আরেক রকম ● নবম বর্ষ বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ অক্টোবর, ২০২১ ● ১-১৫ কার্তিক, ১৪২৮

প্রবন্ধ

আফগানিস্তানের একাল-সেকাল এবং গ্রন্থ

অশোক সিংহরায়


এ বিবরণ কাবুলবাসের; এ বিবরণ সমগ্র আফগানিস্তানের জন-জীবনকে ছুঁয়ে দেখার।

"কাবুলনামা"-র লেখক অমিতাভ রায় তার কাবুলবাসের সময় সেই জাতিটাকে তার ইতিহাস-সংস্কৃতি-জাতিসত্তা-যাপনের আঙ্গিকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন; গত এক শতাব্দী জুড়ে যে জাতির জীবনে ক্রান্তিকাল এসেছে পর্যায়ক্রমে বারবার। বাঙালি মননে আফগানীরা চিরন্তন দুঃখী মানুষ। আত্মজদের হারিয়ে নিঃস্ব গান্ধারীর (কান্দাহারী) মর্মবেদনা; রবীন্দ্রনাথের লেখা 'কাবুলিওয়ালা' গল্পের রহমতের দীর্ঘকালের অদর্শনে তার কিশোরী কন্যাও তাকে মিনির মতো চিনতে ভুল করবে কিনা বলে আক্ষেপ; সৈয়দ মুজতবা আলীর "দেশে বিদেশে"-র আবদুর রহমানের এক অরাজক সময়ে তার মনিব মুজতবা আলীর সঙ্গে দেশ ছেড়ে আসার আকুতি - সেই পরম্পরা আজও আফগানদের ছাড়েনি। আমেরিকার তালিবানদের হাতে দেশটাকে হস্তান্তর করার পরিণতিতে - মা তার শিশুসন্তানকে রক্ষা করার ব্যাকুল কামনায় কাঁটাতারের বেড়ার উপর দিয়ে বিমানবন্দরের ভিতরে ছুঁড়ে দেওয়ার দৃশ্য; কাবুল ছাড়ার জন্যে এক আফগান কিশোরের বিমানের চাকা ধরে ঝোলার পরিণতিতে মৃত্যুবরণের দৃশ্য সেই কথার সত্যতাই প্রমাণ করে। এ বিবরণ সেই দুঃখী মানুষদের দেশটাকে খোঁজার। সব মানুষই চায় সামাজিক ন্যায় এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে সন্তান-সন্ততি সহ সুখে দিনযাপন। কিন্তু আফগানদের সেই স্বপ্ন বারেবারে চুরমার হয়ে গেছে। মাৎস্যন্যায়ের মধ্যে দিয়ে তাদের বারেবারে যেতে হয়েছে।

আফগানিস্তানের রাজা আমানুল্লাহ ১৯১৯ সালে ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে স্বাধীন করে স্বাধীন আফগানিস্তানের প্রতিষ্ঠা করেন। সদ্য প্রতিষ্ঠিত সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করেন। তুরস্কের নেতা কামাল আতাতুর্কের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আফগানিস্তানকে একটি সহনশীল আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। তাঁর রানি সুরাইয়া ছিলেন এই ব্যাপারে তাঁর একান্ত সহযোগী। মেয়েদের জন্য স্কুল-কলেজ চালু করা, কিছু মেয়েকে উচ্চশিক্ষার জন্য তুরস্কে পাঠানো; রানি সুরাইয়ার প্রকাশ্যে পর্দানসীন না থাকা, সব মেয়েদের পর্দাপ্রথা তুলে দিতে উৎসাহ দেওয়া; পুরুষদের বহুবিবাহ বন্ধ করার চেষ্টা করা ইত্যাদির জন্য আমানুল্লা মোল্লাদের বিরাগভাজন হন। পরাজিত এবং অপমানিত ইংরেজের প্ররোচনায় মোল্লাদের শিরোমণি কাবুলের শোরবাজারের নেতৃত্বে পাশতুন শিনওয়ারি আর খুগিয়ানি উপজাতির মানুষ অস্ত্র ধরে 'অধার্মিক' বাদশাহকে গদিচ্যুত করতে। তাজিক ডাকাত সর্দার বাচা-এ-সাকাও লুন্ঠনের উদ্দেশ্যে কাবুল আক্রমণ করে। ক্ষমতাচ্যুত হন আমানুল্লাহ। ১৯২৯-এর জানুয়ারিতে সপরিবারে ব্রিটিশ ভারতে পালিয়ে আসেন এবং ইউরোপে চলে যান। আফগানদের আধুনিক হওয়ার স্বপ্ন পিছিয়ে যায় কয়েক দশকের জন্য। অগ্রগতির পরবর্তী সুযোগ এসেছিল ১৯৭৮ সালে যখন বামপন্থী দল পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি ক্ষমতা দখল করে। নূর মোহাম্মদ তারাকির নেতৃত্বে পিডিপি সরকারের চেষ্টা হল - জনজীবনে ধর্মীয় গোঁড়ামি দূর করা, রাষ্ট্র চালনাতে মসজিদ ও মোল্লাদের প্রভাব নির্মূল করা; শারিয়া আইন রদ করা; মেয়েদের শিক্ষার প্রসার ঘটানো, চাকরি-বাকরিতে মেয়েদের আনা; সামন্ততান্ত্রিক ভূমিব্যবস্থার সংস্কার করা। এতেই ধর্মীয় নেতা ও সামন্তপ্রভুদের স্বার্থে আঘাত লাগলো। তাদের সাহায্যে এগিয়ে এল আমেরিকার সিআইএ, পাকিস্তানের আইএসআই, সৌদি আরব। বিধর্মী কমিউনিস্টদের হাত থেকে আফগানিস্তানকে বাঁচাতে দীর্ঘ এক দশকের মুজাহিনদের যুদ্ধে দেশকে আবার ঠেলে দেওয়া হল মধ্যযুগে। ১৯৯২ সালে পিডিপির সাধারণ সম্পাদক এবং আফগানিস্থানের প্রেসিডেন্ট ডঃ মুহম্মদ নাজিমুল্লাহ তালিবানের হাতে ক্ষমতাচ্যুত হন এবং কাবুলের রাষ্ট্রসংঘের অফিসে আশ্রয় নেন। ১৯৯৬ সালে তালিবানদের হাতে নিহত হন তিনি। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত চলল তালিবানের মধ্যযুগীয় শাসন। নিউইয়র্কের ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগনের ওপর আল কায়দার হামলার প্রতিশোধে মার্কিন নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক বাহিনী আফগানিস্তানে প্রবেশ করে। তার পরের ২০ বছর ধরে নতুন আফগানিস্তান গড়ার স্বপ্ন দেখিয়ে আবার তালিবানদের হাতেই তুলে দেওয়া হল আফগানদের। মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা-মুক্ত উন্নয়নের গাড়িতে বারবার সওয়ার হয়ে মাঝ রাস্তায় নেমে পড়তে বাধ্য হওয়াটাই যেন হতভাগ্য আফগানদের ভবিতব্য। এই আন্তর্জাতিক বাহিনীর নেতৃত্বে আফগানিস্তানের পুনর্গঠন পর্বে আফগানিস্তান সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে প্রযুক্তিবিদ অমিতাভ রায়ের আফগানিস্তান যাত্রা। তার কাবুলবাসের স্মৃতি এবং নিরাপত্তার নিয়মবিধি মেনেও কাবুল ছাড়িয়ে আফগানিস্তানকে দেখার অভিজ্ঞতার ফসল 'কাবুলনামা' গ্রন্থ (প্রকাশকঃ অনুষ্টুপ)। আসুন লেখকের চোখ দিয়েই আমরাও ঘুরে আসি সেই সময়ের এবং সব সময়ের কাবুল তথা আফগানিস্তানে।

আতঙ্কের কাবুলঃ "শুক্রবার সাতসকালেই হুমকি মেশানো হুঁশিয়ারি শুনে ঘুম ভেঙে গেল 'তোমার রেডিয়োটা বন্ধ কেন?'... 'ইভ্যাক্যুয়েশন ব্যাগ' তৈরি করে রাখো। গাড়ি পাঠানো হচ্ছে। গাড়ি না পৌঁছনো পর্যন্ত গেস্ট হাউস থেকে নড়বে না।'" - আপৎকালে নিরাপত্তার এই কঠোর বিধিনিষেধ মেনেই দিনযাপন ছিল কাবুলে। বড় বেদনার কাবুলঃ "জিনিয়া অগুইলান নিহত।... বছর একুশ-বাইশ। থাকা-খাওয়া ছাড়া মাসে নগদ আটশো ডলার রোজগারের জন্য তাইওয়ানের চাকরিটা ছেড়ে বছর খানেক আগে কাবুলে আসে জিনিয়া।... সকাল সাতটা থেকে দুপুর বারোটা আর সন্ধে ছ'টা থেকে রাত ন'টা পর্যন্ত জিনিয়াকে সামলাতে হয় কাবুলের সবচেয়ে সুরক্ষিত বলে কথিত সেরেনা হোটেলের রিসেপশন কাউন্টার।... জিনিয়া আমাদের গেস্ট হাউসের পার্টটাইম রিসেপশনিস্ট। পার্টটাইম কাজ এখানে মোটেও বেআইনি নয়। প্রতিদিন দুপুর একটা থেকে পাঁচটা ওর বাঁধাধরা ডিউটি। আর জুম্মায় সারাদিন। বাড়তি রোজগারের জন্যে এই পরিশ্রমটা ও মেনে নিয়েছে।... কাজের দিন সোয়া চারটে থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী অতিথিরা গেস্টহাউসে ফিরে আসে। 'গুড আফটারনুন' বলে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে জিনিয়া আমাদের স্বাগত জানায়। আমরাও হেসে শুভেচ্ছা জানাই।... আজও ঘন্টা দু-আড়াই আগে ঝকমকে মেয়েটা আমাদের মিষ্টি হেসে স্বাগত জানিয়েছে। তারপর নিয়ম অনুযায়ী ফিরে গেছে নিজের আসল কর্মস্থল সেরেনা হোটেলে।... টিভির খবর অনুযায়ী ফুলের মতো মেয়েটা নাকি একটা মাংসপিন্ডে পরিণত হয়েছে।... তালিবানের মুখপাত্র নাকি জানিয়েছে যে সন্ধ্যে ছ'টা পঁয়ত্রিশ মিনিটে চারজন আত্মঘাতী সন্ত্রাসী শরীরে বিস্ফোরক জড়িয়ে সেরেনা হোটেলে প্রবেশ করে।..."

আফগানদের রকমসকমঃ আফগানিস্তানের তিন মূল জনগোষ্ঠী পাশতুন, তাজিক এবং হাজারা সমাজ গ্রামকেন্দ্রিক এবং কৃষিভিত্তিক। দেশের দুই স্বীকৃত জাতীয় ভাষা পারসি এবং দারিভাষীদের সংখ্যা নিয়ে পাশতুন এবং হাজারাদের যুদ্ধংদেহী মনোভাব। চিকেন-মাটন-বিফে অভ্যস্ত আফগানদের আড়াই-তিনশো গ্রাম কম ওজনের টুকরোয় মন ভরে না। আফগান পুরুষ সারা বছরই থ্রি-পিস স্যুট পরে দপ্তরে যায় যাকে চলতি ভাষায় 'দেরেশি' বলে। আর মেয়েরা ঘরের বাইরে গেলেই নিজেদের বোরখা বা চাদরির ঘেরাটোপে ঘিরে ফেলতে বাধ্য। তাই কাবুলের রাস্তায় 'মেল' আর বোরখা দেখা যায় - 'ফিমেল' দেখা যায় না। যে সব মেয়েরা দপ্তরে যায় তারা দপ্তরে গিয়েই বোরখা খুলে ওভারকোটের মতো চেয়ারে ঝুলিয়ে রাখে।

কাবুলের শহরের প্রাণের ভিতরেঃ কাবুলে অসংখ্য মসজিদও যেমন আছে; আছে তেমনি বেশ কিছু মন্দির। একাদশ শতাব্দীতে গজনীর সুলতান মামুদ কাবুল দখল করার সময় এদেশে হিন্দু রাজা ছিল। শহরের মন্দিরগুলোর মধ্যে আশমাই মন্দির বা আশা মায়ের মন্দির উল্লেখযোগ্য। পাঁচটি গুরুদোয়ারাও আছে কাবুলে। লেখকের কাবুল অবস্থানকালে কাবুলসহ সারা দেশে প্রায় তিন হাজার হিন্দু ও শিখ পরিবার বসবাস করত। মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের সমাধি-সৌধ বাগ-এ-বাবুর রাস্তা থেকে অনেক উঁচুতে পাহাড়ের প্রায় কোল ঘেষে; পাশেই তার আফগান স্ত্রীর সমাধি। কাবুলে সুফি গান এবং কাওয়ালিরও আসর বসে। কাবুলের প্রধান বাজার মাইওয়ান্দি বা চলতি কথায় 'মান্ডি' যথেষ্ট আকর্ষণীয়। কাছেই 'কাফারোশি' বা পাখির বাজার। আছে মাছের বাজার যেখানে 'সিল্ক মাহি' বা মাছই মূলত পাওয়া যায়। শুকনো মাংসের দোকানে জবাই করা পশুর দেহ শুকনো করার জন্য ঝুলিয়ে রাখা হয়। শহর-ই-সোমালির বাজার দেশি-বিদেশি গালিচা-কার্পেটের বাজার।

কাবুল ছাড়িয়ে হাজারাদের দেশেঃ আফগানিস্তানের দরিদ্রতম এবং দুর্গমতম এলাকা বামিয়ান, উরুজগান এবং ঘোর প্রদেশ অঞ্চলগুলি সম্মিলিত ভাবে 'হাজারাহাট' (অর্থাৎ হাজারাস্তান) নামে পরিচিত। কাবুল থেকে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার দূরত্বে বামিয়ান উপত্যকা (বসন্তকালের রঙিন সৌন্দর্যের জন্য ভ্রাম্যিয়ান বা বর্ণময়)। ষষ্ঠ শতাব্দী থেকেই পাহাড়ের খাঁজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সুদীর্ঘকাল সংরক্ষিত ছিল অনেক বুদ্ধমূর্তি। এখনও ডজনখানেক গুহায় তৈলচিত্র আছে যা পঞ্চম থেকে নবম শতাব্দীতে সৃষ্ট। তালিবান সরকারের বিবৃতি অনুযায়ী দু'হাজার এক সালের ছয়ই মার্চ পঞ্চান্ন মিটার উচ্চতার যে পুরুষ বুদ্ধ মূর্তিটি ধ্বংস করা হয় তার নাম 'সালসাল' এবং সাঁইত্রিশ মিটার উচ্চতার যে স্ত্রী বুদ্ধ মূর্তিটি ধ্বংস করা হয় তার নাম 'শামামা'; যদিও একই সরকারের আন্তর্জাতিক মুখপাত্র জানান যে স্থানীয় মানুষ বিরক্ত হয়ে এই ধ্বংসলীলা ঘটিয়েছে।

কাবুল ছাড়িয়ে তাজিকদের দেশেঃ কাবুল থেকে সোয়াশো কিলোমিটার দূরত্বে সবুজ পাহাড় ঘেরা পঞ্চশির নদীর উপত্যকা। সোভিয়েত ও তালিবান বিরোধী যুদ্ধের নায়ক আহমদ শাহ মাসুদ 'পঞ্চশিরের সিংহ' নামে পরিচিত। সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তাকে হত্যা করা হয় আল কায়দা দ্বারা নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এবং পেন্টাগন আক্রান্ত হওয়ার দু'দিন আগে। মাসুদের সবুজ ডোমে আচ্ছাদিত শ্বেতশুভ্র স্মৃতিস্তম্ভ এখানকার অন্যতম দ্রষ্টব্য। আফগানিস্তানের মাটির উপরে ফলে মূল্যবান বিষ; মাটির নীচে মূল্যবান খনিজ সম্ভার - হেরোইন গোত্রের যাবতীয় মাদকের প্রধান প্রাকৃতিক উৎস আফিম, যা পপি ফলের থেকে উৎপন্ন হয়। কম জল এবং কম উৎপাদন খরচে পপি চাষ হয় বলে এবং গমের তুলনায় লাভ দশগুণ বলে দরিদ্র আফগান কৃষক পপির চাষ করে। সারা পৃথিবীর আফিমের চাহিদার নিরানব্বই শতাংশই পূরণ করে আফগানিস্তান। আফিমের দাম আফগান কৃষক যা পায়, আন্তর্জাতিক বাজারে তার মূল্য তার থেকে চার গুণ বেশি। এদেশের খনিজ ভান্ডারে সঞ্চিত রয়েছে লোহা, তামা, কোবাল্ট, সোনা, রূপা, পটাসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, পটাসিয়াম, পেটালাইট প্রভৃতি। পেটালাইট হল লিথিয়ামের আকরিক এবং মোবাইল ফোন, কম্পিউটার প্রভৃতিতে ব্যবহৃত হয় লিথিয়াম ব্যাটারি। (পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নব-গঠিত তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার পিছনে যে এই বিশাল খনিজ সম্ভারের দিকে নজর তা বলাই বাহুল্য। এছাড়া পিছিয়ে পড়া দেশকে সহযোগিতার নামে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য তো আছেই)।

সাহিত্য-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে আফগানঃ যে হাতে অস্ত্র ধরেছে, আফগান সেই হাতে কলমও ধরেছে। এক হাজার দশ খ্রিষ্টাব্দে দারি ভাষায় ফেরদৌসি লিখেছেন 'শাহনামা'। সুফি কবি জালালউদ্দিন রুমি এদেশের বাদাখশানের মানুষ ছিলেন। আফগানিস্তানের উল্লেখযোগ্য মহিলা কবি রাবিয়াবলখি। সামাজিক ও রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে পারসি ও দারি ভাষার সাহিত্য যথার্থ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করতে পারেনি। আফগান মজে সুফি গানে, কাওয়ালিতে এবং নিজস্ব ঘরানার 'আটান' নৃত্যে। তবে কাবুলে লেখক হিন্দি সিনেমা, সিনেমার গান এবং তারকাদের প্রতি ব্যাপক আশক্তি দেখেছেন।

আন্তর্জাতিক বাহিনীর নেতৃত্বে পুনর্গঠন এবং পুনর্নির্মাণঃ বহু দেশই আফগানিস্তানের এই উন্নয়ন-যজ্ঞে সামিল হয়েছিল। দীর্ঘ পাকা রাস্তা এবং হাজার হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ রাস্তা নির্মাণ; বিদ্যুৎক্ষেত্রে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি; পরিবহন এবং বন্টন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ; পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তামার ভান্ডার আইনাকে খনিজ উত্তোলনের জন্য চিনের একটি সংস্থাকে ইজারা দেওয়া; রেলপথে তাজিকিস্তান এবং পাকিস্তানকে সংযুক্ত করা প্রভৃতি কাজ ভালোভাবেই এগোচ্ছিল। কিন্তু তালিবানদের হাতে ক্ষমতা-হস্তান্তরের চুক্তি সব উন্নয়ন পরিকল্পনাকে অনিশ্চয়তার কুয়াশায় ঢেকে দিল।

পরিকল্পনাবিদ অমিতাভ রায় কাবুল তথা আফগানিস্তানকে দেখেছেন শিকারির দৃষ্টিতে এবং তার লেখকসত্তা তা পরিবেশন করেছে সরস বৈঠকী মেজাজে। চুম্বকে কিছু তথ্য তুলে আনা যায় হয়ত; কিন্তু অনবদ্য রচনাশৈলিতে পরপর যেভাবে দেশটার ছবি এঁকেছেন তিনি তা এই স্বল্প পরিসরে বর্ণনা করা অসাধ্য। দুয়ারে কাবুল নয়; পাঠকের মস্তিষ্কে কাবুল তথা আফগানিস্তানকে পৌঁছিয়ে দিতে পেরেছেন তিনি। অনুষ্টুপ প্রকাশনী 'কাবুলনামা'র নতুন সংস্করণ প্রকাশ করে প্রশংসনীয় কাজ করেছেন।


কাবুলনামা

লেখকঃ অমিতাভ রায়
প্রকাশকঃ অনুষ্টুপ, কলকাতা
প্রকাশকালঃ ২০২১ (দ্বিতীয় সংস্করণ)
দামঃ ২৫০ টাকা।