আরেক রকম ● নবম বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২১ ● ১৬-৩০ কার্ত্তিক, ১৪২৮
প্রবন্ধ
মউকা মউকা ও মার্শালাকেবাদ
পল্লববরন পাল
দৃশ্য - এক
গত শতাব্দীর ছয়ের দশকের শেষের দিক। বিল লরি-র অস্ট্রেলিয়া টেস্ট খেলছে ইডেন উদ্যানে। একটা অসাধারণ স্বপ্নসুন্দর ইনিংসে ইয়ান চ্যাপেল তখন নিরানব্বই-এ। বল হাতে বিষেন বেদীর দৌড় ছন্দে গোটা ইডেনে আসন্ন শতরানের আশায় হাততালির আবহ। হঠাৎ আউট। এবং গোটা স্টেডিয়ামে পিন-পতনের স্তব্ধতা। ব্যাট বগলে ফিরে আসছেন চ্যাপেল। ইডেন উঠে দাঁড়িয়ে করতালি স্যালুট জানালো তাঁকে।
খেলোয়াড়সুলভ মানসিকতা।
আমি তখন স্কুল ছাত্র - শুধু খেললেই যে খেলোয়াড় হওয়া যায়না, শুধু পড়াশোনার নামই যে শিক্ষা নয় - ‘মানুষ’ লিখতে মূর্ধন্য ষ - এটা জানা মানেই যে মানুষ হওয়া নয় - সেই আমার হাতেকলমে প্রথম শেখা - জানলাম জীবন আরও অনেক অনেক বড়ো।
দৃশ্য - দুই
সাতের দশকের গোড়ায় সেই ইডেনে ইরানের পাস ক্লাবের সাথে আইএফএ শিল্ড ফাইন্যাল খেলছে ইস্টবেঙ্গল। সেদিন স্টেডিয়ামে প্রচুর কট্টর মোহনবাগানীদেরও চিরশত্রু ইস্টবেঙ্গলের জয়ে আত্মহারা হয়ে মশাল জ্বালাতে দেখেছি। আমি স্কুল ছাত্র তখনও এবং ‘চিরশত্রু’ শব্দটা তখনও যথেষ্ট নিরীহ।
দৃশ্য - তিন
আটের দশক। পাকিস্তানের ক্রিকেট অধিনায়ক আসিফ ইকবাল তাঁর শেষ টেস্ট ইনিংস খেলে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে ইডেনের থেকে যে সম্মান ও অভিবাদন পেলেন - সোচ্চারে স্বীকার করেছেন, এই শ্রেষ্ঠ স্মৃতি তিনি আমৃত্যু বহন করবেন।
এই খেলোয়াড়ি মানসিকতা শুধু ইডেন নয়, কলকাতা - শুধু কলকাতা নয়, বাঙলা - শুধু বাঙলা নয়, ভারতসহ গোটা বিশ্বে - এবং শুধু খেলায় নয়, আমাদের যাপন-চরিত্রেও ‘ভদ্রতা’ ‘শালীনতা’র মতো বিভিন্ন প্রায় সমার্থক নামে অঙ্গাঙ্গী ছিলো। রাজনীতিতেও দেখেছি - বিধান রায় ও জ্যোতি বসু, পরবর্তীকালে জ্যোতি বসু ও সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় বা ইন্দিরা গান্ধী - যত মত, তত পথ - কিন্তু পারস্পরিক মত পথ ও মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান সম্ভ্রমবোধ অটুট। এ সবই - একদা ছিলো - এখন নেই।
দৃশ্য - চার
বজ্রাহত হলাম ছিয়ানব্বইয়ে। বিশ্বকাপের ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ভারতের শোচনীয় ব্যাটিং বিপর্যয়ে সেই ইডেন শিশি বোতল ছুঁড়ে খেলা ভন্ডুল করে দিলো। বিশ্বনিন্দিত হলো ইডেন। হঠাৎ তো নয়, আস্তে আস্তে মাত্র দু’দশকের মধ্যে এই বদল ঘটে গেছে নিঃশব্দে। চোখের সামনে অথচ দৃষ্টির বাইরে।
শায়েস্তা খাঁয়ের আমলে এক টাকায় একমণ চাল পাওয়া যেতো - এই তথ্য এখন যতটা অলীক মনে হয়, ঠিক ততোটাই মুখ হাঁ হয় খেলোয়াড়ি মনোভাবের একদা অস্তিত্বের কথা ভেবে। ছোটোবেলায় শুনেছিলাম - খেলায় হারজিত আছে, মেনে নিতে হয়। এখন খেলা ততক্ষণই খেলা, যতক্ষণ আমার জিত। জিত হলে তবেই খেলোয়াড়ি মনোভাব-টাবের প্রশ্ন। যেনতেন উপায়ে জয় হাসিল করতে হবে - হ্যাঁ, যেনতেন উপায়ে - মউকা মউকা - ‘পরাজয়’ শব্দটা খেলার মধ্যে তো নেইই, আমাদের বৃহত্তর নাগরিক জীবনেও নেই - থাকলেই বিপদ - দেশদ্রোহী উপাধিপ্রাপ্তির আশঙ্কা। খেলোয়াড়ি মনোভাবের মধ্যে যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমন্বয়ের বাস ছিলো, বেমালুম হাপিস। বরং এক হিংস্র দাঁতনখওয়ালা যুদ্ধং দেহী আবহাওয়া বিরাজমান।
মহিলা বিরোধী রাজনৈতিক নেত্রীকে নিয়ে অশালীন উদাত্ত ইঙ্গিত - এক রাজনৈতিক দলের পাঁচজন করে ক্যাডারকে দৈনিক জলখাবারের তালিকাভুক্তির বা ঘরে ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে ধর্ষণের দর্পিত সপার্ষদ ঘোষণা - আমি যা খাই না, তুমি কেন খাবে? সুতরাং মার্শালাকে - আমি যাকে পুজো করি, তুমি কেন অন্য কাউকে? সুতরাং মার্শালাকে - আমি পোড়াই, তুমি কেন কফিনে তুলবে? সুতরাং মার্শালাকে - এখন ‘খেলা হবে’ শ্লোগানের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে হাড়হিম মার্শালাকে-সন্ত্রাস।
এ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এক অনুজ প্রকৌশলী অধ্যাপক তাঁর এক বরিষ্ঠ অধ্যাপক সম্পর্কে আমাকে বলেছিলেন - অমুকদার স্ত্রী কেন তমুকদার স্ত্রীয়ের সঙ্গে মেলামেশা করছেন? একটু দেখুন, তমুকদার পোলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউণ্ডটা বুঝিয়ে বলুন... যেহেতু উক্ত অমুক আমার বিশিষ্ট বন্ধু এবং আমরা দুই বন্ধু ও সেই অধ্যাপক ঘটনাচক্রে একই রাজনৈতিক পার্টির সমর্থক, এবং জনৈক তমুকবাবু বিরুদ্ধ রাজনীতির মানুষ, সুতরাং অনুজ অধ্যাপক ভদ্রলোক পার্টির মহান নির্দেশ পালন করছেন। ‘তোর নাম এই বলে খ্যাত হোক / তুই আমাদের লোক।’ অন্যথা হলেই মার্শালাকে।
উত্তরে আমি থাপ্পড় মেরেছিলাম, নাকি কামড়ে দিয়েছিলাম - সেটা অবান্তর এবং এই বিষয়ের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই - তাই উহ্যই থাক। অন্য কোনো প্রসঙ্গে একদিন প্রকাশ করা যাবে বরং।
অধুনা এই আমাদের সামাজিক সম্প্রীতির বাতাবরণ। খেলোয়াড়ি মানসিকতার সংজ্ঞার মধ্যে মউকা-মউকা থেকে দাঁত নখ পেটো বোমা মায় একেসাতচল্লিশ অবধি হৈ হৈ করে ঢুকে পড়েছে। এখন বিরোধীশূন্য গণতন্ত্রবাদ। বিরোধী মানেই ঠাঁই-ঠাঁই-ঠাঁই-ঠাঁই-ঠাঁই, বিরোধী মানেই দেশদ্রোহী। মার্শালাকে।
এখন আমাদের জীবনে আর খেলা নেই - কারণ আর মাঠ নেই, যেখানে মাঠ ছিলো সেখানে এখন বাণিজ্য ইমারত - চারতলা বাড়ি পুরোটাই শপিং মল। পুরোটাই যুদ্ধ। গত শতাব্দীর অন্তিম দশক থেকে শুরু এই যে সর্বগ্রাসী বাণিজ্যায়ন - এই যে সবকিছুকে মূল্যমানে নির্ধারিত করা - এই ‘এখানে সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ আর ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ নামক সাদাকালো যাপনভঙ্গি - যা আমাদের প্রত্যেকদিন শেখাচ্ছে - জীবন একটি বাণিজ্যস্থল, একমাত্র জয়ীদের জন্যই বিনিয়োগ, কাজেই হয় ফার্স্ট হও নয় সুইসাইড করো, হয় মারো নয় মরো, বেয়াল্লিশে বেয়াল্লিশ নইলে নো উন্নয়ন।
চব্বিশ ঘন্টাই যুদ্ধ, এবং যেনতেন প্রকারেণ জয় চাই - সোজা পথে নাকি বাঁকা পথে - সেটা বড়ো কথা নয়। প্রত্যেকটা ক্রিকেট সিরিজের আগে এই মঊকা-মউকার মতো নোংরা বিজ্ঞাপন দেখলেই (কারণ, ক্রিকেট মানেই বাণিজ্য) আমাদের এই যাপনচিত্রটা পরিষ্কার দেখা যায়।
রাষ্ট্র আমাদের যুদ্ধে নামিয়ে দিয়েছে, কাজেই অভিধান থেকে আমরা মুছে নিয়েছি ‘খেলোয়াড়ি মনোভাব’ বা ‘শালীনতা’ সমার্থক শব্দগুলো, এবং থালা বাজাতে বাজাতে আমরা ‘মউকা মউকা - মার্শালাকে মার্শালাকে’ গেয়ে গেয়ে নেচে চলেছি।
কেন এমন হলো? উত্তর দেবেন কিম্বা দেবেন না সমাজবিজ্ঞানীরা। সেটাও অবশ্য হয়তো নির্ধারণ করবে রাষ্ট্রের বাণিজ্যভঙ্গি।