ সিংহ, ত্রিগুণানন্দ রায়, দীনেন্দ্রকুমার দত্ত, নারায়ণ কাশীনাথ দেবল, প্রদ্যোৎ, প্রবোধ (গঙ্গোপাধ্যায়), বংশু (পি কে সেন), মুকুল (চন্দ্র দে), যতীন্দ্রমোহন বাগচী, লব, সন্তোষচন্দ্র মজুমদার, সুজিতকুমার চক্রবর্তী, সুহৃৎকুমার মুখোপাধ্যায়, সোমেন্দ্রচন্দ্র দেববর্ম্মা (দেবশর্ম্মন), সুধাকান্ত রায়চৌধুরী, সুধীরঞ্জন দাস।

ঞ. জমিদার-সম্পাদকের কর্মচারী-নায়ের সুহৃদ

যে যে-বিষয়ে পারদর্শী, অনেক সময় সে-বিষয়ে কাজ করতে না পেরে রুটি-রুজির কারণে অন্য পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয় অনেক গুণী মানুষই। সে-রকম দুজন গুণী মানুষের সন্ধান পাই আমরা, যাঁরা জমিদার-রবীন্দ্রনাথের সেরেস্তার সাধারণ কর্মচারী এবং নায়েব ছিলেন। সেই কর্মচারী জগদানন্দ রায় এবং কালিগ্রাম পরগণার নায়েব শৈলেশচন্দ্র মজুমদার-এর গুণগ্রাহীতার পরিচয় পেয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁদের যথাযোগ্য সম্মানে প্রতিষ্ঠা করেন।

জগদানন্দ রায় শিলাইদহের জমিদারী সেরেস্তায় কাজ করতেন। তাঁর সাংসারিক অভাব মোচনের জন্য রবীন্দ্রনাথই তাঁকে ওই পদে নিযু্ক্ত করেন - "কিন্তু তাঁকে এই অযোগ্য আসনে বন্দী করে রাখতে আমার মনে বেদনা দিতে লাগল। আমি তাঁকে শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনার কাজে আমন্ত্রণ করলুম। যদিও এই কার্যে আয়ের পরিমাণ অল্প ছিল তবুও আনন্দের পরিমাণ তাঁর পক্ষে ছিল প্রচুর। তার কারণ শিক্ষাদানে তাঁর স্বভাবের ছিল অকৃত্রিম তৃপ্তি। ছাত্রদের কাছে সর্বতোভাবে আত্মদানে তাঁর একটুও কৃপণতা ছিল না। সুগভীর করুণা ছিল বালকদের প্রতি। শাস্তি উপলক্ষেও তাদের প্রতি লেশমাত্র নির্মমতা তিনি সহ্য করতে পারতেন না।" [৮]

রবীন্দ্রনাথও জগদানন্দ রায়ের "গল্পচ্ছলে সরস করে বিজ্ঞানের কথা বলার আশ্চর্য ক্ষমতা"র উল্লেখ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ-সম্পাদিত 'সাধনা' ব্যতীত চারটি সাময়িকপত্রেই জগদানন্দ বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ লিখেছেন ৩১টি।

শৈলেশচন্দ্র মজুমদার ছিলেন বন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের কনিষ্ঠ-ভ্রাতা। ঠাকুর-পরিবারের জমিদারিভুক্ত কালিগ্রাম পরগণার তৎকালীন নায়েব এর দায়িত্ব পালন করতেন শৈলেশচন্দ্র। পরবর্তীতে রবীন্দ্র-স্নেহধন্য শৈলেশচন্দ্র 'মজুমদার লাইব্রেরী'র অন্যতম কর্ণধার হিসাবে রবীন্দ্রনাথের অনেক গ্রন্থ এবং 'বঙ্গদর্শন-নবপর্যায়'-এর প্রকাশক এবং সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। প্রথমে কর্মচারী, পরে প্রকাশক এবং সহকর্মী শৈলেশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় 'ভারতী' পত্রিকায় 'বানুরে বুদ্ধি' এবং 'প্রবাদ প্রসঙ্গ' শীর্ষক দুটি প্রবন্ধের রচয়িতা। ব্যতিক্রমী এই মানুষদ্বয় - জগদানন্দ রায়, শৈলেশচন্দ্র মজুমদার।

ট. মহিলা কবি-লেখিকা

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থায় মহিলা কবি-লেখিকার সংখ্যা রবীন্দ্রনাথের সাময়িকপত্র-সম্পাদনকালে যেমন অপ্রতুল ছিল, বর্তমানেও পুরুষ লেখকদের তুলনায় মহিলা লেখিকাদের সংখ্যা কম। সামগ্রিক বিচারে রবীন্দ্র-সম্পাদিত পাঁচটি সাময়িকপত্রে প্রকাশিতনামা লেখক-লেখিকার সংখ্যা ২৩৬। এই ২৩৬ জনের মধ্যে মাত্র দশ জন মহিলা। এই দশ জনের ৬ জন প্রত্যক্ষত ঠাকুরবাড়ির সদস্যা। সম্পাদকের কন্যাদ্বয়-অতসীলতা (মীরা) ও মাধুরীলতা (বেলা)। জ্যেষ্ঠা সহোদরা-স্বর্ণকুমারী দেবী। দুই ভাগিনেয়ী-হিরন্ময়ী ও সরলাদেবী। এবং ভ্রাতুষ্পুত্রবধূ হেমলতাদেবী (দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথের স্ত্রী)। প্রত্যক্ষত ঠাকুরবাড়ির সদস্যা না হলেও প্রিয়ম্বদাদেবী সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথের দূর সম্পর্কের আত্মীয়া। ভ্রাতৃজামাতা এবং বন্ধু আশুতোষ চৌধুরী ও প্রমথ চৌধুরীর ভাগিনেয়ী এবং লেখিকা প্রসন্নময়ীদেবীর কন্যা প্রিয়ম্বদা। শরৎকুমারীদেবী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বন্ধু অক্ষয়কুমার চৌধুরীর পত্নী। রবীন্দ্রনাথ এঁকে 'লাহোরিণী' বলতেন। অর্থাৎ দশ জনের আট জন সম্পাদক-ঘনিষ্ঠ। দুই জনের পরিচয় অজ্ঞাত। দশ জন মহিলা কবি-লেখিকার মোট রচনা সংখ্যা ৯৩। এঁরা হলেন [৯] - অতসীলতা দেবী (মীরা) (ঠাকুর/গঙ্গোপাধ্যায়), নির্ঝরিণী ঘোষ, প্রিয়ম্বদা দেবী, মাধুরীলতা দেবী (বেলা) (ঠাকুর/চক্রবর্তী), শরৎকুমারী দেবী (চৌধুরানী), সরলা দেবী, স্বর্ণকুমারী দেবী, সুরমাসুন্দরী বসু, হিরন্ময়ী দেবী, হেমলতা দেবী।

ঠ. মুসলমান লেখক

ভারতীয় সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারে সেকাল-একালে বিশেষ ফারাক লক্ষিত হয় না। বর্তমানে শিক্ষার হার কিছুটা উন্নত হলেও, রবীন্দ্রনাথের সাময়িকপত্র-সম্পাদনা-কালে (১৮৯৪-১৯১৫) ভারতীয় তথা বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে যে তেমন শিক্ষার আলো পৌঁছয়নি তা উপলব্ধি করা যায় একটিমাত্র পরিসংখ্যানে। রবীন্দ্রনাথ-সম্পাদিত পাঁচটি বাংলা সাময়িকপত্রে প্রকাশিতনামা সর্বমোট লেখক সংখ্যা ২৩৬। এই ২৩৬ জনের মধ্যে মুসলমান-লেখক মাত্র পাঁচ জন। অনুপাতের অঙ্কে - ২৩৬=২৩১:৫ সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে সংখ্যালঘু মুসলমান লেখকের এই অনুপাত অত্যাশ্চর্যজনক। এই পাঁচ জন মুসলিম লেখক রবীন্দ্র-সম্পাদনায় মাত্র ছয়টি রচনা লেখেন। পাঁচটি সাময়িকপত্রে প্রকাশিত সামগ্রিক রচনা সংখ্যার বিচারে সেই অনুপাত আরও বেশী হতাশাজনক - ১৮০১=১৭৯৫:৬ অর্থাৎ ১৮০১টি প্রকাশিত রচনার ১৭৯৫টির লেখকেরা সংখ্যাগুরু-সম্প্রদায়ের। মাত্র ৬টি রচনা সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত লেখকদের। এই পাঁচ জন অবশ্য উল্লেখ্য মানুষেরা হলেন - কেরামতুল্লা মুন্সী, মিঃ রসুল (আব্দুল রসুল), মোহাম্মদ হেদায়েতউল্লা, মৌলবী মহম্মদ ইমাদুদ্দিন, মৌলবী সিরাজুল ইসলাম।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত সাধনা, ভারতী এবং তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-য় রবীন্দ্রনাথ-সম্পাদিত কালসীমায় কোনও মুসলমান-লেখকের রচনা প্রকাশিত হয়নি।

ড. বঙ্গভাষী অবাঙালি লেখক

রবীন্দ্রনাথ-সম্পাদিত পাঁচটি বাংলা সাময়িকপত্রে প্রকাশিতনামা লেখকদের মধ্যে আমরা মাত্র তিন জন লেখককে খুঁজে পাই, যাঁরা জন্মসূত্রে অবাঙালি কিন্তু বঙ্গভাষা-চর্চাকারী বঙ্গভাষী-লেখক। এই তিন জনই রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে আসেন। তরুণ (রাম) ফুকন জন্মসূত্রে অসমীয়া, রবীন্দ্র অনুরাগী। নারায়ণ কাশীনাথ দেবল ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রথম যুগের ছাত্র। বাবা মারাঠী, মা বর্মী। শান্তিনিকেতন থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে কিছুদিন সেখানেই শিশু-বিভাগে শিক্ষকতা করেন। পরে বিলেতে পড়াশোনা করতে যান। সেখান থেকে তাঁর পাঠানো চিঠি 'তত্ত্ববোধিনী'-তে প্রকাশিত হয়। সখারাম গণেশ দেউস্কর মহারাষ্ট্রীয় সন্তান। আশৈশব বাংলাভাষা চর্চা করে বিশিষ্ট লেখকের মর্যাদা লাভ করেন। 'সাধনা'য় প্রবন্ধ প্রকাশের জন্য এঁকে পারিশ্রমিক দেওয়া হ’ত।

বিশ্বভারতীকে রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের সর্বজাতির, সর্বধর্মের সর্বভাষাভাষীর শিক্ষাচর্চা ও জ্ঞানালোচনার কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাঁর সেই স্বপ্ন অসফল হয়নি। জন্মসূত্রে অবাঙালি হলেও এই তিন জন বঙ্গভাষীর বাংলা রচনা প্রকাশ করে বিশ্বসত্তায় বিশ্বাসী বিশ্বকবি বাংলা সাময়িকপত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। অবশ্য উল্লেখ্য এই তিন জন হলেন - তরুণ (রাম) ফুকন, নারায়ণ কাশীনাথ দেবল, সখারাম গণেশ দেউস্কর।

ঢ. ইংরেজ-লেখক

রবীন্দ্রনাথ-সম্পাদিত পাঁচটি সাময়িকপত্রে যতগুলি রচনা প্রকাশিত হয়েছিল তার একটি বাদে সমস্তই ভারতীয়দের দ্বারা রচিত। 'ভাণ্ডার' পত্রিকার (ভাদ্র-আশ্বিন, ১৩১২) ১ম বর্ষ, ১ম ভাগ, ৫ম-৬ষ্ঠ সংখ্যায় একটিমাত্র রচনা অভারতীয় ইংরেজ-সাহেব লেখকের। বাংলাভাষায় প্রকাশিত কোনও পত্রিকায় সাহেবের নামে মুদ্রিত রচনা, একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। (ই বি) ‘হেবেল সাহেবের চিঠি’ শিরোনামায় পত্রাকার-প্রবন্ধ ‘হাতের তাঁত’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ই বি হেভেল ছিলেন সরকারী আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সমসাময়িক 'Industrial India' পত্রিকাতেও (February 1905, Supplementary Copy) তিনি তাঁত সম্বন্ধে প্রবন্ধ লিখেছেন। 'ভাণ্ডার'-এর রচনাটি হেভেল সাহেবের নিজের, না 'Industrial India' পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের বঙ্গানুবাদ 'ভাণ্ডার'-এ প্রকাশিত হয়েছিল তার কোনও উল্লেখ প্রবন্ধে নেই। তবে প্রবন্ধটি ‘হেবেল সাহেবের চিঠি’ বলেই উল্লিখিত হয় - ই বি হেভেল (Ernest Beanfield Havell)

ণ. আত্মপরিচয় অপ্রকাশে ছদ্মনামা লেখক-লেখিকা

রবীন্দ্রনাথ-সম্পাদিত পাঁচটি সাময়িকপত্রেই আমরা লক্ষ্য করি, বেশ কিছু রচনায় লেখকের নাম প্রকাশিত হয়নি। 'ঠাকুর' পদবীধারীদের রচনাধিক্য জনিত বিরূপ সমালোচনার কারণে সম্ভবত 'সাধনা' পত্রিকার শেষবর্ষে লেখক নাম প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু অন্য চারটি পত্রিকার ক্ষেত্রে সে সমস্যা ছিল না। তবু নামহীন সেই লেখাগুলি তথাকথিত কোনও বিতর্কিত বিষয়ে নয়, বরং অকিঞ্চিৎকর। হয়তো লেখাগুলি তেমন উৎকৃষ্ট মানের নয় বলেই সম্পাদক তাঁদের নাম প্রকাশ করেননি।

এছাড়াও বঙ্গদর্শন, ভাণ্ডার ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-য় প্রকাশিত দশ জন লেখকের সাতচল্লিশটি রচনার সন্ধান পাই, যেখানে লেখক-নাম প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু 'শ্রী', 'শ্রী অঃ', 'শ্রী পাঠক', 'শ্রী ম', 'শ্রী স' ইত্যাদি ছদ্মপরিচয়ে প্রকৃত নাম গোপন রাখা হয়েছে। কিন্তু কেন এই উপায় অবলম্বন, সে বিষয়ে কোনও ব্যাখ্যা বা পাদটীকা সংযোজিত হয়নি। অন্য পাঁচটি নামের ক্ষেত্রে তবুও লেখকদের সম্পর্কে সম্যক ধারণা জন্মায়। যেমন - 'অধ্যাপক' সম্ভবত ব্রহ্মবিদ্যালয়ের কোনও শিক্ষক। 'আশ্রম বালক', 'আশ্রমবাসী', 'জনৈক আশ্রমবাসী' সম্পর্কে ধারণা বা অনুমান করে নেওয়া যায়। বিশিষ্ট রবীন্দ্র-গবেষক প্রশান্তকুমার পাল 'বঙ্গরমণী' রচিত 'ভাণ্ডার'-এর প্রশ্নের উত্তর স্বয়ং সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথের লেখা বলে চিহ্নিত করেছেন। এছাড়া জ্যৈষ্ঠ, ১৩১২ এবং আষাঢ়, ১৩১২ সংখ্যার 'ভাণ্ডার'-এ 'জলকষ্ট' এবং 'অহেতুক জলকষ্ট' শীর্ষক দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধ দুটি 'শ্রীমতী কনিষ্ঠা' এবং 'শ্রীমতী মধ্যমা' ছদ্মনামে রচনা করেন সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথ। [দ্র. স্বদেশী সমাজ (১৩৯৩), পৃ. ৬৮-৭০, ৭১-৭৩] অবশিষ্ট রচনাগুলি সংক্ষিপ্ত অথবা উৎকৃষ্ট মানদণ্ডের বিচারে অকিঞ্চিৎকর বলেই লেখক-নাম অপ্রকাশিত ছিল বলে অনুমান করা যায়। আত্মপরিচয় গোপন রাখা, অথবা সম্পাদকের সিদ্ধান্তে স্বনামে অপ্রকাশিত লেখকেরা হলেন - অধ্যাপক, আশ্রমবালক, আশ্রমবাসী, জনৈক আশ্রমবাসী, বঙ্গরমণী, শ্রীঃ, শ্রী অঃ, শ্রী পাঠক, শ্রীর'ম, শ্রী সচ।

ত. সম্পাদকের অপরিচিত-স্বল্পপরিচিত-স্বতঃপ্রণোদিত রচনা প্রেরক

সাময়িকপত্রের সম্পাদক যখন সম্পাদনাকর্ম শুরু করেন, তখন তাঁর গোষ্ঠী আয়তন থাকে স্বল্প। সময়ের অনিবার্য অগ্রগতিতে সেই গোষ্ঠীর অর্থাৎ সাময়িকপত্রের লেখক-পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে পারে, যদি সেই সমায়িকপত্রগুলি জনাদর লাভ করে। স্মর্তব্য, সম্পাদক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের কার্যকাল সীমায় (নভেম্বর, ১৮৯১ - এপ্রিল, ১৯১৫) তৎকালীন বঙ্গদেশে শিক্ষিত পড়াশোনা জানা মানুষের সংখ্যা ছিল খুব কম। শহর-মফস্বলের মানুষেরাই ছিলেন মূলত রবীন্দ্র-সম্পাদিত সাময়িকপত্রগুলির গ্রাহক-পাঠক। প্রত্যন্ত গ্রামে, দু-একটি ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া সাময়িকপত্রের গ্রাহক পাঠকের সংখ্যা প্রায় ছিল না বলা যায়। পাঁচটি সাময়িকপত্রেরই প্রতি সংখ্যার গড় গ্রাহক-সংখ্যা প্রায় ৬০০ থেকে ১,০০০ বলে অনুমিত হয়। ফলত, সম্পাদকের পরিচিত মানুষেরা যেমন নিয়মিত লেখা দিয়েছেন, তেমনি বিপুল সংখ্যক অপরিচিত, স্বল্প-পরিচিত গ্রাহক-পাঠক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে লেখা পাঠিয়েছেন সম্পাদকের দপ্তরে। বিশেষত 'ভাণ্ডার' পত্রিকায় পাঠকদের উদ্দেশে দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতা, স্বদেশী-আন্দোলনের প্রেক্ষিতে নানান 'প্রশ্ন'-রাখা হ'ত। আহবান করা হ'ত পাঠক-গ্রাহকের 'উত্তর'। সেই উত্তরদাতাদের সিংহভাগ ছিলেন সম্পাদকের অপরিচিত।

আরও কয়েকজন লেখকের সন্ধান আমরা পাই, যাঁরা প্রথমে রবীন্দ্রনাথের অপরিচিত ছিলেন। পত্র-মারফৎ তাঁদের সঙ্গে আলাপ হয়। পরে সেই আলাপ ঘনিষ্ঠ-অন্তরঙ্গতায় পরিণত হয় এবং তাঁরা আজীবন রবীন্দ্র-স্নেহধন্য হয়ে ওঠেন। যেমন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (কথা সাহিত্যিক)। এছাড়াও মালদহের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট উমেশচন্দ্র বটব্যাল, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের দেশের বাড়ি বাঁকিপুরের বন্ধু অতুলচন্দ্র ঘোষ ওরফে বীরেশ্বর গোস্বামীর সঙ্গে পত্রযোগেই সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথের আলাপ। এঁরা সকলেই রবীন্দ্রনাথ-সম্পাদিত সাময়িকপত্রগুলিতে লিখেছিলেন।

যে সমস্ত লেখকদের ব্যক্তিপরিচয় আমরা বিভিন্ন গ্রন্থ, সাময়িকপত্র ঘেঁটেও সংগ্রহ করে উঠতে পারিনি, বা বিস্তারিত কোনও তথ্য যোগাড় করা সম্ভব হয়নি, তন্নিষ্ঠ অন্বেষণের পর আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, এই সমস্ত লেখকেরা সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথের তেমন ঘনিষ্ঠ নন। এঁরা সম্পাদকের অপরিচিত, নয় স্বল্প-পরিচিত, অর্থাৎ সম্পাদকের পরিচিত ব্যক্তি মারফত অথবা ডাকযোগে লেখা পাঠিয়েছিলেন বিবেচনার জন্য অথবা সাধারণ গ্রাহক-পাঠক। যাঁরা স্বতোৎসাহিত হয়ে ধারণ করেছিলেন লেখনী, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রেরণ করেছিলেন রচনা।

এখানেই একজন সম্পাদকের সার্থকতা, যিনি আরও অসংখ্য মানুষকে নানা বিষয়ে লেখনী ধারণে বাধ্য করতে পারেন। সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বল্পপরিচিত বা অপরিচিত ব্যক্তিদেরও স্বতোপ্রাণোদিত হয়ে রচনা-প্রেরণে উৎসাহ যুগিয়েছিলেন তাঁর সম্পাদনা-গুণে। ক্লাসিক-সাহিত্যের মানদণ্ডে হয়তো এই সমস্ত লেখকদের রচনা কালোত্তীর্ণ শিরোপা লাভ করবে না, তবু সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথের সাময়িকপত্রে তাঁদের রচনা স্থান পাওয়ায় তা অকিঞ্চিৎকর বলে দূরে সরিয়ে রাখার সাহসও কোনও গবেষকের হবে না।

একটি, দুটি, বা কয়েকটি লেখা দিয়ে যে সমস্ত লেখকেরা অ-পরিচয়ের গণ্ডি অতিক্রম করে পাঠক মহলে পরিচিত হতে চেয়েছিলেন, তাঁরা হলেন -
অনঙ্গমোহন লাহিড়ী, অন্নদাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, অম্বিকাচরণ উকিল, অম্বিকাচরণ মজুমদার, অশ্বিনীকুমার দত্ত, ইন্দ্রনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, উমেশচন্দ্র দাশগুপ্ত, কামিনীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, কালীচন্দ্র নাথ, কৃষ্ণচরণ মজুমদার, কুমুদিনীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, কুলচন্দ্র রায়চৌধুরী, কেরামতুল্লা মুন্সী, গিরিজাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র রায়, গোপালকৃষ্ণ, গোপালচন্দ্র লাহিড়ী, গোপালচন্দ্র শাস্ত্রী, জিতেন্দ্রচন্দ্র ভট্টাচার্য, জীবেন্দ্রকুমার দত্ত, জ্ঞানেন্দ্রশশী গুপ্ত, তরুণকুমার রায়, তরুণ (রাম) ফুকন, তারকচন্দ্র রায়, ত্রৈলোক্যনাথ মৌলিক, ত্রিগুণানন্দ রায়, দীনেন্দ্রকুমার দত্ত, দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ধর্ম্মানন্দ মহাভারতী, নরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, নলিনীকান্ত সেন, নলিনীনাথ রায়, নিকুঞ্জবিহারী দত্ত, নিত্যগোপাল মুখোপাধ্যায়, নির্ঝরিণী ঘোষ, পরেশনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রদ্যোৎ, প্রবোধ (গঙ্গোপাধ্যায়?), প্রবোধচন্দ্র মজুমদার, প্রসন্নকুমার ভট্টাচার্য, প্রেমবল্লভ গুপ্ত, পৃথৃীশচন্দ্র রায়, প্যারীশঙ্কর দাশগুপ্ত, বরদাকান্ত (চন্দ্র?) তালুকদার, বামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায়, বামাচরণ বসু, বিজয়চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিনয়েন্দ্রনাথ সেন, বেণীভূষণ রায়, ব্রজসুন্দর সান্যাল, ব্রজেন্দ্রচন্দ্র ভট্টাচার্য, ব্যোমকেশ মুস্তফী, ভবানীচরণ ঘোষ, ভুবনমোহন চট্টোপাধ্যায়, ভুবনমোহন মৈত্রেয়, ভূতনাথ ভাদুড়ী, মহিমচন্দ্র মহিন্তা, মহেশ্বর ভট্টাচার্য, মনোরঞ্জন চৌধুরী, মন্মথনাথ দে, মন্মথমোহন বসু, মোক্ষদাকুমার বসু, মিঃ রসুল (আবদুল রসুল), মৌলবী মহম্মদ ইমাদুদ্দিন, মৌলবী সিরাজুল ইসলাম, যতীন্দ্রমোহন গুপ্ত, যতীন্দ্রনাথ চৌধুরী, যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, যতীন্দ্রভূষণ আচার্য, যদুনাথ চক্রবর্তী, যাত্রামোহন সেন, যোগেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়, যোগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, রজনীকান্ত দাস, রমেশচন্দ্র বসু, রসিকমোহন চক্রবর্তী, রাখালচন্দ্র সেন, রাজকৃষ্ণ পাল, রাধাবল্লভ রায়, ললিতচন্দ্র সেন, শরৎচন্দ্র রাহা, শরচ্চন্দ্র শাস্ত্রী, শশধর রায়, শ্রীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীনাথ সেন, সতীশচন্দ্র আচার্য, সুকুমারচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধচন্দ্র রায়, সুরেশচন্দ্র চৌধুরী, সুরমাসুন্দরী বসু, হরচন্দ্র রায়, হেমেন্দ্রলাল কর, হরিহরপ্রসাদ ঘোষ।

রবীন্দ্রনাথ-সম্পাদিত সাময়িকপত্র-পঞ্চে 'রবি-বলয়'ভুক্ত লেখকদের নানা-বর্গে বর্গীকরণ করতে গিয়ে আমরা লক্ষ্য করেছি, কোনও কোনও লেখকের একাধিক-বর্গে উপস্থিতি। কারণ একাধিক-সূত্রে তাঁরা সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগসূত্র রচনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই একাধিক পরিচয়েই আমরা তাঁদের চিহ্নিত করতে চেয়েছি।

আত্মপরিচয়-এ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘একটিমাত্র পরিচয় আমার আছে, সে আর কিছু নয়, আমি কবি মাত্র।’ 'কবি' এখানে ব্যাপক অর্থে সৃষ্টিকর্তা রবীন্দ্রনাথ। কবির কাজ কী? সে কথাও ‘আত্মপরিচয়’-প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন - কবির কাজ বহুমানুষের ‘চিত্তকে উদ্বোধিত করে তোলা’। বহুমানুষের চিত্তকে উদ্বোধিত করতে গিয়ে শুধু কবি নয়, কবি-কর্মীর ভুমিকাও তাঁকে পালন করতে হয়েছে। তাঁর নিজের ভাষায় - “আমাকে এখানে আপনারা বিচার করবেন কবি রূপে নয়, কর্মী রূপে...” (পল্লীপ্রকৃতি/সম্ভাষণ ) রবীন্দ্রনাথের সেই বহুমাত্রিক কর্মজগতের অন্যতম হল সাময়িকপত্রের সম্পাদনা। সম্পাদিত সাময়িকপত্রগুলিকে তিনি শুধু নিজের লেখা প্রকাশের হাতিয়ার করে তোলেননি, পত্রিকাগুলির আদর্শ-মান অনুযায়ী একটি লেখকগোষ্ঠীও তৈরি করে ফেলেছিলেন। লেখক তৈরির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের কর্ম-তৎপরতা কেমন ছিল সে সম্পর্কে জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন - “লেখক তৈরী করবার জন্য তাঁর যে প্রচেষ্টা দেখেছি তা এখনো ভাবলে অবাক হই। কেউ কোনো কাজ করছে জানতে পারলে কবি কী উৎসাহই না দিতেন! ...তিনি বলতেন, আলো থেকেই আলো জ্বালানো যায়, জ্ঞান তপস্বীরাই জ্ঞান বিতরণ করতে পারেন।”


তথ্যসূত্র ও উল্লেখপঞ্জিঃ

১। বিস্তারিত তথ্য সংগৃহীত হয়েছে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ বাংলা সাময়িকপত্র (১ম ও ২য় খণ্ড) এবং গীতা চট্টোপাধ্যায়ের বাংলা সাময়িক পত্রিকাপঞ্জী (১৯০০-১৯১৪) ১ম খণ্ড গ্রন্থ থেকে।
২। সুবর্ণলেখা - আধুনিক ভারতীয় ভাষা বিভাগের সুবর্ণজয়ন্তী স্মারক গ্রন্থ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭৪), গ্রন্থান্তর্গত প্রবন্ধ - আধুনিক ভারতীয় ভাষা বিভাগের প্রথম পঁচিশ বৎসর ১৯১৯-১৯৪৪ - যতীন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায় পৃ. ২৭-১২৮।
৩। তদেব।
৪। অজিতকুমার চক্রবর্তীঃ ব্রহ্মবিদ্যালয়, সুধীরঞ্জন দাসঃ আমাদের শান্তিনিকেতন, গৌতম ভট্টাচার্যঃ আশ্রমকথা (তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ব্রহ্মচর্যাশ্রমের সূচনাপর্ব) প্রভৃতি আরও কয়েকটি গ্রন্থ থেকে তথ্যাদি সংগৃহীত।
৫। দ্র; পূর্বোক্ত গ্রন্থগুলি।
৬। প্রশান্তকুমার পালঃ রবিজীবনী ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৯৩।
৭। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, পৌষ - ১৮৩৩ সংখ্যা।
৮। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্ররচনাবলী - ২৭ খণ্ড / আশ্রমের রূপ ও বিকাশ পৃ. ৩২৪।
৯। চিত্রা দেবঃ ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, ঠাকুরবাড়ির বাহিরমহল, সমীর সেনগুপ্তঃ রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন - প্রভৃতি আরও কয়েকটি গ্রন্থ থেকে তথ্যাদি সংগৃহীত।
## এছাড়াও, রবীন্দ্রনাথ-সম্পাদিত সাধনা, ভারতী, নবপর্যায় বঙ্গদর্শন, ভাণ্ডার এবং তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-গুলি থেকে যাবতীয় তথ্যাদি সংগৃহীত। মৎপ্রণীত সম্পাদক রবীন্দ্রনাথের লেখকেরা গ্রন্থ (এবং মুশায়েরা, কলকাতা প্রকাশিত) থেকেও প্রয়োজনীয় অংশ গৃহীত হয়েছে।
## বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য - মৎপ্রণীত, গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত গবেষণা অভিসন্দর্ভ; রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত সাময়িকপত্রে সম্পাদক ব্যতীত অন্যান্য লেখক ও তাঁদের রচনা (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-২০১২)।