আরেক রকম ● নবম বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২১ ● ১৬-৩০ কার্ত্তিক, ১৪২৮
সম্পাদকীয়
জাতীয় সুরক্ষা, গণতন্ত্র ও সুপ্রিম কোর্ট
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ভারতে যতগুলি সরকার গঠিত হয়েছে তার মধ্যে মোদী সরকারের মতন গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দেওয়ার সংকল্প আর কোনো সরকারের ছিল না। হ্যাঁ, ইন্দিরা জমানায় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়, যা আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের গণতন্ত্রকে দুর্বল করার প্রথম পদক্ষেপ ছিল। কিন্তু মোদী জমানায় ভারতের সংবিধান, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সমস্ত কিছুই প্রায় ধ্বংসের সম্মুখে দাঁড়িয়ে।
মোদী সরকারের আমলে ক্রিকেট খেলায় পাকিস্তানকে সমর্থন করার অজুহাতে ছাত্রদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা রুজু করা হয়। দলিত হওয়ার অপরাধে প্রকাশ্য রাস্তায় মানুষ পেটানো হয়, ধর্ষন করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় হাথরসের নারীকে। নাগরিকত্ব আইনের নামে ধর্মনিরপেক্ষ দেশে ধর্মকে নাগরিকত্বের শর্ত হিসেবে স্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। জম্মু কাশ্মীরের মানুষ, তাদের জনপ্রতিনিধিদের মতামত না নিয়েই নিষ্ঠুরভাবে রাজ্যটিকে দ্বিখণ্ডিত করে, তার রাজ্যের মর্যাদাই কেড়ে নেওয়া হয়েছে, সংবিধানের ৩৭০ ধারাকে বিলোপ করা হয়েছে। কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষের যেকোনো আন্দোলনকে দেশবিরোধী আখ্যা দিয়ে তার উপরে আক্রমণ নামিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। বুদ্ধিজীবি, লেখক, ছাত্র, অভিনেতা, সবাই বিজেপি তথা সরকারের রোষের সম্মুখীন হয়েছে, যদি তারা সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলে।
এই পরিস্থিতিতে, বিরোধীরা যে মানুষকে সংগঠিত করে কোনো গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, তা ঘটনা। তবু বিরোধী রাজনীতি তো দেশ থেকে উধাও হয়ে যায়নি। বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্নভাবে বিরোধীরা বিজেপি-র বিরুদ্ধে লড়াই করছে। একইভাবে কিছু বিবেকবান সাংবাদিক, বা বুদ্ধিজীবিরাও চেষ্টা করছেন বিজেপি-র বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে। স্বাভাবিকভাবেই বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকারের এই সমস্ত কার্যকলাপ পছন্দ নয়। অতএব, সিবিআই, ইডি, এনসিবি, ইত্যাদি কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে বিরোধীদের বিরুদ্ধে লাগাতার ব্যবহার কর হয়েছে। এতেও অবশ্য সরকার সন্তুষ্ট নয়। তাই শুরু হল আড়ি পাতা। বিরোধী নেতা, সাংবাদিক, এমনকি বিচারপতিদের ফোনেও ইজরায়েলি সফ্টওয়ার 'পেগাসাস' দিয়ে আড়ি পাতা হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেন বিশিষ্ট সাংবাদিক এন রাম এবং শশীকুমার। এই মামলা সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার পরে বারবার সরকার পক্ষ থেকে বলা হয় যে তারা 'পেগাসাস' ব্যবহার করেছে না করেনি, তার কোনোটাই লিখিতভাবে তারা জানাবে না। অর্থাৎ সরকার পক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে 'পেগাসাস' ব্যবহার করা স্বীকারও করছে না, আবার অস্বীকারও করছে না। অথচ দেশের নাগরিকদের ফোনো আড়ি পাতা হয়েছে বলে যে খবর প্রকাশিত এবং প্রমাণিত হয়েছে তা নিয়ে সরকার কোনোরকম তদন্ত করতেও রাজি নয়। অর্থাৎ আপনার ফোনে ইজরায়েলের সফ্টওয়ার দিয়ে আড়ি পাতা হলেও, সরকার তা নিয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না। স্বাভাবিকভাবেই সরকারের তরফে তাদের তুরুপের তাসটি ফেলা হয়। বলা হয় যে 'পেগাসাস' সংক্রান্ত তথ্য তারা দিতে অপারগ কারণ এতে দেশের জাতীয় সুরক্ষা বিঘ্নিত হতে পারে। ব্যস! জাতীয় সুরক্ষার মতন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিশ্চয়ই আমার আপনার ফোনে কে আড়ি পাতছে, তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দেশের সরকার যদি মনে করে যে আপনার ফোনে জাতীয় সুরক্ষার জন্য আড়ি পাতা জরুরি, তবে তাই হওয়া সমীচীন। মানুষও বছরের পর বছর জাতীয় সুরক্ষার অজুহাতে তাদের অধিকারগুলিকে একে একে খুন হয়ে যেতে দেখেছেন। তাই সবাই মনে করেছিলেন, এই ক্ষেত্রেও তাই-ই হবে। সুপ্রিম কোর্টও মেনে নেবে যে জাতীয় সুরক্ষার বিষয় আদালত মাথা ঘামাবে না। কিন্তু তা হল না।
সুপ্রিম কোর্টে মাননীয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ রায় দিল যে পেগাসাস কাণ্ডে যেহেতু সরকার কোনো হলফনামা দিতে অস্বীকার করেছে তাই সুপ্রিম কোর্ট একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি গড়ার নির্দেশ দিচ্ছে যার নেতৃত্বে থাকবেন একজন প্রাক্তন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, মাননীয় আর ভি রবীন্দ্রন। সুপ্রিম কোর্ট এই তদন্ত কমিটিকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন 'পেগাসাস' সংক্রান্ত যাবতীয় সত্য উদ্ঘাটন করার। যেমন, 'পেগাসাস' ভারতের নাগরিকদের উপর ব্যবহার করা হয়েছিল কি না? যদি হয়ে থাকে তবে কাদের উপর ব্যবহার করা হয়েছিল। 'পেগাসাস' কি ভারত সরকার বা কোনো রাজ্য সরকার অথবা কোনো কেন্দ্রীয় বা রাজ্যের সংস্থা ব্যবহার করছিল? যদি ব্যবহার করা হয়ে থাকে তবে তা কি আইন মেনে ব্যবহার করা হয়েছিল? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য সুপ্রিম কোর্ট এই কমিটিকে পূর্ণ ক্ষমতা এবং স্বাধীনতা দিয়েছে এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে এই কমিটির কাজে সহায়তা করার জন্য। আশা করা যায় সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতির নেতৃত্বে এই কমিটি শীঘ্রই আমাদের সামনে 'পেগাসাস' সংক্রান্ত প্রকৃত তথ্য তুলে ধরবে।
আমাদের মতে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অংশটি জাতীয় সুরক্ষা এবং সাংবিধানিক অধিকার সংক্রান্ত। সরকার যেহেতু বারংবার জাতীয় সুরক্ষার অজুহাত দেখিয়ে 'পেগাসাস' সংক্রান্ত প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে, সুপ্রিম কোর্টকে সরাসরি জাতীয় সুরক্ষার প্রশ্নটির মোকাবিলা করতে হয়। বিগত দিনে দেশের আদালতের রায় এই কথারই সাক্ষ্য দেয় যে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় সামনে এলেই আদালত পিছিয়ে আসে, সরকারকে নীতি নির্ধারনের বিষয়ে প্রশ্ন করে না। কিন্তু এই রায়ে সুপ্রিম কোর্ট একটি সুস্পষ্ট অবস্থান নেয়। মাননীয় বিচারপতিরা বলেন যে, নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্যের অধিকার তাদের মৌলিক অধিকার। জাতীয় সুরক্ষার ধুয়ো তুলে এই অধিকারগুলিকে নস্যাৎ করা যায় না। যদি বেআইনিভাবে পেগাসাসের মাধ্যমে নাগরিকদের উপর নজরদারি চালানো হয়ে থাকে তাহলে তা তাদের মৌলিক অধিকারের বিরোধী। জাতীয় সুরক্ষার নামে এই অধিকারকে ভূলুন্ঠিত করা যায় না। জাতীয় সুরক্ষা বনাম মৌলিক অধিকারের যে দ্বন্দ্ব সরকার পক্ষ বারবার সুপ্রিম কোর্টের সামনে হাজির করে, মৌলিক অধিকারকে খর্ব করার রাজনীতিতে আইনের ছাপ লাগিয়ে শুদ্ধ করে নিয়েছে, সেই প্রক্রিয়ার উপর সুপ্রিম কোর্ট এবারে একটি যতি চিহ্ন টানল। না, বারবার জাতীয় সুরক্ষার হাড়িকাঠে মানুষের মৌলিক অধিকারকে বলি দেওয়া যাবে না। শুধু এই একটি কারণেই সুপ্রিম কোর্টের এই রায় ভারতের সাম্প্রতিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে রয়ে যাবে।
কিন্তু এখানেই এই রায়ের গুরুত্ব শেষ হয় না। এই রায়ের রাজনৈতিক গুরুত্বও অপরিসীম। মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বারবার মানুষ সুপ্রিম কোর্টে ন্যায়ের দাবি নিয়ে গেছে, সরকারের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আদালতের হস্তক্ষেপ চেয়েছে। কিন্তু দুঃখের হলেও বলতেই হয় যে মানুষ সুবিচার পাননি। নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে ১৫০-র বেশি মামলা সুপ্রিম কোর্টে জমা পড়েছে, কিন্তু শুনানি হয়নি। ৩৭০ ধারা জারি করার বিরুদ্ধেও মামলার কোনো শুনানি হয়নি। কাশ্মীরের মানুষের অজস্র হেবিয়াস কর্পাস পিটিশন, যা দাখিল করা মানুষের মৌলিক অধিকারের সমকক্ষ, সুপ্রিম কোর্টে শুনানি হয়নি। অন্যদিকে, বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা অন্যায় হয়েছে মেনে নিয়েও সেই জমি রাম মন্দিরের জন্য বরাদ্দ করলেন মহামান্য বিচারপতিরা, যেই রায় নিয়ে এই পত্রিকার পাতাতেও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। রাফাল কেলেঙ্কারি নিয়েও সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে কড়া প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে বাধ্য করেনি। মানুষের মনে আস্তে আস্তে এই ধারণাই পোক্ত হচ্ছিল যে সুপ্রিম কোর্ট আসলে সরকারের পক্ষে। সরকারের রাজনৈতিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাপট বোধহয় বিচারপতিদের উপরেও পড়েছে। বিশেষ করে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি, যিনি রাম মন্দিরের রায়ের এক মুখ্য কারিগর, যখন বিজেপি-র বদান্যতায় রাজ্যসভার সদস্যপদ লাভ করেন, তখন এই সন্দেহ মানুষের মনে যে দানা বাঁধবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। মোদী জমানায় গণতন্ত্র এবং সংবিধানের উপর যে আক্রমণ সংগঠিত হচ্ছে, তাতে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের নয়, সরকার পক্ষের সুরক্ষা করতে বেশি তৎপর, এহেন ধারণা বহু মানুষের মনে দৃঢ় হচ্ছিল।
কিন্তু পেগাসাস মামলায় সুপ্রিম কোর্ট এই পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগের বিরুদ্ধে নিজেদের সাক্ষ্য দিল। নতুন প্রধান বিচারপতি এই বার্তা হয়ত দিতে চাইলেন যে সুপ্রিম কোর্ট কোনো সরকারের হয়ে নয়, শুধুমাত্র ভারতের সংবিধানের পক্ষে অবস্থান নেয়। আমরা আশা করব, এই রায়ের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট যে আশার আলো দেখাল, তা মাননীয় বিচারপতিরা অন্যান্য মামলাগুলির ক্ষেত্রেও দেখাবেন। বিশেষ করে নাগরিকত্ব আইন ও এনপিআর-বিরোধী মামলা, ৩৭০ ধারা বিলোপের বিরুদ্ধে মামলার শুনানি করে সংবিধান বাঁচানোর জন্য সুপ্রিম কোর্ট যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।
কিন্তু শুধুমাত্র বিচারব্যবস্থা এবং সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্ন তথা সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব নয়। ভারতের বিরোধী দলগুলি নাগরিকত্ব আইন অথবা ৩৭০ ধারা বিলোপের মতন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে তেমন জোরালো প্রতিবাদ সংগঠিত করে উঠতে পারেনি। যা আন্দোলন হয়েছে তা মুখ্যত নাগরিক সমাজের উদ্যোগেই হয়েছে। কিন্তু আগামীদিনে রাজনৈতিকভাবে বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হলে সুপ্রিম কোর্ট নয়, বিরোধীদের তাকাতে হবে রাস্তার দিকে। সুপ্রিম কোর্টের অলিন্দ নয়, মোদী-মুক্তি ঘটবে ভারতের রাস্তার লড়াইয়ে।