আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২১ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

একবিংশ শতাব্দীর গ্রাম বাংলায় জাতিবাদ

তৌষালী রায়না


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতায় বাংলার গ্রাম সম্পর্কে লিখে গেছেন, ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি’। রবীন্দ্রনাথের কল্পনায় যে গ্রামের ছবি তিনি এঁকেছেন সেই গ্রাম আর একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবের বাংলার গ্রামে বড়ই ফারাক। আমার গবেষণার কাজে যে গ্রামগুলিতে আমি গেছি সেখানে বাস্তব একেবারেই অন্যরকম। এবং তার অন্যতম কারণ জাতিভেদ প্রথার প্রকট অস্তিত্ব। পূর্ব বর্ধমান জেলার তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েতের বিভিন্ন গ্রামে আমার ক্ষেত্র সমীক্ষার ভিত্তিতে কিছু কথা এই প্রবন্ধে তুলে ধরছি।

রোজকার জীবন ও জাতিভেদ প্রথা

আমাদের অনেকেরই ধারণা যে পশ্চিমবঙ্গে জাতিভেদ প্রথা নেই। অন্তত যেভাবে ভারতবর্ষের অন্যান্য অনেক রাজ্যে আছে সেভাবে তো নেই বটেই। এ আমাদের অনেকেরই সুখবিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। যে গ্রামগুলির কথা বলা হচ্ছে সেগুলি একবার ঘুরলেই বোঝা যাবে যে সর্বত্র জাতিভেদ প্রথার চিহ্ন আছে। প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে পাড়াগুলি শুধু নামে আলাদা নয়, সামাজিক জনসংখ্যা অনুযায়ী আলাদা। প্রতিটা গ্রামেই তথাকথিত উচ্চবর্ণের জনবসতি এক জায়গায় এবং তা সাধারণভাবে গ্রামের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত। সবকটি গ্রামেই উচ্চবর্ণের পাড়ার নাম জাতি গোষ্ঠী বা তাদের সঙ্গে জড়িত পদবী দ্বারা চিহ্নিত - বামুন পাড়া, ভট্ট পাড়া ইত্যাদি। একটি গ্রামে ব্রাহ্মণ অধ্যুষিত পাড়াটির নাম ভদ্র পাড়া। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ এবং ভদ্রলোক শব্দটি সমার্থক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। আলাদা করে এই পাড়াগুলির বর্ণনা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ত না যদি গ্রামের সর্বত্র চিত্রটা এক হতো।

সবক'টা গ্রামেই শেষ প্রান্তে দলিত জনবসতি। সেখানেও জাতি গোষ্ঠী ও পদবী অনুযায়ী পাড়ার বিভাজন বর্তমান - বাউড়ি পাড়া, পাল পাড়া, ডোম পাড়া ইত্যাদি। এই চিহ্নিতকরণের উদ্দেশ্য হল জাতিভেদ প্রথা মেনে সীমারেখা টেনে দেওয়া। জাতিভেদ প্রথার পৃথকীকরণের নিয়ম মেনে প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর জন্য আলাদা বসতি রয়েছে। এবং এই নিয়ম কেউ ভাঙ্গার কখনো চেষ্টা করেনি বলেই মনে হয়। উচ্চবর্ণের পাড়ার বাসিন্দাদের সচরাচর দলিত পাড়ায় আসতে দেখা যায় না। এলেও যে রাস্তার ওপর দিয়ে কোনো যানবাহনে যাতায়াত করে, পায়ে হেটে দলিত পাড়ার ভিতর দিয়ে কেউ যাতায়াত করেন না। দলিতরাও কেউ গ্রামের ভিতরের পাড়ায় সচরাচর যান না। এইভাবেই বহু যুগ ধরে চলে আসছে। বিভিন্ন পাড়ার বাচ্চাদেরকেও একসাথে খেলাধুলা করতে দেখা যায় না। কথাচ্ছলে এর কারণ জানতে চাইলে এক দলিত পরিবারের ১০-১২ বছরের বাচ্চা উত্তর দেয় “ওইটা ভদ্রলোকদের পাড়া, আমরা ওইদিকে যাই না, আমরা তো নীচু...”।

জাতিভেদ প্রথার কাঠামোর এক নিজস্ব দর্শন আছে বা আলথুসারের ভাষা ধার করে বলা যেতে পারে এক ‘আইডিওলজি’ আছে যা এই কাঠামোর উচ্চস্তরে থাকা মানুষদের ক্ষমতা, বিশেষাধিকার ও আধিপত্য এবং নিম্নস্তরে থাকা মানুষদের আনুগত্য ও অবদমন প্রদান করে। যারা এই কাঠামোতে জন্মাচ্ছে তারা জন্মের সূত্রেই জাতিভেদ প্রথার এই আদর্শকে আত্মস্থ করে বড়ো হচ্ছে কারণ এই কাঠামো প্রতিদিন তাদের বোঝাচ্ছে যে, তাদের অবস্থান কোথায় (আলথুসারের ব্যবহৃত শব্দ interpellation এই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য)। এই বাচ্চাটির কথায় সেটাই ভীষণভাবে স্পষ্ট। সে তার পরিবারের সদস্যদের কাছে শুনেছে যে এই পাড়ার বাচ্চারা ওই পাড়ার বাচ্চাদের সাথে খেলে না কারণ তারা জাতিগতভাবে আলাদা। এই জাতিভেদ প্রথার কাঠামো তাকে তার পরিবার, পারিপার্শ্বিক এবং জীবনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে সে আসলে এই সমাজে নিচু। এবং এই কাঠামোর আদর্শ তাকে রোজ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে জাতি পরিচিতির সাথে সভ্যতা ভদ্রতার নিবিড় সম্পর্ক আছে। যে এই কাঠামোর উঁচুস্তরে আছে সে অবস্থানগত কারণেই ভদ্রলোক হিসাবে পরিচিত আর যে নিচুস্তরে আছে সে ছোটোলোক হিসাবে পরিচিত, তার এই কাঠামোতে উত্তরণের অধিকার নেই। সুতরাং এই বাচ্চাটি এটি সহজভাবে বিশ্বাস করার ফলে সে নিজেই এই কাঠামোর আদর্শের প্রতিনিধি হয়ে উঠছে।

অসাম্য, পৃথকীকরণ ও বিভাজনের ব্যবস্থা রোজকার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে গ্রামগুলিতে বজায় রয়েছে। উচ্চবর্ণের পাড়াগুলিতে বাড়ির অবস্থা দেখলে অধিবাসীদের আর্থিক সচ্ছলতা অনুমান করা যায়। বেশির ভাগ বাড়ি পাকা এবং দুই তলা। অন্যদিকে দলিত পাড়ার বাড়িগুলি মাটির, কোনোরকমে খড়ের ছাউনি দেওয়া এবং অধিকাংশই ভাঙা। এই অসাম্যের ছবি রাস্তঘাটের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেখানে উচ্চবর্ণের পাড়াগুলিতে পাকা রাস্তা সেখানে দলিত পাড়াগুলিতে একেবারেই মাটির রাস্তা বা বলা যায় যে রাস্তা ঘাট নেই-ই প্রায়। গ্রামের পুকুর আলাদা, জলের কল আলাদা। এবং একটি গ্রামে দলিত পাড়ায় একটাই পুকুর এবং একটাই কল। অন্যদিকে উচ্চবর্ণের অনেকগুলো বাড়ির সাথে লাগোয়া পুকুর এবং প্রত্যেক বাড়িতে জলের কল। এই অসাম্য শুধু অর্থনৈতিক শোষণের ফল নয়, জাতিগত নিপীড়নেরও ফল। দলিতদের অধিকার নেই তথাকথিত উঁচু জাতের জল বা পুকুর ব্যবহার করার। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ কোনো অংশেই মহারাষ্ট্র বা উত্তরপ্রদেশের থেকে পিছিয়ে নেই, যেখানে এই ধরনের অস্পৃশ্যতার অনুশীলনের ঘটনা সবসময় শোনা যায়।

উপাসনার ক্ষেত্রেও জাতিভেদ প্রকট। যদিও গ্রামগুলির বেশিরভাগ লোকের মুখে শোনা গেছে 'আমরা তো হিন্দু গ্রাম', কিন্তু সেই 'হিন্দু গ্রামে' জাতিভেদ প্রথা অনুযায়ী পূজার ঠাকুর এবং মন্দির দুই আলাদা। দলিতদের ঠাকুর মনসা, শীতলা, শ্মশানকালী আর ব্রাহ্মণ, কায়স্থদের দুর্গা এবং শিব। মন্দিরের অবস্থার পার্থক্য দেখেও জাতিভেদ প্রথার অস্তিত্ব বোঝা যায়। গ্রামের ঠিক মাঝে দুর্গা আর কালীমন্দির অবস্থিত। সেই মন্দিরে প্রবেশাধিকার শুধু তথাকথিত উঁচুজাতির আর উগ্রকায়স্থদের। দলিতদের ঢোকার কোনো অধিকার নেই। মন্দিরের চাতালে বসার অধিকারও নেই। এই গ্রামেই দুই বাচ্চা যারা দলিত পরিবারের, তারা ওই মন্দিরের চাতালে ঢুকে পড়ায় তাদেরকে পিটিয়ে মারার ঘটনাও ঘটেছে। এই ঘটনা খুব নতুন কিছু নয়। কাটোয়ায় এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিলো। এই প্রবেশাধিকার না দেওয়ার পিছনে জাতিভেদ প্রথার দূষণনীতিকে দায়ি করা যেতে পারে। এই জাতিভেদ প্রথা দলিতদের ওপরে যে শ্রমের বিভাজন চাপিয়ে দিয়েছে, তা তাদেরকে নোংরা ঘাঁটার কাজ ছাড়া অন্য কিছু করার অনুমতি দেয় না। ফলতঃ তারা অস্পৃশ্য কারণ তাদের দেহ অপবিত্র।

জাতিভেদ প্রথা ও শ্রম

পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অর্থব্যবস্থা বিগত ১০ বছরে অনেক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। বর্ধমানের গ্রামগুলিতে আগে যেখানে মূলত কৃষিকাজ জীবন-জীবিকা নির্বাহের প্রধান মাধ্যম ছিল তা এখন অনেকটাই পাল্টেছে। সরকারী বা বেসরকারী চাকুরিরত মানুষের সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করা মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে গ্রামগুলিতে। শ্রমের বিভাজন ও জাতিভেদ প্রথার বিভাজন গ্রামগুলিতে ভীষণভাবে স্পষ্ট ভারতবর্ষের অন্যান্য অনেক রাজ্যের মতোই। শ্রমের বিভাজনের বিন্যাস যদি দেখি তাহলে দেখা যাচ্ছে যে সরকারী বা বেসরকারী দুই ধরনেরই বেতনসমেত চাকরিতে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ এবং উগ্র ক্ষত্রিয় (আগুরী)-দের আধিপত্য বেশি। গ্রামগুলিতে যে কয়েকটি দোকান চলে (মুদিখানার দোকান, কিছু কাপড়ের দোকান, ওষুধের দোকান ইত্যাদি) তা প্রধানত উগ্র কায়স্থদের হাতে। এবং এই উচ্চবর্ণ ও উগ্র ক্ষত্রিয় এই গ্রামগুলিতে জমির পরিমাণও প্রচুর। অপরদিকে মুসলিম এবং দলিতদের একটা বড় অংশ; বিশেষত ১৮-৩৫ বছর বয়সী; তারা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য পশ্চিমবঙ্গের বাইরে চলে গেছেন। এদের মধ্যে একটা বড় অংশ রাজমিস্ত্রীর কাজ নিয়ে বাইরে গেছেন। আদিবাসী গোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের প্রায় ১০০%-ই পাতা কুড়ানো এবং বিড়ি বাধার কাজ করে থাকেন। গ্রামের দলিত পরিবারগুলিতে যারা থেকে গেছেন তাদের বেশিরভাগ পুরুষই গ্রামেই ক্ষেতমজুরের কাজ করেন। এবং এই ক্ষেতগুলির জমির মালিকানা ব্রাহ্মণ এবং উগ্র ক্ষত্রিয়দের অধীনস্থ। যেহেতু ধানই মূলত চাষ হয় তাই ধানের মরসুম ছাড়া বাকি সময় তারা পার্শ্ববর্তী এলাকার চালের কারখানায় ঠিকা শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন।

জমির মালিক এবং মজুরের সম্পর্ক শুধুমাত্র শ্রেণি পরিচিতির ওপরে দাঁড়িয়ে পরিচালিত হয় না, তার সাথে জাতি পরিচিতি যে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে তা রোজকার জীবনে ভীষণভাবে স্পষ্ট। জমির মালিক যারা একাধারে উচ্চশ্রেণি এবং উচ্চবর্ণ তারা দলিত ক্ষেতমজুরদের বয়স নির্বিশেষে ‘তুই’ সম্বোধনে ডাকে যা ভীষণভাবে অমর্যাদামূলক, অথচ গ্রামের উগ্র ক্ষত্রিয়রা ব্রাহ্মণদের বয়স নির্বিশষে ‘তুমি’ বা ‘আপনি’ সম্বোধন করেন। দলিতদের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে বয়সে ছোটো উচ্চবর্ণ বা উগ্র ক্ষত্রিয় জমির মালিককেও তারা ‘আপনি’ এবং ‘বাবু’ সম্বোধন করছে। এর থেকে বোঝা যায় যে হিন্দুধর্মের জাতিভেদ প্রথা দলিতদের যে নিম্ন স্থান দিয়েছে তা রোজকার জীবনের অপমানের মূল উৎস হয়ে উঠেছে। জাতিভেদ প্রথা থেকে উৎসারিত অপমান এবং বৈষম্য আরো স্পষ্টভাবে বোঝা যায় দলিত ক্ষেতমজুর এবং জমির মালিকের কথোপকথন শুনলে। কাজ করতে দেরি করে আসার জন্য তিন জন দলিতকে শুনতে হয়েছে ‘সবকটা বাউড়ির পিঠের চামড়া তুলে নিতে হবে পরের দিন থেকে’। এখানে তার মজুর পরিচিতির থেকেও বাউড়ি পরিচিতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এমনভাবে যা বুঝিয়ে দেয় যে উচ্চবর্ণের জমির মালিকদের কাছে এই পরিচিতি যথেষ্ট এই ধরনের নিপীড়নমূলক কথা বলার জন্য। এই একটি বক্তব্যের মাধ্যমে জাতিভেদ প্রথা উচ্চবর্ণকে কী পরিমাণ ক্ষমতা দিয়েছে এবং সেই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে তারা দলিতদের কীভাবে নিপীড়ন করতে পারে তা যথেষ্টভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে যে প্রগতিশীলতার ধারণা আছে তা এই একটি মন্তব্য দিয়ে চুরমার হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু যাদের উদ্দেশ্যে এই মন্তব্য করা হয়েছে তাদের তরফ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না পাওয়ায় বা তাদেরকে বিস্মিত বা রাগান্বিত হতে না দেখায় এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে যে এই ঘটনা আকছার ঘটে। এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করায় উচ্চবর্ণের গ্রামের মানুষ সহ রাজনৈতিক কর্মী সবারই এক ধরনের মন্তব্য লক্ষ্য করা যায়। তারা সবাই বিভিন্নভাবে এটাই বলার চেষ্টা করেন যে এরকমই হয়ে আসছে এবং এতে দলিতদের খারাপ লাগার বা অপমানিত হবার কোনো ব্যাপার নেই। দলিত মজুরদের এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করায় একজন বলেন “শুনতে কি আর ভালো লাগে, কিন্তু কী করব, মুখ ফুটে কথা বললে আমার পেট চলবে কী করে, বাবুরা তো এরকমই বলে আসছে বহু বছর ধরে”।

একদিকে উচ্চবর্ণের দ্বারা এই ধরনের বৈষম্যমূলক ঘটনাকে একাধারে খারিজ করা হচ্ছে এবং স্বাভাবিকত্বের জায়গায় নিয়ে চলে যাওয়ার মাধ্যমে জাতিভেদ প্রথার বৈষম্যের অস্তিত্বকে অদৃশ্য করে দেওয়া হচ্ছে। আবার অন্যদিকে অর্থনৈতিক কারণে দলিতদের তরফ থেকে কোনো প্রতিরোধ না আসায় এই ঘটনাকে অবশ্যম্ভাবী ধরে নেওয়া হচ্ছে। দুই-এর সংমিশ্রণে জাতিভেদ প্রথা অদ্ভুতভাবে প্রকট থেকে যাচ্ছে এবং অদৃশ্যও হয়ে যাচ্ছে। এবং রাজনৈতিক দলগুলিও উচ্চবর্ণের আধিপত্যকে খারিজ করে কেউ-ই এই ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করছে না।

গ্রামের মহিলাদের শ্রমের বিন্যাসে জাতিভেদ প্রথা আরো প্রকট। গ্রামের দলিত পরিবারের মহিলারা সাধারণত বাড়িতেই পারিবারিক কাজ করে থাকেন এবং এছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকায় পরিচারিকার কাজ করেন ও ক্ষেতমজুরের কাজও করে থাকেন। উচ্চবর্ণের বিবাহিত ও অবিবাহিত মহিলারা সবাই পরিবারের অবৈতনিক কর্মী হিসাবে কাজ করেন। অবিবাহিত মহিলাদের পড়াশুনা করার অধিকার আছে কিন্তু তারা কেউই বিয়ের পরে চাকরী করেন না বা কোনো ধরনের বৈতনিক কাজ করেন না। এবং উচবর্ণের পরিবারগুলির সাথে কথাবার্তায় বোঝা গেলো যে পুরুষতান্ত্রিক নিয়মেই বাড়ির মহিলাদের কাজ করার কোনো অধিকার নেই কারণ তাদের স্বামী কাজ করেন এবং মহিলাদের যেহেতু পুরুষতন্ত্রের দর্শন অনুযায়ী বাড়ির কাজ করাই জীবনের একমাত্র দায়িত্ব ও ভবিতব্য তাই চাকরি করা বা বাইরে কাজ করাকে তারা অপ্রয়োজনীয় ও খারাপ কাজ মনে করেন। বাইরে কাজ করাকে খারাপ কাজ মনে করার সাথে জাতপাতের ধারণা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দলিত মহিলারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক চাপের মুখে বাধ্য হয়ে বাইরে কাজ করেন, সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে এক উচ্চবর্ণের মহিলা বললেন, “ওরা সব বাউড়ি-ডোম বাড়ির মেয়ে। ভদ্র বাড়ির মেয়েরা ওরকম করে বাইরে কাজ করতে পারে নাকি? ওরা মাঠে ঘাঠে কাজ করে, মুখের ভাষা সাঙ্ঘাতিক, ওদের কোনো লাজ-লজ্জা আছে নাকি!”

ইতিহাসগতভাবে বাংলায় মধ্যবিত্ত-ভদ্রলোক সংস্কৃতির সাথে পুরুষতন্ত্র ও জাতপাতের বিভাজন সমান্তরালে চলেছে। এই মন্তব্যেও তার প্রভাব স্পষ্ট। নিজেদের বাইরের কাজ না করাকে ভদ্রতার সাথে তুলনা করার মাধ্যমে দলিত মহিলাদের কাজ করাকে অভদ্রতার আখ্যা দেওয়া হল। নিজেদের 'ভদ্রলোক' হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য শ্রমের বিনিময়ে উপার্জনকে অবমাননা করা হচ্ছে শুধুমাত্র জাতিগত বিদ্বেষের কারণে। মাঠে-ঘাটে কাজ করা নিজগুণে এখানে খারাপ হিসাবে প্রতিপন্ন হচ্ছে না। দলিত পরিবারের মহিলারা এই কাজ করে থাকেন ফলত তা নিম্নমানের, এবং উচ্চবর্ণের এই কাজ শোভা পায় না সেই মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে এই মন্তব্যে।

যেহেতু জাতিভেদ প্রথা মননে গেঁথে আছে ফলত খুব স্বাভাবিকভাবেই দলিত মহিলারা এই বাড়িগুলিতে কাজ করতে এসে প্রতিনিয়ত অপমানিত ও অবদমিত হন। পরিচারিকার কাজ করলেও তাদের রান্নাঘরে, ঠাকুরঘরে এবং শয়নকক্ষে প্রবেশ করার কোনো অধিকার নেই। জাতিভেদ প্রথার নিয়ম মেনে দলিতদের ‘অপবিত্র’ দেহ নিয়ে উচ্চবর্ণের ঠাকুরঘর, রান্নাঘরের মতো ‘পবিত্র’ জায়গায় প্রবেশ করলে তা দূষিত হয়ে যেতে পারে সুতরাং তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। ব্রাহ্মণের বাড়িতে ঢোকার আগে হাত পা সব ধুয়ে নিতে হয় সাবান দিয়ে। সাধারণত খেতে দেওয়া হয় ঘরের বাইরে উঠোনে এবং বাসন আলাদা করা থাকে এবং সেই বাসন বাইরেই থাকে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে অস্পৃশ্যতার সব নিয়ম ও আচার পালন করা হয়।

এছাড়াও গ্রামে দলিত মহিলাদের অনেকভাবে বিরক্ত ও নিগ্রহ করা হয়। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা উচ্চবর্ণের হাতে। গ্রামগুলিতে মেয়েদের ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়ে যাওয়ার চল। কিন্তু দলিতদের পরিবারগুলিতে ১৪-১৫ বছরেই বিয়ে হয়ে যাওয়ার প্রবণতা আছে। যেহেতু মেয়েদের কাজে বেরোতে হয় অনেক ছোট থেকেই, ফলত রাস্তাঘাটে একা চলাফেরা করা তাদের পক্ষে খুব বিপজ্জনক বলে তাদের অভিভাবকরা মনে করেন। ফলত শুধুমাত্র দলিত নয়, আদিবাসী পরিবারগুলিও যে কোনো ধরনের নিগ্রহের হাত থেকে অবিবাহিত মেয়েদের রক্ষা করতে বিয়ে দিয়ে দেয় অন্যান্য উচ্চবর্ণের জাতি গোষ্ঠীগুলির থেকে ঢের আগে। এই ঘটনাগুলির মাধ্যমে উচ্চবর্ণের ক্ষমতার আরেকটি বীভৎস দিক সামনে আসছে যেখানে তাদেরকে জাতিভেদ প্রথা আধিপত্য বিস্তার করার জন্য নিম্নবর্ণের মহিলাদের ওপর অত্যাচার বা নিগ্রহ করার অধিকার দেয়।

পুরুষতন্ত্র যে সাধারণভাবে অত্যাচারের এবং অবদমনের হাতিয়ার তা গ্রামে জাতিগোষ্ঠী নির্বিশেষে মহিলাদের ওপরে পরিবারের মধ্যে পুরুষদের আধিপত্য এবং নিপীড়নের অভিজ্ঞতা শুনে বোঝা যায়। উচ্চবর্ণের মহিলারা ‘ভদ্রলোক’ সংস্কৃতি বজায় রাখতে গিয়ে সেই অত্যাচারকে সামনে আনতে পারেন না আর দলিত মহিলারা অত্যাচারিত হলে পালটা প্রতিরোধ করলেও দিনের শেষে স্বাধীন হতে পারেন না। দলিত মহিলাদের আরো আরেকটা স্তরের অত্যাচার ও অপমান, বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হয় জাতিভেদ প্রথার কারণে। সমগ্র ভারতবর্ষেই দলিত মহিলাদের এই দুই ধরনের নিপীড়ন সমান্তরালভাবে আঘাত করে। পশ্চিমবঙ্গও যে এই ব্যাপারে বাকি ভারবর্ষের থেকে আলাদা নয় তা উপরোক্ত ঘটনাবলী থেকেই প্রমাণিত।

জাতিভেদ প্রথা ও দলীয় রাজনীতি

উপরোক্ত আলোচনা থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট যে, এই বিভাজনের এবং বৈষম্যের ঘটনা নতুন নয় বরং অনেক দিন ধরেই চলে আসছে, অথচ মূলস্রোতের রাজনীতিতে তার বিশেষ ছাপ পড়েনি, আবার উল্টোদিকে রাজনীতিতে প্রতিনিধিত্বেও দলিতদের অন্তর্ভুক্তি হয়নি। বিভিন্ন রাজনীতি বিশেষজ্ঞ বিভিন্নভাবে এই ঘটনাকে বর্ণনা করেছেন। বাংলার রাজনীতিতে জাতি পরিচিতির এবং জাতিগত বৈষম্যের বিষয়টির অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পিছনে কারণ হিসাবে আমরা দেখাতে পারি দেশভাগ ও জনবিন্যাসে তার প্রভাব, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলিত জাতি গোষ্ঠীর অভাব, শ্রেণির রাজনীতির গুরুত্ব ও সর্বোপরি উচ্চবর্ণের নিরেট আধিপত্য ইত্যাদিকে।

এই গ্রামগুলির ক্ষেত্রেও সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে জাতিগত বৈষম্যকে স্বাভাবিকভাবে দেখার মাধ্যমে তা বৈষম্য হিসাবে অস্বীকার করা। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা অনস্বীকার্য। গ্রামগুলিতে মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃত্ব সবাই উচ্চবর্ণের। মানে দলের কাঠামোতে সিদ্ধান্তকারী সবাই উচ্চবর্ণ। তাদের সাথে কথা বলে বোঝা যায় যে তারা রাজনৈতিক আদর্শ নির্বিশেষে সবাই উচ্চবর্ণের আদর্শ এবং দর্শনকেই মেনে চলে। সবাই মননে ব্রাহ্মণ্যবাদী এবং তারা এই জাতির প্রশ্নটিকে রাজনীতি থেকে অদৃশ্য করে দেওয়ার পিছনে মূল ভূমিকা গ্রহণ করেছেন।

কিন্তু এই বৈষম্যের অদৃশ্যায়ন যেমন হয়েছে তেমনই রোজকার জীবনের রাজনীতিতে কিছু বিষয় উঠে আসছে যা জাতি পরিচিতির প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে আসছে। এই বছরের বিধানসভা নির্বাচনের সময় প্রতিটি রাজনৈতিক দলই তাদের ভাষণে বা নির্বাচনী প্রচারে জাতির প্রশ্নটি সামনে নিয়ে এসেছে। এই গ্রামগুলিতেও প্রচারের সময় প্রার্থীরা এবং দলের কর্মীরা বিভিন্নভাবে এই জাতি পরিচিতির ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসেছেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় প্রার্থীর জাতি পরিচতিকে গুরুত্ব দেওয়া বা জাতিগত বৈষম্যের প্রসঙ্গ তুলে আনা ইত্যাদি। হিন্দুত্ববাদী দল এই জাতি পরিচিতিকে সামনে রেখে বৃহত্তর হিন্দু পরিচিতি গড়ে তুলতে চেয়েছে যা তাদের প্রচারে স্পষ্ট। এবং একইসাথে দলিতদের অবদমনের এবং সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থানের জন্য মুসলিমদের দায়ি করার মাধ্যমে হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মন্যবাদ যা দলিতদের অবদমনের মূল কারণ তাকে অটুট রাখতে চেষ্টা চালিয়ে গেছে। অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলি তাদের প্রচারে বারবার তুলে এনেছে যে বিহার বা উত্তর প্রদেশে হিন্দুত্ববাদীদের হাতে দলিতরা কীভাবে নিপীড়িত হচ্ছে। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক স্কীম এবং বিশেষভাবে দলিতদের জন্য তৈরি প্রকল্পের প্রচার করা হয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে। তার ভালো ফল ভোটে বর্তমান সরকার পেয়েছে। কিন্তু এই নির্বাচনী রাজনীতির পরে রোজকার জীবনে এই জাতিভেদ প্রথার কাঠামোর মধ্যে থেকে উচ্চবর্ণের আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে রাজনৈতিক দলগুলি সামাজিক বৈষম্যের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে কি না বা করলে কীভাবে করে সেটাই ভবিষ্যতে দেখার।