আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২১ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

গ্লাসগো সম্মেলনের পরে


পুঁজিবাদ এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এমন নয় যে পুঁজিবাদের আগে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। কিন্তু পুঁজিবাদ, পুঁজির অবারিত মুক্ত সীমাহীন পৃথিবীর খোঁজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি তথা মালিকানাকে কেন্দ্রে নিয়ে আসে, যেখানে যা কিছু ব্যক্তিগত তাই পবিত্র, সমষ্টিগত সম্পত্তির দায় কারোর নয়। সমষ্টিগত সম্পত্তি যেমন জলবায়ু, পৃথিবী, নদী, সমুদ্র, ইত্যাদি, যার উপর কোনো ব্যক্তি বা কর্পোরেশনের একচেটিয়া অধিকার নেই, যা প্রকৃত অর্থেই সর্বজনীন। এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী গবেষক ১৮৩৩ সালে একটি গবেষণাপত্র লেখেন, যাতে তিনি দেখান যে ব্যক্তিদের যদি সমষ্টিগত সম্পত্তিকে ব্যবহার করার অনুমতি থাকে তবে অচিরেই সেই সমষ্টিগত সম্পত্তি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। যথা, পৃথিবীর বায়ু-বাতাসের উপর একটি কারখানার মালিকের অধিকার রয়েছে দূষিত পদার্থ ছড়াবার। সেই পুঁজিপতি নিজের ব্যক্তিগত মুনাফার হিসেবে জলবায়ু ধ্বংসের অঙ্কটি কষেন না। ফলত, জলবায়ু ধ্বংস হলেও, তার মুনাফা বাড়ে, কর্মসংস্থান হয়, উন্নয়নের নামে আমরা সাধু সাধু রব তুলি। অনেক অর্থনীতিবিদ অবশ্য মনে করেন যে এটি খুব একটা গুরুতর সমস্যা নয়। যদি দূষণ ছড়ানোর উপর কর নির্ধারণ করা যায়, তবে সেই টাকা যারা দূষণের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ তাদের দিয়ে দিলেই লেঠা চুকে যায়। অর্থাৎ, কে কত দূষণ ছড়াতে পারবে, তার যদি একটি বাজার তৈরি করা যায়, তবে যে সর্বাধিক দাম হাঁকবে, তাকে বলা যেতে পারে যে দূষণ করো, কিন্তু তোমাকে সেই পরিমাণ টাকা বাকিদের হাতে তুলে দিতে হবে। অর্থাৎ বাজারের মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু সত্যিই কি তাই?

সমষ্টিগত সম্পত্তি বাঁচানোর তাগিদ, ব্যক্তিগত স্বার্থান্বেষণকে যা দর্শনের পর্যায় নিয়ে গেছে, সেই পুঁজিবাদের আর প্রয়োজন নেই, তা আবারো বোঝা গেল সাম্প্রতিক গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে। রাষ্ট্রপুঞ্জের এই সম্মেলন ডাকা হয়েছিল প্যারিসে যে জলবায়ু সম্মেলন হয় ২০১৫ সালে, সেই বিষয়ে বিস্তারে আলোচনা করে কার্যপ্রণালী ঠিক করার উদ্দেশ্যে। প্যারিস সম্মেলনে বিশ্বের ১৯৬টি দেশ একত্রিত হয়ে ঘোষণা করেছিল যে পৃথিবীর তাপমাত্রা শিল্প বিপ্লবের পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় দুই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি বাড়তে দেওয়া হবে না, পারলে তাকে ১.৫ ডিগ্রিতে বেঁধে রাখা হবে। প্রত্যেকটি দেশ তার নিজস্ব রণনীতি নেবে এই বিষয়ে যা পাঁচ বছর পর পর আলোচনা করে বিশ্বব্যাপী রণনীতিতে প্রতিফলিত হবে। এই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং অন্যান্য ‘গ্রিনহাউস’ গ্যাসের নির্গমনকে কমানো বা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। গ্লাসগো সম্মেলনে এই বিষয়ে বিশদে আলোচনা করে রূপরেখা তৈরি হওয়ার কথা ছিল।

দুই সপ্তাহব্যাপী আলোচনা হওয়ার পরে গ্লাসগোতে যেই চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে, তা কতটা বিশ্ব উষ্ণায়ণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেছে। এই সম্মেলনের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে কয়লার প্রসঙ্গ। শেষ মুহূর্ত অবধি এই দাবির ভিত্তিতে আলোচনা চলে যে সমস্ত দেশ ধীর ধীরে কয়লার ব্যবহার শূন্যে নামিয়ে আনবে। পৃথিবীতে দূষণ ছড়ানোর ক্ষেত্রে কয়লার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, কারণ কয়লার মাধ্যমেই উন্নয়নশীল দেশগুলিতে তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়, যা বাতাসে প্রবল দূষণ ছড়ায়। অতএব, কয়লার ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া বিশ্ব উষ্ণায়ণ কমানোর দিকে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু ভারত ও চিন বেঁকে বসে। তারা বলে যে কয়লার ব্যবহার কমাতে তারা রাজি, কিন্তু শূন্যে নামিয়ে আনতে নয়। বাকিরা বিস্মিত হলেও, ন্যূনতম মতৈক্যের ভিত্তিতে 'কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনা হবে' এই মর্মে চুক্তি সাক্ষরিত হয়। সম্মেলনের মঞ্চে সভাপতির চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে যে তিনি প্রয়োজনীয় চুক্তি বাস্তবায়িত করতে অসফল হলেন।

ভারত সরকারের তরফে যেই যুক্তিটি দেওয়া হয়েছে তা হল এই যে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ভারতের কয়লা ব্যবহার করার অধিকার রয়েছে, যার মাধ্যমে দেশের উন্নতি হবে। প্রথম বিশ্বের দেশগুলি ইতিপূর্বেই কয়লার যথেচ্ছ ব্যবহার করে বায়ুমণ্ডলের ক্ষতিসাধন করেছেন। যা এখন উন্নয়নের কথা ভাবছেন, তাদেরকে কয়লা বা জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার না করতে বলা, তাদের উন্নয়নের পথে বাধা হয় দাঁড়ানো। যুক্তিটি একেবারে ফেলে দেওয়ার মত না হলেও আসলে তা ভ্রান্ত।

প্রথম বিশ্বের দেশগুলি বায়ুমণ্ডলের ক্ষতি করেছে বলে উন্নয়নশীল দেশগুলিরও বায়ুমণ্ডলের ক্ষতি করার সমান অধিকার রয়েছে - এই যুক্তিটি নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার সামিল। গোড়াতেই যেই কথা বলা হয়েছে, বায়ুমণ্ডল বিশ্বের সমষ্টিগত সম্পত্তি। যেই ক্ষতি করুক তার, ক্ষতি আসলে সবার। তাই সমস্ত দেশেরই উচিত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে এসে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি যেমন, সৌরশক্তি, বাতাস-নির্ভর শক্তি ইত্যাদির ব্যবহার বাড়ানো। তা না করে কয়লার মতন ক্ষতিকারক জ্বালানিকে ব্যবহার করব, কারণ বাকিরা আমার আগে করেছে, এটি কোনো যুক্তি হতে পারে না।

কিন্তু বিষয়টি শুধুমাত্র উন্নয়নশীল দেশের বিষয় নয়। প্যারিস সম্মেলনের চুক্তিতে ঘোষণা করা হয়েছিল যে উন্নত দেশগুলি নতুন শক্তির ব্যবহার বাড়ানোর জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলিকে আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত সাহায্য করবে। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষিত হয়নি। উন্নত দেশগুলির তরফে খুব বেশি টাকা উন্নয়নশীল পিছিয়ে পড়া দেশগুলির হাতে তুলে দেওয়া হয়নি। ফলত, প্রযুক্তি এবং অর্থের নিরিখে নতুন জ্বালানিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলির সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যদি সত্যিই জলবায়ু সংক্রান্ত ন্যায় করতে হয়, তবে উন্নত দেশগুলির অবিলম্বে বিপুল পরিমাণ টাকা উন্নয়নশীল দেশগুলিকে দেওয়া উচিত যার মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানিকে পরিত্যক্ত করে গোটা পৃথিবী নতুন এবং পরিবেশ-বান্ধব জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে পারে।

গ্লাসগো সম্মেলেনে উন্নয়নশীল এবং উন্নত দেশের এই দ্বন্দ্বের নিরশন হল না। এর ফল ভুগতে হতে পারে সমস্ত মানব সমাজকে। সমষ্টিগত সম্পত্তি, বিশ্বের জলবায়ু বাঁচানোর জন্য এখনও যদি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ একত্রিত না হতে পারে, তবে এই পৃথিবীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।